ভূমিকম্পে আতঙ্ক নয়, প্রয়োজন মানসম্মত ভবন নির্মাণ

ড. এম শামীম জেড বসুনিয়া
ড. এম শামীম জেড বসুনিয়া
শেয়ার
ভূমিকম্পে আতঙ্ক নয়, প্রয়োজন মানসম্মত ভবন নির্মাণ

৭ দশমিক ৯ মাত্রার ভূমিকম্পে নেপালের রাজধানী কাঠমাণ্ডু রীতিমতো ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। গতকাল রবিবার পর্যন্ত সেখানে মৃতের সংখ্যা সাড়ে ছয় হাজার ছাড়িয়েছে। ভারত ছাড়িয়ে বাংলাদেশেও সেই ভূমিকম্পের ফলে বড় ধরনের কম্পন সৃষ্টি হয়েছিল। অনেক ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

মানুষের মধ্যে ব্যাপক আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। কিন্তু আতঙ্ক তো কোনো সমাধান দেবে না। এ জন্য প্রয়োজন সঠিকভাবে ঘরবাড়ি তৈরি এবং প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি। বাংলাদেশে বিশেষ করে ঢাকা ও এর আশপাশের এলাকায় ফ্ল্যাট প্লেট (flat plate) সিস্টেমে ভবন নির্মাণের প্রবণতা বেড়ে গেছে।
ফ্ল্যাট প্লেট হলো সেই সিস্টেম, যেখানে কোনো বিমের অস্তিত্ব থাকে না। এটি অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ একটি সিস্টেম। একটি কাঠের চেয়ারের চার পায়ার সঙ্গে আনুভূমিকভাবে কাঠের আলাদা ফ্রেম লাগানো হয়। একটু চিন্তা করলেই আমরা বুঝতে পারব যে ওই ফ্রেমগুলো লাগানো না থাকলে চেয়ারটি কিছুদিন ব্যবহারের ফলেই দুর্বল হয়ে পড়ত এবং পায়াগুলো নড়বড়ে হয়ে যেত।
বিমগুলোও ভবনের বেলায় ঠিক একই রকম ফ্রেমের মতো কাজ করে এবং এই বিমের কারণেই কলামগুলো শক্ত-সমর্থ থাকে। ফ্ল্যাট প্লেট ভূমিকম্প প্রতিরোধব্যবস্থায় দুর্বল ও বিপজ্জনক। বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড (BNBC) অনুযায়ী বাংলাদেশের ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকাগুলোয় ফ্ল্যাট প্লেট সিস্টেমে ভবন নির্মাণের অনুমোদন নেই। শুধু ঘরের ভেতর বিম ঝুলে থাকবে- এই দোহাই দিয়ে অনেক ভবন মালিক বিম-কলাম সিস্টেমে বিল্ডিং বানাতে চান না। অথচ একজন ভালো স্থপতিকে দিয়ে ভবনের নকশা করালে সেখানে এমনভাবে সব কিছু করা সম্ভব যে বিম থাকা সত্ত্বেও তা বাসিন্দাদের খুব একটা দৃষ্টিগোচর হবে না এবং ভবনের নিরাপত্তাও নিশ্চিত হবে।

একটি ভবন নির্মাণের সময় এ বিষয়টি অবশ্য মাথায় রাখা উচিত, যেন ভবনটি কোনো অবস্থায়ই ডিজাইনের বেশি উচ্চতাসম্পন্ন না হয়। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় যে ছয়তলার অনুমোদন ও ডিজাইন করিয়ে নিয়ে সেখানে ৯-১০ তলা নির্মাণ করা হচ্ছে। রানা প্লাজার ক্ষেত্রেও একই ব্যাপার ঘটেছিল। একজন মানুষ যদি ২০ কেজি ওজন মাথায় নেওয়ার সামর্থ্য রাখে এবং তার ওপর যদি ৪০ কেজি ওজন চাপিয়ে দেওয়া হয়, তাহলে সে যে অতিরিক্ত ভারে নুয়ে পড়বে, এটাই স্বাভাবিক। কাজেই ভবনের ফাউন্ডেশন যদি ছয়তলার হয়ে থাকে, তাহলে তার ওপর সাততলা নির্মাণ করাও বিপজ্জনক। কিন্তু আমাদের দেশের ভবন মালিকরা এ বিষয়টি প্রায়ই লঙ্ঘন করে থাকেন।

অনেক সময় ভবন মালিকরা প্রকৌশলীকে জিজ্ঞেস করেন যে তাঁর করা ডিজাইনে ভবনটি ভূমিকম্পের ক্ষেত্রে কত রিখটার স্কেল পর্যন্ত সহনশীল হবে? একটা বিষয় মনে রাখা প্রয়োজন, কত রিখটার স্কেলে ভূমিকম্প হচ্ছে এর থেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল কোথায়। রিখটার স্কেলের ৮ মাত্রার ভূমিকম্প হয়তো ঢাকা শহরের ওপর খুব একটা প্রভাব ফেলবে না, যদি তার উৎপত্তিস্থল ঢাকা থেকে চার হাজার মাইল দূরে হয়। অথচ রিখটার স্কেলের ৫ মাত্রার ভূমিকম্পও বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে, যদি তার উৎপত্তিস্থল ঢাকা বা তার আশপাশে কোথাও হয়। মূলত কোনো জায়গার ভূমিকম্পের পূর্ব-ইতিহাস এবং ওই জায়গার ভূগর্ভস্থ চরিত্র (geological characteristics) বিশ্লেষণ করে ভূমিকম্পের তীব্রতা হিসাব করা হয় এবং ভূমিকম্প হলে মাটিতে সর্বোচ্চ কতটা কম্পন (vibration) সৃষ্টি হতে পারে, তা নির্ণয় করে ভবনটির ডিজাইন করা হয়ে থাকে।

রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) নকশা অনুমোদনের ক্ষেত্রে যতটা নিয়মনীতি মেনে চলে, স্ট্রাকচারাল ডিজাইন নিয়ে অতটা মাথা ঘামায় না। বিষয়টা এমন দাঁড়িয়েছে যে শুধু প্ল্যান পাস হয়ে গেলেই ভবনটি নির্মাণের জন্য প্রস্তুত হয়ে গেল। কিন্তু ভবনটি কোনো দক্ষ প্রকৌশলীকে দিয়ে ডিজাইন করানো হচ্ছে কি না এবং নির্মাণকালে ভবনের সার্বিক নিরাপত্তার (safety) বিষয়টি যথাযথভাবে পালন করা হচ্ছে কি না- এ বিষয়গুলো উপেক্ষিতই রয়ে যাচ্ছে। এ কারণে অনেক ভবন ডিজাইন ছাড়া তৈরি হয়ে যাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে রাজউকসহ অন্যান্য বিভাগীয় শহরে যেসব কর্তৃপক্ষ এ কাজের তত্ত্বাবধানে নিয়োজিত, তাদের আরো সতর্ক ও দায়িত্বশীল হতে হবে। অন্য জেলা শহরগুলোতেও যথাযথ কর্তৃপক্ষ নিয়োগ করে কেন্দ্রীয়ভাবে সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।

ঢাকা শহরের অভ্যন্তরে কোনো ভবনের নকশা ও ডিজাইন করার জন্য অবশ্যই রাজউকের অনুমোদিত স্থপতি ও প্রকৌশলী হতে হবে। প্রায়ই দেখা যায়, শুধু ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন অব বাংলাদেশ বা আইইবির সদস্য হয়েছেন এমন ইঞ্জিনিয়ার ডিজাইন করে থাকেন। এটা মোটেও ঠিক নয়। কেননা স্নাতক পাসের পর দুই বছর অতিক্রম করলেই আইইবির সদস্য পদ পাওয়া যায়। কিন্তু তিনি যদি এ সময়ে প্রত্যক্ষভাবে ডিজাইনের সঙ্গে সম্পৃক্ত না থাকেন, তাহলে তিনি কিভাবে একটি ভবনের স্ট্রাকচারাল ডিজাইন করবেন? আরেকটি বিষয় হলো, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ও পেশাগত বিষয় এক নয়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে সবাই ডিজাইন সম্পর্কে পড়াশোনা করে এলেও পেশাগত ক্ষেত্রে আরো অনেক বাস্তব অভিজ্ঞতার প্রয়োজন হয়, যেটা এর সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত না থাকলে অর্জন করা যায় না। উদাহরণস্বরূপ, অনেক ইঞ্জিনিয়ার আছেন যাঁরা সফটওয়্যারের সাহায্যে একটি ১০ তলা ভবন ডিজাইন করে ফেলতে পারেন অথচ বাস্তব ক্ষেত্রে একটি ১০ মিলিমিটার রড ও একটি ১২ মিলিমিটার রডকে আলাদা করতে পারেন না। কাজেই শুধু আইইবির সদস্য হলেই যে তিনি ডিজাইন করতে পারবেন, এটা ঠিক নয়। এ ক্ষেত্রে পরীক্ষার মাধ্যমে যোগ্যতা প্রমাণ করে তারপর ডিজাইন করা উচিত। রাজউকের একটি শাখা আছে, যেটি এ ধরনের পরীক্ষা নিয়ে থাকে। এর নাম বাংলাদেশ প্রফেশনাল ইঞ্জিনিয়ার্স রেজিস্ট্রেশন বোর্ড (বিপিইআরবি)। এখানে পরীক্ষা দিয়ে একজন প্রকৌশলী তাঁর যোগ্যতার মাপকাঠি বিচার করে ডিজাইন করতে পারেন; যদিও এই বিপিইআরবিতেও অনেক ফাঁকফোকর আছে। যেমন, এখানে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারদের জন্য চার রকম পরীক্ষার ব্যবস্থা আছে। ক) স্ট্রাকচার, খ) সয়েল, গ) কনস্ট্রাকশন এবং ঘ) প্লাম্বিং। কিন্তু দুঃখজনক ব্যাপার হলো, একজন সিভিল ইঞ্জিনিয়ার প্লাম্বিংয়ের জন্য পরীক্ষা দিয়ে রাজউক থেকে একটি নম্বর পেয়ে তিনি স্ট্রাকচারাল ডিজাইনেও সই করে যাচ্ছেন। এ ব্যাপারে রাজউককে আরো বেশি চোখ-কান খোলা রাখা উচিত। এসব ক্ষেত্রে রাজউক প্রদত্ত রেজিস্ট্রেশন নম্বরে শ্রেণি বিভাগ থাকা উচিত, যেটা দেখলে বোঝা যায় যে ওই প্রকৌশলী কোন ধরনের ডিজাইন করার যোগ্যতা রাখেন। কাজেই প্রকৌশলীদের প্রতি একটি অনুরোধ, তাঁরা যেন ঢালাওভাবে সব ধরনের ডিজাইনে সই না করেন। যদি করতেই হয়, তবে রাজউক থেকে যোগ্যতার পরীক্ষা দিয়ে অনুমোদন নিন।

