স্থিতধী আহমদ ছফা। যা চিন্তা করতেন, লিখতেন অকপটে। ভণিতার লেশমাত্রও তাঁর ছিল না। খুব নির্মোহ সমালোচক ছিলেন।
আজও অপরিহার্য আহমদ ছফা
- তুহিন ওয়াদুদ
notdefined

তৃতীয় শ্রেণিতে পড়াকালীন জীবনের প্রথম কবিতা লিখেছেন।
আহমদ ছফা কখনো সাংবাদিকতা, কখনো সম্পাদনা, কখনো সংগঠকের কাজ করেছেন। সাহসিকতার আধার ছিলেন তিনি।
আহমদ ছফা গল্প, উপন্যাস, কবিতা, প্রবন্ধ, স্মৃতিকথা, অনুবাদ, ইতিহাস, ভ্রমণকাহিনী লিখেছেন। এখনো সেগুলোর পাঠকপ্রিয়তায় কোনো কমতি নেই। কালজয়ী এসব রচনার মধ্য দিয়ে বারংবার আলোচনায় এসেছেন আহদ ছফা। তাঁর রচনাসম্ভারেই তাঁর অমরত্ব রচিত হয়েছে। তাঁর ‘গাভী বৃত্তান্ত’, ‘ওঙ্কার’, ‘জল্লাদ সময়’, ‘বাঙালি মুসলমানের মন’, ‘অলাতচক্র’, ‘আনুপূর্বিক তসলিমা নাসরিন ও অন্যান্য স্পর্শকাতর প্রসঙ্গ’, ‘যদ্যপি আমার গুরু’সহ বিভিন্ন রচনা এখনো বহুল আলোচিত।
হুমায়ুন আজাদ, আল মাহমুদ, তসলিমা নাসরিনসহ অনেকের লেখা নিয়ে চাছাছোলা বক্তব্য প্রদান করেছেন। ‘বাঙালি মুসলমানের মন’ প্রকাশিত হওয়ার পর অনেক মুসলমানই তাঁর তীব্র সমালোচনা করেছেন। আহমদ ছফার সঙ্গে শিল্পসাহিত্য বিষয়ে বিরোধ অনেক সময় শিল্পের পর্যায়ে উন্নীত হয়েছিল। একজনের সমালোচনার জবাব অন্যজন লিখে প্রদান করতেন। যেমন হুমায়ুন আজাদের একটি সাক্ষাত্কারে তাঁর কয়েকটি পরিচয় তুলে ধরা হয়। আহমদ ছফা সেগুলোর অসারতা লক্ষ করে তাঁর সম্পর্কে লিখেছেন—‘হুমায়ুন আজাদ সাক্ষাত্কারে নিজের অনেক পরিচয়ের কথা উল্লেখ করেছেন। যেমন : তিনি একজন কবি, ভাষাবিজ্ঞানী, অধ্যাপক, উপন্যাস লেখক, প্রবন্ধকার, সমালোচক ইত্যাদি ইত্যাদি। তিনি তাঁর অনেকগুলো পরিচয় ঢেকেও রেখেছেন। সেগুলো হলো—হুমায়ুন আজাদ একজন স্ট্যান্ডবাজ, পরশ্রীকাতর এবং অত্যন্ত রুচিহীন নির্লজ্জ একজন মানুষ। হুমায়ুন আজাদ কী পরিমাণ নির্লজ্জ, সে সম্পর্কে তাঁর নিজের কোনো ধারণা নেই।’ (আহমদ ছফা রচনাবলি, খণ্ড ৮, পৃষ্ঠা ৩৯৯)
পরস্পরের গ্রহণ-বর্জনের এসব বিতর্ক চলেছে দীর্ঘ সময়। পরস্পরের প্রতি অভিযোগ-অনুযোগের মধ্য দিয়ে পাঠক নিজস্ব একটি সিদ্ধান্তের বলয় তৈরি করে নিতে সক্ষম হন। অপবাদ-বিষোদগারের সত্যতাও তাঁদের লেখার মধ্য দিয়েই অনেক সময় উঠে এসেছে।
তসলিমা নাসরিনের সঙ্গেও তাঁর বুদ্ধিবৃত্তিক বিরোধ তুঙ্গে ছিল। পত্রিকার পাতায় একজনের অপবাদের অসারতা প্রমাণ করতেন অন্যজন। লেখার মান নিয়েও হতো সমালোচনা। বিভিন্ন লেখায়, সাক্ষাত্কারে আহমদ ছফা তসলিমা নাসরিন সম্পর্কে বিশদ বলেছেন। তাঁর একটি প্রবন্ধগ্রন্থের নাম ‘আনুপূবির্ক তসলিমা এবং অন্যান্য স্পর্শকাতর প্রসঙ্গ’। এই প্রবন্ধে তসলিমা নাসরিনের প্রতি নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি বর্ণিত হলেও তাঁর ওপর মৌলবাদীদের যে আক্রমণ, তার সমালোচনা করেছেন আহমদ ছফা। বিরোধ যে যুক্তির আলোকে, এটা তারই অর্থ বহন করে।
