২১. (মূসা আ. বলল), হে আমার সম্প্রদায়, পবিত্র ভূমিতে প্রবেশ করো, যা আল্লাহ তোমাদের জন্য নির্ধারিত করে দিয়েছেন। আর পেছন দিকে প্রত্যাবর্তন করো না। অন্যথায় তোমরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়বে।
২২. তারা বলল, 'হে মূসা! সেখানে একটি প্রবল পরাক্রম জাতি রয়েছে।
২১. (মূসা আ. বলল), হে আমার সম্প্রদায়, পবিত্র ভূমিতে প্রবেশ করো, যা আল্লাহ তোমাদের জন্য নির্ধারিত করে দিয়েছেন। আর পেছন দিকে প্রত্যাবর্তন করো না। অন্যথায় তোমরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়বে।
২২. তারা বলল, 'হে মূসা! সেখানে একটি প্রবল পরাক্রম জাতি রয়েছে।
২৩. খোদাভীরুদের মধ্য থেকে দুই ব্যক্তি বলল, যাদের প্রতি আল্লাহ অনুগ্রহ করেছিলেন, তোমরা তাদের ওপর আক্রমণ করে দরজায় প্রবেশ করো। অতঃপর তোমরা যখন তাতে প্রবেশ করবে, তখন তোমরাই বিজয়ী হবে।
তাফসির : আগের আয়াতে বলা হয়েছিল, বনি ইসরাঈল ও ইহুদি জাতি আল্লাহর সর্বাধিক নেয়ামতপ্রাপ্ত হয়েছিল। আলোচ্য আয়াতগুলোতে আল্লাহ তায়ালা একটি বিশেষ ঘটনার অবতারণা করে দেখিয়ে দিচ্ছেন, কিভাবে তারা সর্বাধিক নেয়ামত পেয়ে সর্বাধিক অবাধ্য ও অকৃতজ্ঞ জাতিতে পরিণত হয়েছিল।
ইহুদিদের প্রতি পবিত্র ভূমিতে প্রবেশের আদেশ
আলোচ্য প্রথম আয়াতে বলা হয়েছে, মূসা (আ.) ইহুদিদের পবিত্র ভূমিতে প্রবেশের আদেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু ইহুদিরা সেখানে যেতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিল। এখানে পবিত্র ভূমি বলতে কোন ভূমিকে বোঝানো হয়েছে, এ প্রশ্নে কোরআন ব্যাখ্যাদাতাদের মতামত বাহ্যত ভিন্ন ভিন্ন। কারো কারো মতে, বায়তুল মুকাদ্দাস, কারো মতে কুদস শহর ও ইলিয়া। কেউ কেউ বলেন, আরিহা শহর, যা জর্দান নদী ও বায়তুল মুকাদ্দাসের মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থিত।
(তাফসিরে মা'আরেফুল কোরআন ও ইবনে কাছির অবলম্বনে)
দেশে এক ধরনের গুমট অবস্থা বিরাজ করছে। নবগঠিত জাতীয় নাগরিক কমিটির (এনসিপি) শীর্ষস্থানীয় নেতা হাসনাত আবদুল্লাহর ফেসবুকের একটি স্ট্যাটাসকে কেন্দ্র করে দেশে নতুন এক সংকটময় পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। এরই মধ্যে এনসিপির অন্যান্য শীর্ষ নেতাদের কেউ কেউ হাসনাতের ওই বক্তব্যের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেছেন। শুধু হাসনাত নন, আরো অনেকেই সেনাবাহিনীকে নিয়ে অনাকাঙ্ক্ষিত মন্তব্য করছেন।
আমরা জানি, একটি দেশের নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্বের প্রতীক হলো সেনাবাহিনী। দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনী কোনোভাবে বিতর্কিত হওয়ার মানে হলো দেশের সার্বভৌমত্ব হুমকির মুখে পড়া। দেশের সংকটময় পরিস্থিতিতে কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে কিংবা কোনো রাজনৈতিক নেতার সঙ্গে সেনাবাহিনীর বিভিন্ন আলোচনা হতে পারে। এসব আলোচনার মূল লক্ষ্য হলো সংকট উত্তরণের জন্য একটি সুন্দর পথ খুঁজে বের করা।
অনেকেই বুঝে না বুঝে সেনাবাহিনী সম্পর্কে উসকানিমূলক বক্তব্য দিচ্ছেন। অনেকে বলছেন, রাজনীতির বিষয়টি রাজনীতিবিদদেরই থাকা উচিত, সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপ করা উচিত নয়। তাঁর বক্তব্য যদি আমরা মেনে নিই, তাহলে প্রশ্ন উঠা স্বাভাবিক যে গত ৫ আগস্ট সব রাজনৈতিক দল এবং ছাত্র-জনতা কেন সেনাবাহিনীর দিকে তাকিয়ে ছিল? ছাত্র প্রতিনিধি এবং গণ-অভ্যুত্থানে নেতৃত্বদানকারী অনেকেই সেনা সদরে গিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বৈঠক করেছিলেন। এমনকি সেনাপ্রধানের মধ্যস্থতায় সেদিন অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়েছে।
আমরা চাই দেশে একটি স্থিতিশীল পরিবেশে তৈরি হোক।
সেনাবাহিনীর প্রতি আক্রমণাত্মক কথা না বলার আহ্বান জানিয়ে সেনাপ্রধান গত ২৫ ফেব্রুয়ারি বলেছিলেন, ‘একটা কমন জিনিস আমি দেখতে পাচ্ছি, সেনাবাহিনী এবং সেনাপ্রধানের প্রতি বিদ্বেষ কারো কারো। কিন্তু কী কারণে, আজ পর্যন্ত আমি এটা খুঁজে পাইনি।’ সেনাপ্রধান আরো বলেন, ‘আমরা হচ্ছি একমাত্র ফোর্স, যেটা আপনাদের জন্য কাজ করে যাচ্ছি, দাঁড়িয়ে আছি প্ল্যাটফর্মে। অবকোর্স নেভি অ্যান্ড এয়ারফোর্স। নেভি, এয়ারফোর্স উই অল।’
সেনাপ্রধান শেখ হাসিনার আত্মীয়—এই পরিচয়েও জেনারেল ওয়াকারকে বিতর্কিত করার অপচেষ্টা করা হয়। কিন্তু তিনি কারো সঙ্গে আত্মীয়ের পরিচয়ের বাইরেও একজন দেশপ্রেমিক দায়িত্বশীল নাগরিক হিসেবে নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ছাত্র-জনতার পক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন—সেটি পরিষ্কারভাবে অনুমান করা যায়। সেনাবাহিনীর ১৩ লং কোর্সে সেনাপ্রধানের কোর্সমেট ছিলেন মেজর জাবের (অব.)। তিনি একটি জাতীয় দৈনিকের সাংবাদিককে বলেছিলেন, ‘জেনারেল ওয়াকার ছাত্র-জনতার ওপর গুলি করার আদেশ মেনে নিতে পারেননি। তাঁকে আমরা যেভাবে জানি, এ ধরনের হত্যাকাণ্ডে সমর্থন দেওয়া তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়। আমাদের জানা মতে, ১৭ জুলাইয়ের পর থেকেই এ আদেশ নিয়ে তিনি চাপের মুখে ছিলেন এবং এ কারণেই তিনি ছাত্র-জনতার ওপর গুলি না চালাতে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেন।’