রানা প্লাজা ধসের প্রধান তিনটি কারণ হলো- ক) অত্যন্ত নিম্নমানের কংক্রিটের ব্যবহার, খ) ছয়তলার অনুমোদন নিয়ে ৯ তলা নির্মাণ এবং গ) বাণিজ্যিক হিসেবে নির্মিত ভবনে গার্মেন্ট ভাড়া দেওয়া। রানা প্লাজার ক্ষেত্রে বিষয়টি আমাদের চোখে ধরা পড়েছে বলে আমরা এখন এসব বিষয় নিয়ে আগ্রহ দেখাচ্ছি। অথচ আতঙ্কের বিষয় হলো- সাভার, আশুলিয়া, টঙ্গী, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জসহ ঢাকার অভ্যন্তরেও এমন শত সহস্র ভবন আছে, সেখানে অত্যন্ত নিম্নমানের কংক্রিট ব্যবহৃত হয়েছে, অনুমোদনের বাইরে গিয়ে অতিরিক্ত বেশ কয়েক তলা বানানো হয়েছে এবং আবাসিক বা বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহারের জন্য ডিজাইন করা ভবনে কলকারখানা ও ভারী যন্ত্রপাতি বসানো হয়েছে। কাজেই অদূর ভবিষ্যতে যদি আরো কিছু ভবনের রানা প্লাজার মতো পরিণতি হয়, তাহলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। আশঙ্কাজনক হলেও সত্য, কিছু কিছু ক্ষেত্রে রানা প্লাজা থেকেও ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটতে পারে এবং সে ক্ষেত্রে প্রাণহানির সংখ্যা রানা প্লাজাকেও ছাড়িয়ে যেতে পারে। রানা প্লাজা সাভার মেইন রোডের ওপর হওয়ায় সেখানে ফায়ার সার্ভিস ও অ্যাম্বুল্যান্স পৌঁছতে পেরেছে। কিন্তু এমন কিছু ভবন এই ঢাকা ও এর আশপাশে আছে, দুর্ঘটনা ঘটলে উদ্ধারকর্মীদের সেখানে পৌঁছতেই অনেক বেগ পেতে হবে। সুতরাং ভবন মালিকদের এখনই সতর্ক হতে হবে, যেন তাঁরা তাঁদের ভবনটি অন্য কোনোভাবে ব্যবহার না করেন এবং যদি ইতিমধ্যে নিয়মবহির্ভূতভাবে ভবনটি ব্যবহার করতে দেওয়া হয়ে থাকে, তবে অবিলম্বে তা প্রত্যাহার করুন। সেই সঙ্গে কলকারখানা ও শিল্পপ্রতিষ্ঠানের ঊর্ধ্বতন ব্যক্তিদের প্রতি অনুরোধ, কোনো ভবন ভাড়া নেওয়ার আগে জেনে নিন যে ভবনটি শিল্পপ্রতিষ্ঠান হিসেবে ব্যবহারের উপযুক্ত কি না।

আমাদের দেশে ইস্পাতের তৈরি ভবনের প্রচলন এখনো খুব বেশি শুরু হয়নি; যদিও দেশে ইস্পাতের তৈরি ফ্যাক্টরি ভবনের সংখ্যা প্রচুর, তবু এর বাইরে সাধারণ ভবনের বেলায় এটি খুব বেশি জনপ্রিয় হয়ে ওঠেনি। দেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে ইস্পাতের ব্যবহারকে আরো বেশি জনপ্রিয় করে তোলা প্রয়োজন। কেননা এ ধরনের ভবনে অনেক সুবিধা পাওয়া যায়। যেমন, ইস্পাতের ভার বহনক্ষমতা অনেক বেশি, যার ফলে ধসে পড়ার ঝুঁকি কম, ভূমিকম্প প্রতিরোধব্যবস্থায় এটি অনেক উপযোগী, অল্প সময়ে ভবনটি নির্মাণ করা যায়। ফলে খরচ অনেক কমে যায় এবং ইস্পাতের স্ক্র্যাপ ভ্যালু অনেক বেশি অর্থাৎ ভবনটিকে চাইলে ভেঙে ফেলা যায় আর ওই ইস্পাতগুলোকে অন্য জায়গায় আবার ব্যবহার করা যায়। বিশেষ করে যেসব ভবনে শিল্প-কারখানার ভারী যন্ত্রপাতি ও জেনারেটর বসবে সেসব ভবন ইস্পাত দ্বারা নির্মাণ করা উচিত। আমাদের দেশে বর্তমানে বেশ কিছু ভালো প্রতিষ্ঠান আছে, যারা ইস্পাতের কাঠামো নির্মাণ করে থাকে। কাজেই শুধু ফ্যাক্টরি ভবনের ক্ষেত্রেই এর ব্যবহারকে সীমাবদ্ধ না রেখে বহুতল বাণিজ্যিক ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রেও এর ব্যবহারকে বিস্তৃত করা যেতে পারে।

শরীর ভারসাম্য হারিয়ে ফেললে সব সময় যে মস্তিষ্ক দায়ী, তা নয়। অনেক সময় কানের সমস্যার জন্যও শরীর ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে। কারণ মানুষের কান শরীরের ভারসাম্য রক্ষার জন্য অনেকাংশে দায়ী। সে ক্ষেত্রে কানেরও চিকিৎসার প্রয়োজন। এ কথা বলার উদ্দেশ্য এই যে বাংলাদেশে ভবন নির্মাণসংক্রান্ত দুর্ঘটনাগুলোর জন্য কোনো একটি বিষয় এককভাবে দায়ী নয়। এর সঙ্গে আরো অনেক বিষয় জড়িয়ে থাকে, যেগুলো আপাতদৃষ্টিতে প্রকট বলে মনে হয় না। কাজেই ভবন মালিকদের সদিচ্ছা থেকে শুরু করে কর্তৃপক্ষের নজরদারি, প্রকৌশলগত ও কারিগরি খুঁটিনাটি, নির্মাণ উপকরণের মান নিয়ন্ত্রণ, নির্মাণকাজের সার্বিক তত্ত্বাবধান ইত্যাদি বিষয় নিশ্চিত করা প্রয়োজন। এখনো যদি আমরা সতর্ক না হই, তাহলে ভবিষ্যতে এ ধরনের দুর্ঘটনা ঘটতেই থাকবে। শুধু দুঃখ প্রকাশ করেই আমরা এর দায় এড়াতে পারি না। তাজরীন ফ্যাশনস ও স্পেকট্রাম ভবনের দুর্ঘটনা থেকেও আমরা শিক্ষা নিতে পারিনি। সাভারে রানা প্লাজাও একটি নির্মম শিক্ষা দিয়ে গেল। ভূমিকম্প ছাড়াই যেখানে এমন ভবনধসের ঘটনা ঘটে সেখানে নেপালের মতো বড় ধরনের ভূমিকম্প হলে কী অবস্থা হবে তা সহেজই অনুমেয়। এর পরও কি আমরা চোখ বন্ধ করে রাখব?

