ঢাকা, বৃহস্পতিবার ১৩ মার্চ ২০২৫
২৮ ফাল্গুন ১৪৩১, ১২ রমজান ১৪৪৬

ঢাকা, বৃহস্পতিবার ১৩ মার্চ ২০২৫
২৮ ফাল্গুন ১৪৩১, ১২ রমজান ১৪৪৬

শোভনের চিঠি

  • রোজ ওষুধ খাওয়ার মতো নিয়ম করে চিঠি লেখেন শোভন। সিটি করপোরেশন থেকে ফোন কম্পানি পর্যন্ত। এ পর্যন্ত চার হাজার চিঠি লিখেছেন শোভন। কাজও হয়েছে কিছু। চিঠিতে নয় সশরীরেই তার খোঁজ নিতে গিয়েছিলেন সানজাদুল ইসলাম সাফা
notdefined
notdefined
শেয়ার
শোভনের চিঠি

শোভনের জন্ম ১৯৮২ সালে। পড়াশোনায় বেশি ভালো ছিলেন না। স্কুল পালানোর ফিকিরেই সময় যেত। কিন্তু মা রাখতেন কড়া নজর।

নবম শ্রেণিতে পড়ার সময় কিছুটা মুক্তি মিলল। বাল্লা লোকাল, চাঁদপুর লোকাল আর কর্ণফুলীতে চেপে দূরে দূরে চলে যেতেন। মাকে জানিয়েই ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় একবার দাদার বাড়ি গিয়েছিলেন। ফেরার দিন গেলেন পাগাচং স্টেশনে।
টিকিট কেনার পর দেখলেন, গায়ে লেখা দামের চেয়ে দুই টাকা বেশি রেখেছে। অভিযোগ দিতে গেলেন সহকারী স্টেশন মাস্টারের কাছে। তিনি জানালেন, এখনকার মূল্য এটাই, টিকিট আগে ছাপানো হয়েছে। শোভন বললেন, তাহলে নোটিশ টানান।
এরপর শোভন যান ব্রাহ্মণবাড়িয়া স্টেশন মাস্টারের কাছে। মাস্টার তাঁকে পুরো বিষয়টি বুঝিয়ে বললে তিনি চিঠি লেখেন পূর্বাঞ্চল রেলের সদর দপ্তর, চট্টগ্রামে। সেটাই শুরু। প্রতিকার চেয়ে এখন পর্যন্ত চার হাজার চিঠি লিখেছেন শোভন। চিঠি লেখেন ব্লগেও।

ঢাকায় এলেন

২০০৫ সাল। প্রথম দুই বছরে প্রায় ৪০০ চিঠি ছোট-বড় বিভিন্ন পত্রিকায় ছাপা হয়। চিঠিগুলো ছিল যানজট, যত্রতত্র পার্কিং, ময়লা-আবর্জনা ইত্যাদি বিষয়ে। সে সময় কর্তাব্যক্তিরা যানজটের কারণ হিসেবে রিকশাকে দায়ী করতেন। শোভন লিখলেন, আসলে প্রাইভেট কার যানজটের অন্যতম কারণ। তিনি নজর কাড়তে একই বিষয়ে ভাই, বন্ধু, সহকর্মীদের নাম দিয়েও চিঠি পাঠাতেন। পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (পবা) সঙ্গে কাজ করা শুরু করেন ঢাকায় আসার পরপরই। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় সংগঠনটির প্রেস রিলিজ পৌঁছে দেওয়ার সময় নিজের লেখা একটি চিঠিও দিতেন। প্রামাণ্যচিত্র, গবেষণাপত্র বা পবার ফিল্ড রিপোর্ট দেখে তিনি তথ্যাদি সংগ্রহ করতেন এবং চিঠিতে সেই মতো আবেদন জানাতেন। তারপর যখন নির্দিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে লিখতেন, তখন ছাপা হওয়া চিঠি সংযুক্ত করতেন। পত্রিকার প্রতিবেদকদেরও তিনি অনেক চিঠি লিখেছেন। কখনো জনস্বার্থ বিষয়ে লেখা ছাপানোর জন্য, কখনো বা প্রয়োজনীয় বিষয় নজরে আনার জন্য।

 

উৎসাহ পেয়েছেন ভালো

বহু মানুষ তাঁকে চিঠি লেখায় উৎসাহ দিত, বিশেষ করে পবার চেয়ারম্যান আবু নাসের খান তাঁকে খুবই উৎসাহ দেন। শোভন অনুষ্ঠানাদিতে তাঁর ছাপা হওয়া চিঠির ফটোকপি নিয়ে যেতেন। যেন অন্যরা উৎসাহী হয়। যখন কোনো চিঠি সাড়া তৈরি করত না, তখন তিনি দুই তরফা চেষ্টা চালাতেন। ফের লিখতেন পত্রিকায়, লিখতেন দপ্তরের কর্তাব্যক্তিকেও। মাঝেমধ্যে উত্তর দিত কর্তৃপক্ষ। সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো বেশি উত্তর দেয় না। তবে বাংলাদেশ ব্যাংক, ভোক্তা অধিকার অধিদপ্তর, পরিবেশ অধিদপ্তরের কাছ থেকে উত্তর পেয়েছেন। পেয়েছেন বিশ্বব্যাংকের চিঠি।

ঘটনাটি লালবাগের

পরিবেশ আন্দোলনের কাজে একবার লালবাগ কেল্লায় গিয়ে দেখেন দেয়াল ঘেঁষে কিছু একটা হচ্ছে। শোভন কেল্লার লে-আউট, নকশা আর সীমানা সম্পর্কে খোঁজখবর করতে লাগলেন। মেইলও লিখলেন অনেককে। ফ্রান্সের একজন মানুষ, নাম পিটার, জানালেন, ব্রিটিশ মিউজিয়ামে তথ্য থাকতে পারে। তিনি মিউজিয়ামকে বললেন, ‘আমরা লালবাগ স্থাপনা রক্ষায় কাজ করছি। কিন্তু আমাদের কাছে পর্যাপ্ত তথ্য নেই।’ ফিরতি মেইলে মিউজিয়াম জানায়, তাঁরা সহযোগিতা করতে আগ্রহী এবং এশিয়া ডিপার্টমেন্টকে ইতিমধ্যেই অবহিত করা হয়েছে। পরে তারা ই-মেইলে কেল্লার নকশা এবং ডাকযোগে ১৯৬৮ সালের একটি বই শোভনকে পাঠিয়েছিল।