আমরা জানি, অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে শিল্প-কারখানাগুলোর নিরাপত্তার বিষয়ে ভরসার স্থল হয়ে দাঁড়ান সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান। গত ৮ আগস্ট ঢাকায় সেনা সদরে তাঁর সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন বিশিষ্ট ব্যবসায়ীরা। এ সময় তাঁরা শিল্প ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সহযোগিতা চান। জবাবে দেশের সব নাগরিকের পাশাপাশি ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে রাষ্ট্রের অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করবেন বলে ব্যবসায়ী নেতাদের আশ্বস্ত করেন সেনাপ্রধান। অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে দেশে হঠাৎ সৃষ্ট বন্যা পরিস্থিতি মোকাবেলা, পুলিশ সদস্যদের ‘ভগ্ন মনোবল’ ফেরানোর চেষ্টা, অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার অভিযান পরিচালনা, মাদকবিরোধী অভিযা—এসব কাজেও সেনাবাহিনীর নিরলস চেষ্টা অব্যাহত।
গত ১৭ ফেব্রুয়ারি ঢাকা সেনানিবাসে আয়োজিত সংবাদ ব্রিফিংয়ে আগের ৫০ দিনে সেনাবাহিনীর কার্যক্রমের পরিসংখ্যান তুলে ধরেন সেনা সদর মিলিটারি অপারেশনস ডাইরেক্টরেটের কর্নেল স্টাফ কর্নেল মো. শফিকুল ইসলাম। তিনি জানান, ওই সময়ের মধ্যে দেশের বিভিন্ন শিল্পাঞ্চলে ৮৮টি অস্থিতিশীল পরিস্থিতি এবং এ ধরনের পরিস্থিতি থেকে উদ্ভূত ৩০ বার মূল সড়ক অবরোধ নিয়ন্ত্রণে সেনাবাহিনী সক্রিয় ভূমিকা রেখেছে। এ ছাড়া গত এক মাসে ৪২টি বিভিন্ন ধরনের বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করেছে, যার মধ্যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সরকারি অফিস, রাজনৈতিক কোন্দল এবং অন্য বিভিন্ন ধরনের ঘটনাও ছিল।
দেশের পরিস্থিতি স্বাভাবিক ও স্থিতিশীল রাখার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলের নেতাদেরও ভূমিকা রয়েছে। বক্তব্য প্রদানে তাঁদের আরো দায়িত্বশীল হওয়া উচিত। সেনাপ্রধান কিংবা সেনাবাহিনীর কোনো সদস্যকে শুধু ব্যক্তি বিবেচনা না করে প্রতিষ্ঠানের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিবেচনা করা উচিত। আমরা জানি দেশে বিভিন্নভাবে নানা ধরনের ষড়যন্ত্র বিদ্যমান রয়েছে। এসব ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করতে আমাদের সবাইকে সচেষ্ট থাকতে হবে। দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে দেশবাসী মোটেও সন্তুষ্ট নয়। আর এসব অসন্তুষ্টি কাটিয়ে উঠতে না পারলে দেশে ভয়াবহ সংকট তৈরি হতে পারে। অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি করে সেনাবাহিনীকে সাধারণ মানুষের মুখোমুখি দাঁড় করানোর কোনো অপচেষ্টা কোনোভাবেই কাম্য নয়। দেশে এমন কোনো পরিস্থিতি আমরা চাই না, যার মাধ্যমে সংকট দীর্ঘস্থায়ী হয়। কোনোভাবেই দেশের সেনাবাহিনীর দুর্বলতা সামনে আসা সমীচীন হবে না। দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব নিয়ে প্রশ্ন ওঠে এমন বক্তব্য-বিবৃতি এবং কার্যক্রম বিষয়ে সবাইকে সতর্ক থাকা উচিত।
লেখক : অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
সুস্থ-সচেতন মানুষ কখনোই স্বাধীনতা বিসর্জন দিয়ে বেঁচে থাকতে চাইতে পারে না। কিন্তু স্বাধীনতা এমনই এক বিষয়, যা চাইলেই পাওয়া যায় না। অনেক ক্ষেত্রে স্বাধীনতার জন্য জীবন বিসর্জন দিতে হয়। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মানুষ এক সাগর রক্তের বিনিময়ে স্বাধীনতার সূর্য ছিনিয়ে এনেছিল।
১৯৭১ সালে দেশমাতৃকার যে স্বাধীনতার জন্য আমরা সর্বাত্মক যুদ্ধে অবতীর্ণ হই তার পটভূমি রচিত হয়েছিল অনেক আগেই। ১৭৫৭ সালে ইংরেজরা বাংলাদেশের স্বাধীনতা সূর্য ছিনিয়ে নিলে বাংলাদেশের মানুষ কিন্তু তা নীরবে সহ্য করেনি। বরং তারা নানাভাবে ইংরেজ শাসনযন্ত্রকে ব্যতিব্যস্ত করে রাখে।
পরবর্তী সময়ে ১৯৪০ সালে ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাবে বাংলাকে আলাদা স্বাধীন দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার বিধান রাখা হয়েছিল। মূল লাহোর প্রস্তাবে বলা হয়েছিল, সন্নিহিত এলাকায় অবস্থিত মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল নিয়ে এক বা একাধিক স্বাধীন রাষ্ট্র গঠিত হবে। পরে পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ টাইপিং মিসটেক হিসেবে উল্লেখ করে একাধিক মুসলিম রাষ্ট্র গঠনের বিধানটি বাতিল করেন। অখণ্ড ভারতে যাঁরা বাঙালি নেতা ছিলেন তাঁরা ঠিকই অনুধাবন করতে পেরেছিলেন দেড় হাজার মাইলের ব্যবধানে দুটি অঞ্চল, যাদের সংস্কৃতি ও কৃষ্টি সম্পূর্ণ ভিন্ন, তারা শুধু ধর্মীয় পরিচয়ে একক জাতিসত্তা গঠন করতে পারে না। যাহোক, সেই সময় পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের মানুষের স্বাধীনতার বাসনা জলাঞ্জলি দিতে হলেও তাঁরা হৃদয়ে স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা লালন করতে থাকেন। তাই যখনই অখণ্ড পাকিস্তানের অধীনে তাদের স্বাধীনতা এবং কৃষ্টি-কালচারের ওপর আঘাত এসেছে তখনই বাংলাদেশের মানুষ তা রুখে দাঁড়িয়েছে। বুকের রক্ত দিয়ে অধিকার প্রতিষ্ঠিত করেছে। পাকিস্তান স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৪৮ সালেই প্রথম সংকট দেখা দেয় রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নে। