‘দেখে যা রে মাইজভাণ্ডারে/হইতেছে নূরের খেলা/নূরী মাওলা বসাইলো প্রেমের মেলা’ গানটি শোনেননি এমন কম বাঙালিই আছেন। এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে প্রচলিত মাইজভাণ্ডারী গানের মধ্যে আবদুল গফুর হালী রচিত এই গানটি জনপ্রিয়তার শীর্ষে। শুধু তা-ই নয়, গফুর হালী রচিত এই গানের সুর-বাণীর কারণে মাইজভাণ্ডারী অনুসারীদের দেশব্যাপী পরিচিতি ও গ্রহণযোগ্য অবস্থান সৃষ্টি হয়েছে বললে অত্যুক্তি হবে না। বাংলাদেশের সুফিসংগীতের দীর্ঘদিনের প্রচলন ও চর্চা যখন নানা সংকট ও হুমকির মুখে, তখন গফুর হালী দৃঢ়প্রত্যয়ে সংগীতের এই ধারার চর্চা করে চলেছেন-একদিকে গানের রচয়িতা হিসেবে, অন্যদিকে সুরকার ও কণ্ঠশিল্পী হিসেবে; কোনো কোনো ক্ষেত্রে নতুন প্রজন্মের শিল্পী ও সাধক তৈরিতে তিনি অবদান রেখে চলেছেন।
মাইজভাণ্ডারি গানের কিংবদন্তি আবদুল গফুর হালী
সাইমন জাকারিয়া

গফুর হালী চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গান ও মাইজভাণ্ডারী গানের রচয়িতা, সুরকার ও কণ্ঠশিল্পী হিসেবে জীবন্ত কিংবদন্তিতে পরিণত হয়েছেন। তাঁর জীবন ও সংগীত নিয়ে জার্মানির হাইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষিণ এশীয় সাহিত্য ও সংস্কৃতিবিশারদ হান্স হার্ডার গবেষণা সম্পন্ন করেছেন অনেক আগেই এবং তা জার্মান ভাষায় গ্রন্থাকারে হালে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশিত হয়েছে। শুধু তা-ই নয়, চট্টগ্রামের সুফিসংগীতে আবদুল গফুর হালীর অবদানের ওপর তিনি ইংরেজি আর্টিকেলে আলোচনা করেছেন।
এই বহুমাত্রিক সংগীত সাধকের জন্ম ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দের ৬ আগস্ট চট্টগ্রাম জেলার পটিয়া থানার রশিদাবাদ গ্রামে।
জন্ম সূত্রে গফুর হালী বেড়ে ওঠেন বিখ্যাত পুঁথি সংগ্রাহক ও সম্পাদক-লেখক আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ এবং পুঁথি ও সংগীত রচয়িতা আস্কর আলী পণ্ডিতের নানা পুঁথিপাঠ ও ভাবসংগীতের আবহে। তাই একেবারে ছোটবেলা থেকেই তাঁর ভেতর রোপিত হয় ভাবসংগীতের সুর-বাণীর ভাবধারা। বাউল, মুর্শিদি, মারফতি, কবিগান শুনতে শুনতে তিনি নিজেই যে কখন সংগীতের ঘরে বসতি স্থাপন করেন, তা আজ শনাক্ত করা মুশকিল। তাঁর চেতনার ভেতর থেকে বেরিয়ে এসেছে অসাম্প্রদায়িক সুফিসংগীতের মর্মবাণী-‘আমিই আমার আল্লাহ-রাসুল/আমিই আমার জ্ঞাতি/লালনের যে জাত ছিল/আমারও সেই জাতি॥/সংসারধর্ম করছি বলে/মিশে আছি তোদের দলে/আমার ভাবে আমি চলি/কার বা তাতে ক্ষতি।’ গফুর হালী নিজের সত্তার গভীরে এ ধরনের মানবিক চেতনা কিভাবে পেলেন? এই প্রশ্নের উত্তরে জানা যায়, ১৯৫৫-৫৬ খ্রিস্টাব্দের দিকে তিনি একবার ফটিকছড়ির মাইজভাণ্ডার শরিফে গিয়ে বিভিন্ন সাধকের বিনয়ী ভাব দেখে, প্রাণ আকুল করা গান শুনে ও তাঁদের লাল পোশাক দেখে আকৃষ্ট হন। সবচেয়ে মজার ব্যাপার, সেখানে একদিন এক ভক্তের অনুরোধে গানও গাইতে হলো; কিন্তু গান শেষ করার পর দেখলেন, তাঁর হারমোনিয়ামের ডালা টাকায় ভরে গেছে-অর্থাৎ তাঁর গানে মুগ্ধ হয়ে ভক্ত-শ্রোতারা তাঁকে এই টাকা উপহার দিয়েছেন। এই-ই প্রথম গফুর হালী উপলব্ধি করলেন যে গান গেয়ে টাকা পাওয়া যায়। মাইজভাণ্ডারে গিয়ে এ ধরনের নানা বিষয়ের মধ্যে গফুর হালীর উপলব্ধি হলো যে ভাণ্ডার শরিফে কোথায় যেন একটা মোহনীয় শক্তি বিরাজ করে, আর সেই শক্তিতে সবাই জাত-পাত ভুলে প্রেমসাগরে ডুবে যায়। তিনি নিজেও যেন সেই প্রেমসাগরে ভেসে গেলেন, হাত রাখলেন তাঁর মুরশিদ শফিউল বশর মাইজভাণ্ডারীর হাতে, মানে তরিকতে দাখিল হলেন। এরপর তিনি মানুষের লোভ-মোহের পেছনে ছোটাছুটির প্রতি শ্লেষ করে লিখলেন সেই বিখ্যাত গান-‘আর কত কাল খেলবি খেলা/মরণ কি তোর হবে না?/আইল কত গেল কত/কোথায় তাঁদের ঠিকানা’ ইত্যাদি। অনেকে এখন গফুর হালীর কাছেও শিষ্যত্ব নিতে আসেন। গফুর হালী গান রচনা, সুরারোপ, সংগীত পরিবেশন, নতুন শিল্পী তৈরি ও মাইজভাণ্ডারী সাধনার সঙ্গে যুক্ত থেকে নিজের গানের বাণী ও সুর ভবিষ্যৎ প্রজন্মের শিল্পী-সাধকদের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার লক্ষ্যে গ্রন্থ প্রকাশনার ব্যাপারেও যথেষ্ট যত্নশীল। সম্প্রতি আবদুল গফুর হালীর রচিত গানের স্বরলিপিসহ দুটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে, ‘স্বরলিপিসহ চাটগাঁইয়া গান : শিকড়’ ও ‘স্বরলিপিসহ আবদুল গফুর হালী’র গীতিকাব্য : সুরের বন্ধন’। এ ছাড়া তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে ‘তত্ত্বনিধি’, ‘জ্ঞানজ্যোতি’ ও চাটগাঁইয়া ভাষায় প্রথম লিখিত নাটক : গুলবাহার’। তিনি চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় ‘গুলবাহার’, ‘নীলমণি’, ‘কুশল্যা পাহাড়’, ‘চাটগাঁইয়া সুন্দরী’, ‘সতী মায়মুনা’, ‘আশেক বন্ধু’ ইত্যাদি নাটক লিখেছেন। মাইজভাণ্ডারী গানের এই জীবন্ত কিংবদন্তি আবদুল গফুর হালীর নাম বাংলাদেশের আঞ্চলিক নাটকের ইতিহাসেও গুরুত্বের সঙ্গে লিপিবদ্ধ থাকবে।
সম্পর্কিত খবর