 

মাকে দেখে শিখেছেন

ছোটবেলায় মাকে দেখতেন কেউ অসুস্থ হলে সেবা দিতে। হাসপাতালেও নিয়ে গেছেন অনেককে। পড়াশোনার জন্য গ্রাম থেকে যারা আসত তাদের ভরসা হয়ে উঠেছিলেন শোভনের মা। বয়োজ্যেষ্ঠদের কাছে শোভনের মা হয়ে উঠেছিলেন নিজের মেয়ে। তাঁরা শেষ মুহূর্তে শোভনের মায়ের হাতের পানি খেতে চাইতেন। এসব দেখেই শোভন মানুষের জন্য কিছু করার শিক্ষা পেয়েছেন। একবার ২০০০ সালে কালীবাড়ি মোড়ে একটি তেলের দোকানে আগুন লাগে। শোভনরা তিন ভাই তখন ঘুমাচ্ছিলেন। মা তাদের জাগিয়ে তুলে আগুন নেভাতে পাঠান। অথচ অন্যরা তখন নিজের ঘরের আসবাব বাঁচাতে ব্যস্ত ছিল। কেউ মারা গেলে শোভন ও তাঁর ভাইয়েরা দাফনের বন্দোবস্ত করতেন। এলাকায় চক্ষুশিবির বসাতেন। সংগ্রহ করতেন শীতবস্ত্র।

১০ টাকার জন্য

২০১০ সালে শোভন একটি মোবাইল ফোন কোম্পানির মিসকল সার্ভিস ব্যবহার করতেন। কিন্তু হঠাৎই সার্ভিসটি বন্ধ হয়ে যায়। অথচ মাসে ১০ টাকা ঠিকই কেটে নিচ্ছিল। গ্রাহকসেবায় ফোনে খরচ হয় আরো ১০০ টাকা। তারপর লিখলেন চিঠি। একে একে ২৫ বার চিঠি ও ফ্যাক্স করলেন। ফল না পেয়ে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরে ডাকে চিঠি পাঠান। দ্বিতীয় চিঠি হাতে হাতে গিয়ে দিলে ছয় মাস পর সাড়া পেলেন। কোম্পানিটিকে তারা কারণ দর্শাতে বলে।  উত্তরে সন্তুষ্ট না হয়ে তারা শোভন ও কোম্পানি কর্তৃপক্ষকে ডেকে পাঠায়। অধিদপ্তরের আইনজীবী ও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ছিলেন তিনজন। ফোন কোম্পানির কর্তারা ১০ টাকার জন্য তাঁদের ডেকে পাঠানোয় খুব বিরক্ত হন। কিন্তু শোভন নাছোড়বান্দা। অবশেষে শুনানিতে শোভনের পক্ষে রায় হলে আপস রফা হয়। শোভনকে ২৯০ টাকার টকটাইম ফেরত দেয়া হয়। যদিও যাওয়া-আসায় এর চেয়ে বেশি খরচ হয়ে গেছে; কিন্তু শোভন ভেবেছে—এটা না করলে আরো মানুষ ভুক্তভোগী হবে। আরেক ফোন কোম্পানির সঙ্গেও ঘটেছে আরেকটি ঘটনা। তারা গ্রাহককে প্রতিদিন প্রচুর এসএমএস পাঠাত। বাংলাদেশ টেলিরেগুলেটরি কমিশনকে (বিটিআরসি) চিঠি দিয়ে শোভন জানান, এতে তাঁর সময়ের অপচয় হয়। তাই এটি বন্ধ করা হোক। কিছুদিন পর বিটিআরসি এ-সংক্রান্ত একটি নির্দেশনা জারি করে।

 

কাঠগড়ায় বিশ্বব্যাংক

নির্মল বায়ু শোধন প্রকল্পের আওতায় বিশ্বব্যাংক ঢাকায় ফুট ওভারব্রিজ নির্মাণে অর্থ দেয়। এ ক্ষেত্রে শোভনের মনে অনেক প্রশ্ন তৈরি হয়। যেমন—শারীরিক প্রতিবন্ধী মানুষরা কিভাবে এটি ব্যবহার করবে? কষ্ট হবে বয়স্কদেরও। আরো প্রশ্ন—ক্লাইমেট চেঞ্জ এবং নির্মল বায়ুর সঙ্গে এটি কোন দিক থেকে সামঞ্জস্যপূর্ণ। বিশ্বব্যাংকের মূল নীতিমালায় আছে রাস্তা সর্বজনীন। তার সঙ্গে ফুট ওভার কি মেলে? শোভন চিঠি লিখলেন। বেশ কয়েকবার চিঠি চালাচালির পর বিশ্বব্যাংকের কর্মকর্তারা বিষয়টি নিয়ে আলোচনার জন্য ৩১ জানুয়ারি ঢাকায় বসছেন।

বন বিভাগ সচল করে

২০ অক্টোবর ২০১৩। আগারগাঁওয়ের বন ভবন থেকে একটি স্টিকার লাগানো হয়। তাতে লেখা ছিল—কোথাও কেউ বন্য প্রাণী হত্যা করলে বা ধরলে জানান এই নম্বরে ০১৭৫৫৬৬০০৩৩। তিনি বাসায় এসে ফোন দিয়ে প্রথমে দেখেন বন্ধ। তারপর একদিন ২০-২৫ বার চেষ্টা করলেন। কেউ সাড়া দিল না। প্রধান বন সংরক্ষকের কাছে প্রথমে ডাকে, তারপর হাতে হাতে, তারপর ই-মেইলে, সব শেষে ফ্যাক্সে চিঠি দিলেন। ফেসবুকেও লেখেন—এটি ভালো উদ্যোগ, জনগণ অংশ নিতে চায়। কর্তৃপক্ষ একপর্যায়ে নম্বরটি সচল করে। শোভন জানান, ধানমণ্ডি, রায়েরবাজার এলাকায়ও বন্য প্রাণী বিক্রি হতে দেখেছেন তিনি। বিশেষ করে বনবিড়াল, বেজি ও কাঠবিড়ালি। রায়েরবাজারের এক বাড়িতে বনবিড়াল বিক্রি হতে দেখে ফোন দেওয়ার পরও ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছিল না। তিনি আবার চিঠি দেন। কিন্তু সুরাহা হয় না। সেদিন বৃহস্পতিবারই ফেসবুকে বন বিভাগের অভিযোগ নম্বর ও অফিসের ল্যান্ডফোন নম্বর দিয়ে সবাইকে ফোন দেওয়ার অনুরোধ জানান। প্রচুর মানুষ ফোন দেয়। পরদিনই সে বাড়িতে অভিযান চালায় বন বিভাগ। উদ্ধার করে বিপুল পরিমাণ ঘুঘু, টিয়া ও বনবিড়াল।

