ঢাকা, শনিবার ০৫ এপ্রিল ২০২৫
২২ চৈত্র ১৪৩১, ০৫ শাওয়াল ১৪৪৬

ঢাকা, শনিবার ০৫ এপ্রিল ২০২৫
২২ চৈত্র ১৪৩১, ০৫ শাওয়াল ১৪৪৬

সাংবাদিকদের মানিক মিয়া অসাধারণ স্বাধীনতা দিয়েছেন

notdefined
notdefined
শেয়ার
সাংবাদিকদের মানিক মিয়া অসাধারণ স্বাধীনতা দিয়েছেন

মওলানা আকরম খাঁ থেকে শুরু করে তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার মতো এ দেশের অনেক কিংবদন্তি সম্পাদক, সাংবাদিকের সঙ্গে কাজ করেছেন তিনি। ব্যক্তিগতভাবে মেলামেশার সুযোগ হয়েছে। আলী হাবিবের কাছে সেই সব অভিজ্ঞতা তুলে ধরলেন প্রখ্যাত কলাম লেখক ও সাংবাদিক আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী। ছবি তুলেছেন কাকলী প্রধান

 

মওলানা আকরম খাঁর সঙ্গে কবে কাজ করেছেন?

১৯৫৮ সালে, তখন মার্শাল ল চলছে।

পারিবারিক বিবাদে আজাদ প্রায় বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল। এখানের মার্শাল ল অ্যাডমিনিস্ট্রেটর জেনারেল ওমরাহ হস্তক্ষেপ করে কাগজটি সরকারের হাতে নিয়ে নিলেন। আজাদেরই রিপোর্টার সৈয়দ জাফরকে প্রশাসনের দায়িত্ব দিলেন। এই সময়ে আমি ইত্তেফাক ছেড়ে আজাদে এলাম।
সম্পাদক ছিলেন আবুল কালাম শামসুদ্দীন। আজাদে অনেক বিখ্যাত সাংবাদিককে সহকর্মী হিসেবে পেয়েছি। তখন মুজিবর রহমান খাঁ, পরে কায়রো দুর্ঘটনায় নিহত মোজাম্মেল হক সেখানে কাজ করতেন। ফয়েজ আহমদ আমাদের চিফ রিপোর্টার ছিলেন।
কিছুদিন এভাবে চালানোর পর আবার মওলানা আকরম খাঁর মালিকানায় কাগজটি ফিরিয়ে দেওয়া হলো। শামসুদ্দীন ভাই-ই সম্পাদক থাকলেন। তবে প্রধান সম্পাদক হিসেবে প্রিন্টার্স লাইনে আকরম খাঁ তাঁর নাম বসালেন। প্রতিদিন তাঁর বৈঠকখানায় সহকারী সম্পাদকদের মিটিং হতো। সেখানে আবুল কালাম শামসুদ্দীন, মুজিবর রহমান খাঁসহ অনেকে থাকতেন।
আকরম খাঁ সবচেয়ে অল্পবয়সী সাংবাদিক হিসেবে আমাকে খুব স্নেহ করতেন। এভাবেই তাঁর সঙ্গে আমার সখ্য গড়ে ওঠে। আগে তাঁর সম্পর্কে ব্যক্তিগতভাবে আমার ধারণা ছিল, তিনি একজন সাম্প্রদায়িক মানুষ। কিন্তু পরে মেলামেশা থেকে তাঁর সম্পর্কে ধারণা হলো, রাজনীতিতে সাম্প্রদায়িক হলেও ব্যক্তিগতভাবে তিনি খুব উদার ও অসাম্প্রদায়িক। সাংবাদিকতার ক্ষেত্রেও সাম্প্রদায়িকতাকে প্রশ্রয় দিতে চাইতেন না। আইয়ুব খান যখন মুসলিম লীগ ভাগ করেন, তিনি দৃঢ়ভাবে সেটির বিরুদ্ধে দাঁড়ান। তখন প্রাদেশিক মুসলিম লীগ কাউন্সিলের সভাপতি ছিলেন তিনি। আইয়ুব খান তাঁর সঙ্গে দেখা করলেও তিনি কনভেনশন মুসলিম লীগে যোগ দেননি। তিনি আমাদের বলতে শুরু করেন, তোমরা সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে সমালোচনামূলক লেখা শুরু করো।

 

সাংবাদিক হিসেবে তিনি আপনাদের কেমন স্বাধীনতা দিয়েছেন?