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ঘটে বিস্ফোরণ। পাকিস্তানের মোট জনসংখ্যার ৫৬ শতাংশ বাংলাভাষী হলেও উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। বাংলাদেশের মানুষ বুকের রক্ত দিয়ে পাকিস্তানিদের চক্রান্ত রুখে দেয়। সেই সময়ই বাংলাদেশের মানুষ বুঝে নেয় পাকিস্তানের সঙ্গে একত্র থাকা সম্ভব নয়। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি শাসকচক্রের হঠকারিতার জন্যই বাংলাদেশের মানুষ অস্ত্র হাতে তুলে নিতে বাধ্য হয়েছিল। জাতীয় নির্বাচনে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনকারী দলের কাছে যদি শাস্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হতো, তাহলে পাকিস্তানের ইতিহাস অন্যভাবে লেখা হতে পারত।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতের বেলা পাকিস্তানি বাহিনী নিরস্ত্র বাঙালির ওপর নির্মম হত্যাকাণ্ড শুরু করলে বাংলাদেশের মানুষ হতবিহ্বল হয়ে পড়ে। এ অবস্থায় ২৬ ও ২৭ মার্চ কালুর ঘাট রেডিও স্টেশন থেকে তৎকালীন মেজর জিয়া স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। পরবর্তী সময়ে দিবসগুলোতে সেই ভাষণই কিছুটা পরিবর্তিত আকারে শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষ থেকে পুনরায় ঘোষণা করা হয়। রেডিওতে মেজর জিয়ার স্বাধীনতার ঘোষণা শুনে আমার যে কি অনুভূতি হয়েছিল তা প্রকাশ করা সম্ভব নয়। মেজর জিয়ার সেই ঐতিহাসিক ঘোষণার পর আমি স্বাধীনতাযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হই এবং মানসিকভাবে প্রস্তুতি গ্রহণ করতে থাকি। আমার সৌভাগ্য, আমি মাতৃভূমির স্বাধীনতাযুদ্ধে অংশগ্রহণের সুযোগ পেয়েছিলাম। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ আমার জীবনে সবচেয়ে স্মরণীয় ঘটনা। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি আমার মানসপট থেকে কখনো বিদূরিত হবে না। আমি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন তরুণ শিক্ষক। ১৯৭১ সালে মার্চ মাসের অগ্নিঝরা দিনগুলোতে আমি সূর্য সেন হলের একটি ফ্ল্যাটে অবস্থান করছিলাম। অসহযোগ আন্দোলন শুরু হলে মার্চ মাসের মাঝামাঝি কিছুদিনের জন্য নিজ শহর ফেনীতে চলে যাই। আমি ঢাকা আসার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে থাকি। কিন্তু আমি ঢাকা আসতে পারছিলাম না। তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ ছিল। ২৫ মার্চ মধ্যরাতে পাকিস্তানি বাহিনী অতর্কিতে নিরীহ বাঙালিদের ওপর সামরিক অভিযান শুরু করে। ঢাকায় বিপুলসংখ্যক মানুষকে হত্যা করা হয়। এপ্রিল মাসের প্রথম দিকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী জেলা ও মহকুমা শহরগুলোতে অভিযান শুরু করে। এপ্রিল মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে ফেনী শহরে সামরিক অভিযান শুরু করে। স্থল বাহিনীর অগ্রযাত্রাকে নিরাপদ করার জন্য প্রথমে বিমানবাহিনী ফেনী শহরে হামলা শুরু করে। প্রথম যেদিন ফেনীতে বিমান হামলা করা হয় সেদিন আমি পরিবারের অন্যান্য সদস্যসহ ফেনী শহরেই ছিলাম। প্রথমে বুঝতে পারিনি আসলে কী হচ্ছে। পরে আমরা বুঝতে পারি পাকিস্তানি বাহিনী একতরফা বিমান হামলা শুরু করেছে। আমরা বাসার সবাই ভয়ে খাটের নিচে আশ্রয় গ্রহণ করি। বিমান হামলা থেমে গেলে রাস্তায় বেরিয়ে দেখি মানুষ এদিক-ওদিক ছোটাছুটি করছে। পরদিন আমি পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে শহরের অদূরে গ্রামের বাড়িতে চলে যাই।
এলাকার যুবসমাজ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধ শুরু করার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিল। আমাদের এলাকায় মকবুল হোসেন মকু মিয়া নামের এক ব্যক্তি ছিলেন। তিনি পাকিস্তানি সেনাবাহিনীতে কর্মরত ছিলেন। সেই সময় তিনি গ্রামের বাড়িতে ছুটি কাটাচ্ছিলেন। আমি মকু মিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করে তাঁকে পুরো পরিস্থিতি সম্পর্কে অবহিত করি এবং মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণে আগ্রহী ছাত্র-যুবকদের প্রশিক্ষণদানের জন্য অনুরোধ জানাই। মকু মিয়া আমার অনুরোধে সাড়া দেন। আমরা গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মাঠে সভা আহ্বান করি। সেই সভার পর আনুষ্ঠানিকভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণেচ্ছুদের প্রশিক্ষণ শুরু হয়।
