<p>জন্ম নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার থানার দয়াকান্দা গ্রামে। তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছেন সেখানেই। এরপর চলে আসেন ঢাকায়। উত্তর যাত্রাবাড়ীতেই কেটেছে তাঁর শৈশব-কৈশোর ও যৌবন। ছোটবেলাতেই নাচে আগ্রহী হন। ক্লাস ফোরে পড়ার সময় বিটিভির অনুষ্ঠান ‘নৃত্যের তালে তালে’র প্রেমে পড়ে যান। নৃত্য পরিচালক আমির হোসেন বাবু ও নায়িকা অঞ্জনা নাচতেন সেখানে। প্রতি শুক্রবার রাত ৯টায় প্রচারিত হতো। এই শো কোনোভাবেই মিস করতেন না আজিজ। ইচ্ছে হলো নাচ শিখবেন। কিন্তু কোথায় শিখবেন, জানেন না। একদিন বন্ধু আফসার বলল, ‘চল তোকে এক জায়গায় নিয়ে যাই।’ নিয়ে গেল গওহর জামিলের বাসায়। তাঁর একাডেমিতে ভর্তি হতে তখন তিন টাকা লাগত। এই টাকাটাও ছিল না আজিজের কাছে। আফসার নিজের পকেট থেকে টাকাটা দিল। ‘তিন টাকার বিনিময়ে এখন তিন কোটি টাকা দিলেও সেই ঋণ শোধ হবে না। সেদিন যদি আমার বন্ধু হাত না বাড়াত তাহলে আমার নাচ শেখা হতো না। আজকের আজিজ রেজাও হতে পারতাম না’, বললেন আজিজ।</p> <p>যাঁর কাছে নাচ শিখেছেন সেই গওহর জামিলের প্রতিষ্ঠান ‘জাগো আর্ট সেন্টার’-এর শিক্ষক হলেন আজিজ। মাত্র ক্লাস নাইনে পড়েন তখন। তবে সিনেমায় নিয়মিত হওয়ার পর<img alt="" src="/ckfinder/userfiles/images/print/Print- 2018/Feature/04 April/21-04-2018/1/Ronger-mela-26-04-2018-11.jpg" style="float:right; height:789px; margin:8px; width:260px" /> শিক্ষকতা ছেড়ে দিলেন। সিনেমায় সুযোগ পেলেন কিভাবে? “১৯৭৯ সালের কথা। ডিগ্রি পরীক্ষা সবে শেষ হলো। বন্ধু খলিলুর রহমান আমাকে নিয়ে গেল পপুলার স্টুডিওতে। বাংলাদেশের অন্যতম সেরা মেকআপ আর্টিস্ট খলিল। গিয়ে দেখি ‘রসিয়া বন্ধু’ ছবির শুটিং চলছে। শ্রদ্ধেয় এ টি এম শামসুজ্জামান ও সুলতানা ম্যাডাম একটা গানের শুটিং করছিলেন। সেখানেই ছিলেন নৃত্যপরিচালক আমির হোসেন বাবু। উনি আগে থেকেই আমাকে চিনতেন। বললেন, ‘তুমি যখন এসেছ আমাকে একটু হেল্প করো। সবার সামনেই নাচ দেখাতে বললেন, করলাম। সবাই খুব প্রশংসা করলেন।’ তখনই বাবু ভাই প্রস্তাব দিলেন তাঁর সহকারী হওয়ার। ডিগ্রির রেজাল্ট বের হতে তিন মাস বাকি। ভাবলাম, তিন মাস না হয় তাঁর সঙ্গে কাজ করি। সেই তিন মাস আর শেষ হয়নি, এখনো কাজ করে যাচ্ছি। বাবু ভাইয়ের সঙ্গে ছিলাম টানা আট বছর”, বললেন আজিজ। </p> <p>গওহর জামিলের কাছে হাতেখড়ি হলেও পরবর্তী সময়ে ভরতনাট্যম শিখেছেন বেলায়েত হোসেন ঝন্টুর কাছে। শান্তিনিকেতনেও শিখেছেন তিন বছর—ভরতনাট্যম ও কত্থক। তবে মাস্টার্স পরীক্ষার কারণে শান্তিনিকেতনের কোর্স কমপ্লিট করতে পারেননি। আর সিনেমায় শিখেছেন আমির হোসেন বাবুর কাছে। জাভেদের কাছ থেকে অনেক টেকনিক শিখেছেন।