<p>কুড়িগ্রামের ২৩ বছর বয়সী ইমরান ফিরোজের দুটি কিডনিই বিকল। তাঁর রক্তের গ্রুপ ‘ও’। চিকিৎসকের পরামর্শ, ইমরানকে বাঁচাতে অবিলম্বে প্রয়োজন কিডনি প্রতিস্থাপন। ছেলেকে বাঁচাতে নিজের কিডনি দিতে চান ইমরানের মা। কিন্তু বিধি বাম! দুজনের রক্তের গ্রুপ আলাদা। কিডনি প্রতিস্থাপনের জন্য কিডনিদাতার সঙ্গে রোগীর রক্তের গ্রুপ ও টিস্যু টাইপিংয়ের যথেষ্ট মিল থাকাই নিয়ম। তবে আশার কথা, ইমরান ফিরোজের ক্ষেত্রে অন্য দাতা খুঁজতে হয়নি। রক্তের গ্রুপ আলাদা হওয়া সত্ত্বেও অবশেষে মা পেরেছেন নিজের ছেলেকে কিডনি দিতে।</p> <p>গত ৫ জুলাই এবিও ইনকমপ্যাটিবল ট্রান্সপ্লান্টেশন (এবিওআই) পদ্ধতিতে দেশে প্রথমবারের মতো কিডনি প্রতিস্থাপন করা হলো ঢাকার কিডনি ফাউন্ডেশন হাসপাতাল অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউটে। এর মধ্যে ইমরান ও তাঁর মা হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র পেয়ে বাসায় গেছেন এবং তাঁরা ভালো আছেন বলে কালের কণ্ঠকে জানিয়েছেন।</p> <p>কিডনি ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি অধ্যাপক ডা. হারুন আর রশিদের নেতৃত্বে বিশেষজ্ঞ নেফ্রোলজি টিম, ট্রান্সপ্লান্ট সার্জন অধ্যাপক ডা. খুরশিদুল আলম ও অধ্যাপক ডা. সাজিদ হাসানের নেতৃত্বে ট্রান্সপ্লান্ট টিম, ব্লাড  ব্যাংক স্পেশালিস্ট, অ্যানেসথেটিস্ট ও নার্সের সমন্বয়ে বিশেষ টিম এই কিডনি প্রতিস্থাপন কার্যক্রম পরিচালনা করে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এর মাধ্যমে কিডনি সংযোজনে ঘটল যুগান্তকারী ঘটনা, বাংলাদেশ পৌঁছল নতুন উচ্চতায়। এখন আর রোগীর সঙ্গে কিডনিদাতার রক্তের গ্রুপের মিল নিয়ে ভাবতে হবে না। আর আধুনিক ‘এবিওআই’ পদ্ধতির ব্যবহার নিয়মিত সম্ভব হলে কিডনিদাতার সংখ্যা অনেক বেড়ে যাবে, সমাধা হবে দাতা সংকটের। পাশাপাশি অনেকাংশেই কমে যাবে কিডনি বেচাকেনার মতো গর্হিত কাজ।</p> <p>সাধারণত রক্তদান আর কিডনি প্রতিস্থাপনের ক্ষেত্রে নিয়ম একই। ‘ও’ এবং ‘এবি’ গ্রুপ ছাড়া (‘ও’ গ্রুপ সর্বজনদাতা এবং ‘এবি’ গ্রুপ সর্বজনগ্রহীতা) এক রক্তের গ্রুপের ব্যক্তিই সেই রক্তের গ্রুপধারী অন্য ব্যক্তিকে রক্ত দিতে পারে। কিডনি সংযোজনের ক্ষেত্রেও নিয়মটা একই, যাকে বলে ‘এবিও কমপ্যাটিবল’ কিডনি প্রতিস্থাপন। এই পদ্ধতিতে কিডনি প্রতিস্থাপনের কয়েক সপ্তাহ আগে থেকে ‘প্লাজমাফেরেসিস’ পদ্ধতিতে রক্তের প্লাজমা বা রক্তরসকে রক্তকোষ থেকে আলাদা করা হয়। একটি ছাঁকনির মাধ্যমে বারবার ছেঁকে সেখান থেকে অ্যান্টিবডিগুলো আলাদা করা হয়। আর অ্যান্টিবডি আলাদা করলে অন্য রক্তের গ্রুপের কোনো ব্যক্তির কিডনি প্রতিস্থাপন করার ক্ষেত্রে কোনো সমস্যা থাকে না। ইমরান ফিরোজের এন্টিবডি ছিল ১ ঃ ১২৮, যা ব্লাড এফেরেসিস মেশিনের মাধ্যমে ও কিছু ওষুধ প্রয়োগ করে ১ ঃ ৮-এ নামিয়ে আনা হয়। পুরো প্রস্তুতি শেষ হতে সময় লাগে তিন সপ্তাহ। এর পরই প্রতিস্থাপনের প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়।