এবার খাবার দোকানে

গেল বছরের ঘটনা। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার এক হোটেলে খাওয়ার পর দেখেন, পানির আসল দামের চেয়ে বেশি দাম রাখা হচ্ছে। ম্যানেজার বললেন, ‘এটি ভালো হোটেল, তাই দাম বেশি দিতে হয়।’ ঢাকায় এসে ভোক্তা অধিকারে তিনি চিঠি দেন শোভন। কুমিল্লায় শুনানির জন্য হোটেল মালিককে ডাকা হয় এবং জরিমানা করা হয়। ঢাকার হোটেলগুলোতেও একই পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়ে তিনি অভিযোগ করেছেন এবং সাড়া পেয়েছেন। ফেসবুকে তরুণদের মধ্যেও সচেতনতা তৈরি করেছেন। অভিযোগ করে সুফল পেয়েছেন শর্মা হাউসের বিরুদ্ধেও।

ব্যাংকের সাড়া

ব্যাংকগুলোতে স্টেটমেন্ট নিতে গেলে দেখেন, একেক বেসরকারি ব্যাংক একেক হারে চার্জ রাখছে। ২০০৯ সালে এ নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকে চিঠি লিখেন। বাংলাদেশ ব্যাংক সাড়া দিয়ে নিয়ম করল, সব চার্জ ওয়েবসাইটে উল্লেখ করতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকে অভিযোগ দেওয়া কঠিন ছিল। কারণ সেখানে হাজির হয়ে অভিযোগ দিতে হয়। তাই তিনি আবার লিখলেন একটি ফোন নম্বর দেওয়ার জন্য। বাংলাদেশ ব্যাংক একটি ফিরতি চিঠি দেয়। তাতে একটি নম্বরও লেখা ছিল। পরে সরেজমিন নম্বরটি খুঁজতে একটি ব্যাংকে গেলে দেখেন, তা লেখা আছে টয়লেটের সামনে। আরো কয়েকটি ব্যাংকে গিয়ে দেখেন, নম্বরটি নির্ধারিত স্থানে প্রদর্শিত হচ্ছে না। তিনি বাংলাদেশ ব্যাংকে ই-মেইল করে বিষয়টি জানান। কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিয়ে শোভনকে ফিরতি মেইলে নিশ্চিত করে। গত সপ্তাহে মোহাম্মদপুরে একটি সরকারি হাসপাতালের সামনে ময়লার ভাগাড় দেখে উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র বরাবর খোলা চিঠি দেন। বিষয়টি নিয়ে বেশ কিছু গণমাধ্যম সংবাদ প্রচার করে।

আহত হয়েছিলেন আক্তার হোসেন

২০০৯ সালে বিডিআর বিদ্রোহ শুরুর সময় ধানমণ্ডি লেকের কাছাকাছি ছিলেন শোভন। শব্দ শুনে এগিয়ে গিয়ে দেখেন, ১০-১২ বছরের এক ভ্রাম্যমাণ চা বিক্রেতা রাস্তায় পড়ে আছে। শোভন তাকে তুলে নিয়ে পুলিশের কাছে পৌঁছে দেন। পাঁচ-ছয় মাস পর দেখেন, ছেলেটি তার পঙ্গু বাবার সঙ্গে ফুটপাতে ভিক্ষা করছে। শোভন জানতে পারলেন, সে সময় হাত ভাঙার পর হাতে পচন ধরে গিয়েছিল। কিছুদিন চিকিৎসা করিয়ে গ্রামের বাড়ি চলে গিয়েছিল। পরে এখন আবার ঢাকায় এসেছে চিকিৎসা করাতে। তবে টাকা দরকার। শোভন ছেলেটিকে নিজের অফিসে নিয়ে আসেন। ডাক্তারের কাছে নিয়ে গিয়ে জানলেন, এক লাখ টাকা লাগবে। পত্রিকা অফিসগুলোতে গেলেন মানবিক সাহায্যের আবেদন জানাতে। নয়া দিগন্ত ও বাংলাদেশ সময় ছাড়া আর কেউ প্রচার করল না। ছেলেটির নাম ছিল আক্তার। তার মা প্রতিরাতে ফোন করে আকুতি জানাতেন, তাঁর ছেলেটি যেন মারা না যায়। সে কথা তিনি ব্লগে লিখেছিলেন। অনেককে ফোনও করেছিলেন। ব্লগেও শোভন লিখে চলেছিলেন নিয়মিত। লোকজন টাকাও পাঠাত ৫, ১০ বা ২০ টাকা। একপর্যায়ে ৮০ হাজার টাকা জোগাড় হয়েছিল। প্রধানমন্ত্রী বরাবর চিঠি লিখেছিলেন। এক লাখ টাকা পেয়েছিলেন। এর মধ্যে আবার অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী এটম খান চিকিৎসার দায়িত্ব নিতে এগিয়ে আসেন। একপর্যায়ে অনেক টাকা জড়ো হয়ে যায়। পরে শোভনরা পরিবারটিকে বরিশালের মেহেন্দীগঞ্জে একটি জমি কিনে ঘর বানিয়ে দিয়েছিলেন।

 

গিনেস বুকে ঢাকার রিকশা

ঢাকায় সবচেয়ে বেশি রিকশা আছে—এ কথা লিখে হাজার হাজার ঠিকানায় তিনি মেইল করেন। গিনেস বুক থেকে তাঁর দাবির সপক্ষে তথ্যপ্রমাণ দিতে বলা হয়। তিনি নানা জায়গা ঘুরে তথ্যাদি সংগ্রহ করেন এবং কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠিয়ে দেন। একদিন ঘুম থেকে উঠে দেখেন, গিনেস বুক কর্তৃপক্ষ ই-মেইলে জানিয়েছে, তাঁর দাবি বিশ্বরেকর্ড হিসেবে মনোনীত হয়েছে। কিছুদিনের মধ্যে সার্টিফিকেটও হাতে পান। শোভন জানান, সার্টিফিকেটটি সরকারি দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানে হস্তান্তর করতে চান তিনি।