তিনি আজাদের মালিক-সম্পাদক ছিলেন। তবে তাঁর এক এবং একমাত্র বাতিক ছিল, ইসলামকে ‘এছলাম’ লিখতে হবে। তিনি চাইতেন, আরবি শব্দ বাংলায় লেখার সময় সব জায়গায় ‘ছ’ লিখতে হবে। এ ছাড়া তাঁর আর কোনো বাতিক ছিল না। বাংলা লেখার ব্যাপারে তখন সাংবাদিকরা পুরনো ভাষা ব্যবহার করতেন। যেমন—‘ধান্য কর্তন নিয়া বিবাদে দুইজন নিহত’। এসব দেখে তিনি রাগ করতেন। বলতেন, “তোমরা ‘ধান্য কর্তন’ লেখো কেন? ‘ধান কাটা নিয়া বিবাদে দুইজন মারা গেছে’—এভাবে লিখবে।” আমরা ভাষা ব্যবহারের সময় যদি দু-একটি সংস্কৃতি শব্দ ব্যবহার করতাম, তাতে তাঁর কোনো আপত্তি ছিল না।

 

সম্পাদক আবুল কালাম শামসুদ্দীনের কথা মনে পড়ে?

আবুল কালাম শামসুদ্দীন প্রথমে মোহাম্মদীতে, পরে আজাদে যোগ দেন। তবে তিনি ধীরে ধীরে আকরম খাঁর চেয়েও বেশি মুসলিম লীগপন্থী হয়ে ওঠেন। বাংলা ভাষার প্রশ্নে তিনি আপসহীন ছিলেন। ১৯৫২ সালে যখন আমাদের ওপর গুলি চালানো হলো, তখন তিনি কিন্তু মুসলিম লীগের এমএনএ (মেম্বার অব প্রভিনশিয়াল অ্যাসেমব্লি)। এই অন্যায়ের প্রতিবাদে তিনি পদত্যাগ করলেন এবং মুসলিম লীগের সঙ্গে সব ধরনের সম্পর্ক ছেদ করলেন। সম্পাদক হিসেবে আজাদে খুব বলিষ্ঠ ভাষায় গুলিবর্ষণের নিন্দা জানিয়ে সম্পাদকীয় লিখেছিলেন। এমনকি প্রাদেশিক পরিষদ থেকে বেরিয়ে তিনি মুসলিম লীগের প্রাদেশিক শাসক নুরুল আমিনের বিপক্ষে বিবৃতি দেন এবং প্রথম শহীদ মিনারের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। পাকিস্তানিরা এটি ভেঙে ফেলার পর মওলানা ভাসানী আবার শহীদ মিনারের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। তিনি অসাধারণ লেখক ছিলেন, অনুবাদ সাহিত্যে তাঁর খুব দক্ষতা ছিল, নিজে উপন্যাস লিখেছেন। তাঁর অনেক প্রবন্ধের বইও আছে। তাঁর প্রবন্ধগুলোতে তখনকার দিনের রাজনীতি উঠে এসেছে।

 

তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার সঙ্গেও তো কাজ করেছেন?