সেই সময় যুদ্ধের প্রকৃত অবস্থা জানার তেমন কোনো সুযোগ ছিল না। রেডিও পাকিস্তান থেকে প্রচারিত মিথ্যা সংবাদ কেউ বিশ্বাস করত না। সেই সময় যুদ্ধের প্রকৃত অবস্থা জানার একমাত্র মাধ্যম ছিল বিবিসি ও ভয়েস অব আমেরিকা। গ্রামে কয়েকটি রেডিও ছিল। শ্রোতারা জটলা পাকিয়ে বিবিসি ও ভয়েস অব আমেরিকার খবর শুনত। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের খবরও তারা মনোযোগ দিয়ে শুনত।
রেডিওতে ঘোষণা করা হয়, ১ জুন থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাভাবিক শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হবে। এ অবস্থায় আমি দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগতে থাকি। আমি কি ঢাকায় ফিরে যাব, নাকি সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতে চলে যা্ব? নাকি গ্রামেই অবস্থান করব? কিন্তু অনেকেই পরামর্শ দিলেন বিশ্ববিদ্যালয় খোলার পরও আমি যদি যোগদান না করে গ্রামে অবস্থান করি অথবা ভারতে চলে যাই, তাহলে পুরো পরিবার বিপদে পড়তে পারে। তাই শেষ পর্যন্ত ঢাকা আসার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি এবং ৩১ মে আমি ঢাকা চলে আসি।
ঢাকা আসার পর আমি ডাকযোগে জীবননাশের হুমকিসংবলিত একটি চিঠি পাই। যমদূত বাহিনীর এই চিঠি পাওয়ার পর আমি ঢাকা শহর ত্যাগ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি। কারণ ঢাকা শহর আমার জন্য তখন আর নিরাপদ ছিল না। আমি ৩১ মে সীমান্ত পাড়ি দেওয়ার মানসে রাজধানী ত্যাগ করি।
আমি সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতের পথে যাত্রা শুরু করি। এর মাধ্যমে আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ ঘটনা সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের অধ্যায় শুরু হলো।
কিছুদিন আগরতলায় অবস্থান করার পর আমি কলকাতা গমনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি। উদ্দেশ্য ছিল বৃহত্তর পরিসরে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়া। কলকাতা পৌঁছানোর পর আমরা কয়েকজন মিলে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে জনমত গঠনের কাজে নিয়োজিত হই। বিভিন্নভাবে মুক্তিযুদ্ধে অবদান রাখার চেষ্টা করি। পরবর্তী সময়ে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর নানা সংকট পেরিয়ে দেশে প্রত্যাবর্তন করি।
আমরা সদ্যঃস্বাধীন বাংলাদেশের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য অবদান রাখার অঙ্গীকার করি। আমার অঙ্গীকার ছিল মানবিক সমাজ গঠনের মাধ্যমে বাংলাদেশকে সত্যিকারার্থে একটি কল্যাণ রাষ্ট্রে পরিণত করা। কিন্তু স্বপ্নভঙ্গ হতে বিলম্ব হয়নি। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ কোনো একক দলের নেতৃত্বে সংঘটিত হয়নি। সব দল-মতের মানুষ এতে অংশ নিয়েছি। এটা ছিল মূলত জনযুদ্ধ। কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশে একটি রাজনৈতিক দল রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা কুক্ষিগত করে নেয়। অথচ সেই সময় জাতীয় সরকার গঠন করে সম্মিলিতভাবে দেশটাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়াটাই ছিল জরুরি। জাতীয় সরকার গঠিত হলে সম্মিলিতভাবে দেশের পুনর্গঠনে কাজ করা সম্ভব হতো। তখনকার ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের এক শ্রেণির নেতাকর্মী দুর্নীতি, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজির মাধ্যমে দেশে অরাজক পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) গণবাহিনী তৈরি করে। সে সময় সরকার রক্ষী বাহিনীর মাধ্যমে বিরোধী দলের ওপর সীমাহীন নির্যাতন চালায়। বিশেষ করে সরকারি দলের লোকদের নির্বিচার লুটপাটের কারণে ১৯৭৪ সালে দেশে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ সৃষ্টি হয়। অসংখ্য মানুষ খাদ্যাভাবে মারা যায়। পরে বিভিন্ন গবেষণায় প্রতীয়মান হয়েছে যে ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষের পেছনে খাদ্যের স্বল্পতা যতটা না দায়ী ছিল তার চেয়ে বেশি দায়ী ছিল খাদ্য সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছাতে না পারা। সরকারদলীয় এক শ্রেণির ব্যবসায়ী সেই সময় দেশের বাইরে খাদ্য পাচার করেছিল। সরকারি দলের এক শ্রেণির নেতাকর্মীর ব্যাপক লুটপাটের কারণে দেশে অরাজক অবস্থার সৃষ্টি হয়। শেখ মুজিবুর রহমানের জনপ্রিয়তা শূন্যের কোঠায় নেমে আসে। এমনকি এক অবস্থায় বাকশাল গঠন করে রাষ্ট্রক্ষমতা চিরদিনের জন্য কুক্ষিগত করার চেষ্টা চালানো হয়। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ঘটে মর্মান্তিক ঘটনা। সেনাবাহিনীর একটি বিক্ষুব্ধ অংশের হাতে শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নিহত হন। কিন্তু দেশে যে বিশৃঙ্খল অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল তা কোনো না কোনোভাবে এখনো বিদ্যমান রয়েছে।