প্রাসঙ্গিক
মন্তব্য

সম্পর্কিত খবর

[ অন্য জীবন ]

ফেরিওয়ালা ইকবাল

    বয়সের ভারে এখন ন্যুব্জ। তবু প্রতিদিন কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে, বুকে বই চেপে ধরে ঘুরে বেড়ান শহরের ওলিগলি থেকে রাজপথ। রোদ, বৃষ্টি, শীত উপেক্ষা করে এভাবে বই বিক্রি করে চলেছেন ২৮ বছর। নওগাঁয় হায়দার আলী ইকবালের দেখা পেয়েছিলেন ফরিদুল করিম
শেয়ার
ফেরিওয়ালা ইকবাল

রংপুরের গুপ্তপাড়ার ইসহাক আলী ও শাহিদা বিবির সন্তান ইকবাল ঘুরতে ঘুরতে রংপুর থেকে নওগাঁয় আসেন প্রায় ৪৪ বছর আগে। এখন বয়স ৭২ বছর। বাবা ইসহাক আলী চাকরি করতেন বগুড়ার জামিল গ্রুপে। ইকবাল থাকতেন মায়ের সঙ্গে রংপুরে।

প্রাথমিকের গণ্ডি পেরোতে পারেননি। এ নিয়ে তাঁর আক্ষেপও কম নয়। খুব অল্প বয়সে মাকে হারান ইকবাল। কিছুদিন পর বাবা ইসহাক আলী আবার বিয়ে করেন।
বাবার দ্বিতীয় সংসারে আর বোঝা হয়ে থাকতে চাননি ইকবাল। একদিন রংপুর থেকে ট্রেনে করে চলে আসেন বগুড়ার নসরত্পুরে। এখানে হেমিওপ্যাথির শিশি তৈরির কারখানা থেকে শিশি কিনে নিয়ে বিভিন্ন বাজারে বিক্রি করতে থাকেন। ২৪ বছর বয়সে বিয়ে করেন রংপুরের বলতিপুকুরের সাবিনা ইয়াসমিনকে।
বিয়ের মাত্র ছয় মাসের মাথায় জটিল রোগে আক্রান্ত হয়ে সাবিনা মারা যান। স্ত্রীর অকাল প্রয়াণে ইকবাল মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন। এরপর বিষাদ ভরা মন নিয়ে একদিন রংপুর রেলওয়ে স্টেশন থেকে অজানার উদ্দেশ্যে বের হয়ে পড়েন। সান্তাহার জংশনে নেমে ঘুরতে ঘুরতে চলে আসেন নওগাঁয়। কয়েক দিন ঘোরাফেরার পর একজনের পরামর্শে পৌর কাঁচা বাজারে চায়ের স্টল খুলে বসেন।
কিন্তু চা খেয়ে অনেকেই টাকা দিতেন না। বিরক্ত ইকবাল একদিন সব বেচে দিয়ে শূন্য হাতে চলে যান সান্তাহার জংশনে। দুই দিন অনাহারে কেটে যায় স্টেশনে। তৃতীয় দিন স্টেশনের এক বইয়ের দোকানদার তাঁকে খেতে দেন। ইকবালের সব কথা শুনে তাঁকে কিছু বই দিয়ে ফেরি করে বিক্রি করতে বলেন। এভাবেই সেদিনের ইকবাল হয়ে ওঠেন আজকের বইয়ের ফেরিওয়ালা।

সেই থেকে ইকবাল জীবনের সব দুঃখ-কষ্ট বুকে চেপে রেখে হাসিমুখে কথা বলেন শিশু থেকে নানা বয়সী মানুষের সঙ্গে। নওগাঁ শহরের প্রায় সবাই তাঁকে চেনে বই ফেরিওয়ালা হিসেবে। সকালে যা পারেন রান্না করে খেয়ে বের হন বাসা থেকে। বাসা বলতে শহরের দয়ালের মোড়ে ভাড়া নেওয়া টিনের ছাপরা দেওয়া একটি ছোট্ট ঘর।

সারা দিন ঘুরে যা আয় হয়, তা দিয়ে কোনোভাবে খেয়েপরে দিন চলছে তাঁর। করোনা মহামারির সময় খুব কষ্টে কেটেছে তাঁর দিন। জমানো টাকা যা ছিল তা খরচ হয়ে যায়; এমনকি ঘরভাড়ার ৭০০ টাকা জোগাড় করতেও হিমশিম খেতে হয়েছে। তবু কারো কাছে হাত পাতেননি।

হায়দার আলী ইকবাল বলেন, ‘নওগাঁ আমাকে মায়ার বাঁধনে বেঁধে ফেলেছে। স্ত্রী মারা যাওয়ার পর বিয়ে থা আর করা হয়নি। জীবনের সবটাই তো পেরিয়ে এসেছি। আগামী দিনে কী আছে তা নিয়ে আর ভাবি না। বই আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছে, খাবার জুগিয়েছে। তাই বইয়ের কাছে আমি ঋণী। দুই পায়ে ভর দিয়ে চলতে কষ্ট হয়। একটি ভ্যানগাড়ি তৈরি করে নিয়েছি। কিন্তু শিশুতোষ পণ্য ওঠানোর মতো টাকাকড়ি নেই। শিশুতোষ বইয়ের সঙ্গে খেলনাসামগ্রী তুলে স্কুলের সামনে বিক্রি করব। একটি অটোভ্যান পেলে খুব ভালো হতো।’

মন্তব্য
[ ভ্রমণ ]

বালির কফিবাগানে একদিন

গৌরাঙ্গ নন্দী
গৌরাঙ্গ নন্দী
শেয়ার
বালির কফিবাগানে একদিন

এখন বাজারে নানা ধরনের কফি পাওয়া যায়, যা বিভিন্ন কম্পানি তাদের নিজস্ব পদ্ধতিতে কৃত্রিম উপায়ে তৈরি করে। বাজারজাতকরণের জন্য এসব কফি পাউডারের সঙ্গে নানা কৃত্রিম উপাদানের মিশ্রণও ঘটানো হয়। তবে বাগান থেকে কফির বীজ সংগ্রহ, পরিচর্যা, গুঁড়া তৈরি—কোনো ক্ষেত্রেই কৃত্রিম কোনো উপাদান ব্যবহার না করে তৈরি কফিই গুণে-মানে সেরা। স্বাদও অপূর্ব।