লেখক : সাবেক অধ্যাপক, পুরকৌশল বিভাগ, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট)

ও সভাপতি, ইনস্টিটিউশন অব ইঞ্জিনিয়ার্স, বাংলাদেশ (আইইবি)

মন্তব্য

সম্পর্কিত খবর

অভিমত

অর্থনীতি না বাঁচলে গণতন্ত্র বাঁচবে না

    অদিতি করিম
শেয়ার
অর্থনীতি না বাঁচলে গণতন্ত্র বাঁচবে না
অদিতি করিম

অর্থনীতি এবং গণতন্ত্র একে অন্যের পরিপূরক। অনেকটা রেললাইনের মতো। রেল যেমন দুটি লাইন ছাড়া চলতে পারে না, ঠিক তেমনি একটি রাষ্ট্র রাজনীতি ও অর্থনীতির ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থান ছাড়া চলতে পারে না। রাজনীতি ঠিক না থাকলে যেমন অর্থনীতি ভঙ্গুর হয়ে পড়ে, তেমনি অর্থনীতি না বাঁচলে গণতন্ত্রের মৃত্যু হয়।

সুশাসন, জবাবদিহি ও গণতান্ত্রিক পরিবেশ অর্থনীতিকে এগিয়ে নেয়। বিনিয়োগকারীদের আস্থা সৃষ্টি করে। ঠিক তেমনি অর্থনীতিকে সহায়ক পরিবেশ না দিলে গণতন্ত্র চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে। গণতন্ত্র বিকাশের জন্য অর্থনীতিতে স্বস্তি অপরিহার্য।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর থেকে আমরা যদি ইতিহাস পর্যালোচনা করি তাহলে দেখব, যখন গণতন্ত্র ধ্বংস হয়েছে, রাজনীতি নষ্ট হয়েছে, তখন অর্থনীতিও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, মুখ থুবড়ে পড়েছে। আবার যখন অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পড়েছে, তখন গণতন্ত্র রক্ষা পায়নি। শুধু বাংলাদেশের ইতিহাস নয়, গোটা বিশ্বের ইতিহাসই এ রকম।

বিগত সাড়ে ১৫ বছর দেশে কোনো রাজনীতি ছিল না।

রাজনীতির নামে মূলত একদলীয় কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থা কায়েম করা হয়েছিল। ফলত অর্থনীতিও সঠিক পথে চলেনি, বরং ব্যবসায়ী, শিল্প উদ্যোক্তাদের বাধ্য করা হয়েছিল ক্ষমতাসীন দলের আজ্ঞাবহ হতে, সরকারের নিয়ন্ত্রণ ছিল সর্বত্র। ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে এবং সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক না রাখলে ব্যবসায়ীদের ব্যবসা করা ছিল অসম্ভব। সেই বাস্তবতায় একদিকে যেমন ব্যবসায়ীরা অনেকটা বাধ্য হয়েই তৎকালীন শাসক দলের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন, হাজার হাজার মানুষের কর্মসংস্থানের ধারা অব্যাহত রাখার জন্য তাঁদের সামনে আর কোনো বিকল্প ছিল না। সেই অবস্থা থেকে উত্তরণের পথ খোলে গত বছর জুলাইয়ে ছাত্র-জনতার এক অভূতপূর্ব অভ্যুত্থানের মাধ্যমে।
এই জুলাই বিপ্লব ছিল একটি নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণের আকাঙ্ক্ষা। সেই নতুন বাংলাদেশ কেমন হবে তা নিয়ে এখন নানা রকম আলাপ-আলোচনা চলছে। কিন্তু এসব আলোচনায় অর্থনৈতিক ভাবনাগুলো সামনে আসছে না।

সরকারের পক্ষ থেকে প্রথম ছয় মাসের মধ্যে অনেক বিষয়ে সংস্কার কমিশন গঠন করা হয়েছে। এই সংস্কার কমিশনগুলোর রিপোর্ট পর্যালোচনা করা, কোনটিকে গ্রহণ করা হবে, কোনটি গ্রহণ করা হবে না তা নিয়ে একটি ঐকমত্যে পৌঁছানোর জন্য জাতীয় ঐকমত্য কাউন্সিল গঠিত হয়েছে। এই কাউন্সিলের একটি বৈঠক গত ১৫ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত হয়। ওই বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা নিজেই বলেছেন, সরকারের দ্বিতীয় অধ্যায় শুরু হয়েছে এবং ডিসেম্বরের মধ্যে একটি নির্বাচন হওয়ার ব্যাপারে প্রধান উপদেষ্টা, নির্বাচন কমিশন আশাবাদ ব্যক্ত করেছে। নির্বাচন হবে কিন্তু দেশে অর্থনীতির কী হবে সেটি যেন এখনো উপেক্ষিত। বরং এই সরকারের কিছু পদক্ষেপ ব্যবসায়ী, শিল্পপতি, বিনিয়োগকারীদের উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। বেসরকারি খাত হয়ে পড়েছে উদ্যমহীন, হতাশ, আতঙ্কিত।

অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর গত ছয় মাসে দেশের অর্থনীতির তেমন অগ্রগতি কারো চোখে পড়েনি। অতীতের দুর্নীতির অনুসন্ধানের পাশাপাশি আগামী কর্মপরিকল্পনা এবং ব্যবসায়ীদের আস্থায় নিয়ে বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টিতে আয়োজন নেই সরকারের। আমাদের বৈদেশিক মুদ্রা, রিজার্ভ এখন পুরোপুরি রেমিট্যান্স নির্ভর। প্রবাসীরা যে রেমিট্যান্স পাঠাচ্ছেন সেটিই অর্থনীতির একমাত্র সুখবর। কিন্তু অর্থনৈতিক সম্পর্কে ন্যূনতম যাঁদের জ্ঞান আছে, তাঁরা জানেন, এভাবে একটি দেশের অর্থনীতি চলতে পারে না। গত ছয় মাসে ব্যবসা-বাণিজ্যের অবস্থা শোচনীয়। কোনো শিল্পোদ্যোক্তা নতুন বিনিয়োগে আগ্রহী হচ্ছেন না, সাহস পাচ্ছেন না। বাস্তবতা হলো, এ রকম অস্থির পরিস্থিতিতে কোনো ব্যবসায়ী নতুন কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করতে চান না। গত ছয় মাসে শত শত শিল্প-কারখানা বন্ধ হয়েছে। কয়েক লাখ শ্রমিক চাকরিচ্যুত হয়েছে। ৫ আগস্টের পর বিভিন্ন শিল্প-কারখানায় সন্ত্রাসী তাণ্ডব হয়েছে, হামলা হয়েছে। এই কারখানাগুলো এখন পর্যন্ত ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। ব্যাংকিং খাতের অবস্থা খুবই নাজুক। কয়েকটি ব্যাংককে টাকা ছাপিয়ে তারল্য সরবরাহ করা হলেও সেই ব্যাংকগুলো ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। যে পরিমাণ সুদের হার নির্ধারণ করা হয়েছে তা দিয়ে আর যাই হোক ব্যবসা-বাণিজ্য করা যায় না। ব্যাংকগুলোতে এখনো ডলারের সংকট তীব্র। ফলে আমদানিতে ব্যাপক সংকট দেখা দিচ্ছে। আমদানি সংকটের প্রভাব পড়েছে রপ্তানিতেও। সরকার ব্যবসায়ীদের আস্থায় নিতে পারেনি এখনো। শিল্প-কারখানা বন্ধ, শিল্পবান্ধব পরিবেশের অভাব, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে উৎপাদনও ব্যাহত হচ্ছে। গ্যাস, বিদ্যুৎ সংকট চালু কারখানাগুলোকেও কঠিন সংকটে ফেলেছে। এর মধ্যে বিভিন্ন স্বার্থান্বেষী মহল সরকারকে ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে রীতিমতো যুদ্ধের জন্য উসকানি দিচ্ছে। বিভিন্ন ব্যবসায়ী শিল্প গ্রুপকে নানাভাবে হয়রানি করা হচ্ছে। অনেক শিল্পপ্রতিষ্ঠানের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দ করা হচ্ছে। আওয়ামী লীগের দালাল তকমা দিয়ে স্বাভাবিক ব্যবসা কার্যক্রমে বাধা সৃষ্টি করা হচ্ছে। ব্যবসায়ীরা কোন পরিস্থিতিতে, কিভাবে বাধ্য হয়ে স্বৈরাচারী সরকারের কাছে আনুগত্য প্রকাশ করেছিল, তা কারো অজানা নয়। এ জন্য তাঁদের দায়ী করাটাও অযৌক্তিক। মনে রাখতে হবে, প্রকৃত শিল্পোদ্যোক্তা, ব্যবসায়ীরা কোনো দলের নয়, দেশের দালাল। তাঁরা যা করেন তা দেশের স্বার্থেই করেন। অথচ এখন এমন একটি প্রতিকূল পরিস্থিতি তৈরি করা হচ্ছে, যেখানে তাঁরা ব্যবসা বন্ধ করে হাত-পা গুটিয়ে থাকতে বাধ্য হচ্ছেন। এ রকম অবস্থা দেশের অর্থনীতির জন্য অশনিসংকেত। বিদ্যুত্সংকট আস্তে আস্তে দানা বেঁধে উঠছে। আগামী গ্রীষ্ম মৌসুমে বিদ্যুৎ সংকট প্রবল হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। গ্যাসসংকটের কারণে অনেক শিল্প-কারখানা প্রচণ্ড সংকটে। এ ক্ষেত্রেও সরকার যথাযথ ভূমিকা পালন করতে পারছে না। এসব বিষয়কে এখনই সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে। যেকোনো দেশের অর্থনীতির গতিপ্রবাহ নির্ভর করে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির ওপর। যদি আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভালো না থাকে, তাহলে অর্থনীতিতে গতি আনা অসম্ভব ব্যাপার। গত সাড়ে ছয় মাসে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির তেমন কোনো উন্নতি হয়নি। নিয়ন্ত্রণহীন সন্ত্রাস শিল্পাঞ্চলে রীতিমতো আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে। এ রকম পরিস্থিতিতে অর্থনীতির জন্য কোনো ইতিবাচক সংকেত নেই, পূর্বাভাসও নেই। অর্থনীতির দিকে রাজনৈতিক দলগুলোর মনোযোগ কম, বরং অর্থনীতির চেয়ে রাজনৈতিক বিষয়ে তাদের আগ্রহ এবং মনোযোগ বেশি। কোন নির্বাচন আগে, কোনটা পরে ইত্যাদি নানা টানাপড়েনের মধ্যে তারা নিজেদের ব্যস্ত রাখছে। কিন্তু একটি কথা ভুলে গেলে চলবে না, দেশের অর্থনীতি যদি মুখ থুবড়ে পড়ে, অর্থনীতি যদি স্থবির হয়ে যায়, তাহলে জনগণকে স্বস্তি দেওয়া যাবে না। মানুষের মধ্যে নানারকম অসন্তোষ দানা বেঁধে উঠবে। এটি শেষ পর্যন্ত গণতন্ত্রকেই আঘাত করবে। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য আগে অর্থনীতি পুনরুদ্ধার প্রয়োজন।