তখন দৈনিক মিল্লাতে কাজ করি। সেখানে আমার লেখা একটি উপসম্পাদকীয় পড়ে মানিক মিয়া মিল্লাতের সম্পাদক মোতাহার হোসেন সিদ্দিকীকে বলেন, ‘এই ছেলেটিকে আমি চাই। সে ইত্তেফাকে চলে আসুক।’ ছাত্রলীগ নেতা আবদুল আউয়াল তখন সেখানে কাজ করেন। তিনি আমাকে তাঁর কাছে নিয়ে গেলেন। প্রথম দিন থেকেই তিনি আমার লেখা খুব গুরুত্ব দিয়ে ছাপতেন। মাঝেমধ্যে লেখা তাঁর মনমতো না হলে খুব চটেও যেতেন। তাঁর মনটি ছিল খুব উদার। তিনি রাগারাগি করতেন। তবে সবার সামনে না। পরে সব ভুলে যেতেন। সাংবাদিকদের মানিক মিয়া অসাধারণ স্বাধীনতা দিয়েছেন। নিজে একসময় আমেরিকার পক্ষে ছিলেন। ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় আহমেদুর রহমান ভিয়েতনামের পক্ষে ও আমেরিকার বিপক্ষে দারুণ একটি এডিটরিয়াল লিখলেন। আমরা ভেবেছিলাম, মানিক ভাই লেখাটি ছাপবেন না; কিন্তু সেটি ছাপা হলো। পরদিন আবার তাঁর রাজনৈতিক মঞ্চে তিনি আহমেদুর রহমানের লেখার সমালোচনাও করলেন। তিনি লিখলেন, ‘এই লেখাটি আমরা ছেপেছি বটে, তবে এই লেখার মতামতের সঙ্গে ইত্তেফাকের নয়, আমার এই এই বিষয়ে বিরোধ আছে।’ অন্যরা তো লেখা ছাপতে দেয় না, বন্ধ করে দেয়; তিনি সেটি করেননি। ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধের সময় তিনি সবচেয়ে সাহসের পরিচয় দিয়েছেন। আমি এই যুদ্ধের বিরোধী ছিলাম। তখন বাংলা একাডেমিতে একটি মিটিং হয়েছিল। সেখানে রবীন্দ্রনাথ, শরত্চন্দ্রের সব বই পুুড়িয়ে দেওয়ার প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। আইয়ুব খানের আইনমন্ত্রী এ টি এম মোস্তফা সেই সভার সভাপতিত্ব করেছিলেন। এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করলে ডা. মুর্তজাকে খুব প্রহার করা হয়। মারামারি দেখে যখন প্রেস ক্লাবে এলাম, এ বি এম মূসা বলল, এটি নিয়ে কেউ লিখবে? আমি এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে খুব কঠিন ভাষায় এডিটরিয়াল লিখলাম। তাতে বলেছিলাম—যুদ্ধ চলছে, চলুক। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ, শরত্চন্দ্রের বই কেন পুড়িয়ে ফেলা হবে? যুুদ্ধে জয়-পরাজয় হবেই, কিন্তু সাহিত্যের ওপর কেন খড়্গাঘাত করা হচ্ছে? লেখাটি প্রেসে না পাঠিয়ে মানিক ভাইয়ের টেবিলে রেখে বাসায় চলে এলাম। মনে মনে ভেবেছিলাম, যুদ্ধের মধ্যে, ভয়াবহ মার্শাল লর মধ্যে লেখাটি ছাপবেন না। পরদিন খুব ভোরে ইত্তেফাকে তাঁর ব্যক্তিগত পিয়ন বশির আমার পুরনো ঢাকার কে এম দাস লেনের বাসায় এসে হাজির। বলল, সাহেব আপনাকে ডাকছেন। আমি তো ভয়ে অস্থির যে আজকেই চাকরি শেষ। অফিসে গিয়ে দেখি, তিনি আমার লেখাটি বিশেষ সম্পাদকীয় হিসেবে প্রথম পাতায় ছেপেছেন। তাঁর রুমে ঢুকলাম। তিনি আমাকে শুধু একটি কথাই বললেন, ‘এই এডিটরিয়ালটি ছাপানোর জন্য যদি আমাকে জেলে যেতে হয়, যেতে রাজি আছি।’ এ রকম স্বাধীনতা তিনি আমাদের দিয়েছেন! ছয় দফা আন্দোলনের সময় নারায়ণগঞ্জের কাছে নাখালপাড়ায় যখন গুলি চালানো হলো, তাতে একজন মারা গেলেন। তখন আমাদের এডিটরিয়াল বিভাগে নুরুল ইসলাম পাটোয়ারী গুলিবর্ষণের প্রচণ্ড সমালোচনা করে লিখলেন। সেটি ছাপা হলো। পরদিনই আর্মির দুজন কর্তাব্যক্তি অফিসে এসে মানিক মিয়াকে ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। বারবার জানতে চেয়েছে, এই লেখাটি কে লিখেছে বলুন, আমরা তাঁকে গ্রেপ্তার করতে চাই। তিনি একটাই উত্তর দিয়েছেন, ‘আমি তো এই কাগজের সম্পাদক। সব লেখার জন্য আমিই দায়ী। গ্রেপ্তার করতে হলে আমাকে করুন। কোনো নাম আমি বলব না। কারণ যে লিখেছে সে আমার অধীনস্থ সাংবাদিক। সে আমার কথায় লেখাটি লিখেছে, আমার ভিউ থেকে লিখেছে।’ সন্ধ্যায় তারা তাঁকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হলো। তিনি অভুক্ত অবস্থায় অফিসে এলেন। তাঁর অবস্থা এত খারাপ ছিল যে যেকোনো সময় তিনি পড়ে যেতে পারেন। তার পরও পাটোয়ারীর নাম তিনি বলেননি। এভাবে তিনি সাংবাদিকদের প্রটেক্ট করতেন।