তবে এর মধ্যে ইন্দোনেশিয়ায় তৈরি লুয়াক কফি সবচেয়ে সুস্বাদু, উন্নতমানের ও দামি। শুনেছিলাম, ইন্দোনেশিয়ায় এ ধরনের কফির বাগান আছে অনেক। ইচ্ছা ছিল সুযোগমতো কফিবাগানে ঢু মারার। ট্যাক্সিচালককে জানাতেই তিনি বালি দ্বীপের উবুড সিটির একাধিক জায়গা ঘুরিয়ে শেষ বিকেলে সিঙ্গাপাডু তেনগাহের একটি কফিবাগানে হাজির করলেন।
সুয্যিমামা ততক্ষণে পশ্চিমে ঢলে পড়েছে। বাগানে তখন গাছের দীর্ঘ ছায়া। আঁধার নামছে। বাগানের কর্মী সাবিত্রি দ্রুতলয়ে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে কফিবাগান দেখালেন।
কফিগাছ, তার ফল, ফল সংগ্রহ করার পদ্ধতি, পরিচ্ছন্নতা, খোসা ছাড়ানো, বীজ গুঁড়া করা—সব।

লুয়াকের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, এই কফির বীজ বিড়াল আকৃতির এক ধরনের মঙ্গুস (বেজি) গোত্রের প্রাণীকে খাওয়ানো হয়। বাগানে খাঁচার মধ্যে প্রাণীটিকে রেখে এই ফল খাওয়ানো হয়। কারণ প্রাণীটি এই ফল খায়, তার পাকস্থলীতে গিয়ে এই ফল জার্মিনেটেড হয়; তবে ওই ফল আবার বর্জ্য হিসেবে বের করে দেয়। 

বাগানে ওই বর্জ্য সংগ্রহ করা হয়।

তা একাধিকবার ফুটন্ত গরম পানিতে ধুয়ে পরিষ্কার করে শুকানো হয়। কখনো কখনো তা ভাজাও হয়। পরবর্তী সময়ে বাগানের কর্মীরা ওই ফলের খোসা ছাড়ান। খোসা ছাড়ানো বীজ বা ফলের ভেতরের শক্ত অংশটি হামানদিস্তা বা মসলা গুঁড়া করার পাত্রে গুঁড়া করা হয়। ওই গুঁড়া ছাঁকনি দিয়ে ছেঁকে মিহি গুঁড়া বের করা হয়। এই গুঁড়াই কফি, যা শুধু ফুটানো পানিতে গুলে অথবা ফুটানো পানির সঙ্গে দুধ, চিনি যোগ করে পান উপযোগী করতে পারেন। 

এই কফির মান কেমন? মান পরীক্ষা করানোর জন্য বাগানের কর্মী তাঁদের নির্ধারিত স্থানে নিয়ে বসালেন। তবে এখানে কফিপান বিনা মূল্যে নয়। সাধারণ ছোট এক কাপ কফির দাম ৫০ হাজার ইন্দোনেশিয়ান রুপিয়া। বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৩৫০ টাকা। অবশ্য স্বাদের পার্থক্য অনুভবের জন্য আপনাকে পাশাপাশি আরো সাত রকমের কফি দেওয়া হবে। চুমুক দিয়ে দেখলাম, স্বাদে অনন্য। এই কফি পাউডার প্যাকেট বা বোতলজাত করে বিক্রি করা হয়। ১০০, ২০০ বা ৫০০ গ্রামের প্যাকেট। পরিমাণ বা প্যাকেটের ধরনের ওপর দাম কমবেশি হয়ে থাকে। ১০০ গ্রাম লুয়াক কফি পাউডারের দাম সাত লাখ ২০ হাজার ইন্দোনেশিয়ান রুপিয়া, বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার টাকা। এই কফি থেকেই তৈরি করা হয়েছে চকোলেট।

ইন্দোনেশিয়ায় পর্যটকদের জন্য তীর্থভূমি বালিজুড়ে এ রকম অনেক কফিবাগান ছড়িয়ে আছে, যেখানে একেবারে প্রাকৃতিক উপায়ে কফি তৈরি ও বিপণন করা হয়।

মন্তব্য
[ দিনগুলি মোর ]

হারিয়ে গেছে বুকের কাছের বকুল ফুলের ঘ্রাণ

শেয়ার
হারিয়ে গেছে বুকের কাছের বকুল ফুলের ঘ্রাণ
চিত্রকর্ম : ছায়া ও সখি। শিল্পী : সমর মজুমদার

আমার পাশের সিটটা বলা যায় নীলুর জন্য রেজিস্ট্রিই করা। সেই যে নীলু, শহর থেকে আসা হ্যাংলা মেয়েটা, এক দুপুরে আমার পাশে বসল, সেটা এক দিনের জন্যও বদলায়নি। দিন দিন আমাদের নৈকট্য বেড়েছে। সহপাঠী থেকে আমরা হয়ে গেলাম সই।

বাংলা স্যার তো আমাদের নিয়ে ছড়াও বানিয়ে ফেলেছেন : ‘নীলু-বিলু আসে/একসাথে বসে আর মিটিমিটি হাসে...।’

ঘণ্টা পড়ে গেছে, কিন্তু নীলু এখনো এলো না। আমার খুব একা একা লাগছে। যদিও মন বলছে সে এক্ষুনি চলে আসবে।

এসে বলবে, বাবুটার জন্য দেরি হয়ে গেছেরে! আজও আমার বাংলা খাতা হারিয়ে ফেলেছে, শেষমেশ খাটের নিচে পেয়েছি। নাম ডাকা কি শেষ? 

কিন্তু সে আসে না। প্রথম পিরিয়ড শেষ হয়, দ্বিতীয় পিরিয়ড শেষ হয়, শেষ হয় শেষ পিরিয়ডও; তবু সে আসে না। ছুটির পরে আমি বাবার সঙ্গে বাড়ি ফিরছি।

ছমিরহাট পৌঁছতেই গগনবিদারি চিৎকারের শব্দ শুনে আমরা থমকে দাঁড়াই। অনেক উত্সুক লোকজন দৌড়ে যাচ্ছে নীলুদের বাড়ির দিকে। আমরাও ছুটে গেলাম। বাড়ির অন্দর থেকে শোকের মাতম বাতাসে ভেসে আসছে। হয়তো নীলুর দাদি মারা গেছেন।
দাদিহারা নীলুর জন্য খুব মায়া হলো আমার। বুড়ি নীলুকে খুব ভালোবাসতেন। রাতে গল্প বলে বলে ঘুম পাড়াতেন। সেসব গল্প নীলু আমাকে কত দিন শুনিয়েছে! 