অন্তর্বর্তী সরকার অনেক বিষয় সংস্কার করেছে। কিন্তু অর্থনীতিকে পুনরুদ্ধারের জন্য এখন পর্যন্ত সুনির্দিষ্ট কোনো উদ্যোগ নেই। ব্যবসায়ীদের আস্থায় নিয়ে সবার সঙ্গে বৈঠক করে একটি ঐক্যবদ্ধ অর্থনৈতিক উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণের কোনো উদ্যোগ দৃশ্যমান নয়।

নানা রকম সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও স্বাধীনতার ৫৩ বছরে বাংলাদেশ যে অভূতপূর্ব অর্থনৈতিক উন্নতি করছে, তার পেছনে প্রধান কারণ হলো বেসরকারি খাত। বেসরকারি খাতের বিনিয়োগকারীরা তাঁদের শ্রম, মেধা এবং উদ্ভাবনী সৃজনশীলতা দিয়ে নিত্যনতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করেছেন, শিল্প-কারখানার বিকাশ ঘটিয়েছেন এবং বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক বাস্তবতা হলো, বাংলাদেশে কখনোই ব্যবসায়ীদের দেশ গড়ার কারিগর হিসেবে বিবেচনা করা হয়নি। সব সময় ব্যবসায়ীদের একটি নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে চিহ্নিত করার এক ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত প্রয়াস লক্ষ করা যাচ্ছে। একজন ব্যবসায়ী তিনি কোনো দল-মতের নন, তিনি বাংলাদেশের, তিনি একজন শিল্পোদ্যোক্তা। তাঁর শিল্প উদ্যোগের মাধ্যমে দেশে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ঘটে, বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হয়। খুব কমসংখ্যক ব্যবসায়ী আছেন, যাঁরা লুটেরা, যাঁরা অর্থ পাচার করেন এবং ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে লোপাট করেন। এঁরা মূলত রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়ায় থাকেন। যেসব ব্যবসায়ী শিল্প উদ্যোগে মনোযোগী, শিল্প উদ্যোগে আগ্রহী, তাঁরা নির্বিঘ্নে নির্ভয়ে ব্যবসা করতে চান। কিন্তু বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতা হলো, ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলগুলো ব্যবসায়ীদের কুক্ষিগত করতে চায়, তাঁদের ব্যবহার করতে চায়। যতক্ষণ পর্যন্ত ব্যবসায়ীরা তাদের আনুগত্য স্বীকার না করে, ততক্ষণ পর্যন্ত তাঁদের নানা রকম রাজনৈতিক বাধার মুখে পড়তে হয়। এ কারণেই অনেক ব্যবসায়ী বাধ্য হয়ে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন সরকারি অনুষ্ঠানে যোগ দেন। কারণ, এটি শুধু তাঁদের স্বার্থের বিষয় নয়, এর সঙ্গে লাখ লাখ উৎপাদন কর্মী, শ্রমিকের স্বার্থ জড়িত। কিন্তু অনেকেই এই বাস্তবতা উপলব্ধি করেন না। কোনো ব্যবসায়ী কোনো বিশেষ রাজনৈতিক দলের সমর্থক থাকতেই পারেন, সেটি ভিন্ন বিষয়। কিন্তু যেসব ব্যবসায়ী কোনো রাজনৈতিক দল করেন না বা কোনো রাজনৈতিক চিন্তা-ভাবনাকে লালন করেন না, তাঁরা বিভিন্ন সময় সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হন শুধু দেশের স্বার্থে। দেশের উন্নয়ন এবং উৎপাদন বৃদ্ধির স্বার্থে। কাজেই যেকোনো সরকার পরিবর্তনের পর একটা দলীয় তকমা ব্যবসায়ীদের লাগিয়ে দেওয়াটা সঠিক নয়। এর ফলে একটা নেতিবাচক বার্তা যায়। ব্যবসায়ীরা উদ্যম হারিয়ে ফেলেন। এ দেশে যেমন রাজনীতিবিদদের অবদান আছে, তাঁরা গণতন্ত্রকে সুসংহত করেন, তেমনি শিল্পোদ্যোক্তা এবং ব্যবসায়ীরা ছাড়া দেশের অর্থনীতিকে সচল রাখা অসম্ভব ব্যাপার। আর সে কারণেই অতীতে কে কী করেছেন তার পেছনে না ছুটে বর্তমানে একজন শিল্পোদ্যোক্তা, ব্যবসায়ী কিভাবে দেশকে এগিয়ে নেবেন, তাঁর ভাবনাকে গ্রহণ করা উচিত। সারা দেশে একটি ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ তৈরি করা হলো বর্তমান সরকারের প্রধান দায়িত্ব। সাড়ে ১৫ বছর আওয়ামী লীগ কিভাবে ব্যবসায়ীদের জিম্মি করেছে, কিভাবে ব্যবসায়ীদের আনুগত্যে বাধ্য করেছে তা সবাই জানে। আর সে কারণেই আমলাদের অনেককে সরকারের আনুগত্য স্বীকার করতে হয়েছে, যে কারণে রাজনৈতিক দলগুলোকে স্বৈরাচারী শাসনব্যবস্থার বাস্তবতাকে হজম করতে হয়েছে, ঠিক সেভাবেই ব্যবসায়ীরাও শুধু দেশের স্বার্থে এবং কর্মসংস্থানের জন্য লাখ লাখ কর্মীর মুখের দিকে তাকিয়ে মুখ বুজে অন্যায় সহ্য করেছেন। এ জন্য কোনোভাবেই একজন ব্যবসায়ীকে দোষী করা যায় না।

এখন দেশে রাষ্ট্র সংস্কার চলছে। নানা বিষয়ে সংস্কার প্রস্তাব দেওয়া হচ্ছে। আমার মনে হয়, এসব সংস্কার প্রস্তাবে বেসরকারি খাতের সঙ্গে সরকারের সম্পর্ক বিষয়ে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা থাকা দরকার। ভবিষ্যতে যারাই ক্ষমতায় আসবে তারা ব্যবসায়ীদের জিম্মি করবে না। সরকারের আনুগত্য, দেনদরবার, ঘুষ ছাড়া শিল্প উদ্যোক্তারা, ব্যবসায়ীরা তাঁদের কাজ যেন এগিয়ে নিতে পারেন, সে ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট প্রতিশ্রুতি এবং অঙ্গীকার থাকতে হবে। ব্যাংকঋণ, গ্যাসলাইন, বিদ্যুৎ সংযোগ পেতে সরকারের কাছে ধরনা দিতে হবে না। মন্ত্রী-এমপিদের কাছে তদবির করতে হবে না। রাজনৈতিক কর্মসূচিতে ব্যবসায়ীদের যোগ দিতে বাধ্য করা যাবে না। সবচেয়ে বড় কথা, রাষ্ট্র সংস্কারের জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের উচিত হবে দেশের প্রতিষ্ঠিত শিল্প গ্রুপ ও ব্যবসায়ীদের সঙ্গেও বৈঠক করা। দলীয় সরকারগুলো অতীতে তাঁদের কিভাবে ব্যবহার করেছে তা শোনা এবং এর প্রতিকারের ব্যবস্থা নেওয়া। ব্যবসায়ী, উদ্যোক্তাদের রাজনৈতিক ডামাডোল এবং বিতর্কের বাইরে রাখতে হবে। যেন সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে তাঁরা হয়রানির শিকার না হন। মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশের অর্থনীতির হৃিপণ্ড বেসরকারি খাত। বেসরকারি খাত না বাঁচলে গণতন্ত্র বাঁচবে না, রাষ্ট্র পড়বে অস্বিত্বের সংকটে।

 

লেখক : নাট্যকার ও কলাম লেখক

ইমেইল : auditekarim@gmail.com

 

মন্তব্য

নারী ফুটবলে বিভাজন কাম্য নয়

    ইকরামউজ্জমান
শেয়ার
নারী ফুটবলে বিভাজন কাম্য নয়

দেশে নারী ফুটবল আমাদের হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে নারী ফুটবলে যে সমস্যা ও জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে, এটি কোনোমতেই গ্রহণযোগ্য নয়। সুস্থ খেলার চর্চা ও বিকাশের ক্ষেত্রে ব্যক্তি ও সমষ্টির স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় এবং তাদের অযৌক্তিক কথাবার্তা, প্ররোচনা, নেতিবাচক চিন্তা ও মানসিকতা সুস্থ জীবনবোধসম্পন্ন ক্রীড়াপিপাসু মানুষ প্রত্যাশা করে না। খেলা যেখানে দেশের জন্য, সেখানে কেন শুনতে হবে দেখা যাক তারা কতটুকু খেলতে পারে’—এটি তো ক্রীড়াসুলভ মনোভাবের পরিচয় নয়।