পদত্যাগ করে ভারতে পালিয়ে যাওয়া বিনা ভোটে নির্বাচিত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আমলে আমরা প্রত্যক্ষ করেছি দুর্নীতির ভয়াবহ চিত্র। রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহার করে দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত অর্থ দেশের বাইরে পাচার করা হয়েছে। আগে বিদেশি শাসকরা আমাদের দেশ থেকে অর্থ-সম্পদ লুটে তাদের দেশে নিয়ে যেত। আর এখন আমাদের দেশের এক শ্রেণির মানুষ দুর্বৃত্তায়নের মাধ্যমে অর্থ উপাজন করে তা বিদেশিদের কাছে দিয়ে আসছে। অন্তর্বর্তী সরকারের উদ্যোগে গঠিত শ্বেতপত্র কমিটি তাদের প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে, ২০০৯ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত সময়ে বাংলাদেশ থেকে ২৩ হাজার ৪০০ কোটি মার্কিন ডলার সমতুল্য ২৮ লাখ কোটি টাকা বিদেশে পাচার করা হয়েছে। প্রতিটি প্রতিষ্ঠানকে দলীয়করণের মাধ্যমে বিপর্যস্ত করে ফেলা হয়েছে। বিগত সরকারের আমলে দুর্নীতির মাধ্যমে যেভাবে রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুটে নেওয়া হয়েছে বাংলাদেশের ইতিহাসে তার কোনে নজির নেই। উন্নয়নের নামে বিপুল পরিমাণ অর্থ লুট করা হয়েছে।
ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে স্বৈরাচারী শেখ হাসিনা সরকারের পতন হয়েছে। শেখ হাসিনা প্রাণ বাঁচানোর জন্য ভারতে পলায়ন করেছেন। দেশ এক নতুন যুগে প্রবেশ করেছে। বাংলাদেশের পূর্বাকাশে নতুন সূর্যের উদয় হয়েছে। উদীত নতুন সূর্যের আলোয় আমাদের আগামী দিনে পথ চলতে হবে। এর আগেও বেশ কয়েকবার আমরা দেশ গড়ার সুযোগ পেয়েছিলাম। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলোর স্বার্থপরতা ও দূরদর্শিতার অভাবেব কারণে সেই সুযোগ আমরা কাজে লাগাতে পারিনি। কিন্তু এবার ব্যর্থ হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। আমরা যদি ৫ আগস্টের নতুন বাংলাদেশের সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে না পারি, তাহলে জাতির ভবিষ্যৎ আবারও অন্ধকারে নিমজ্জিত হতে বাধ্য। এই মুহূর্তে সবচেয়ে বড় প্রয়োজন হচ্ছে সব ভেদাভেদ ভুলে ঐক্যবদ্ধভাবে জাতি গঠনে সবাইকে তৎপর হওয়া। ক্ষুদ্র স্বার্থে বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থ জলাঞ্জলি দেওয়া হলে আগামী প্রজন্ম আমাদের কখনোই ক্ষমা করবে না।
লেখক : সাবেক ভাইস চ্যান্সেলর
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বাহরাইনে নিযুক্ত বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত
ভারতের বিপক্ষে শিলংয়ের জওয়াহেরলাল নেহরু স্টেডিয়ামে আজ (২৫ মার্চ) এএফসি এশিয়া কাপ যোগ্যতা মানের খেলা হবে। এই খেলা ঘিরে যে রোমাঞ্চ, স্নায়ুক্ষয়ী উত্তেজনা, উন্মাদনার জন্ম হয়েছে, অতীতে কখনো কোনো একটি আন্তর্জাতিক ম্যাচ ঘিরে এত বেশি আলোচনা-উত্তেজনা দেখতে পাইনি। মিডিয়া দিনের পর দিন দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখেছে এই ম্যাচটি ঘিরে। ইংলিশ প্রিমিয়ার লীগের খেলোয়াড় বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত হামজা চৌধুরীর অভিষেক হবে বাংলাদেশ জাতীয় দলের হয়ে ভারতের বিপক্ষে।
এদিকে দেশের প্রয়োজনে অবসরে যাওয়া সুনীল ছেত্রীকে ভারতের ফুটবল ফেডারেশন জাতীয় দলে ফিরিয়ে এনেছে।
হামজা চৌধুরী ইতিবাচক খেলোয়াড়। তিনি জানেন দেশের জাতীয় দলে তাঁর কী ভূমিকা হওয়া উচিত। তাঁর বড় প্রয়োজন সতীর্থ খেলোয়াড়দের কাছ থেকে সহযোগিতা এবং তাঁদের বোঝা। একা খেলে তো হামজা দলকে জেতাতে পারবেন না—অন্যদের সহযোগিতা লাগবে।
হামজার অন্তর্ভুক্তি বাংলাদেশ দলের শক্তি বৃদ্ধিতে সহায়ক হয়েছে। খেলোয়াড়রা অনুপ্রাণিত এবং উজ্জীবিত। তাঁরা মাঠে সামর্থ্য উজাড় করে লড়বেন দেশের জন্য। ভারতের বিপক্ষে যদি দল জেতে, তাহলে কি ফুটবলের গতিপথ বদলে যাবে রাতারাতি? তা নয়। ফুটবল আত্মবিশ্বাস ফিরে পাবে, উজ্জীবিত হবে। গতিপথ বদলাতে হলে নতুন পরিকল্পনার মাধ্যমে নতুন রূপরেখা নির্ণয় করতে হবে। পাশাপাশি প্রয়োজন ফুটবলে ফিফা অনুমোদিত সংস্কার সাধন। ফুটবলে প্রয়োজন দ্রুত সমস্যার সমাধান এবং দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়ন, ঐকমত্য পোষণের ভিত্তিতে। প্রবাসী, বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত এবং নাগরিকত্ব নিয়ে খেলোয়াড়দের খেলা নিয়ে কিছু কথা উঠেছে। এটি যাঁরা বলছেন, তাঁরা অজ্ঞতা এবং সচেতনতার অভাবের জন্য এটি বলছেন। শুধু বলব, দুনিয়াজুড়ে বিভিন্ন দেশের ফুটবলে এই প্র্যাকটিস আছে। আর এটি ফিফা কর্তৃক অনুমোদিত। এই প্র্যাকটিস দেশের ফুটবলকে ধ্বংস করে না বরং সমৃদ্ধ করে, জাগিয়ে তুলতে সাহায্য করে।
