<p>একটি হাসপাতালের মানসিক বিভাগে আমার ভিজিটিং কার্ড দিতে গিয়েছিলাম, যাদের কাউন্সেলিং প্রয়োজন তাদের যেন ‘রেফার’ করা হয়। কিন্তু মানসিক ডাক্তারের কথায় আমি হতবাকই হলাম। তিনি বললেন যে ‘আমিই কাউন্সেলিং করি। কারো কাছে আমার ‘রেফার‘ করার প্রয়োজন হয় না।’</p> <p>আরেক দিন একটি স্কুলে গিয়ে প্রচার চালাচ্ছিলাম, যেসব ছাত্রছাত্রী বা শিক্ষকের মানসিক সমস্যার জন্য সাহায্যের দরকার তারা যেন কাউন্সেলিংয়ের জন্য ‘রেফার’ করেন। দুজন শিক্ষক আমাকে মুখের ওপর ফের বলে দিলেন, ‘ছাত্রছাত্রীদের আমরাই কাউন্সেলিং করি।’ এ তো একজন চক্ষু বিশেষজ্ঞ হয়ে দাঁতের যন্ত্রণায় কাতর রোগীর দাঁতের অপারেশন করার শামিল। একজন স্কুল শিক্ষক যদি মানসিক সমস্যার জন্য কাউন্সেলিং করেন (প্রশিক্ষণ ছাড়া), তাহলে ওই রোগী বা ক্লায়েন্ট কি সঠিক মানসিক স্বাস্থ্যসেবা পাবে? তাঁদের কথা শুনে ভাবলাম, সবাই যদি কাউন্সেলিং করেন, তবে যাঁরা কাউন্সেলিংয়ের ওপর পড়াশোনা ও উচ্চতর প্রশিক্ষণ নিয়েছেন তাঁদের কাজ কী হবে!</p> <p>অপ্রিয় হলেও সত্য যে এখনো পর্যন্ত অনেকেরই কাউন্সেলিং সম্পর্কে সঠিক ধারণা নেই। অনেকেই ভাবেন, কাউন্সেলিং হলো পরামর্শ দেওয়া। কিন্তু না, কাউন্সেলিং মোটেও পরামর্শ দেওয়া নয়। কাউন্সেলিংয়ে মূলত একজন মানুষের চিন্তাভাবনা, আবেগ ও আচরণগত বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করা হয়। তাই আমাদের এ লেখার মূল উদ্দেশ্য হলো কাউন্সেলিং সম্পর্কে সঠিক ধারণা দেওয়া।</p> <p>কাউন্সেলিং প্রক্রিয়াটি শুরু হয়েছিল প্রাচীন সভ্যতার মিসর, মেসোপটেমিয়া (বর্তমানে ইরাক) ও পারস্যে (ইরান)। সেখানকার ধর্মযাজকরা মন্ত্র উচ্চারণের মাধ্যমে মানসিক প্রশান্তি দান করতেন। ঐতিহাসিক পণ্ডিতদের মতে, সমসাময়িক কাউন্সেলরদের আবির্ভাব ঘটে ১৮০০ শতকের পর। তখনকার কাউন্সেলররা মূলত ছিলেন বিদ্যালয়ের শিক্ষক (বিশেষত প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষক), যাঁরা ছাত্রদের শুধু একাডেমিক ফলাফল ছাড়াও তাদের ব্যক্তিগত বিভিন্ন সমস্যা, যেমন আবেগীয় ও আচরণগত সমস্যা, এসব ক্ষেত্রে তাদের সাহায্য করে কাউন্সেলরের ভূমিকা পালন করতেন। আমেরিকার কংগ্রেস ১৯৫৮ সালে ন্যাশনাল ডিফেন্স এডুকেশন অ্যাক্ট (এনডিইএ) চালু করে এবং এর মাধ্যমে স্কুলগুলোতে কাউন্সেলিংয়ের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে।</p> <p>যে ব্যক্তি কাউন্সেলিং দেন, তিনিই কাউন্সেলর। একজন ব্যক্তি কাউন্সেলিং পেশায় সংশ্লিষ্ট হওয়ার জন্য তাঁকে মনোবিজ্ঞানে অনার্স ও কাউন্সেলিং সাইকোলজি কিংবা ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিতে উচ্চতর শিক্ষা অর্থাৎ মাস্টার্স, সেই সঙ্গে দক্ষতা অর্জনের জন্য বিভিন্নভাবে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হতে হয়। আর যে ব্যক্তি কাউন্সেলিং সেবা নেন তাঁকে বলা হয় ক্লায়েন্ট।