<p>১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে টাঙ্গাইলের কাদেরিয়া বাহিনীর বীরত্বগাথা অনেকেরই জানা। সে সময় টাঙ্গাইলে আরেকটি বাহিনী গড়ে উঠেছিল, যার নাম ‘বাতেন বাহিনী’। সেই বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধাদের অসামান্য অবদানের কথাও মনে রাখবে টাঙ্গাইলবাসী। সরকারি সা’দত কলেজ ছাত্রসংসদের তখনকার সহসভাপতি খন্দকার আবদুল  বাতেন নিজের নামে গঠন করেছিলেন এই বাহিনী। এই বাহিনীর ছিল ২১টি কম্পানি, ৬৩টি প্লাটুন ও ১০০টি সেকশন। মোট মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ছিল আট হাজারের মতো। স্বেচ্ছাসেবক ছিলেন এক হাজার ২০০ জন। রিক্রুটিং সেন্টার ছিল টাঙ্গাইলের দেলদুয়ার উপজেলার লাউহাটী। আর ট্রেনিং সেন্টার ছিল যুদ্ধ এলাকা ও ভারতে। যুদ্ধ এলাকা ছিল টাঙ্গাইল, মানিকগঞ্জ, পাবনা ও ঢাকার কিছু অংশ।</p> <p>সেই বাহিনীর নিরাপত্তা ও বেসামরিক প্রধান ছিলেন মীর শামসুল আলম শাহজাদা। ১৭ জুলাই পর্যন্ত ক্যাশিয়ারের দায়িত্ব পালন করেন এ কে এম আজাদ শাহজাহান। ১৮ জুলাই থেকে অস্ত্র বিভাগের প্রধান ছিলেন তিনি। তথ্য ও গোয়েন্দা প্রধান ছিলেন উপেন্দ্র নাথ সরকার। দেলোয়ার হোসেন হারিজ ছিলেন উপপ্রধান (রিক্রুটিং এবং জয় বাংলা কম্পানি কমান্ডার), এম এ রশিদ ছিলেন উপপ্রধান (কোয়ার্টার মাস্টার এবং বঙ্গবন্ধু কম্পানি কমান্ডার) ও খন্দকার আবদুস ছালাম ছিলেন রিক্রুটিং ও ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে। এ ছাড়া সহকারী নিরাপত্তা ও বেসামরিক কর্মকর্তা ছিলেন ৯ জন। সহকারী রিক্রুটিং অফিসার ছিলেন দুজন। এ বাহিনীর ছিল ১১ সদস্যের মেডিক্যাল টিম ও চার সদস্যের খাদ্য বিভাগ।</p> <p>মীর শামসুল আলম শাহজাদা জানান, ১৯৭১ সালের ৩০ মার্চ সখীপুরের কাছে আছিমতলা যুদ্ধে করটিয়া সা’দত কলেজের ছাত্র জুমারত আলী শহীদ হন। যুদ্ধের পর দুই ইপিআর সদস্যের রেখে যাওয়া দুটি রাইফেল ও ১৬৫ রাউন্ড গুলি নিয়ে খন্দকার আবদুল বাতেন ফিরে এসে গঠন করেন ‘বাতেন বাহিনী’। এরপর দেলদুয়ারের পাহাড়পুর গ্রামের একটি পুকুর থেকে আটটি রাইফেলসহ আশপাশ থেকে আরো কিছু অস্ত্র সংগ্রহ করা হয়। ২ এপ্রিল মীর শামসুল আলম শাহজাদার নেতৃত্বে নাগরপুরের কোনড়া গ্রামে গড়ে ওঠে ১০ সদস্যের একটি প্রতিরোধ কমিটি। পরে তারা বাতেন বাহিনীতে যোগ দিয়ে যুদ্ধ শুরু করে। এভাবে বিভিন্ন এলাকা থেকে দেশপ্রেমিক অনেক তরুণ যোগ দেন এ বাহিনীতে। মুক্তিযোদ্ধা সিদ্দিকী বিএসসি ২০ মে একটি এলএমজি, কয়েকটি রাইফেল ও বেশ কিছু গুলি-বিস্ফোরক নিয়ে বাতেন বাহিনীতে যোগ দেন। এই বাহিনীর প্রথম সফল অভিযান হয় ১০ জুন। এর পর থেকে বহু যুদ্ধে অংশ নেয় বাতেন বাহিনী। খন্দকার আবদুল বাতেনের নেতৃত্বে অভিযান চালিয়ে মানিকগঞ্জের সিংগাইর থানা দখলে নেওয়া হয়। ১৭ জুন দৌলতপুর থানা আক্রমণ করে দখল করা হয়। এ যুদ্ধেও খন্দকার বাতেন নেতৃত্ব দেন। মীর শামসুল আলম শাহজাদা বলেন, সাটুরিয়া থানা আক্রমণ ছিল উল্লেখ করার মতো। সেদিন ছিল ২৭ জুন। বাতেন বাহিনীর কাছে ওসিসহ থানার সবাইকে আত্মসমর্পণ করার জন্য খবর পাঠানো হয়। ওসি আত্মসমর্পণের কথা স্বীকার করেও মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর গুলিবর্ষণ করেন। পরে মুক্তিযোদ্ধারা পুকুর সাঁতরে থানা ঘেরাও করেন। মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণে পর্যুদস্ত হয়ে থানার ওসি মরতুজ আলী মুরগির এক খাঁচায় লুকিয়ে থাকেন। সেখান থেকে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তার করা হয় আরো আট পুলিশ সদস্যকে। সেই যুদ্ধে কেউ হতাহত হয়নি।