যাঁরা বলেছেন, তাঁরা তো এই ফুটবলেই অসাধারণ অবদান রেখেছেন। পতাকার সম্মানের জন্য সব সামর্থ্য উজাড় করে দিয়ে মাঠে প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত লড়েছেন একসময়। যত সময় গড়িয়েছে, ততই পরিষ্কার হয়েছে কার বা কাদের কোন স্বার্থ রক্ষা, দাবি আদায় ও তথাকথিত আদর্শ এবং প্ররোচনার শিকার হলেন একসঙ্গে ১৮ জন নারী ফুটবলার। দেশের ফুটবলের অভিভাবকের কাছে তাদের সিদ্ধান্তের বিরোধিতা (ব্রিটিশ কোচ নিয়োগ দুই বছরের জন্য) করে ইংরেজিতে কড়া চিঠি লিখলেই ফুটবল ফেডারেশন মাথা নুইয়ে ফেলবে ভাবার সুযোগ নেই।
অভিভাবক সংস্থা হিসেবে ফেডারেশন নারী ফুটবলের জন্য যা করার, সেটি অবশ্যই করবে। কেননা নির্বাচিত ফেডারেশন হিসেবে তাদের দায় এবং জবাবদিহি আছে। ইগো সমস্যা এবং ব্যক্তিস্বার্থ থেকে দেশের ফুটবল অনেক বড়। 

মিডিয়ায় লক্ষ করেছি, নারী ফুটবলারদের অতি মূল্যায়নের পাশাপাশি অবমূল্যায়ন।

একটি বাংলা দৈনিক লিখেছে, মিডিয়া এখনো পাবলিক খাওয়ানো সংস্কৃতি থেকে বের হতে পারেনি। অতি উৎসাহ দেখানো, বাড়াবাড়ি, পাশাপাশি অযৌক্তিক অনেক কিছু বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে টেনে এনে স্টোরি প্রকাশ কিন্তু সমস্যার সমাধান নয়, এতে আশা পূরণ হয় না, বরং সমস্যা আরো বাড়ে। এ ক্ষেত্রে নারী ফুটবলারদের কারো কারো পায়ের নিচে মাটি নরম হয়েছে। কেননা কাউকে তো নিয়ম-নীতি এবং শৃঙ্খলা ভঙ্গ করার মতো কার্যকলাপে লিপ্ত হওয়ার লাইসেন্স দেওয়া হয়নি।

ফুটবল ফেডারেশনের সভাপতি, সিনিয়র সহসভাপতি, চারজন সহসভাপতি এবং নারী উইংয়ের দায়িত্বে চেয়ারম্যানকে উদ্ধৃত করে প্রায় তিন সপ্তাহ ধরে প্রকাশিত খবরগুলো নিয়ে কথা উঠেছে।

তাঁরা কে কী বলেছেন, আর কে কী বলেননিএগুলো নিয়ে আলোচনা অর্থহীন।

একজন ফুটবলার যদি ফিট থাকেন, তাহলে তিনি অনেক দিন পরও মাঠে নেমে ফিটনেস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারেন। এখনো সামর্থ্য আছে, এটি প্রমাণ করতে পারেনসর্বোপরি দলের জন্য তাঁকে প্রয়োজন আছে, এটি প্রমাণ করতে পারেনতাহলে তো কোনো সমস্যা হওয়ার কথা নয়। 

নারী ফুটবলে বিভাজন কাম্য নয়ফুটবল ফেডারেশন কেন দুই বছরের জন্য ব্রিটিশ কোচ পিটার বাটলারকে তাঁদের কোচ হিসেবে নিয়োগ দিলএর প্রতিবাদে অধিনায়ক সাবিনা খাতুনের নেতৃত্বে ১৮ জন নারী ফুটবলার একজোট হয়ে খেলা থেকে বিরত থেকেছেন। ফুটবল ফেডারেশনকে ইংরেজিতে লেখা প্রতিবাদ চিঠি দিয়েছেন। জানিয়ে দিয়েছেন, এই ব্রিটিশ কোচের অধীনে তাঁরা আর কখনো মাঠে নামবেন না। ফুটবল ফেডারেশন একটি প্রতিষ্ঠান। দেশের ফুটবলের নির্বাচিত অভিভাবক। তারা নারী ফুটবলের বৃহত্তর স্বার্থে এবং নির্দিষ্ট লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্যই পেশাদার অভিজ্ঞ কোচ নিয়োগ দিয়েছে।

এশিয়া ফুটবল কনফেডারেশনের মানচিত্রে যতগুলো দেশের স্থান আছে, গত ২৩ বছরের মধ্যে কোনো দেশের নারী ফুটবলাররা এভাবে কোচ নিয়োগের জন্য প্রকাশ্যে বিদ্রোহ করে খেলা থেকে বিরত থাকার হুমকি দেননি। ফুটবল ফেডারেশন একটি প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠানকে জিম্মি করার অধিকার কর্মকর্তা, খেলোয়াড়, কোচ কারো নেই। কারো অধিকার নেই ব্যক্তি এবং সমষ্টির বিভিন্ন স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য পানি ঘোলা করে মাছ শিকারের চেষ্টা করার। ক্রীড়াঙ্গনের বিষয়ে মানুষ এখন অনেক সচেতন। তাদের চিন্তাশক্তির পরিধি বেড়েছে। তারা সাদা-কালোর পার্থক্য বোঝে। কারো অধিকার নেই খেলার চত্বরকে অশান্ত এবং খেলার ভবিষ্যৎ নিয়ে ছিনিমিনি খেলার। আবেগ আর মতলবে তো ক্রীড়াঙ্গন চলে না।

দেশের ক্রীড়াঙ্গনে ব্যবস্থাপনা ও পরিষেবা ভীষণ দুর্বল এবং পেশাদারি খেলোয়াড় নিয়ে সময় অনুযায়ী প্রয়োজনীয় কাজ করা হয় না। সব কিছু হালকাভাবে নেওয়া হয় বিভিন্ন বিষয় চিন্তা-ভাবনা না করেআর এর পরিণতি যে কত খারাপ হয়, পরিবেশ অশান্ত হয়ে ওঠে, তার প্রমাণ হলো সাবিনা ও ঋতুপর্ণার নেতৃত্বে খেলোয়াড়দের বিদ্রোহ। তাঁরা প্রকাশ্যে এ ধরনের হুমকি দিতে পারেন না। তাঁরা ফেডারেশনের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ। তাবিথ আউয়ালের নেতৃত্বে ফুটবল ফেডারেশন ভেবেছে, মেয়েরা ভুল করেছে, তারা আবেগের বশবর্তী হয়ে শৃঙ্খলাহীন কাজে নিজেদের জড়িয়ে ফেলেছে। নারী ফুটবলারদের বিষয়ে বিভিন্ন কারণে ফেডারেশন প্রথম থেকেই নমনীয় উদ্যোগ নিয়েছে। ভেবেছে, মেয়েরা তাদের ভুল বুঝতে পেরে আবার মাঠে ঠিকই ফিরে আসবে।

কথা হলো, অক্টোবর থেকে যে সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে, তুষের আগুন ধীরে ধীরে জ্বলছেএই আগুন নেভানোর উদ্যোগ শুরু থেকে কেন নেওয়া হয়নি? নারী ফুটবলারদের নিয়ে যেভাবে বসা উচিত ছিল, কেন সেভাবে বসা হয়নি। সাফ বিজয়ের পর ফুটবল ফেডারেশনের নবনির্বাচিত গভর্নিং বডির দুটি সভা অনুষ্ঠিত হয়েছেসেখানে কেন এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি আলোচনায় উঠে আসেনি। এদিকে একটি বাংলা দৈনিকে বলা হয়েছে, নারী উইং নাকি কোচ বাটলারের চুক্তি নবায়নের পক্ষে ছিল না। নারী উইং এই কোচের নিয়োগ চায় না। যেহেতু অশান্তি সৃষ্টি হয়েছে, তাই বাটলারকে কোচ হিসেবে নিয়োগ দেওয়া উচিত নয়। নারী উইং থেকে বলা হয়েছে, এর পরও কোচ নিয়োগ দেওয়া হয়েছে ইমার্জেন্সি কমিটির মাধ্যমে। সেখানে সভাপতি, সিনিয়র সহসভাপতি ও সহসভাপতিরা ছিলেন। নারী উইংয়ের চেয়ারম্যানের কি কথা বলার সুযোগ ছিল না?

