<p>সরকার শিক্ষার পাশাপাশি শিক্ষকদের জীবনমানের উন্নয়নে পদক্ষেপ নিচ্ছে বলে জানিয়েছেন শিক্ষা মন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী। তিনি বলেছেন, শুধু কারিকুলাম বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের উন্নয়ন করলে হবে না। সুশিক্ষা নিশ্চিত করতে শিক্ষকদের জীবনমানের উন্নয়নও করতে হবে। সরকার সেই উদ্যোগ নিচ্ছে। নতুন শিক্ষা কারিকুলাম নিয়ে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্টের অপচেষ্টা বন্ধে সকলের সহযোগিতা কামনা করেন তিনি।</p> <p>আজ রবিবার (২৮ এপ্রিল) জাতীয় প্রেস ক্লাবে বাংলাদেশ কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি (বাকবিশিস) আয়োজিত ‘জাতীয় শিক্ষানীতি ও নতুন কারিকুলাম’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে প্রধান অতিথির বক্তৃতায় এ সব কথা বলেন তিনি।</p> <p>বাকবিশিস সভাপতি অধ্যাপক ড. নুর মোহাম্মদ তালুকদারের সভাপতিত্বে বৈঠকে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, ‘জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে যদি সেই ৭৫-এর ১৫ আগস্ট না হারাতাম, তাহলে শিক্ষক সমাজের যে দাবিগুলো নিয়ে আজকে আমরা আন্দোলন করছি এখনো, যে দাবিগুলোর এখনো সুরাহা হয়নি, রাষ্ট্র এখনো দায়িত্ব নিতে পারেনি সেগুলোর হয়তো সূত্রপাতই হত না। বঙ্গবন্ধুকে হারিয়ে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে শিক্ষাপরিবার।’</p> <p>তিনি আরো বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাদের শিক্ষা পরিবারকে সঙ্গে নিয়ে জাতি গঠনের দায়িত্ব দিয়েছেন। যুবকদের দক্ষ করে গড়ে তোলার দায়িত্ব দিয়েছেন। স্মার্ট বাংলাদেশের স্মার্ট জেনারেশন তৈরি করার দায়িত্ব দিয়েছেন। সেই লক্ষ্যেই কাজ চলছে। নতুন কারিকুলামের সঠিক বাস্তবায়নের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের ঝড়ে পড়া বন্ধ হবে। সকল শিশু সুশিক্ষা পাবে। এক্ষেত্রে কোনো ত্রুটি থাকলে সেটাও সংশোধন করা হবে। এ বিষয়ে আলোচনা-সমালোচনা হতে পারে। তবে অপপ্রচার বন্ধ করতে হবে।’</p> <p>সভাপতির বক্তব্যে ড. নুর মোহাম্মদ তালুকদার বলেন, ‘শিক্ষায় যখন কোনো বড় পরিবর্তন আনা হয় তার ধকলটা আসে শিক্ষকদের ওপর। নতুন কারিকুলামে শিক্ষকদের দায়িত্ব ও কাজের পরিধি বেড়েছে, কিন্তু বেতন-ভাতা বাড়েনি। মাত্র ৭ দিনের প্রশিক্ষণে কিছুই হয় না। পাঠদানের জন্য শিক্ষকদের অনেক পরিশ্রম করতে হয়। আর এই অধিক পরিশ্রমের কারণে বেতন-ভাতা বৃদ্ধির কথা বললে বলা হয়, না পারলে চাকরি ছেড়ে চলে যান, লোকের অভাব হবে না।’</p> <p>তিনি আরো বলেন, ‘দ্রব্যমূল্যের এই চড়া বাজারে শিক্ষকদের বেঁচে থাকাটা অনেক কষ্ট হয়ে যাচ্ছে। শিক্ষামন্ত্রীর কাছে আমাদের অনুরোধ আমাদের বেতন-ভাতার বিষয়টি অবশ্যই দেখবেন।’</p> <p>নতুন কারিকুলাম নিয়ে সমালোচনা করে ড. নুর মোহাম্মদ বলেন, ‘নতুন কারিকুলামে শিক্ষার্থীদের মূল্যায়নের বিষয়টি স্পষ্ট নয়। সমালোচনার ফলে অনেককে আইনের আওতায় আনার মতো ঘটনাও ঘটেছে। এগুলো বলে আমি বাসায় ফিরে যেতে পারব কিনা তার নিশ্চয়তা কী? শিক্ষকদের কান ধরে ওঠ বস করানো, জুতা পেটা থেকে শুরু করে নানানভাবে হয়রানি করা হয়। শিক্ষকরা নিজের অধিকারের কথা বলতে গেলেই তাদের ওপর অনেক প্রতিষ্ঠান মালিক অত্যাচার করেন শারীরিক ও মানসিকভাবে। শিক্ষার উন্নয়নের স্বার্থে শিক্ষকদের সমস্যার সমাধান করতে হবে।’