উঠানে পা দিতেই দেখি একটা বকুলগাছের তলায় নীলু শুয়ে আছে। পাশেই তার ছোট ভাই বাবু নীলুর মতোই নিস্তব্ধ, নিথর! যেন এইমাত্র ঝরে পড়া দুটি হলুদ পাতা জড়াজড়ি করে শুয়ে আছে!

আমার নীলু! আমার খেলার সাথি! আমার হরিণী! নিবিড় বনের মতো আচ্ছন্ন চোখের চাহনি তার নীল হয়ে গেছে। এই চোখে তাকিয়ে আমি কত দিন মুগ্ধতায় অবশ হয়েছি। কী হয়েছে নীলুর?

বাবা নীলুকে উপুড় করে কোলে তুলে নিলেন। মুখের ভেতর হাত দিলেন, মুখ দিয়ে গড়গড়িয়ে এক কলসির মতো পানি বেরোলো। বাবা নীলুর মুখে মুখ লাগিয়ে শ্বাস দিলেন; হাতের তালু, পায়ের তালু ঘষে ঘষে গরম করতে চাইলেন। দুই হাতের আঙুল ওপর-নিচে ধরে তার বুকের ওপর চাপ দিলেন। চোখের পাতা উল্টে দেখলেন, হাতের কবজিতেও কী যেন দেখলেন! নীলুর কোনো সাড়া নেই। বাবা নীলুর ভাই বাবুকেও একই রকম করলেন। তার ঠোঁটও নীলচে হয়ে গেছে, হাতের তালু কুচকে গেছে।

নীলুর মা আর্তনাদ করে বাবাকে বললেন, ‘স্যার, কিছু বলছেন না কেন? ওরা কি আর নেই?’

বাবা বললেন, ‘ডাক্তার নিয়ে এসো।’ বলেই পাঞ্জাবির পকেট থেকে রুমাল বের করে বাবা চোখ মুছলেন।

‘আল্লাগোওওওও’ বলে চিৎকার দিয়ে নীলুর মা জ্ঞান হারালেন। 

বাড়ি ভর্তি মানুষ গিজগিজ করছে। কানাঘুষা চলছে। একজন বললেন, মা-টা এমন বেখেয়ালি! শোকের বিলাপ তুলে আরেকজন বললেন, আজ ভোরেও চোখ বন্ধ করে ঝরা বকুলের সুবাস নিয়েছিল নীলু। সেই নীলু এখন লাশ হয়ে শুয়ে আছে তারই মৃত ভাইয়ের পাশে!

নীলুর লোটন আপু বললেন, উঠোনে কাপড় শুকাতে দিতে গিয়ে দেখি দুই ভাই-বোন গোসল করছে, মগ কেটে গায়ে পানি ঢালছে। হয়তো বাবু পা পিছলে পানিতে পড়ে যায়, আর নীলু তাকে তুলতে ঝাপ দেয়। কিন্তু নীলু ভুলে যায় সে সাঁতার জানে না। সাঁতার না জানার মতো সামান্য অক্ষমতার কাছে ভাইয়ের প্রতি ভালোবাসার পরাজয় হতে পারে না। তাই বুঝি একসঙ্গে বাঁচতে চেয়ে দুই ভাই-বোন একসঙ্গেই তলিয়ে যায় দিঘির মতো দীর্ঘ পুকুরের অতল জলে। হয়তো ডুবন্ত ভাই-বোনের দপাদপিতে পাতিহাঁসের দল ডানা ঝাপটে উঠে আসে পারে। বেজি কিংবা বাগডাশ ভেবে আমরা ওদিকে যাইনি। আহা যদি একবার যেতাম!

কত অসংখ্য দিন নীলু আমাকে তাদের বাড়ি যেতে বলেছিল! নানা ছুতোয় যাইনি। আজ কোনো অনুরোধ ছাড়াই এসেছি। পিঁপড়ার দলার মতো গিজগিজ করা মানুষের ভিড়ের মধ্যে নীলুর লাশের পাশে বসে আছি।

নীলু বলেছিল, আমাদের একটা বকুলগাছ আছে, বড় একটা পুকুর আছে, তার শান-বাঁধানো ঘাট, পুকুরে পাতিহাঁস সাঁতার কাটে, রক্তজবার ঝোপের ভেতর টুনটুনির বাসা, লজ্জাবতীর ঝাড় স্পর্শ পেলেই নুয়ে পড়ে, একটা সাদা বিড়াল আছে মিনি। বলেছিল, আমার লোটন আপু আছে, সে অনেক বড় বড় নভেল পড়ে আর রেডিওতে অনুরোধের আসরে চিঠি লেখে। আমার ভাইটা খুব দুষ্ট। বাবা খুব ব্যস্ত, খালি ঢাকা যেতে হয়। আর মা? মা আমার খুব প্রিয়। কেক বানাতে পারে, পুডিং বানাতে পারে। এত মজা করে পায়েস রাঁধে যে খেলে তুই ভুলতেই পারবি না! আমার শান্ত জ্যাঠা এমন পাওয়ারের চশমা পরে যে তাকালে চোখ দুটিকে অনেক দূরের মনে হয়। আমাদের কাকাতুয়ার মতো ঝুঁটিওয়ালা মোরগ আছে, খুব ভোরে চিৎকারে করে আমাদের ঘুম ভাঙিয়ে দেয়। আয় না একদিন আমাদের বাড়ি!

চিৎকারে করে বলতে ইচ্ছা করছে, নীলু, আমি এসেছি নীলু!

এই উঠোন পার হয়েই কি পুকুরে গিয়েছিল নীলু? ওই তো ছোট্ট পায়ের ছাপ এখনো মুছে যায়নি! ইচ্ছা করছে সেখানে চুমু খাই। উঠোনের বকুলগাছটাকে দেখি। নীলুর শোকেই কি সব ফুল ঝরে পড়ে আছে?