</p> <p>অধ্যাপক ডা. হারুন আর রশিদ কালের কণ্ঠকে বলেন, উন্নত বিশ্বে এই প্রক্রিয়ায় (এবিওআই) কিডনি প্রতিস্থাপনের সাফল্যের হার প্রায় ৯৫ শতাংশ। স্বাভাবিক প্রতিস্থাপনের রোগীদের মতো তাদের ক্ষেত্রেও ইনফেকশন ও কিডনি রিজেকশন ছাড়া অন্য তেমন কোনো ঝুঁকি নেই। তবে প্রতিস্থাপনের পর বিশেষ ফলোআপে থাকতে হয় কিছুদিন। তিনি জানান, কিডনি ফাউন্ডেশনে প্রতিস্থাপন বাবদ খরচ হয় দুই লাখ ৬০ হাজার টাকার মতো। এই রোগীর ক্ষেত্রে সব মিলিয়ে খরচ হয়েছে সাড়ে আট লাখ টাকার মতো। তবে রোগীর কাছ থেকে নেওয়া হয়েছে অতিরিক্ত দুই লাখ টাকা, বাকিটা কিডনি ফাউন্ডেশন বহন করেছে।</p> <p>রোগী ইমরান ও তাঁর মায়ের বক্তব্য : এবিওআই পদ্ধতির সুফলভোগী রোগী ইমরান ফিরোজের বাড়ি কুড়িগ্রামের উলিপুরে। তিনি বিএ চূড়ান্ত বর্ষের শিক্ষার্থী। চলতি বছরের জানুয়ারিতে ঢাকায় বোনের বাসায় বেড়াতে এসে হঠাৎ বমি শুরু করেন ইমরান। তিনি গতকাল কালের কণ্ঠকে জানান, বাড়ি ফিরে রংপুরে গিয়ে কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে কিডনির ডাক্তার দেখানোর পর জানতে পারেন, তাঁর দুটি কিডনিই বিকল। এরপর ঢাকায় এসে কিডনি প্রতিস্থাপনের সিদ্ধান্ত নেন। তাঁর মা কিডনি দানের ইচ্ছা পোষণ করলেও রক্তের গ্রুপ ভিন্ন হওয়ায় জটিলতা তৈরি হয়। পরে ‘এবিও কমপ্যাটিবল’ পদ্ধতিতে দেশে প্রথমবারের মতো ঢাকার মিরপুরে কিডনি ফাউন্ডেশন হাসপাতালে ৫ জুলাই সফলভাবে তাঁর কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট হয়।</p> <p>কিডনি প্রতিস্থাপনের পর এখন কেমন আছেন—এই প্রশ্নের জবাবে ইমরান ফিরোজ গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বেশ ভালো আছি, বেশ সুস্থ বোধ করছি। খাওয়াদাওয়া ঠিকমতো করা যাচ্ছে, তবে শরীর সামান্য দুর্বল। প্রস্রাব-পায়খানা ক্লিয়ার, কোনো সমস্যা হচ্ছে না। ডাক্তার বলেছেন, নিয়মিত ফলোআপের জন্য ছয় মাসের মতো ঢাকায় থাকতে হবে। এ জন্য মাসহ মিরপুরে বাসা ভাড়া নিয়ে আছি। আগামী সোমবার ফলোআপ করতে হারুন স্যারের নিকট যাব।’</p> <p>ইমরানের কিডনিদাতা মা ৫২ বছর বয়স্ক ফাতেমা বেগম গতকাল টেলিফোনে কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ছেলে সুস্থ হচ্ছে দেখে আমার অনেক ভালো লাগছে। ডাক্তার বলেছেন পুরো সুস্থ হতে তিন মাসের মতো সময় লাগবে। কিন্তু এখন আমি অনেকটাই ভালো বোধ করছি। হাঁটাচলা, খাওয়াদাওয়া সবাই করতে পারছি। কোনো সমস্যা হচ্ছে না।’</p> <p>তিনি আরো বলেন, ‘কিডনি দানের জন্য অপারেশন থিয়েটারে ঢোকার আগেও কোনো ভয় পাইনি। সব সময় মনে হয়েছে—যদি আমার শরীর দিয়ে একমাত্র ছেলে সুস্থ হয়, তবে ভয় কিসের। সেই সাহস করেই অপারেশন থিয়েটারে গেছি।’</p> <p>উল্লেখ্য, দেশে প্রায় দুই কোটি লোক কোনো না কোনোভাবে কিডনি রোগে আক্রান্ত। এর মধ্যে প্রতিবছর সম্পূর্ণভাবে কিডনি বিকল হয় প্রায় ৪০ হাজার রোগীর, যাদের ৮০ শতাংশই মারা যায়। বাকি ২০ শতাংশের মধ্যে ৯৫ ভাগ হেমো ডায়ালিসিস ও দুই থেকে আড়াই ভাগ সিএপিডি ও কিডনি প্রতিস্থাপনের মাধ্যমে বেঁচে থাকে। এ পর্যন্ত বাংলাদেশে দুই হাজারের বেশি রোগীর কিডনি প্রতিস্থাপন হয়েছে, যাদের সবই জীবিত এবং আত্মীয়-স্বজনের কাছ থেকে নেওয়া। </p>