</p> <p>আলোচনায় অংশ নিয়ে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) সদস্য (শিক্ষাক্রম) মো. মশিউজ্জামান বলেন, ‘মুখস্থনির্ভর শিক্ষা পদ্ধতির পরিবর্তে এবারে সৃজনশীল চিন্তনশীল শিক্ষা পদ্ধতি চালু করতে দুই বছরব্যাপী গবেষণার পর ২০১৯ এই শিক্ষাক্রমের রূপরেখা প্রণয়ন করা হয়। শিক্ষার্থীদের বৈশিক নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে এবারের শিক্ষাক্রমে সমস্যা চিহ্নিত করে উত্তরণের উপায়, অন্যের মতামতকে শ্রদ্ধা করা, বৈচিত্র্যের প্রতি সম্মান দেখানো, সকল নিপীড়িতগোষ্ঠীর মানুষকে মর্যাদা দিতে শেখার মন মানসিক অবস্থা তৈরির জন্য শিক্ষা উপকরণের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে।’</p> <p>বৈঠকে উত্থাপিত প্রবন্ধে বাকবিশিস প্রেসিডিয়াম সদস্য প্রফেসর ড. আজিজুর রহমান বলেন, ‘বর্তমান ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির একটি শিক্ষাক্রমেও বহু ধারার (বাংলা, ইংরেজি ও মাদ্রাসা শিক্ষা) শিক্ষা ব্যবস্থাকে বহাল রাখা হয়েছে, যা ১৯৭২ সালের সংবিধানের ১৭ নম্বর অনুচ্ছেদের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। সংবিধানের ওই অনুচ্ছেদের মূল কথাটি হচ্ছে, রাষ্ট্র একই পদ্ধতির, গণমুখী ও সর্বজনীন শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা এবং সকল শিশুর জন্য অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষাদানের কার্যকর পদক্ষেপ নেবে।’</p> <p>তিনি বলেন, ‘বহু ধারার শিক্ষাব্যবস্থা আসলে একই জাতি চিন্তার পরিবর্তে বিভিন্ন ধারার মানসিকতাসম্পন্ন জনগোষ্ঠী তৈরি করে। তাই বৃহত্তর জাতীয় ঐক্যের স্বার্থে প্রাক-প্রাথমিক, প্রাথমিক এবং উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের মাতৃভাষায় (তবে, আদিবাসী শিশুদের জন্য তাদের স্ব স্ব মাতৃভাষায় শিক্ষার সুযোগ রেখে) এক ও অভিন্ন শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করতে হবে।’</p> <p>অপর প্রবন্ধে বাকবিশিস যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক অধ্যক্ষ আকমল হোসেন বলেন, ‘জাতীয় শিক্ষানীতিতে শিক্ষা ছাড়া অন্য কোনো কাজে শিক্ষকদের যুক্ত করা হবে না বলা হলেও তা কার্যকর হয়নি। শিক্ষা আইন তৈরির কথা থাকলেও দুই দফা খসড়া প্রস্তাবনার পরও সেই আইন হয়নি। শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাত ৩০:১ করার কথা থাকলেও তা নিশ্চিত করা হয়নি। সরকারি কর্ম-কমিশনের অনুরূপ বিকল্প নিয়োগ কমিশন গঠনের প্রস্তাবও কার্যকর হয়নি। শিক্ষকদের আর্থিক সুবিধা নিশ্চিত করার জন্য পৃথক বেতন কাঠামো গঠন করা হয়নি। মেধা ও দক্ষতার ও অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে নির্বাচিত শিক্ষকদের শিক্ষা প্রশাসনে বিভিন্ন পদে পদোন্নতির কথা থাকলেও তা কার্যকর হয়নি। স্থায়ীভাবে শিক্ষা কমিশন গঠনের প্রস্তাবনা থাকলেও তা বাস্তবায়িত হয়নি।’ ওই সকল নির্দেশনা দ্রুত বাস্তবায়নের আহ্বান জানান তিনি।</p> <p>গোলটেবিল বৈঠকে আরো বক্তৃতা করেন বাংলাদেশ বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারী অবসর সুবিধা বোর্ডের সদস্য সচিব অধ্যক্ষ শরীফ সাদী, বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক বজলুর রহমান, বিশ্ব শিক্ষক ফেডারেশনের সভাপতি অধ্যক্ষ মাহফুজা খানম, শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ড. মনজুর আহমেদ চৌধুরী, বাকবিশিস সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর প্রমুখ।</p>