এতে মনে হওয়া স্বাভাবিক যে নবনির্বাচিত ফুটবল ফেডারেশনে অল্প সময়ের মধ্যে অনৈক্যের বাঁশি বাজতে শুরু করেছে ঠিক অতীতের মতো। একে অপরের দিকে আঙুল তুলতে শুরু করেছেন। স্ববিরোধিতা এবং বিভাজন কাম্য নয়। নারী উইং থেকে গত ১৬ ফেব্রুয়ারি জানানো হয়েছে, নারী ফুটবলাররা ছুটি কাটিয়ে আসার পর কোচ পিটার বাটলারের অধীনে অনুশীলনে ফিরবেন। বলা হয়নি যে এ ক্ষেত্রে কিছু প্রক্রিয়া আছে। 

এদিকে খুব স্বাভাবিকভাবেই ২৬ ফেব্রুয়ারি ও ২ মার্চ অনুষ্ঠেয় আরব আমিরাতের বিপক্ষে দুটি প্রীতি ম্যাচের জন্য স্কোয়াড ঘোষণা করা হয়েছে। এখানে যাঁরা অনুশীলনে ছিলেন না, বিদ্রোহ করেছেন, তাঁদের বাদ দিয়েই পুরনো এবং নতুন খেলোয়াড় নিয়ে স্কোয়াড ঘোষণা করেছেন কোচ। এটি অবশ্যই স্কোয়াডের খেলোয়াড়দের জন্য চ্যালেঞ্জ এবং নিজেদের তুলে ধরার একটি সুযোগ।

বাফুফে নারী ফুটবল নিয়ে সমস্যা সৃষ্টি হওয়ায় ফুটবল ফেডারেশনের সিনিয়র সহসভাপতি মো. ইমরুল হাসানের নেতৃত্বে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছেসেই কমিটি সময়মতো কিছু সুপারিশসহ রিপোর্ট জমা দিয়েছে। বাফুফের সভাপতি সেটি পর্যালোচনা করেছেন। নারী ফুটবলারদের অসাধারণ অবদান সবাই স্বীকার করেন গর্বের সঙ্গে। তবে একটি বিষয় মনে রাখতে হবে, পারফরম্যান্সের দোহাই দিয়ে কিন্তু শৃঙ্খলাবহির্ভূত আচরণ এবং ফুটবলকে বিপদে ফেলার অধিকার কারো নেই। ব্যক্তি বা সমষ্টির জন্য কিন্তু কোনো কিছুই আটকে থাকে না। আর কেউ সব সময় অপরিহার্য নয়। ক্রীড়াঙ্গন মনে করে, এখানে পারফরম্যান্সের জয়গান সব সময় বাজে।

লেখক : কলামিস্ট ও বিশ্লেষক। সাবেক সিনিয়র সহসভাপতি, এআইপিএস এশিয়া। আজীবন সদস্য, বাংলাদেশ স্পোর্টস প্রেস অ্যাসোসিয়েশন প্যানেল রাইটার, ফুটবল এশিয়া

 

মন্তব্য

রমজানে দ্রব্যমূল্য স্থিতিশীল রাখতে হবে

    ড. নিয়াজ আহম্মেদ
শেয়ার
রমজানে দ্রব্যমূল্য স্থিতিশীল রাখতে হবে

প্রতিবছর রমজান সামনে রেখে নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে যায়। এ সময়ে কিছু পণ্যের চাহিদাও বেড়ে যায়। বাড়তি চাহিদা মেটানোর জন্য বাড়তি আমদানিও করা হয় এবং রমজানের বেশ আগে থেকেই এই কাজটি করা হয়ে থাকে। কিন্তু তার পরও বাড়তি চাহিদার নাম করে পণ্যমূল্য বৃদ্ধি করা যেন আমাদের সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে।

ছোলা, খেজুর, ফলমূলসহ কিছু পণ্যের চাহিদা বেশি থাকে। সরকারের পক্ষ থেকে রমজানে মানুষের কষ্ট লাঘবের জন্য বহুবিধ পদক্ষেপও গ্রহণ করা হয়, কিন্তু কাঙ্ক্ষিত ফল পাওয়া যায় না। যেখানে বিশ্বের সব দেশে রমজানের সময় পণ্যমূল্য রোজাদারদের কথা মাথায় রেখে কমানো হয়, সেখানে আমাদের দেশ ব্যতিক্রম। ব্যবসায়ীরা যেন এক মাস মুনাফা করে বছরের বাকি সময়টা বসে বসে খেতে চান।
এ বছরের রমজানে শীতের সবজি বাজারে থাকবে বলে সবজির দাম বেশ কম হবে, কিন্তু রমজানে সবজি বড় অনুষঙ্গ নয়। রোজাদাররা একটু মুখরোচক খাবার খেতে পছন্দ করেন, কিন্তু সেসব খাবারের দাম কমে না। প্রতিবছর সরকারের পক্ষ থেকে নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য খাদ্যপণ্যে ভর্তুকি এবং বিনা মূল্যে খাদ্যপণ্য দেওয়া হয়। এরই ধারাবাহিকতায় এ বছর ৩০ টাকা কেজি দরে চাল পাবে ৫০ লাখ পরিবার।
ঈদের সময় এক কোটি পরিবারকে বিনা মূল্যে ১০ কেজি করে চাল দেওয়া হবে। আমরা নিশ্চিত, আমাদের স্বল্প আয়ের মানুষ এর দ্বারা উপকৃত হবে। এ ছাড়া ২৫টি স্থানে সুলভ মূল্যে দুধ, ডিম ও মাংস বিক্রি করা হবে, কিন্তু আমাদের প্রয়োজনের তুলনায় তা অনেক কম। আমাদের জীবনযাত্রার মানের বিবেচনায় এখন নিম্ন আয়ের মানুষের পাশাপাশি মধ্যবিত্তের কথাও মাথায় রাখতে হবে। কেননা মধ্যবিত্ত এখন সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছে।
তারা না পারছে নিজেদের সামলাতে, আবার তাদের জন্য বিশেষ কোনো ব্যবস্থা না থাকায় বিশেষ কোনো সুবিধাও পাচ্ছে না। এখন সময় এসেছে তাদের জন্যও কিছু করার।

https://asset.kalerkantho.com/public/news_images/share/photo/shares/1.Print/2025/02.February/23-02-2025/2/kalerkantho-ed-1a.jpgঅন্যান্য সময়ের তুলনায় আমরা রমজানে বাজার মনিটরিংয়ের ওপর বেশি জোর দিই। কেননা আমরা নিশ্চিত হই যে এ সময়ে জিনিসপত্রের দাম বাড়ানো হয়। ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে প্রতি রমজানেই বলা হয়, পর্যাপ্ত মজুদ রয়েছে, কোনো জিনিসের দাম বাড়বে না। এমনকি সরকারের পক্ষ থেকে পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে শুল্কছাড়ও দেওয়া হয়, কিন্তু সুফল বেশ কম পাওয়া যায়। নতুন একটি সরকার এবং নতুন এক পরিবেশে আমরা এ বছর ভিন্ন কিছু আশা করি। আমরা বৈষম্যহীন ছাত্রসমাজের কাছ থেকে উদ্যোগ আশা করি। আমরা দেখেছি, ৫ আগস্টের পর বেশ কয়েক দিন জিনিসপত্রের দাম নিয়ন্ত্রণে ছিল। এখন আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর পাশাপাশি তাদের কাছ থেকেও আমরা গঠনমূলক উদ্যোগ আশা করতে পারি। বাজার মনিটরিং কাজটি সার্বক্ষণিক হওয়া দরকার। কেননা একটি নির্দিষ্ট সময়ে মনিটরিং করলে বাকি সময় আগের অবস্থা বিরাজ করে। এর জন্য প্রয়োজন জনবলের। বিভিন্ন ব্যক্তির সমন্বয়ে যৌথ উদ্যোগ গ্রহণ করা যেতে পারে। শুধু আইন বাস্তবায়নে যুক্ত ব্যক্তিবর্গ দিয়ে কাজ হয় না। স্থানীয় ব্যক্তিবর্গ নিয়ে প্রতিটি এলাকায় কমিটি করা যেতে পারে, যারা সরকারকে সহায়তা করবে।

ব্যবসায়ীদের নৈতিকতা ভালো হলে কোনো সমস্যা দেখা যেত না। এমনিতেই জিনিসপত্রের দাম কম হতো। ব্যবসায়ীরা কম মুনাফা করলে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা স্বাভাবিক থাকত। কাজেই আমরা যদি কঠোর মনিটরিং ও নজরদারি করতে পারি, তাহলে তাঁদের কম মুনাফা করতে বাধ্য করতে পারি। অর্থনীতির ভাষ্য মতে, একমাত্র জোগান কমলে এবং চাহিদা বাড়লে দাম বাড়ার আশঙ্কা থাকে। কিন্তু আমরা দেখি রমজানের সময় বাজারে পণ্যের কোনো ঘাটতি থাকে না। তার পরও দাম বাড়ানো হয়। কাজেই কঠোর বাজার মনিটরিং এবং নজরদারিই একমাত্র পথ। যেসব ব্যবসায়ী এমন অনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকবেন, তাঁদের জরিমানাসহ অন্যান্য শাস্তির আওতায় আনতে হবে। সময় এসেছে মধ্যবিত্তদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করা। আমরা রমজান সামনে রেখে ক্যাটাগরি অনুযায়ী ভর্তুকির ব্যবস্থা করতে পারি। যেমনহতদরিদ্র ও দরিদ্রদের জন্য বিনা মূল্যে কিংবা নামমাত্র মূল্যে খাদ্যপণ্য সরবরাহ করা। মধ্যবিত্তদের জন্যও আরেকটু কম দামে খাদ্যপণ্য সরবরাহ করা যেতে পারে। কেননা দেশের অর্থনীতি নিম্নমুখী এবং মুদ্রাস্ফীতি বেড়ে গেলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ। তাদের আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যায়। তখন স্বাভাবিক জীবনযাত্রা বজায় রাখা কঠিন হয়ে পড়ে।