ঝরা ফুলের বেদনা বুকে নিয়ে আমি আর বাবা ফিরে আসি। আমাদের মন পড়ে থাকে বকুলগাছটার তলায়। নীলুর কাছে। নীলুর ভাইয়ের কাছে। আমার চোখ ভিজে উঠে বারবার। যতই চোখ মুছি নীলুর স্মৃতির কোলাজ বারবার জ্বলে ওঠে মনের মাঝে।

ঢোলকলমির ফুল দিয়ে নীলু প্রায়ই মাইক বানাত। হাবিজাবি মাইকিং করত। স্কুলের পেছনে আমগাছের ডালে বসে একেক দিন একেক ঘোষণা দিত : একটি হারানো বিজ্ঞপ্তি, একটি হারানো বিজ্ঞপ্তি... নীলু নামের একটি মেয়ে হারিয়ে গিয়েছে। তার পরনে ছিল লাল স্কার্ট, সাদা টপস...

নীলু সত্যিই হারিয়ে গেছে। হারিয়ে গেছে বুকের কাছের বকুল ফুলের ঘ্রাণ। হারিয়ে গেছে ‘আয়রে আমার কনকচাঁপার আনন্দ উদ্যান।’

—কাইছুন নেছা কুহেলী

সুবর্ণচর, নোয়াখালী।

মন্তব্য

আলমগীরের বিদ্যালয়টি দেশসেরা

    কুড়িগ্রামের সুখাতী বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী ও অটিজম বিদ্যালয়ের নাম এখন অনেকেই জানেন। কিছুদিন আগে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় থেকে ‘দেশসেরা’র স্বীকৃতি পেয়েছে বিদ্যালয়টি। এ পর্যন্ত স্কুলটির বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন পাঁচটি শিশু স্বাভাবিক জীবনে ফিরেছে। ফেরার অপেক্ষায় আরো ২৩ শিশু। উদ্যোক্তা আলমগীর হোসেন নামের এক তরুণ। লিখেছেন আব্দুল খালেক ফারুক
শেয়ার
আলমগীরের বিদ্যালয়টি দেশসেরা
পুরস্কার হাতে আলমগীর হোসেন

বিদ্যালয়টি নাগেশ্বরী উপজেলা শহর থেকে প্রায় তিন কিলোমিটার দূরে সুখাতী গ্রামে অবস্থিত। গত বছরের ৩ ডিসেম্বর মিরপুরে জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশনের অনুষ্ঠানে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় প্রতিবন্ধতা উত্তরণে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখায় প্রতিষ্ঠান ক্যাটাগরিতে ‘সুখাতী বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী ও অটিজম বিদ্যালয়’কে দেশসেরার পুরস্কার দেয়।

 

শুরুর কথা

বগুড়ার সরকারি আজিজুল হক কলেজ থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর আলমগীর। ছাত্রাবস্থায় বন্ধুদের নিয়ে ‘উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ সামাজিক সেবা’ নামের একটি সংগঠন গড়ে তোলেন এক দশক আগে।

সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের নিয়ে কাজ করতে গিয়ে দেখলেন এ ধরনের শিশুদের জন্য অনেক প্রতিষ্ঠান আছে, কিন্তু বুদ্ধিপ্রতিবন্ধীদের নিয়ে কাজ করার লোক কম। এরই মধ্যে তাঁর চাচাতো বোনের গর্ভে জন্ম নেয় একটি বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশু। সেরিব্রাল পালসিতে আক্রান্ত সেই শিশুর অবস্থা দেখে খারাপ লাগত আলমগীরের। ভাবলেন, এ ধরনের শিশুর জন্যই কাজ করবেন।
সেই ভাবনা বাস্তব রূপ পায় ২০১৫ সালে। বন্ধুদের সহযোগিতায় গড়ে তোলেন ‘সুখাতী বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী ও অটিজম বিদ্যালয়’। ভাড়া করা ঘরে সাতজন শিশুকে নিয়ে শুরু করা হয় কার্যক্রম। পরে দাদুর দান করা ১২ শতক জমিতে টিনশেড ঘর নির্মাণ করেন।
পাখি ফাউন্ডেশনের সহযোগিতায় এ ধরনের শিশুদের যত্নআত্তির বিষয়ে প্রশিক্ষণ নেন তিন মাসের। পরেও বিভিন্ন জায়গায় প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। ইনফ্রারেড থেরাপি ল্যাম্প, টেন্স থেরাপি মেশিন, আলট্রাসাউন্ড থেরাপি মেশিন, শর্টওয়েভ, টেডমিল, ক্যাপসুল বলসহ শুভাকাঙ্ক্ষীদের সহযোগিতায় স্কুলের সরঞ্জাম সংগ্রহ করেন।

আব্দুল্লাহ আল নোমানও এখন সুস্থতার পথে।      

ব্যতিক্রমী এক প্রতিষ্ঠান

সরকারি হিসাবে কুড়িগ্রামে প্রতিবন্ধীর সংখ্যা প্রায় ৬৪ হাজার।

স্বীকৃতি ও অনুদানের আশায় গ্রামে গ্রামে গড়ে উঠেছে নামসর্বস্ব অনেক প্রতিবন্ধী স্কুল। সেদিক থেকে আলমগীরের স্কুলটি একেবারেই ব্যতিক্রম। নানা সরঞ্জামে সাজানো ঝকঝকে, তকতকে স্কুলটি দেখলেই মন ভালো হয়ে যাবে। মোট ১২টি কক্ষ। সামনে স্পিচ অ্যান্ড ল্যাঙ্গুয়েজ থেরাপি, অকুপেশনাল থেরাপি, সেন্সরি ইন্ট্রিগেশন থেরাপি, ফিজিও থেরাপিসহ নানা পরিচিতিমূলক নেমপ্লেট দেখে বোঝা যায় এখানে শিক্ষার্থীদের জন্য রয়েছে বিশেষ সব ব্যবস্থা।

আলমগীর জানান, কুড়িগ্রাম জেলায় বিশেষ শিশুদের জন্য সমন্বিত উদ্যোগের একমাত্র প্রতিষ্ঠান এটি। অটিজম, সেরিব্রাল পালসি, ডাউন সিনড্রোম, সেন্সরি ডিস-অর্ডার, বিলম্বে কথা বলা, বুদ্ধিপ্রতিবন্ধিতা এবং অতিচঞ্চল শিশুদের জন্য প্রতিষ্ঠানটি গড়ে তোলেন তিনি। ওদের সমাজের মূলধারায় এনে স্বাভাবিক জীবন নিশ্চিত করাই ছিল উদ্দেশ্য। শুরু থেকে অভিভাবকদের কাছে আস্থা আর বিশ্বাসের প্রতীক হয়ে ওঠে আলমগীরের প্রতিষ্ঠানটি।