ইতালি থেকে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত তরুণ খেলোয়াড় ফাহমিদুল সৌদি আরবে গিয়ে বাংলাদেশ স্কোয়াডে যোগ দিয়েছিলেন। মিডিয়ায় দেখেছি, তাঁকে নিয়ে অনেক কথাই লেখা হয়েছে। কেউ কেউ বলেছেন, তিনি হবেন দলের তুরুপের তাস ভারতের বিপক্ষে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম তাঁকে নিয়ে দারুণভাবে মেতেছে। সৌদিতে ক্যাম্প শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তিনি বাংলাদেশে না এসে ইতালিতে ফিরে গেছেন। এই বিষয়টি নিয়েও প্রচুর আলোচনা, তর্কবিতর্ক হয়েছে। অনেকেই মনে করেছেন ষড়যন্ত্র। সিন্ডিকেটের খেলা। মিছিল বের করা হয়েছে। বিক্ষোভ প্রদর্শন করা হয়েছে। অমুকের পদত্যাগ, তমুকের পদত্যাগ চাওয়া হয়েছে। অবিবেচকের মতো ফুটবলে এই সমস্যা সমাধানের জন্য আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া, উপদেষ্টা যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের হস্তক্ষেপ কামনা করা হয়েছে। তিনি জানেন, এ ক্ষেত্রে তাঁর হস্তক্ষেপের কোনো সুযোগ নেই। সরকারের হস্তক্ষেপ ফিফা কখনো বরদাশত করে না। পাবলিককে খুশি করার জন্য বা পরিস্থিতি সামাল দেওয়ায় ক্রীড়া উপদেষ্টা ফুটবল ফেডারেশনের সভাপতির সঙ্গে বসেছেন। শেষ পর্যন্ত জানা গেছে, ফাহমিদুল বাংলাদেশের দলের জন্য এখনো তৈরি নন। ভবিষ্যতে অবশ্যই সুযোগ আছে।
হামজা চৌধুরীর অন্তর্ভুক্তি বাংলাদেশের ফুটবলে কী ধরনের প্রভাব সৃষ্টি করতে পারে এটি জানতে চাওয়া হয়েছিল বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের সিনিয়র সহসভাপতি এবং বসুন্ধরা কিংসের প্রেসিডেন্ট মো. ইমরুল হাসানের কাছে। তিনি বলেছেন, বাংলাদেশের ফুটবল নিয়ে ভক্তদের অভিযোগের অন্ত নেই। শুধু আন্তর্জাতিক অঙ্গন নয়, বাংলাদেশের ঘরোয়া ফুটবল নিয়েও রয়েছে মানুষের বিস্তর অভিযোগ। ফুটবলের মান পড়ে গেছে কিংবা ঘরোয়া ফুটবলে দর্শক নেই, বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের (বাফুফে) অন্যতম শীর্ষকর্তা হিসেবে অভিযোগটি আমাকেও শুনতে হয় প্রায়ই। বরাবরের মতো আমার উত্তর, বাংলাদেশের ঘরোয়া ফুটবলে দর্শকশূন্যতার জন্য ক্লাবগুলোও অনেকাংশে দায়ী। মাঠে দর্শক আসে ক্লাবের টানে। প্রিয় খেলোয়াড়ের খেলা দেখতে। বাংলাদেশের ক্লাবগুলো নিজেদের সমর্থক ধরে রাখা বা মাঠে আনতে ব্যর্থ। একই সঙ্গে দর্শকদের সামনে হাজির করতে পারেনি কোনো ফুটবল ‘আইকন’, যাদের খেলা দেখতে ভক্তরা মাঠে আসতে উৎসাহ বোধ করবে। খেলোয়াড় বা তারকা তৈরির মূল কাজটি তো ক্লাবেরই কাজ। বাংলাদেশের ফুটবলে তারকা খেলোয়াড়ের অভাব ছিল না। কাজী সালাউদ্দিন, চুন্নু, এনায়েত, কায়সার হামিদ, মুন্না, আসলাম আর সাব্বিরদের খেলা দেখার জন্য আলাদা দর্শক ছিল। তারা মাঠে যেত প্রিয় খেলোয়াড়ের খেলা দেখতে। বর্তমানে কোনো বাংলাদেশি খেলোয়াড়ের খেলা দেখতে আলাদাভাবে কোনো দর্শক মাঠে আসে কি না আমার জানা নেই। ফুটবলে প্রিয় ক্লাব তো থাকবেই, কিন্তু বিশেষ খেলোয়াড়দের ভক্তরাও কম গুরুত্বপূর্ণ না। লিওনেল মেসি, ক্রিস্টিয়ানো রোনালডোরা ইউরোপ ছেড়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কিংবা সৌদি আরবে পাড়ি জমালে সেই সব দেশের ফুটবল ক্লাব আর লীগ জাতে উঠে যায়। দর্শক বেড়ে যায় রাতারাতি। আসলে ক্লাব ফুটবল বলেন কিংবা জাতীয় দল, মানুষের আগ্রহের কেন্দ্রে আসার জন্য প্রয়োজন তারকা খেলোয়াড়ের উপস্থিতি, যিনি নিজ দেশ কিংবা ক্লাবের জন্য বড় ‘বিজ্ঞাপন’ হিসেবে কাজ করেন। বাংলাদেশের জন্য কাজটি করতে পারেন হামজা চৌধুরী।
হামজা চৌধুরী সম্পর্কে নতুন কিছু বলার নেই। খেলাধুলা বা ফুটবল নিয়ে সামান্য খোঁজখবর রাখেন এমন সবাই এখন হামজাকে চেনেন। ইংল্যান্ডে জন্ম নেওয়া হামজা বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত। তাঁর নানাবাড়ি সিলেটে। ফুটবল খেলছেন ইংলিশ প্রিমিয়ার লীগের বড় দল লেস্টার সিটিতে। ইংলিশ প্রিমিয়ার লীগ বিশ্বের সবচেয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ আর জনপ্রিয় ফুটবল প্রতিযোগিতা। সেই আসরের পরিচিত মুখ হামজা। তাই বিশ্বব্যাপী ফুটবল অনুরাগীরা হামজাকে কমবেশি চেনেন। সেই হামজা বাংলাদেশের হয়ে খেলার জন্য ফিফার ছাড়পত্র পেয়েছেন। কাজটি সহজ ছিল না। হামজার লক্ষ্য ছিল ইংল্যান্ডের জাতীয় দলে খেলা। তিনি ইংল্যান্ডের বয়সভিত্তিক দলে খেলেছেন। এ ছাড়া গ্রানাডার হয়ে খেলার সুযোগও তাঁর ছিল। তবে তিনি শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের পক্ষে আন্তর্জাতিক ফুটবলে খেলার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। ধন্যবাদ হামজাকে। প্রশ্ন হচ্ছে, হামজা বাংলাদেশের হয়ে খেললে কী হবে? বাংলাদেশের ফুটবল কি রাতারাতি বদলে যাবে? উত্তর হচ্ছে, না। ফুটবল দলীয় খেলা। হামজা একা বাংলাদেশের ফুটবলকে এশিয়া কিংবা বিশ্ব পর্যায়ে নিয়ে যাবেন—এমন আশা করলে ভুল হবে। তবে হ্যাঁ, হামজা অন্তর্ভুক্তিতে বাংলাদেশ পাবে বিশ্ব মিডিয়ার ফোকাস। এতে হামজার সতীর্থরাও আলোকিত হবেন। তাঁদের জন্য খুলে যাবে সম্ভাবনার নতুন দুয়ার। হয়তো হামজার কল্যাণে বাংলাদেশের কেউ কেউ পেয়ে যেতে পারেন বিদেশি কোনো বড় লীগে খেলার সুযোগ। তবে শর্ত একটাই, নিজেদের সেরাটা দিতে হবে। এ ছাড়া ইউরোপের ফুটবল সম্পর্কে তাঁর ধারণা পরিষ্কার। ফিটনেস কিংবা ব্যক্তিগত ট্রেনিং নানা টিপস দিয়ে তিনি সহযোগিতা করতে পারেন বাংলাদেশি সতীর্থদের। বাফুফে তো জাতীয় দলের জন্য উন্নতমানের বিদেশি কোচ আর ট্রেনারের ব্যবস্থা করেছে। ক্লাব ফুটবলেও ফুটবলাররা বিদেশি কোচের সান্নিধ্য পান নিয়মিত। তবু দলের মহাতারকার সঙ্গে সতীর্থ খেলোয়াড়দের তথ্য আদান-প্রদানের ভূমিকা অনেক। তাঁরা অনেক কিছু শেখেন। রোনালদিনিওর কাছ থেকে তরুণ মেসি, মেসির কাছ থেকে অনেক কিছু শিখেছেন বলে জানিয়েছেন খোদ নেইমার। আমিও মনে করি বাংলাদেশ দলের রাকিব, মোরসালিনদের অনেক কিছু শেখা হবে হামজাকে সতীর্থ হিসেবে পাশে পেলে। অন্তত তাঁদের ম্যাচ টেম্পারামেন্ট বা মানসিক শক্তি বিকাশে হামজা ভূমিকা রাখবেন, সন্দেহ নেই।