</p> <p>আরো অস্ত্র প্রয়োজন হওয়ায় খন্দকার আবদুল বাতেন ১৮ জুলাই রাতে ভারত যান। ওই দিনই তিনি বাতেন বাহিনীর অস্থায়ী হাইকমান্ডের দায়িত্ব দেন এ কে এম আজাদ শাহজাহানকে এবং নিরাপত্তাপ্রধানের দায়িত্ব দেন মীর শামসুল আলম শাহজাদাকে। আরো কয়েকজনকে বিভিন্ন দায়িত্ব দেওয়া হয়। বাতেন ভারত রওনা হওয়ার সময় তাঁর বাহিনীতে ১৭টি সিভিল গান, একটি চায়নিজ এলএমজিসহ মোট অস্ত্র ছিল ৪৫টি।</p> <p>ভারতে খন্দকার বাতেন বন্দি হয়েছেন বলে খবর ছড়িয়ে পড়ে। এতে তাঁর বাহিনীর সদস্যদের মনোবল কিছুটা ভেঙে পড়ে। কিন্তু অস্থায়ী হাইকমান্ড এ কে এম আজাদ ও বেসামরিক প্রধান মীর শামসুল আলম শাহজাদার নেতৃত্বে তাঁরা আবার চাঙ্গা হয়ে ওঠেন। ২৫ জুলাই তাঁরা শিবালয় থানা দখল করে বেশ কিছু অস্ত্র দখলে আনেন। পরের দিন ঘিওর থানা আক্রমণ করা হয়। এটিও তাঁরা দখল করে বেশ কিছু অস্ত্র ও গুলি উদ্ধার করেন। ১১ আগস্ট দ্বিতীয়বারের মতো আক্রমণ করা হয় দৌলতপুর থানা। এ যুদ্ধে থানা দখল করার সঙ্গে সঙ্গে কয়েকজন পাকিস্তানি সেনাকে বন্দি করা হয়। ২৫ জন পুলিশ সদস্য অস্ত্রসহ আত্মসমর্পণ করেন। এরপর দেলদুয়ারের লাউহাটী যুদ্ধ, সিরাজগঞ্জের চৌহালী থানা আক্রমণ, মানিকগঞ্জের যাবরা এলাকায় পাকিস্তানিদের একটি টহল গানবোট ডুবিয়ে দেওয়া, নাগরপুর থানা দখলসহ আরো বেশ কয়েকটি যুদ্ধে অংশ নেয় বাতেন বাহিনী। ১২ ডিসেম্বর মুক্তিযোদ্ধা আরজন খাঁর নেতৃত্বে দল্যা নামক স্থানে হানাদার বাহিনীর নৌকা ডুবিয়ে দিলে ৩১ জন সেনা নিহত হয়। পরের দিন পাকিস্তানি বাহিনী পালিয়ে যাওয়ার সময় নাগরপুরের কোনড়া এলাকায় বাতেন বাহিনীর সঙ্গে খণ্ড খণ্ড যুদ্ধ হয়। এদিন মুক্তিযোদ্ধা কফিল উদ্দিন পেটে গুলিবিদ্ধ হন, আবদুর রউফ ও নিজাম উদ্দিন শহীদ হন।</p> <p>বাতেন বাহিনীর সহকারী নিরাপত্তা ও বেসামরিক কর্মকর্তা ছিলেন কলেজ ছাত্র মুলতান উদ্দিন। তিনি বলেন, ডিসেম্বর মাসের ১৩ কিংবা ১৪ তারিখের দিকে পাকিস্তানি বাহিনী সিরাজগঞ্জ থেকে ধলেশ্বরী নদীর পাড় দিয়ে ঢাকার দিকে যাচ্ছিল। নাগরপুরের মোকনা ইউনিয়নের লাডু গ্রামে তাদের সঙ্গে যুদ্ধ হয় বাতেন বাহিনীর। সেখানে সাতজন সেনাকে আটক করা হয়। কয়েকজন আহত হয়, বাকিরা পালিয়ে যায়।</p> <p>যুদ্ধ শেষে ১৯৭২ সালের ২২ জানুয়ারি ভারত থেকে ঢাকায় আসেন খন্দকার আবদুল বাতেন। ২৫ জানুয়ারি নাগরপুর ডাকবাংলোর সামনে এবং ৭ ও ৯ মার্চ দেলদুয়ারের লাউহাটী স্কুল মাঠে বাতেন বাহিনীর অস্ত্র জমা দেওয়া হয়। ৪ ফেব্রুয়ারি সাটুরিয়া হাই স্কুল মাঠে খন্দকার আবদুল বাতেনকে দেওয়া হয় সংবর্ধনা।</p> <p>ঢাকায় অবস্থানরত খন্দকার আবদুল বাতেনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি মোবাইল ফোনে এ বিষয়ে কথা বলতে অস্বীকৃতি জানান।</p>