এখানে প্রতিবন্ধী শিশুদের চাহিদামতো অকুপেশনাল থেরাপি, ফিজিও থেরাপি, স্পিচ অ্যান্ড ল্যাঙ্গুয়েজ থেরাপি, মিউজিক, ডান্স ও ইয়োগা থেরাপি এবং গ্রুপ থেরাপির মাধ্যমে শিশুদের সুরক্ষায় কাজ করছেন একদল তরুণ-তরুণী।

 

যেভাবে চলে

এখন কোনো অভিভাবক তাঁর বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন সন্তানকে স্কুলে নিয়ে এলে প্রথমেই ম্যানেজমেন্ট টিমের মাধ্যমে তার শারীরিক ও মানসিক সমস্যা বা প্রতিবন্ধিতার ধরন চিহ্নিত করা হয়। অভিভাবকসহ শিশুটিকে একটি কক্ষের ভেতরে রেখে সিসি ক্যামেরায় তার আচরণ পর্যবেক্ষণ করা হয়। খোলা হয় তার জন্য পৃথক ফাইল। তারপর শুরু হয় পুনর্বাসনের কাজ। 

সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, পুরো প্রতিষ্ঠান প্রাঙ্গণ সাজানো চিত্রাঙ্কন ও শিশুদের ভালো লাগা ছবিতে। মাঠে শিশুদের খেলার সরঞ্জাম। বিশেষ শিশুদের ভোকেশনাল ট্রেনিং, ডেইলি লিভিং অ্যাক্টিভিটি ট্রেনিং, ভারী কাজ করানো, সোশ্যালাইজেন, আইইপি স্কুলিং ছাড়াও বহির্বিভাগ থেরাপি কার্যক্রম, শিশুদের ১:১ পদ্ধতিতে বিশেষ শিক্ষাদান চলে।

প্রাক-প্রাথমিক থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পাঠদান, অভিভাবক প্রশিক্ষণসহ আউটিং কার্যক্রম রয়েছে। প্রয়োজনে আসেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ও থেরাপিস্ট। কখনো শিক্ষার্থীদের নেওয়া হয় তাঁদের কাছে। আর প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষকরা তো আছেনই।

শিক্ষকের সঙ্গে খেলায় মেতেছে মেঘলা।   ছবি : লেখক

সাফল্য আসছে

আলমগীর চেষ্টা করেন এখানে আসা সবাইকে সুলভে সেবা দেওয়ার। তাঁদের সেবায় সেরিব্রাল পালসিসম্পন্ন পাঁচ শিশু এখন স্বাভাবিক হয়ে ফিরেছে পরিবারে। একই লক্ষণের ২৩টি শিশু ধীরে ধীরে সুস্থতার দিকে যাচ্ছে। এরই মধ্যে ১৭ জনকে এরই মধ্যে মূলধারার শিক্ষাক্রম অনুযায়ী শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে। এখন মোট ১১০টি শিশু রয়েছে প্রতিষ্ঠানটিতে।

সুস্থ হয়ে ফেরা শিশুদের একজন সাত বছর বয়সী মেঘলা শীল। তার মা তৃষ্ণা রানী বলেন, ‘আমার বাচ্চা আগে হাঁটতে পারত না। কথা বলতে পারত না। কিন্তু এখন সে হাঁটতে পারে, কথাও বলতে পারে।’  সারাবান তহুরা পুষ্পর বয়স ১০ বছর। তার মা সালেমা বেগম বলেন, ‘আমার মেয়ে ছিল অস্থির (হাইপার) ও শ্রবণপ্রতিবন্ধী। এখন প্রায় ৭০ শতাংশ সুস্থ হয়েছে। স্কুলটিতে সরকারি সহায়তা পেলে অনেক বাচ্চার উপকার হতো।’ সেরিব্রাল পালসিতে আক্রান্ত ১২ বছরের আব্দুল্লাহ জয়ের মা জাহানারা বেগম এসেছেন হাসনাবাদ থেকে। বললেন, ‘ও আমার প্রথম সন্তান। মাত্র ছয় মাসে সবার চেষ্টায় ওর অনেক উন্নতি হয়েছে।’ এই সাফল্যের স্বীকৃতিও মিলেছে। জেলা-উপজেলা পর্যায়ে একাধিক সম্মাননাসহ ২০২০ সালে শেখ হাসিনা ইয়ুথ ভলান্টিয়ার অ্যাওয়ার্ড জিতেছিল প্রতিষ্ঠানটি। এবার তো হয়েছে দেশসেরা।

 

ভিডিও লিঙ্ক : https://www.facebook.com/watch/?v=1312484092657030&ref=sharing

 

ভবিষ্যতের ভাবনা

সহানুভূতিশীল মানুষের আর্থিক অনুদানে প্রতিষ্ঠানটি চলছে। আলমগীর বলেন, ‘স্কুলটি পরিচালনা করতে প্রতি মাসে লক্ষাধিক টাকা খরচ হয়। আয় হয় প্রায় ২২ হাজার টাকা। প্রতিষ্ঠানটিতে শিক্ষক, কর্মচারীসহ মোট ২৮ জন কর্মরত। কাউকে নিয়মিত বেতন দিতে পারছি না।’ তিনি বলেন, ‘প্রতিষ্ঠানটি আমার স্বপ্ন। কিন্তু দিন যত যাচ্ছে কুলিয়ে উঠতে পারছি না। আমার দরকার প্রতিষ্ঠানের স্বীকৃতি এবং নিয়মিত অনুদান পাওয়ার নিশ্চয়তা। সব শর্ত মেনে আবেদন করা হলেও এখনো সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বীকৃতি মেলেনি।’  

 

কর্মকর্তারা বললেন

নাগেশ্বরী উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা জামাল হোসেন বলেন, ‘গ্রামের প্রতিষ্ঠান হলেও সেবার মান উন্নত। অনেক অটিজম শিশুর উন্নতি হয়েছে তাদের মাধ্যমে। আশা করি, অচিরেই প্রতিষ্ঠানটি স্বীকৃতি পেয়ে যাবে।’ নাগেশ্বরী ইউএনও ফারজানা জাহান বলেন, ‘স্কুলটি পরিদর্শন করে খুব ভালো লেগেছে। আমরা আলমগীরকে সহযোগিতার চেষ্টা করছি।’

 

মন্তব্য

সর্বশেষ সংবাদ