ফিরে আসি বাংলাদেশ দল প্রসঙ্গে। অনেক দিন ধরে বাংলাদেশ দলে বড় কোনো তারকা নেই। সুইডেনপ্রবাসী অধিনায়ক জামাল ভূঁইয়াকেই বর্তমানে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় তারকা ধরা যায়। তবে হামজার অ্যাডভান্টেজ ইংলিশ প্রিমিয়ার লীগে খেলা। তিনি বাংলাদেশে আসছেন মহাতারকা হিসেবেই। হামজাকে বাংলাদেশের পরিচিত করিয়ে দেওয়ার কিছু নেই। বরং হামজার জন্যই বাংলাদেশ ফুটবল বিশ্বে পরিচিতি পাবে নিঃসন্দেহে। বিষয়টি হামজার জন্য চ্যালেঞ্জিংও বটে। বাংলাদেশ দলের পক্ষে ভরাডুবি হলে তাঁর মোহভঙ্গ হতে পারে। তিনি উৎসাহ হারাতে পারেন। নিজেদের সেরাটা নিয়ে হামজাকে ধরে রাখার দায়িত্বটা বাংলাদেশের আলো-বাতাসে বেড়ে ওঠা ফুটবলারদের ওপর বর্তাবে। এটা তাঁদের জন্যও চ্যালেঞ্জ। তাঁরা হামজার যোগ্য সতীর্থ হিসেবে নিজেদের প্রমাণের চ্যালেঞ্জটা নেবেন, চ্যালেঞ্জে জয়ী হবেন আশা করছি।
বাংলাদেশ দলে হামজার অন্তর্ভুক্তি বড় ঘটনা। তাঁর মতো আন্তর্জাতিক খ্যাতি পাওয়া কোনো ফুটবলার বাংলাদেশ দলে কখনো খেলেননি। তাই এখন থেকে বাংলাদেশের প্রতিটি পারফরম্যান্স দেশ তো বটেই, দেশের বাইরের মিডিয়ায় থাকবে আতশ কাচের নিচে। অন্তত ইংলিশ মিডিয়া যে বাংলাদেশের পারফরম্যান্স নিয়ে কিছুটা হলেও মাতবে, সেটা নিয়েও কোনো সন্দেহ নেই। তাদের এই আগ্রহ ধরে রাখতে হবে। হামজার পথ ধরে বাংলাদেশে অনেক প্রবাসী ফুটবলার আসুন। এরই মধ্যে জামাল ভূঁইয়া আর তারিক কাজীরা লাল-সবুজের জার্সি গায়ে চাপিয়েছেন। এলিটা কিংসলে প্রথম ভিনদেশি খেলোয়াড় হিসেবে নাগরিকত্ব নিয়ে বাংলাদেশ জাতীয় দলে খেলেছেন। তবে তিনি বাংলাদেশ দলে যোগ দিয়েছিলেন বড্ড দেরিতে। তাই বাংলাদেশ কিংসলের কাছ থেকে আশানুরূপও সার্ভিস পায়নি। ভবিষ্যতে বাংলাদেশ ভালো মানের বিদেশি খেলোয়াড়, যাঁদের অন্তত পাঁচ বছর আন্তর্জাতিক ফুটবলে দাপটের সঙ্গে খেলার সম্ভাবনা আছে, তাঁদের নাগরিকত্ব দিয়ে চেষ্টা চালাতে পারে। আমি রক্ষণশীল নই। বাংলাদেশের ফুটবলের উন্নয়নের জন্য যা যা দরকার আমি করতে রাজি। স্পেন, জার্মানি, ফ্রান্সের জাতীয় দলে বহু প্রবাসী আর ভিনদেশি ফুটবলার খেলেছেন। খেলছেন। হ্যাঁ, নাগরিকত্ব নিয়ে ফিফার অনুমতি পাওয়াটা একটা জটিল প্রক্রিয়া। তবে সব প্রক্রিয়া সহজভাবে সম্পন্ন করতে আমাদের দায়িত্ব নিতে হবে। আর অবশ্যই দেশি ফুটবলারদের নিজেদের আত্মবিশ্বাস জাগাতে হবে। আমরাও হামজার মতো সতীর্থের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে খেলার যোগ্যতা রাখি, বিশ্বাস নিয়ে মাঠে নামতে হবে। এতে বাংলাদেশ দল উপকৃত হবে। সমৃদ্ধ হবে। বাংলাদেশ আর হামজা চৌধুরীর জন্য শুভ কামনা।
লেখক : কলামিস্ট ও বিশ্লেষক। সাবেক সিনিয়র সহসভাপতি, এআইপিএস এশিয়া। আজীবন সদস্য বাংলাদেশ স্পোর্টস প্রেস অ্যাসোসিয়েশন। প্যানেল রাইটার, ফুটবল এশিয়া
প্রকৃত বিপদ ঘটল ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধের পরে। ওই যুদ্ধ কোনো গৌরব আনল না। এদিকে শেখ মুজিব ছয় দফা দিলেন। সেনাবাহিনীর বাঙালি সদস্যরা ‘ষড়যন্ত্র’ করছেন বলে জানা গেল।
জনবিক্ষোভের মুখে ইয়াহিয়া খানের পক্ষে সংখ্যাসাম্য ও এক ইউনিট ওই দুয়ের কোনোটিই টিকিয়ে রাখা সম্ভব ছিল না। জনমতকে ঠাণ্ডা রাখার জন্য নির্বাচনও দিতে হলো। সংখ্যাসাম্য ভেঙে তার জায়গায় প্রাপ্তবয়স্ক ভোট চালু করার ফলে নির্বাচনের জন্য পরিকল্পিত ৩০০ আসনের মধ্যে ১৬২টি পড়ল পূর্ব পাকিস্তানের ভাগে, ১৩৮টি পেল পশ্চিম পাকিস্তান।
ব্যাপারটি দাঁড়াল এই রকমের যে ভোটের ফল অনুযায়ী শেখ মুজিবুর রহমানকে প্রধানমন্ত্রী করা ছাড়া অন্য কোনো উপায় রইল না।
পাঞ্জাবি সেনা কর্মকর্তাদের জন্য এসব কী ভয়ংকর এক দুঃস্বপ্ন! তা ছাড়া বাঙালিরা যদি আনুপাতিক হারে অংশ চায়, তাহলে সিন্ধি, পাঠান, বেলুচ, মোহাজেররাই বা চুপ করে থাকবে কেন? তারাও ন্যায়বিচার চাইবে। ফলে পাঞ্জাবি আধিপত্যের সর্বনাশ ঘটবে, সেনাবাহিনী তার ‘বিশ্ববিখ্যাত’ শক্তি ও সংগঠন হারাবে। আর ওই বাহিনীই যদি ভেঙে পড়ে, তাহলে পাকিস্তানের আর রইল কী?
ছোটখাটো আশঙ্কা আরো ছিল। যেমন—কর্নেল ওসমানী যদি প্রতিরক্ষামন্ত্রী হন, তাহলে অবস্থাটা কেমন দাঁড়াবে, এই দুশ্চিন্তা! তিনি তো যারা তাঁর ওপর অসদাচরণ করেছে, তাদের ছেড়ে কথা বলবেন না। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় যারা শেখ মুজিবকে জড়িয়েছিল, সেসব কর্মকর্তাই বা কী করে পার পাবেন? ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প-কারখানা বাঙালিদের হাতে চলে যাওয়া শুরু করবে। শেষ পর্যন্ত রাওয়ালপিন্ডি থেকে রাজধানীকে ঢাকায় সরিয়ে নেওয়ার দাবি যে উঠবে না, তা-ই বা কে নিশ্চিত করতে পারে?