</p> <p>সহকারী থেকে পূর্ণাঙ্গ নৃত্য পরিচালক হওয়ার গল্পটাও বললেন, “বাবু ভাইয়ের সঙ্গে কাজ করার সময় শাবানা, রোজিনা, সুচরিতা, নূতন, অঞ্জনা ম্যাডামসহ সিনিয়র সবার সঙ্গেই কাজ করেছি। ওনারা দেখতেন আমি ভালো করছি। তাঁরাই বলতেন, তুমি সলো ডিরেকশন দাও। ওস্তাদকে ছেড়ে যাওয়ার ইচ্ছে আমার কখনোই ছিল না। পরিচালক শফি বিক্রমপুরী ভাই ‘তুফান মেইল’ ছবির নৃত্য পরিচালক হওয়ার প্রস্তাব দিলেন। বললাম, ভাই আমি তো একা পারব না। আপনি যদি ওস্তাদকে বলে রাজি করাতে পারেন, তাহলে করব। উনি বাবু ভাইয়ের কাছে গেলেন। ওস্তাদ আমাকে বললেন, তুমি যদি পারো করো। কোনো সমস্যা হলে আমি তো আছি। তারপর থেকেই একচেটিয়া কাজ করা শুরু করলাম।”</p> <p>এ পর্যন্ত বিভিন্ন সিনেমার এক হাজার ৯৬ গানে কোরিওগ্রাফি করেছেন। পশ্চিমবঙ্গের ছবিতেও করেছেন ৪২টা গান। চিরঞ্জিত, প্রসেনজিৎ, ইন্দানী হালদার, ঋতুপর্ণা সেনগুপ্তদের সঙ্গে কাজ করেছেন। সেখানে প্রথম ছবি ‘মান সম্মান’-এর পুরস্কারের জন্য মনোনয়ন পেয়েছিলেন।</p> <p>স্বীকৃতি পেয়েছেনও। তাঁর বাসার ড্রয়িংরুমের শোকেসে ১৬৪টা ট্রফি। এর মধ্যে আছে ‘নাচে নাগিন’ ছবির জন্য পাওয়া জাতীয় পুরস্কারও।</p> <p>গত ৩০ বছরে ঢালিউডে যত নায়ক-নায়িকা এসেছেন তাঁদের বেশির ভাগই নৃত্যের তালিম নিয়েছেন আজিজ রেজার কাছে।</p> <p>চলচ্চিত্রে এখনো নিয়মিত কাজ করেন। উত্তরা কামারপাড়া চৌরাস্তায় তাঁর নাচের স্কুল। ৮০ জন ছেলেমেয়েকে সেখানে নাচ শেখান। টুকটাক অভিনয়ও করেন। প্রায় ৬০টি টিভি নাটক করেছেন। ‘আমি এডিটিং করি, ক্যামেরা চালাই। আমার বাসার ছাদে আড়াই শ গাছ আছে টবে। অবসরে গাছগুলোর পরিচর্যা করি। টুকটাক গানও করি। ইউটিউবে আমার চ্যানেলে ঢুকলে দেখতে পাবেন গানগুলো’, বললেন আজিজ।</p> <p>নিজের কোরিওগ্রাফ করা সেরা দশ গানের কথা জানতে চাইলে বলেন, “কোনটা সেরা সেটা আমি বলতে পারব না। এই মুহূর্তে মনে পড়ছে এমন কয়েকটা গানের কথা বলতে পারি মাত্র—‘তুমি আমার চাঁদ আমি চাঁদেরই আলো’, ‘পাথরের পৃথিবীতে কাঁচের হৃদয়’, ‘চিঠি লিখলাম ও লিখলাম তোমারে’... আর তো মনে পড়ছে না।”</p> <p>আজিজের দুই ছেলে, দুজনই আছেন আমেরিকায়।</p> <p>এই সময়ের নায়ক-নায়িকাদের মধ্যে আজিজ রেজার পছন্দ সাইমন ও তানহা মৌমাছি।</p> <p> </p> <p>সহকর্মীদের চোখে</p> <p>তিনি আমার গুরু</p> <p>শাবনূর অভিনেত্রী</p> <p>এককথায় বললে তিনি আমার গুরু। একসঙ্গে অনেক কাজ করেছি। আমাকে অসম্ভব ভালোবাসেন। আমিও তাঁকে ভালোবাসি, শ্রদ্ধা করি। আমির হোসেন বাবু ভাই ও তাঁর সঙ্গে কাজ করে কখনো কোনো সমস্যায় পড়তে হয়নি। বাবু ভাই তো তাঁরও গুরু। আমার প্রথম ছবি ‘চাঁদনী রাতে’র নৃত্য পরিচালক তিনি। আমার পেছনে অনেক শ্রম দিয়েছেন। এহতেশাম দাদুর কাকরাইলে অনেক বড় অফিস ছিল। সেখানে আমি আর আমার হিরো সাব্বির প্র্যাকটিস করতাম। দাদু আজিজ ভাইকে বলতেন, ‘এই দুইটাকে নাচের সব শিখিয়ে দেবে। কোনো কিছু যেন বাদ না থাকে।’ তারপর যখন শুটিংয়ে গেলাম, আমার প্রথম শট একবারেই ওকে হয়ে গেল। কারণ আমি আগেই আজিজ ভাইয়ের কাছে প্র্যাকটিস করেছি। সারাজীবন শেখাটা কাজে দিয়েছে। ইন্ডাস্ট্রিতে নতুন কেউ এলে উনি অসম্ভব সহযোগিতা করেন। আজকের অবস্থানে আসার জন্য উনি শাকিব খানকেও অনেক হেল্প করেছেন। মানুষ হিসেবেও অনেক ভালো, খুব শৌখিন মানুষ।</p> <p> </p> <p>ওর কাজের গতি অতুলনীয়</p> <p>এফ আই মানিক পরিচালক</p> <p>আমি যখন এ জে মিন্টুর সঙ্গে সহকারী হিসেবে কাজ করি তখন আমাদের একটা সিনেমার দেশের গানের জন্য ও আসে। সিনেমাটির কোরিওগ্রাফার ছিলেন আমির হোসেন বাবু। তখন একটা গ্রুপ ড্যান্সে ছিল আজিজ রেজা। বাফা থেকে কতগুলো ছেলেমেয়ে আনা হয়েছিল। ও তখন সেই গানটায় কাজ করল। এরপর তো অনেক কাজ করেছে। আমার সঙ্গেও বেশ কিছু কাজ করেছে। ওর একটা বড় গুণ, কাজটা খুব সহজে করতে পারে। কাজের গতি অতুলনীয়। কাজের প্রতি খুবই সিনসিয়ার। ক্যারিয়ারে অনেক ভালো ভালো কাজ করেছে।</p> <p> </p> <p>নতুন কিছু দিতে পারে</p> <p>সোহানুর রহমান সোহান পরিচালক</p> <p>ভালো কাজের জন্য মনোযোগ দরকার, সেই ব্যাপারটা ওর মধ্যে খুব আছে। সেটাই হয়তো আজকে ওর এই অবস্থানটা তৈরি করে দিয়েছে। ওর একটা গুণ হচ্ছে যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নতুন কিছু দিতে পারা, ক্রিয়েটিভ কাজে যা খুব দরকার।</p> <p><img alt="" src="/ckfinder/userfiles/images/print/Print- 2018/Feature/04 April/21-04-2018/1/Ronger-mela-26-04-2018-12.jpg" style="height:275px; width:253px" /></p> <p>আজিজ রেজার আক্ষেপ</p> <p>একটাই আক্ষেপ, ঠিক আক্ষেপও নয়—কষ্ট। শাকিব খান আমার স্নেহের ছোট ভাই, অনেক আদরের ভাই। তাকে হিরো বানানোর জন্য অনেক কষ্ট করেছি। বলতে গেলে লালন-পালন করেছি। আজকে সে সুনামের সঙ্গে দেশ-বিদেশে কাজ করছে—এটা আমার অনেক বড় গর্বের জায়গা। সে স্বীকার করুক আর না করুক, তাতে আমার কিছু আসে যায় না। এফ আই মানিক ভাই, সোহান ভাইদের যে কত বলে-কয়ে শাকিবকে কাস্ট করিয়েছি, তা আমি যেমন জানি তাঁরাও জানেন। এ নিয়ে তাঁদের সঙ্গে আমার মনোমালিন্যও হয়েছে। আমার কাজ হাতছাড়া হয়েছে। আমার স্বপ্ন ছিল একদিন শাকিব সুপারস্টার হবে—আমরা দুই ভাই দেশ-বিদেশ ঘুরব, একসঙ্গে কাজ করব। কিন্তু ও যখন তারকা হয়ে উঠল, আমাকে ধীরে ধীরে জীবন থেকে সরিয়ে দিয়েছে। আমি যে প্রডিউসার-ডিরেক্টরের সঙ্গে কাজ করতাম তাঁদের সঙ্গে যখন শাকিব কাজ শুরু করল, সব ছবি থেকে বাদ পড়লাম। পরে আমিও দূরে সরে গেলাম। ইদানীং ও আবার নতুন করে বলছে, ‘ভাইয়ের কাছে নাচ শিখেছি।’ ওর জন্য অনেকের বকা শুনতে হয়েছে। শাকিব তখন বলত, ‘আমরা রক্তের ভাই না তো কী হইছে। একদিন এই দুই ভাইয়ের সম্পর্ক আদর্শ ভাইয়ের উদাহরণ হবে।’</p>