 

জহুর হোসেন চৌধুরী?

তাঁকে আমি ভালোবাসি। তিনি বামপন্থী মানবতাবাদী ছিলেন। আমার সময়ে সংবাদে তিনি নির্বাহী সম্পাদক আর খায়রুল কবীর সম্পাদক ছিলেন। তখন নুরুল আমিনের সরকার ক্ষমতায়। একবার তিনি পুরুষোত্তম দাশ ট্যান্ডনকে নিয়ে একটি লেখা লিখেছিলেন। আজও সেই লেখার মতো অ্যান্টি-ইন্ডিয়ান লেখা কেউ লিখতে পারেনি। কাশ্মীর নিয়েও তিনি লিখেছিলেন। তিনি প্রগতিশীল, আধুনিক লোক ছিলেন। কিন্তু সংবাদ পত্রিকার ব্যাপারে আমি তাঁর দ্বৈত সত্তা দেখতাম। মানিক মিয়া যেখানে সব কিছু সাহসের সঙ্গে ফেস করতেন, তিনি তা করতেন না। কোনো না কোনোভাবে দোদুল্যমানতার মধ্যে থাকতেন। এসব আমি দেখেছি। তবে তিনি খুবই শক্তিশালী লেখক ছিলেন—এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই।

 

কাজী মোহাম্মদ ইদরিস?

কলকাতায় আবুল হাশেম পরিচালিত মিল্লাতের যখন তিনি সম্পাদক, তখন থেকেই আমি তাঁর লেখার খুব ভক্ত ছিলাম। এ দেশে আসার পর তিনি দৈনিক ইত্তেহাদে সম্পাদক হিসেবে যোগ দেন। তাঁর সঙ্গে কাজ করার সৌভাগ্য হয়নি। তবে বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করতে মাঝেমধ্যে আমি তাঁর অফিসে যেতাম। তখন আমাকে দেখলে বলতেন, ‘এই, তুমি কি বসে আছ? আমাদের একটি এডিটরিয়াল লিখে দিয়ে যাও।’ লিখে দিতাম। মাহবুবুল হকের ‘পল্লীবার্তা’ নোয়াখালী থেকে বেরোত। ইত্তেহাদ বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর হামিদুল হক চৌধুরী তাঁকে এনে পল্লীবার্তার সম্পাদক করেন। সেটি ঢাকা থেকে সাপ্তাহিক হিসেবে বেরোত। আমাকে একটি কলাম লিখতে বললেন। ‘ঈসা খাঁ’ নাম দিয়ে প্রায় বছর দুই কলামটি লিখেছি। সেখানেই বেসিক ডেমোক্রেসির বিরুদ্ধে প্রথম লেখাটি ছাপা হয়েছে। আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে লেখা প্রকাশিত হয়েছে। এ সবগুলো লেখাই ইদরিস ভাইয়ের ব্রিফিংয়ে লিখেছি। তিনি একটু রাগী স্বভাবের ছিলেন। মাঝেমধ্যে চটে যেতেন। কখনো কখনো বলতেন, ‘এই লেখা তো এভাবে লিখতে বলিনি।’ ইদরিস ভাই খুবই ভালো লোক ছিলেন। শেষ বয়সে খুব কষ্ট করেছেন।