নির্বাচনের পরে জানুয়ারির দ্বিতীয় সপ্তাহে ইয়াহিয়া খান ঢাকায় এসেছিলেন, ফেরার পথে বিমানবন্দরে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে বলেছিলেন যে শেখ মুজিবই প্রধানমন্ত্রী হবেন এবং তখন তিনি (ইয়াহিয়া খান) আর থাকবেন না। বলেই হয়তো খেয়াল হয়েছে যে ওই ভয়ংকর সম্ভাবনাকে ঠেকানো দরকার। সে জন্য তিনি করাচিতে নেমেই ভুট্টোর শরণাপন্ন হয়েছেন। সমস্বার্থের চাপে দুই পক্ষ তখন এক পক্ষ হয়ে গেছে। ভুট্টোও তখন বুঝতে শুরু করেছিলেন যে খোদা না করুন শেখ মুজিব যদি প্রধানমন্ত্রী হন, তাহলে তাঁকে হয় তাঁর অধীনে মন্ত্রিত্ব নিতে হবে, নয়তো বসতে হবে বিরোধী দলের নেতার অস্বস্তিকর আসনে; যে দুটি সম্ভাবনার কোনোটিই তাঁর কাছে গ্রহণযোগ্য ছিল না। ভুট্টো তাই মুজিবকে শত্রু হিসেবে দাঁড় করিয়ে ইয়াহিয়ার সঙ্গে হাত মিলিয়েছিলেন। বিপদগ্রস্ত ভুট্টো নানা রকমের উল্টাপাল্টা আওয়াজ তোলা শুরু করলেন। এমনও বলছিলেন, পাকিস্তানে তিনটি রাজনৈতিক দল রয়েছে, আওয়ামী লীগ, পিপলস পার্টি ও সামরিক বাহিনী; তাদের মধ্যে মীমাংসা না ঘটার আগে ক্ষমতা হস্তান্তর ঘটানো যাবে না। আর মীমাংসা হবে গণপরিষদের বাইরে, ভেতরে নয়। শেষ পর্যন্ত এমন কথাও তিনি বলেছেন যে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে দুই পাকিস্তানে দুই মেজরিটি পার্টির কাছে। এসব কথা রাষ্ট্রদ্রোহের শামিল, কিন্তু এগুলো তিনি বলেছেন সামরিক বাহিনীর প্রশ্রয়েই। সেনাকর্তাদের তিনি আশ্বস্ত করেছেন যে আওয়ামী লীগ একটি বুর্জোয়া দল, এদের পক্ষে কোনো জনবিদ্রোহ করা সম্ভব নয়। সেনাকর্তারা শুনেছেন, কারণ তাঁদের জন্য আশ্বাসের খুব দরকার ছিল। তবে দুই পক্ষের মধ্যে সম্পর্কটা যে ভালোবাসার ছিল না, সেটা অত্যন্ত পরিষ্কারভাবেই জানা গেছে যুদ্ধ শেষ হওয়ার পরে ভুট্টো যখন প্রেসিডেন্ট ও চিফ মার্শাল ল অ্যাডমিনিস্ট্রেটর হয়েছেন এবং সঙ্গে সঙ্গেই ইয়াহিয়া খানকে গৃহবন্দি করে ফেলেছেন। এবং সপ্তাহ ঘুরতে না ঘুরতেই ইয়াহিয়া ও তাঁর সহকর্মীদের ব্যর্থতার তদন্তের জন্য একটি কমিশন বসিয়ে দিয়েছেন।
যুদ্ধ যখন তুঙ্গে, তখন ভুট্টো একটি বই লেখেন ‘দ্য গ্রেট ট্র্যাজেডি’ নাম দিয়ে, সেই বইয়ে মহাবিজ্ঞের মতো তিনি বলেন যে তিনি আশা করেন সেনাবাহিনীর লোকেরা আওয়ামী লীগের শহুরে সদস্যদের নিরস্ত্র করার মধ্যেই নিজেদের কর্মক্ষেত্র সীমাবদ্ধ রেখেছে, গ্রামের মানুষকে ঘাঁটায়নি; কেননা ঘাঁটালে সত্যিকারের বিপদ ঘটবে। তিনি জানতেন না যে সামরিক বাহিনীর পক্ষে গ্রামের মানুষের ওপর অত্যাচার না করে উপায় ছিল না। কারণ শহর-গ্রাম-নির্বিশেষে বাংলাদেশের সব মানুষ তখন হানাদারদের বিরুদ্ধে এক হয়ে দাঁড়িয়ে গেছে। হানাদাররা অবশ্য কোনো তত্ত্বের পরোয়া করেনি, তারা সরাসরি গণহত্যায় নেমে পড়েছিল।
ঢাকায় ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে প্রহসনের সংলাপ যখন চলছিল, তখন ভুট্টোর সঙ্গে মুজিবের একবার দেখা হয়। প্রেসিডেন্ট ভবনেই। মুজিব তাঁকে আড়ালে ডেকে নিয়ে গিয়ে বলেছিলেন, ‘এরা কিন্তু আগে আমাকে মারবে, তারপর তোমাকে।’ ভুট্টো নাকি নাটকীয়ভাবে জবাব দিয়েছিলেন, ‘আমি সেনাবাহিনীর হাতে মরব, তবু ইতিহাসের হাতে মরব না।’ এ খবর তিনি জানিয়েছেন আমাদের, তাঁর ওই বইয়ের মারফত। তা ইতিহাসের জন্য অপেক্ষা করার দরকার পড়েনি, সেনাবাহিনীর হাতেই তো তিনি প্রাণ দিলেন। সেনাবাহিনী কিন্তু শেখ মুজিবের গায়ে হাত দিতে পারেনি। তারা মুজিবকে বন্দি করে পাকিস্তানে নিয়ে যেতে পেরেছিল দেখে আশ্বস্ত হয়েছিল, কিন্তু পাকিস্তান নিজেই তো তত দিনে ভেঙে গেছে। ২৬ মার্চ পাকিস্তানের মৃত্যু দিবস বৈকি। সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে ২৬ মার্চ করাচি বিমানবন্দরে অবতরণ করে তিনি ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানিয়েছিলেন পাকিস্তানকে বাঁচিয়ে দেওয়ার জন্য। সেদিন ভুট্টো কি সত্যি সত্যি ভেবেছিলেন যে গণহত্যা পাকিস্তানকে বাঁচাবে, নাকি তিনি সেনাবাহিনীর তৎপরতা দেখে ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন? ভেবেছিলেন কি যে ওই রকমের একটি আওয়াজ না দিলে তাঁকেও ওই ভগ্নস্তূপে নিক্ষেপ করা হবে, নাকি তিনি ইতিহাসজ্ঞান ও বাস্তববুদ্ধি দুটিই হারিয়ে ফেলেছিলেন ক্ষমতার লোভে? তবে তিনি যে অস্থিরচিত্ত এক জুয়াড়ি ছিলেন, তা মোটেই মিথ্যা নয়। অপরিণামদর্শী ও ক্ষমতাভোগী সেনাকর্তাদের অভিসন্ধির বিরুদ্ধে তিনি যদি শেখ মুজিবের সঙ্গে হাত মেলাতেন, তবে ইতিহাস কোন গতিপথ বেছে নিত আমরা জানি না, তবে যে গতিপথে এগোচ্ছিল, সেটি ধরে হয়তো এগোত না।
ইয়াহিয়া তখন সর্বশক্তিমান, কিন্তু তিনিও যে স্বাধীন ছিলেন এমন নয়। তাঁর চারপাশে যেসব বাজপাখি ওত পেতে বসে ছিল, তাদের সম্মতির বাইরে পদক্ষেপ নেবেন এমন ক্ষমতা তাঁর ছিল না। কোনো কোনো জেনারেলের সঙ্গে উচ্চাকাঙ্ক্ষী ভুট্টোর যে ঘনিষ্ঠতা ছিল, এ খবরও তাঁর অজানা থাকার কথা নয়। ক্ষমতার লিপ্সায় জাতীয়তাবাদী ভুট্টো তখন চরমপন্থী। এক পর্যায়ে তো শেখ মুজিবকে বলেই ছিলেন যে ‘তুম উধার হাম ইধার’। ভাবটা অনেকটা ১৯৪৬-৪৭-এ অখণ্ড বাংলার হিন্দু মহাসভাপন্থীদের মতো, ক্ষমতা হারানোর আশঙ্কায় যাঁরা বাংলাকে দ্বিখণ্ডিত করার পক্ষে দৃঢ় অবস্থান নিয়েছিলেন। ক্ষমতাই যদি না থাকল, তাহলে তাতে দেশ থাকলেই বা কী, না থাকলেই বা কী। মহাসভাপন্থীরাও জাতীয়তাবাদীই ছিলেন—হিন্দু জাতীয়তাবাদী।
লেখক : ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়