আমাদের লক্ষ্য শুধু রমজান সামনে রেখেই নয়, সার্বিকভাবে পণ্যমূল্য দেশের মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখার চেষ্টা করতে হবে। পাশাপাশি পর্যাপ্ত কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। পরিবর্তিত পরিস্থিতি এবং বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে আমাদের প্রত্যাশা থাকবে কঠোর নজরদারির মাধ্যমে বাজার নিয়ন্ত্রণ করা। অতীতের মতো রমজানকে কেন্দ্র করে পণ্যদ্রব্য সরবরাহ ও মূল্যবৃদ্ধির কোনো খবর পত্রিকায় শিরোনাম হিসেবে আমরা আর দেখতে চাই না। ধর্মপ্রাণ মানুষ যেন স্বস্তিতে রোজা রাখতে পারে, আমরা এমন প্রত্যাশা করছি। আমরা আশা করি, সরকারের প্রচেষ্টায় এবারের রমজান এবং রমজান-পরবর্তী ঈদ সবার জন্য আনন্দদায়ক হবে। সিয়াম সাধনার মাস রমজানকে আমরা স্বাগত জানাই।

      লেখক : অধ্যাপক, সমাজকর্ম বিভাগ শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

neazahmed_2002@yahoo.com

মন্তব্য

তিস্তা প্রকল্প ও আমাদের জাতীয় ঐকমত্য

    গাজীউল হাসান খান
শেয়ার
তিস্তা প্রকল্প ও আমাদের জাতীয় ঐকমত্য

বহুমুখী তিস্তা সমস্যা সমাধানে সাবেক আওয়ামী লীগ এবং প্রতিবেশী ভারত সরকারের দীর্ঘসূত্রতা ও বিভিন্ন টানাপড়েনের কারণে দীর্ঘদিন ধরে ঝুলে রয়েছে এই বিস্ফোরণোন্মুখ ইস্যুটি। এই বিষয়টি নিয়ে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারও কোনো ত্বরিত সিদ্ধান্ত দিতে পারছে না। এ ব্যাপারে দেশের নদী বিশেষজ্ঞ কিংবা গবেষকরাও সরকার কী চায় সে সম্পর্কে কোনো পরিষ্কার সিদ্ধান্ত বা দিকনির্দেশ পাচ্ছেন না। ফলে দুই দেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত অভিন্ন নদী তিস্তার পানিবণ্টন এবং উত্তরবঙ্গের পরিবেশ রক্ষার জরুরি বিষয়টি নিয়ে সম্প্রতি এ অঞ্চলের ভুক্তভোগী পাঁচটি জেলার মানুষ তিস্তাকেন্দ্রিক এক গণ-আন্দোলন শুরু করেছে।

সোচ্চার হয়ে উঠেছে দেশের সর্ববৃহৎ গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল বিএনপি। তিস্তায় ভারতের আচরণ অন্যায্য বলে উল্লেখ করেছেন দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। তিনি তাঁর বাবা শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের মতো এই সমস্যার সমাধান খুঁজে পেতে জাতিসংঘে যেতে আগ্রহী বলে উল্লেখ করেছেন। তা ছাড়া একই সঙ্গে প্রতিবেশী দেশের অসম, অন্যায্য ও একতরফা সব চুক্তি পুনর্মূল্যায়ন বা পুনর্বিবেচনার ঘোষণা দিয়েছেন।

https://asset.kalerkantho.com/public/news_images/share/photo/shares/1.Print/2025/02.February/23-02-2025/2/kalerkantho-ed-1a.jpgগত ১৮ ফেব্রুয়ারি থেকে তিস্তাপারের পাঁচটি জেলার উপদ্রুত মানুষ এ অঞ্চলের ১১টি পয়েন্টে তিস্তা নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা আদায় এবং পরিবেশ বিপর্যয় ঠেকাতে ৪৮ ঘণ্টাব্যাপী আন্দোলনের কর্মসূচি দিয়েছিল। আন্দোলনকারীরা বলেছে, দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত তাদের বিভিন্ন কর্মসূচি অব্যাহত থাকবে। বৃহত্তর রংপুর এলাকার পাঁচটি জেলায় বিএনপির নেতৃত্বে গৃহীত কর্মসূচি পালন উপলক্ষে দলনেতা তারেক রহমান বলেছেন, ভারতের সঙ্গে যে অভিন্ন ৫৪টি নদী, তার ন্যায্য হিস্যা আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী বাংলাদেশের প্রাপ্য। অথচ তিস্তার পানির জন্য বাংলাদেশের মানুষকে আন্দোলন করতে হচ্ছে।

সমস্ত আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে প্রতিবেশী দেশটি উজানে গজলডোবায় বাঁধ নির্মাণ করেছে। বাংলাদেশ-ভারত যৌথ নদী কমিশনকে সম্পূর্ণ অকার্যকর করে রাখা হয়েছে। এ ব্যাপারে আর সময়ক্ষেপণ না করে ১৯৯২ সালের ওয়াটার কনভেনশন এবং ১৯৯৭ সালের জাতিসংঘ পানিপ্রবাহ কনভেনশনে স্বাক্ষর করা আমাদের জন্য জরুরি হয়ে পড়েছে। উত্তরাঞ্চলকে মেরুকরণের হাত থেকে বাঁচাতে তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের কোনো বিকল্প নেই।

তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন কিংবা এ ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করার ব্যাপারে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার কতটুকু এগিয়েছে, সে সম্পর্কে দেশের নদী বিশেষজ্ঞরা ওয়াকিফহাল নন।

মহাপরিকল্পনা প্রণয়নের লক্ষ্য, কর্মসূচি কিংবা একটি কৌশলপত্র তৈরির ব্যাপারে এখনো কেউ কোনো সম্যক ধারণা পেতে সক্ষম হননি। এ ক্ষেত্রে চীন দুই বছর আগে যে কাজ করেছে, তার আর কোনো অগ্রগতি হয়নি। সম্প্রতি ঢাকায় নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন বলেছেন, চূড়ান্তভাবে প্রণীত তিস্তা পরিকল্পনা বাস্তবায়নে চীন প্রস্তুত। তবে এ ব্যাপারে সুস্পষ্ট সিদ্ধান্ত নিতে হবে বাংলাদেশকে। দ্রুত ব্যবস্থা নিলে বাংলাদেশ লাভবান হবে বলে রাষ্ট্রদূত ওয়েন উল্লেখ করেছেন। তা ছাড়া আগামী অক্টোবর-ডিসেম্বরের মধ্যে পাওয়ার চায়না একটি প্রতিবেদন জমা দেবে বাংলাদেশ সরকারের কাছে। বাংলাদেশকে তার নিজের দায়িত্বে একটি স্বাধীন সিদ্ধান্ত নিতে হবে। রাষ্ট্রদূত ওয়েন বলেছেন, তিস্তা প্রকল্প বাস্তবায়নে প্রস্তুত চীন। তাঁরা এ ব্যাপারে দুই বছর অপেক্ষা করেছেন বলেও জানান তিনি। তিস্তাপারের জন্য যে মহাপরিকল্পনা প্রণয়নের চিন্তা-ভাবনা হচ্ছে, তাতে তিস্তার তীর রক্ষা বাঁধ, নদীর প্রয়োজনীয় খননকাজ, সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন এবং বন্দর ও নগর গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত অন্তর্ভুক্ত ছিল। তিস্তায় একটি পরিকল্পিত নৌপথ চালু করতে হলে পরিকল্পিতভাবে খনন করে এর নাব্যতা বা গভীরতা বৃদ্ধি করতে হবে। সে কাজগুলো করার জন্য এখন থেকেই সুদূরপ্রসারী উদ্যোগ প্রয়োজন। এই মহাপরিকল্পনাটি উত্তরাঞ্চলের সার্বিক পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষা এবং এর অর্থনৈতিক উন্নয়নের লক্ষ্যেই প্রণীত হতে হবে। এতে বাংলাদেশের বাইরে থেকে কে কী ভাববে, সেটি আমাদের বিবেচনার বিষয় নয়।

বাংলাদেশ তিস্তাসহ অভিন্ন নদীগুলোর ন্যায্য হিস্যা পাওয়ার ব্যাপারে বিগত ৫০ বছর অপেক্ষা করেছে, যা কোনো সুফল বয়ে আনেনি। সে উল্লেখযোগ্য সময়টিতেও প্রতিবেশী পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য সরকারের দিক থেকে দেখা গেছে বিভিন্ন স্বার্থপরতা এবং কেন্দ্রীয় সরকারের দিক থেকে বিভিন্ন অজুহাত ও গড়িমসি। গত জুলাই-আগস্টের আন্দোলন-পরবর্তী অবস্থায় বাংলাদেশের সংগ্রামী জনগণ সেসব ব্যাপারে আর অহেতুক সময়ক্ষেপণ করতে রাজি নয়। এ ক্ষেত্রে কারো আর কোনো অজুহাত কিংবা স্বার্থপরতা বাংলাদেশের মানুষ মেনে নেবে বলে মনে হচ্ছে না। কারণ বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের মানুষের বর্ষায় প্রবল বন্যা, তিস্তাপারের মানুষের সহায়-সম্বল সব কিছু নিয়ে ভেসে যাওয়া এবং নদীভাঙনের ফলে উদ্বাস্তু হয়ে পড়া আর কোনোভাবেই চলতে দেওয়া যায় না। চলতে দেওয়া যায় না শুষ্ক মৌসুমে তিস্তার পানি বা পানি সেচের অভাবে এক সর্বনাশা মরুকরণ, যাতে কোনো ফসল বা রবিশস্য ফলানো সম্ভব হয় না।

পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর নতজানু পররাষ্ট্রনীতির কারণে বিগত দেড় দশকেরও বেশি সময়ে তিস্তার পানিবণ্টন সমস্যার কোনো সমাধান করতে পারেননি। বারবার ব্যর্থ হয়েছেন তাঁর বলিষ্ঠ নেতৃত্ব কিংবা সিদ্ধান্তহীনতার কারণে। শেখ হাসিনা তিস্তা ইস্যুতে কখনো ঘোড়ার আগে গাড়ি জুড়েছেন নতুবা গাড়ির আগে ঘোড়া জুড়েছেন। এতে তাঁর সমূহ দ্বিধাদ্বন্দ্ব কিংবা রাজনৈতিক দুর্বলতারই বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে, মূল সমস্যা সমাধানের কোনো পথ খুঁজে পাওয়া যায়নি। চীনের সঙ্গে পরামর্শ করে প্রস্তাবিত তিস্তা মহাপ্রকল্পের জন্য একটি কৌশলপত্র প্রণয়নের উদ্যোগ নিলেও সঠিক দিকনির্দেশনার অভাবে বারবার হোঁচট খেয়েছেন শেখ হাসিনা। ভারতের মোদি সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা বা সহায়তার মাধ্যমে বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় বহাল থাকার জন্য শেখ হাসিনা ভারতের কূটচালে বারবার হোঁচট খেয়েছেন। এতে তিনি দিশা হারিয়েছেন তাঁর প্রস্তাবিত তিস্তা প্রকল্পের বাস্তবভিত্তিক কোনো অগ্রগতি বা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে। ভারত প্রস্তাবিত তিস্তা প্রকল্পে চীনের কোনো প্রকৌশলী ও কর্মীর কাজ করার ক্ষেত্রে আপত্তি জানিয়েছে। তাদের আপত্তির মূল কারণ হচ্ছে নিরাপত্তাজনিত। তারা বলেছে, চীনের প্রকৌশলী ও কর্মীরা এ প্রকল্পে কাজ করলে সেটি শিলিগুড়ি করিডরের (চিকেন নেক) নিরাপত্তার জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে। এমন যুক্তি অতীতে আর কখনো শোনা যায়নি। ভারতের সে বাধার মুখে শেখ হাসিনা প্রস্তাবিত তিস্তা প্রকল্পের নির্মাণকাজটি তাদের হাতে (ভারতের) ছেড়ে দেওয়ার চিন্তা-ভাবনা করছিলেন। কিন্তু সে মুহূর্তেই প্রতিবাদমুখর হয়ে ওঠে বাংলাদেশের অনেক ওয়াকিফহাল নাগরিক। তাদের মতে, ভারত শেষ পর্যন্ত এই প্রস্তাবিত প্রকল্প বাস্তবায়িত করতে সক্ষম হবে না। ফলে তারা পরিকল্পিতভাবেই প্রকল্পের কাজটি সম্পূর্ণভাবে ঝুলিয়ে দেবে এবং শেষ পর্যন্ত মোটেও তা বাস্তবায়িত হবে কি না, তাতে ঘোরতর সন্দেহ দেখা দেবে। তা ছাড়া চীন যে প্রযুক্তিতে প্রস্তাবিত তিস্তা প্রকল্পের কাজটি বাস্তবায়িত করবে, সে প্রযুক্তি ভারতের কাছে আছে কি না, সেটিও জানা নেই। এমন একটি পরিস্থিতিতে সম্পূর্ণ প্রকল্পের পরিকল্পনাটি ভারত আবার নতুন করে তার সুবিধা অনুযায়ী প্রণয়ন করতে চাইবে বলে অনেকে ধারণা করে।

ভারতের নিরাপত্তার ব্যাপারে সব সময় একটু বেশিই উদ্বিগ্ন থাকে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং তাঁর নিরাপত্তাবিষয়ক উপদেষ্টা ও প্রতিরক্ষা বিভাগ। বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে অর্থাৎ লালমনিরহাটের পুরনো বিমানবন্দরটি সংস্কার করে বাংলাদেশ বিমান ও বাংলাদেশ এয়ারফোর্সের ব্যবহার উপযোগী একটি পূর্ণাঙ্গ বিমানবন্দর গড়ে তোলার খবরেও তাই বাধা দিয়েছিল ভারত। তাদের ধারণা, এই বিমানবন্দরটি চালু হলে তা ভারতের জন্য নিরাপত্তা হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে। তা ছাড়া চট্টগ্রামের উপকূলে পেকুয়ায় বাংলাদেশের একটি সাবমেরিন ঘাঁটি গড়ে তোলার খবরেও বাধা দিয়েছে ভারত। অথচ শিলিগুড়ি করিডর এবং বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিম সীমান্তের ওপারে ভারত গড়ে তুলেছে এক বিরাট নিরাপত্তাব্যবস্থা। সেখানে ভারত চীনের সম্ভাব্য আক্রমণ এবং এমনকি চিকেন নেককে কেন্দ্র করে বাংলাদেশকে লক্ষ্য করে ভারত স্থাপন করেছে বিভিন্ন রেঞ্জের ক্ষেপণাস্ত্র। বাংলাদেশ সীমান্তের নিকটবর্তী হাসিমারাসহ আসামের সীমান্তসংলগ্ন এলাকায় গড়ে তুলেছে বিভিন্ন ক্ষমতার সেনাঘাঁটি। সেখানে ফ্রান্স থেকে কেনা ভারতের বহুমুখী জঙ্গিবিমান রাফায়েলের একটি বহর ও আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়েছে। বাংলাদেশ তার সার্বভৌম সীমান্তের অতি নিকটবর্তী এলাকায় ভারতের সামরিক বা প্রতিরক্ষা ঘাঁটি গড়ে তোলার বিরুদ্ধে কখনো কোনো কথা বলতে বা প্রতিবাদ করতে পারেনি। অথচ ভারত বাংলাদেশে যেকোনো সামরিক ঘাঁটি গড়ে তোলার উদ্যোগের বিরুদ্ধে কথা বলেছে। আর তা যদি হয় ভারত সীমান্তের কাছকাছি, তাহলে তো কথাই নেই। সেই একই কারণে তারা চীনের তত্ত্বাবধানে প্রস্তাবিত তিস্তা প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রেও বিভিন্ন আশঙ্কা প্রকাশ করেছে এবং চীনকে নিয়ে বিভিন্ন বাধা সৃষ্টির অপপ্রয়াস চালাচ্ছে। পর্যবেক্ষকদের মতে, এগুলো হচ্ছে বাংলাদেশের বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প থেকে চীনকে দূরে রাখার প্রচেষ্টা। এ ক্ষেত্রে তারা শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ সরকারকে বিভিন্ন অজুহাতে ব্যতিব্যস্ত রাখতে পেরেছে, তবে বর্তমানে পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে সেগুলো আর আগের মতো মোটেও কাজ করবে বলে কেউ মনে করে না। কারণ বাংলাদেশের সংগ্রামী ছাত্র-জনতা মনে করে, এখন তাঁবেদারির দিন শেষ। বাংলাদেশে সূচিত হয়েছে কারো কাছে মাথা নত না করার এক নতুন প্রত্যয়।

উপরোল্লিখিত এই সার্বিক পরিস্থিতিতে আগামী অক্টোবর থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে পাওয়ার চায়নার তিস্তা প্রকল্পকে কেন্দ্র করে একটি বিস্তারিত প্রতিবেদন অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে জমা দেওয়ার কথা রয়েছে। বাংলাদেশ সরকার তাদের প্রতিবেদনে উল্লেখিত বিভিন্ন শর্তে একমত হলে চীন সরকার প্রস্তাবিত তিস্তা প্রকল্প বাস্তবায়নে এগোতে পারে নতুবা নয়। বাংলাদেশ তাদের শর্তে রাজি হলে দুই দেশের মধ্যে তিস্তা প্রকল্প বাস্তবায়নের ব্যাপারে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হতে পারে। তবে চুক্তির বিভিন্ন শর্ত নিয়ে দুই দেশের মধ্যে আরো আলাপ-আলোচনা হতে পারে। এই প্রস্তাবিত প্রকল্পের ব্যাপারে চীন সরকারের যথেষ্ট আগ্রহ রয়েছে। তবে বাকিটা নির্ভর করছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ঐক্যবদ্ধ বলিষ্ঠ পদক্ষেপের ওপর। যদি এ ব্যাপারে আমরা একটি শক্তিশালী ঐকমত্যে পৌঁছতে পারি, তবে নিকট ভবিষ্যতে বাংলাদেশে চীনের যথেষ্ট উন্নয়নমূলক বিনিয়োগ প্রস্তাব আসার সম্ভাবনা রয়েছে। অবকাঠামোগত বিনির্মাণ ও উৎপাদনমুখী শিল্প-কারখানা স্থাপনসহ চীনের বহু বিনিয়োগ বাংলাদেশে আসার পথ প্রশস্ত হতে পারে। সামরিক ও বেসামরিক প্রযুক্তির ক্ষেত্রে বিধি-নিষেধের দ্বার অপ্রত্যাশিতভাবে উন্মোচিত হতে পারে। এতে চীন দিনে দিনে বাংলাদেশের আরো ঘনিষ্ঠ উন্নয়ন সহযোগী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে বলে অনেকের বিশ্বাস। তবে আমাদের জাতীয় স্বার্থে এই মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন একটি জাতীয় ঐকমত্যের সুদৃঢ় ভিত্তি প্রতিষ্ঠা করা। আমরা যেন তাতে ব্যর্থ না হই, সেটিই হচ্ছে একমাত্র প্রত্যাশা।

 

লেখক : বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) সাবেক প্রধান সম্পাদক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক

gaziulhkhan@gmail.com

মন্তব্য

সর্বশেষ সংবাদ