 

আপনার বন্ধু আহমেদুর রহমান, যিনি ‘ভিমরুল’ ছদ্মনামে ‘মিঠেকড়া’ কলামটি লিখতেন?

আমরা দুজন মিল্লাতে একসঙ্গে কাজ করেছি। মানিক মিয়া মিল্লাতের মালিক হওয়ার পর আহমেদুর রহমান নির্বাহী সম্পাদক হিসেবে সেখানে ছিল। সে আমাকে বলল, ‘ছদ্মনামে তুমি আমাদের কাগজেও লেখো।’ ওখানে ‘রং-বেরং’ নামে কলাম লিখতাম। এর কিছুদিন পর মার্শাল ল হলো। মানিক মিয়া মিল্লাত বন্ধ করে দিলেন এবং আহমেদুর রহমানকে ইত্তেফাকে নিয়ে নিলেন। খন্দকার আবদুল হামিদ প্রথম ‘মিঠেকড়া’ শুরু করেছিলেন। যেদিন মানিক মিয়া রাজনৈতিক মঞ্চ লিখতেন না, সেদিন আবদুল হামিদ ‘মিঠেকড়া’ লিখতেন। পরদিন আমি লিখতাম। আহমেদুর রহমান যোগদানের পর সে একটানা লিখেছে। তখন থেকেই সে বামপন্থার দিকে ঝুঁকে গেল। বিশেষ করে ওয়াহিদুল হকের সংস্পর্শে গিয়ে মস্কোপন্থী হয়ে গেল। পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সে অনেক লিখেছে। এ জন্য মানিক মিয়ার কাছে অনেক নালিশও গেছে। তবে তিনি বলেছিলেন, ‘মস্কোপন্থা-চীনপন্থায় আমার কিছু আসে যায় না।’ তিনি তাকে খুব স্বাধীনতা দিয়েছিলেন, খুব ভালোবাসতেন। তার মৃত্যুর পর আমরা তার স্ত্রীকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য তার বাড়ি পর্যন্ত গিয়েছিলাম। যে কায়রো বিমান দুর্ঘটনায় সে মারা যায়, সে ফ্লাইটে ইত্তেফাকের পক্ষ থেকে আমারই যাওয়ার কথা ছিল। সে এসে বলল, ‘তুমি তো প্রতিবারই বিদেশে যাও। এবার আমি যাব।’ তার পাসপোর্ট ছিল না। কমিউনিস্ট বলে পুলিশি রিপোর্টও খারাপ ছিল। মানিক মিয়া ব্যক্তিগতভাবে তদবির করে তার যাওয়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। প্রথম পাসপোর্টে প্রথম বিদেশযাত্রায় গিয়ে সে মারা গেল। এ বি এম মূসা তার মৃত্যুর সংবাদে অবজারভারে হেডিং দিয়েছিল, ‘পাসপোর্ট টু ডেথ’।

 

ফয়েজ আহমদ?