আহমদ ছফা বাঙালি মুসলমানদের পিছিয়ে থাকার কারণ অন্বেষণ করেছেন। বিভিন্ন লেখায় তার প্রতিফলন ঘটেছে। তার পরও ‘বাঙালি মুসলমানের মন’ শীর্ষক প্রবন্ধটি তার একটি বিশেষ কারণে লিখিত। স্বঘোষিত নাস্তিক ছিলেন আবুল ফজল। আহমদ ছফা ছিলেন তাঁর অনুসারী। একদিন সকালে তিনি আবুল ফজলকে টুপি পরে সিরাত অনুষ্ঠানে যাওয়া দেখে বিস্মিত হন। জিয়াউর রহমান সরকারের তখন তিনি উপদেষ্টাও ছিলেন। আবুল ফজলের বদলে যাওয়াটাকে তিনি বিচ্ছিন্ন ঘটনা মনে না করে এর কার্যকারণ সন্ধানের চেষ্টা করেন। আবুল ফজলের পরিবর্তিত রূপ তার মধ্যে প্রচণ্ড রকম আলোড়ন সৃষ্টি করে। সেই আলোড়ন নিয়ে এক রাতে ‘বাঙালি মুসলমানের মন’ শীর্ষক প্রবন্ধটি লেখেন।
বাঙালি মুসলমানদের নিয়ে বাংলা সাহিত্যে বিস্তর লেখালেখি হয়েছে। বিশেষত মুসলিম সাহিত্য সমাজের লেখকরা বাঙালির বোধে এক নবতর রেখাপাত করেন। আবুল হুসেন, আবুল ফজল, মোতাহের হোসেন চৌধুরী, কাজী আবদুল ওদুদ, কাজী মোতাহের হোসেন প্রমুখ বাঙালি মুসলমানের মুক্তবুদ্ধিচর্চার একটি পথ নির্মাণ করেন। সেই পথের আলোকশিখা হাতে আহমদ শরীফ, আহমদ ছফাও হেঁটেছেন। হুমায়ুন আজাদ ধর্ম নিয়ে ক্রমাগত নেতিবাচক কথা লিখেছেন। আমহদ ছফার দৃষ্টিভঙ্গি এখানে সম্পূর্ণ ভিন্ন। হুমায়ুন আজাদ যেখানে বিদ্বেষপ্রসূত, আহমদ ছফা সেখানে সংশোধনকামী। আহমদ ছফা বাঙালি মুসলমানদের মধ্যেও নিজেকে যুক্ত করেন। তাঁর মূল্যায়ন হচ্ছে—এই অধপতিত সমাজের যথেষ্ট কারণ আছে। সেই কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বাঙালি মুসলমানদের মুসলমান হয়ে ওঠার প্রক্রিয়ার গলদ নিয়েও তিনি বিশ্লেষণ করেছেন। আহমদ ছফার এই রূঢ় সমালোচনা অনেকের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়নি। তিনি নিজের চিন্তার স্বাধীনতায় বিশ্বাস করতেন। যুক্তির আলোকে ব্যক্তি-জাতি-রাষ্ট্রকে বিশ্লেষণ করেছেন। বাঙালি মুসলমানদের চিন্তার দ্বীনতা সম্পর্কে তিনি ক্রমাগত শোষণ-নিষ্পেষণকে বড় করে দেখেছেন।
আমদ ছফা তাঁর নিজের জীবনকে ব্যর্থতার জীবন বলে আখ্যায়িত করেছেন, যা করতে চেয়ছিলেন তা আসলে তিনি করতে পারেননি। সাজ্জাদ শরিফ ও ব্রাত্য রাইসুর নেওয়া এক সাক্ষাত্কারে নিজেই সে কথা উল্লেখ করেছেন—‘এই অর্থে ব্যর্থ যে আমি সমাজে যেই সমস্ত জিনিস করতে চেয়েছিলাম শিল্প, সাহিত্য, রাজনীতি কোনোটাই ভালোভাবে করা হয় নাই।’ আহমদ ছফা বিনয় করে নিজের ব্যর্থতার কথা উচ্চারণ করলেও সময় তার উল্টো সাক্ষ্য বহন করে। পুরস্কারপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে তাঁর অপ্রাপ্তি ছিল। তিনি সে সবের তোয়াক্কা করতেন না। আহমদ ছফার দৃঢ় অবস্থান ছিল সমকালে, সমকাল উত্তরেও আছে এবং আগামীতেও থাকবে।
সাহিত্যের বহুধা শাখায় পল্লবিত লেখক আহমদ ছফার জন্মদিন ছিল ৩০ জুন। তাঁর জন্মস্মরণে বিনম্র প্রণতি।
সম্পর্কিত খবর