<div> ঘটনাটি গত বৃহস্পতিবারের। রাজধানীর বারডেম হাসপাতালের একজন চিকিৎসকের কক্ষে যান দুই যুবক। তাঁরা নিজেদের হিজবুত তাওহীদের মুজাহিদ (সদস্য) পরিচয় দিয়ে ওই চিকিৎসককে দাওয়াতপত্র দেন। এরপর সংগঠনকে সহায়তার জন্য চাঁদা দাবি করেন। সেই অনুষ্ঠানের দাওয়াতপত্র পেয়ে বিব্রত হন চিকিৎসক। তিনি এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘পত্রপত্রিকায় দেখেছিলাম, ওই সংগঠনটি জঙ্গিবাদের অভিযোগে কালো তালিকাভুক্ত। সেই সংগঠন এখন প্রকাশ্যে চাঁদা চাইতে এলো! স্মার্ট দুই যুবক এসে বলছে- তারা দেশের এমন অবস্থায় কিছু করতে চায়। আসলে কী হচ্ছে? এগুলো কিছুই বোঝা যাচ্ছে না!’</div> <div> ওই চিকিৎসকের মতোই অনেকের মনে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে হিজবুত তাওহীদ নামের সংগঠনটিকে নিয়ে। সম্প্রতি রাজধানীসহ সারা দেশে ব্যাপক তৎপরতা শুরু করেছে এ সংগঠন। ব্যানার, লিফলেট, হ্যান্ডবিল, বই, ডকুমেন্টারিসহ তারা নানা প্রচারণা কার্যক্রম চালাচ্ছে। এই সংগঠনের রয়েছে নিজস্ব প্রচারের জন্য দৈনিক দেশেরপত্র ও বজ্রশক্তি নামের দুটি পত্রিকাও। আজ বৃহস্পতিবার জাতীয় প্রেসক্লাবে ‘জঙ্গীবাদ’ নামে একটি বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করতে যাচ্ছে সংগঠনটি। আর সেই অনুষ্ঠানের প্রতিপাদ্য বিষয়- ‘জঙ্গীবাদ উত্তরণের একমাত্র পথ’। তবে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জঙ্গিবাদ বিষয়ে সক্রিয় হয়ে ওঠা এ সংগঠনের বিরুদ্ধেই মৌলবাদী প্রচারণাসহ জঙ্গিবাদের অভিযোগ আছে। হিজবুত তাওহীদ বা এর অঙ্গীভূত কোনো প্রতিষ্ঠানের অনুষ্ঠানে উপস্থিত না থাকতে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নির্দেশ দিয়েছে সরকার। গত বছরের ২৩ নভেম্বর এ-সংক্রান্ত একটি চিঠি জারি করেছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। গত ২২ জানুয়ারি জঙ্গি সম্পৃক্ততার অভিযোগে ‘কালো তালিকাভুক্ত’ সংগঠন হিজবুত তাওহীদ বা এর কোনো অঙ্গপ্রতিষ্ঠানের অনুষ্ঠানে যোগ না দিতে ব্যাংকগুলোর ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের সতর্ক করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।</div> <div> গোয়েন্দা সূত্র জানায়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে যেসব ‘সন্দেহভাজন’ সংগঠন নিষিদ্ধকরণের পর্যলোচনার তালিকায় আছে, তাদের মধ্যে অন্যতম হিজবুত তাওহীদ। এক বছর ধরে সংগঠনটি প্রচারণার নতুন কৌশল গ্রহণ করেছে। দলীয় পত্রিকাসহ বিভিন্ন নামে সভা-সেমিনার করছে তারা। সরকারি বিভিন্ন দপ্তরসহ গণমাধ্যম অফিসে তারা তাদের প্রচারপত্র বিলি করছে। তারা সরকারি দলের নেতা-কর্মীদের নিজেদের সংগঠনের সঙ্গে সম্পৃক্ত করারও চেষ্টা করছে বলে জানিয়েছে সূত্র।</div> <div> তবে হিজবুত তাওহীদের সংশ্লিষ্টরা বলছে, সংগঠনটির বিরুদ্ধে ‘অপপ্রচার’ চালাচ্ছে গণমাধ্যম। হিজবুত তাওহীদ নিষিদ্ধ বা কালো তালিকাভুক্ত সংগঠন নয়, এ সংগঠন ইসলামের জন্য কাজ করছে।</div> <div> হিজবুত তাওহীদের ব্যাপারে জানতে চাইলে র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক মুফতি মাহমুদ খান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এ সংগঠটির বেশ কিছু কর্মীকে আমরা নানা অভিযোগে গ্রেপ্তার করেছি। জঙ্গিবাদসহ নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড এবং রাষ্ট্রবিরোধী তৎপরতা যারা চালাতে পারে, এমন সন্দেহভাজন সংগঠনের ওপর আমাদের নজরদারি আছে। তথ্য-প্রমাণ পাওয়া গেলেই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’</div> <div> সংগঠনটি কালো তালিকাভুক্ত, আছে নজরদারিতে : জানা গেছে, গত বছরের ১৩ এপ্রিল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে জঙ্গিসংক্রান্ত এক বৈঠকে হিজবুত তাওহীদ ও আনসারুল্লাহ বাংলা টিমকে নিষিদ্ধ করার আগে এদের বিষয়ে গোয়েন্দাদের আরো পর্যালোচনা করার নির্দেশ দেওয়া হয়। তবে গত এক বছরেও হিজবুত তাওহীদকে নিষিদ্ধ করার ব্যাপারে কোনো ইতিবাচক পদক্ষেপ নেয়নি সংশ্লিষ্ট বিভাগ। সূত্র জানায়, নিষিদ্ধ হওয়ার ঝুঁকিতে পড়ে গোয়েন্দা, গণমাধ্যমসহ কয়েকটি পর্যায়ে নিজেদের সংগঠনের ব্যাপক প্রচারণা শুরু করেছে হিজবুত তাওহীদ। গত বছরের ২৩ নভেম্বর হিজবুত তাওহীদকে কালো তালিকাভুক্ত করে চিঠি জারি করে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। চিঠির বিষয়বস্তুতে বলা হয়েছে, কালো তালিকাভুক্ত সংগঠন ‘হিজবুত তাওহীদ’-এর প্রচারণার নতুন কৌশলের বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ।</div> <div> কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সতর্কতা : সূত্র জানায়, গত ২২ জানুয়ারি জঙ্গি সম্পৃক্ততার অভিযোগে অভিযুক্ত ‘হিজবুত তাওহীদ’ বা এর কোনো অঙ্গপ্রতিষ্ঠানের অনুষ্ঠানে যোগ না দিতে ব্যাংকগুলোর ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের সতর্ক করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের চিঠির আলোকে ওই নির্দেশনা দেওয়া হয়।</div> <div> জঙ্গিবাদ নির্মূলে বই! : জঙ্গিবাদের সন্দেহে অভিযুক্ত এবং কালো তালিকাভুক্ত সংগঠন হিজবুত তাওহীদ এক বছর ধরে বিভিন্ন স্থানে প্রকাশ্যে কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে। তাদের কর্মীর মাধ্যমে ‘দৈনিক দেশেরপত্র’ নামের একটি পত্রিকার মাধ্যমে এ দেশে খিলাফত রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রচারণা চালাচ্ছে এবং স্কুল-কলেজে পড়া ছাত্রদের হিজবুত তাওহীদে যোগ দেওয়ার আহ্বান জানানো হচ্ছে। রাজধানীতে জাতীয় প্রেসক্লাব ও ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতেও সভা-সেমিনার করছে তারা। আজ বৃহস্পতিবার বিকেল ৩টায় জাতীয় প্রেসক্লাবে ‘জঙ্গীবাদ’ নামের একটি বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করা হচ্ছে। সংগঠনের পক্ষে মশিউর রহমান সবুজ নামের একজন প্রেসক্লাবে বুকিং দেন। তাঁর সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি নিজেকে সংগঠনের মুজাহিদ এবং পত্রিকার বিশেষ প্রতিনিধি পরিচয় দেন। সবুজ বলেন, ‘জঙ্গীবাদ উত্তরণের একমাত্র পথ’ শিরোনামে ‘জঙ্গীবাদ’ নামের একটি বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করা হবে। পশ্চিমা ষড়যন্ত্র এবং জঙ্গিবাদের উত্থানের বিষয়ে এই বই লেখা। সংগঠনের কর্মকাণ্ডের ব্যাপারে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘এর আগেও আমরা প্রেসক্লাবে দুটি অনুষ্ঠান করেছি। ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে করেছি। আমরা ৪৫ হাজার ডকুমেন্টারি প্রদর্শন করেছি। ঢাকাসহ সারা দেশে আমাদের কার্যক্রম চলছে।’ সংগঠনটির কালো তালিকাভুক্তি এবং অভিযোগের ব্যাপারে প্রশ্ন করা হলে তিনি ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলেন, ‘১৯ বছর ধরে আপনারা আমাদের বিরুদ্ধে অপপ্রচার আর ষড়যন্ত্র চালাচ্ছেন। এসব ষড়যন্ত্র, আর কিছুই না। আপনার কাছে প্রমাণ থাকলে নিয়ে আসেন।’ একপর্যায়ে মোবাইল ফোনের নম্বর দিয়ে শীর্ষস্থানীয় নেতাদের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন সবুজ। পরে আবার বলেন, ‘কিছু বলার থাকলে আমাদের অনুষ্ঠানে আসেন।’</div> <div> জানা গেছে, দৈনিক বজ্রশক্তির উপদেষ্টা ও দৈনিক দেশেরপত্রের সাবেক সম্পাদক রুফায়দাহ পন্নীর হাত ধরেই যাত্রা শুরু করে হিজবুত তাওহীদ। এখন আমির মসীহ-উর রহমান এবং ঢাকার আমির আলী হোসেন সংগঠনকে চাঙ্গা করে তুলেছেন। ঢাকার বাইরেও  হিজবুত তাওহীদ কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে। গত ২২ ফেব্রুয়ারি ইসলামের স্পর্শকাতর বিষয় নিয়ে বিভ্রান্তিকর মন্তব্য করায় হিজবুত তাওহীদ সংগঠনের কর্মীদের সঙ্গে রংপুর মহানগরের বোতলা এলাকায় স্থানীয় মুসল্লিদের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। সম্প্রতি নোয়াখালীর সোনাইমুড়িতে হিজবুত তাওহীদের কর্মীদের সঙ্গে গ্রামবাসীর সংঘর্ষে পুলিশসহ কমপক্ষে ৩০ জন আহত হয়।  গত বছরের ১৭ অক্টোবর রাজধানীর মোহাম্মদপুর ইকবাল রোডে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে নাফিস (৩৮) নামে হিজবুত তাওহীদের এক কর্মী গুলিবিদ্ধ হন। ঝটিকা মিছিলে বাধা দিলে পুলিশকে লক্ষ্য করে ইট ও ককটেল নিক্ষেপ করে মিছিলকারীরা।</div>