ইত্তেফাকে আমি যখন ডেস্কে, ফয়েজ রিপোর্টিংয়ে। ১৯৫৪ সালে সে ইত্তেফাকের চিফ রিপোর্টার হয়। তখন মওলানা ভাসানীর নির্বাচনের জন্য সে সারা বাংলাদেশ ঘুরে বেড়িয়েছে। ভাসানী তাকে খুব বিশ্বাস করতেন। তিনি সাদা কাগজে সই করে দিতেন। আগে থেকে ৫০-৬০ পাতা সই করে রেখেছিলেন, সেগুলোর ওপর সে রিপোর্ট লিখে পাঠাত। তখন তো টেলিফোন, ফ্যাক্স কিছুই ছিল না। ভাসানী যেদিন যেখানে বক্তৃতা দিতেন, সেদিনই আগে থেকে সে বক্তৃতা লিখে পাঠাত। সে ঠিকই আন্দাজ করতে পারত, বক্তৃতায় ভাসানী কী বলবেন। ইত্তেফাকই একমাত্র কাগজ, যেখানে পাবনা, দিনাজপুর, রংপুর—এসব জায়গা থেকে ভাসানীর বক্তৃতা ছাপা হয়েছে। আমরা টেরই পেতাম না, কিভাবে এটি হলো। অথচ মওলানার স্বাক্ষরিত বিবৃতি এটি! এমনও হয়েছে, তিনি বক্তৃতা দিতে আসেননি, অথচ ফয়েজ লিখে পাঠিয়েছে (হাসি)। নির্বাচনের পুরো সময় সে এভাবে ভাসানীর বক্তৃতা লিখে পাঠিয়েছে। তবে তিনি কোনো দিন আপত্তি করেননি। উল্টো তিনি বলতেন, ‘ফয়েজ, তুমি ভালোই লিখেছ। আমার অনেক কথাই আগে থেকে লিখে দিয়েছ।’ যখন আজাদের চিফ রিপোর্টার ছিল, তখন মণি সিংহ ১২ কি ১৮ বছর পর আন্ডারগ্রাউন্ড থেকে বেরোচ্ছেন। সেই খবর সে প্রথম প্রকাশ করে এবং মণি সিংহ সেদিন আত্মপ্রকাশ করেন। আজাদে যখন চাকরি করত, ভারতের চর অপবাদ দিয়ে তাকে সাত বছর জেলে রাখা হয়েছিল। বেরিয়ে এসে তো সে আর চাকরি পায় না। কোনো কাগজের সম্পাদকই এই কমিউনিস্ট, রাজবন্দিকে চাকরি দিতে রাজি নন। তখন আজাদের কামরুল আনাম খাঁ তাকে চিফ রিপোর্টার করে নিয়ে গেলেন। এই তার নতুন জীবন শুরু হলো। সে খুব ভারতপন্থী ছিল, কিন্তু পরে চীন বেতারে চাকরি নিয়ে চীনে চলে যায়।

 

এম আর আখতার মুকুলের সঙ্গে তো পূর্বদেশে কাজ করেছেন?

হ্যাঁ। ফয়েজ আর মুকুল অভিন্নহৃদয় বন্ধু ছিল। মুকুল যেখানে কাজ করত, সেখানে নিজের অস্তিত্ব বিলিয়ে দিত। যেমন—মোনেম খাঁর পতনের পর হঠাৎ সিদ্ধান্ত হলো, ‘সহি মোনায়েমনামা’ নামে একটি সাপ্লিমেন্ট প্রকাশ করা হবে। এ ছাড়া ‘সহি আইয়ুবনামা’ও বের করা হবে। মুকুল তখন পূর্বদেশের ব্যবস্থাপনা সম্পাদক। হামিদুল হক চৌধুরী আমাকে বললেন, ‘গাফ্ফার, তুমি এটি বের করো। আর মুকুল, তুমি তাকে সহযোগিতা করো।’ সে আমাকে যথেষ্ট সহযোগিতা করেছে।              

[শ্রুতলিখন : ওমর শাহেদ ও রেনেসাঁ রহমান]

মন্তব্য

সম্পর্কিত খবর

সর্বশেষ সংবাদ