</p> <p>কাউন্সেলিং এমন একটি প্রক্রিয়া যেখানে একটি পেশাগত সম্পর্ক বিরাজ করে এবং ব্যক্তিগত, দলগত ও পারিবারিক বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করা হয়। ফলে তাদের মধ্যে নিজেদের ও অন্যদের সম্পর্কে এমন একটা স্পষ্ট ধারণা জন্মায় যেটা তাদের দৈনন্দিন জীবনের সমস্যা ও দ্বন্দ্বগুলো সফলভাবে কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করে। অনেকেই কাউন্সেলিং ও সাইকোথেরাপি শব্দ দুটি সমার্থক কিংবা একই অর্থে অদলবদল করে ব্যবহার করে। থেরাপি শব্দটি গ্রিক শব্দ থেরাপিয়া থেকে এসেছে, যার অর্থ ‘একসঙ্গে পথ হাঁটা’। কাউন্সেলিং প্রক্রিয়ায় কাউন্সেলর ও ক্লায়েন্ট একসঙ্গে স্বয়ংক্রিয়ভাবে কাজ করেন। তাহলে দুটি বিষয়ই অর্থাৎ কাউন্সেলিং ও সাইকোথেরাপির কাজ মোটামুটি একই রকম।</p> <p>কাউন্সেলরের প্রাথমিক কাজ হলো ক্লায়েন্টকে তার নেতিবাচক চিন্তাপদ্ধতি পরিবর্তন, প্রতিরোধ, পুনর্বাসন, জীবনের মানোন্নয়ন ও বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের মাধ্যমে সে যেন তার অনুকূল মাত্রায় মনঃসামাজিক কাজকর্মে সক্রিয় হতে পারে সে ক্ষেত্রে তাকে সাহায্য করা। এ জন্য কাউন্সেলররা মানসিক স্বাস্থ্য, মনোবৈজ্ঞানিক ও মানুষের বিকাশগত বিভিন্ন তত্ত্ব প্রয়োগ করে চিন্তাভাবনা, আবেগীয়-আচরণীয় অথবা নিয়মতান্ত্রিক বিভিন্ন কৌশলের মাধ্যমে তাদের ভালো থাকা বা সুস্থ থাকা, ব্যক্তিগত বিকাশ অথবা পেশাগত উন্নয়ন, এমনকি মনোরোগ থাকলে সে ক্ষেত্রেও সাহায্য করে থাকেন।</p> <p>কাউন্সেলরের ভূমিকা অন্যান্য পেশা থেকে ভিন্ন। কারণ এখানে কাউন্সেলর সমস্যাটির দিকে খেয়াল করেন এই ভেবে যে এই সমস্যাটি ব্যক্তি, নিয়ম ও সংস্কৃতি—সব মিলিয়েই বেড়ে চলেছে। কাউন্সেলররা রোগ নির্ণয় ও প্রতিকারের তুলনায় বেশি খেয়াল করেন ক্লায়েন্টদের মানসিক বিকাশ ও মানসিক ব্যাধি প্রতিরোধ, দক্ষতা, গুণাগুণ, মানসিক শক্তির উৎস ও চাপ নিয়ন্ত্রণ করা ইত্যাদি বিষয়ের ওপর।</p> <p>সাধারণত কাজে অনাগ্রহ, সামাজিক ভয়, প্রিয়জনকে হারানোর বেদনায় আচ্ছন্ন, পারিবারিক দ্বন্দ্ব, যোগাযোগে অক্ষম, অবিরাম চিন্তা, দুশ্চিন্তায় আচ্ছন্ন, যেকোনো মাদকে আসক্ত হয়ে পড়া, শুচিবায়ু, বারবার হাত ধোয়া, হতাশাগ্রস্ততা, একাকিত্ব, আশাহীনতা, পেটে সমস্যা, মাথাব্যথা, অকারণে জ্ঞান হারানো, অনিয়ন্ত্রিত রাগ, ভাঙচুর করা, মিথ্যা কথা বলা, অতি চঞ্চলতা, অমনোযোগী, অটিজম, মিশতে না পারা, দুঃখজনক ঘটনা থেকে প্রাপ্ত আঘাত, দুঃস্বপ্ন দেখা, নিদ্রাহীনতা, ঘুমে ব্যাঘাত, মন মরা হয়ে থাকা কিংবা অনিয়ন্ত্রিত আনন্দ করা ইত্যাদি ক্ষেত্রে কাউন্সেলিং করা হয়।</p> <p>কাউন্সেলিং প্রক্রিয়াটি যখন শুরু হয় তখন ক্লায়েন্ট তার মনের কষ্টের সব কথা খুলে বলতে থাকে। দুঃখের কথা বলতে গিয়ে অনেক সময়ই সে খুব কান্নাকাটি করে, ভেঙে পড়ে। তখন ক্লায়েন্ট নিজেও হয়তো মনে করতে পারে যে এখানে এসে সব কিছু খুলে বলে তো আমি আবারও আগের সেই আঘাত পাওয়া মুহূর্তের কষ্টটা পাচ্ছি। তাহলে আমার সঙ্গে এটা কী হচ্ছে? এটা কাউন্সেলিং প্রক্রিয়াতে ক্লায়েন্টের জন্য বিপজ্জনক। কিন্তু ভয়ের কিছুই নেই; সেই বিপজ্জনক মুহূর্তটিতেও তাকে সাপোর্ট দেওয়ার জন্যই কাউন্সেলররা আছেন। কাউন্সেলরই ওই মুহূর্তটিতে তাকে সহায়তা করবেন স্থির হওয়ার জন্য, ভালো থাকার জন্য।</p> <p>কাউন্সেলিং সেশনটি সাধারণত হয় ৪৫-৫০ মিনিটের। আর কাউন্সেলিং সেশন সংখ্যার গড় হলো সাত-আটটি। তবে সমস্যার বিষয়ভেদে ও ক্লায়েন্ট অনুযায়ী সেশন সংখ্যা কমবেশি হতে পারে।</p> <p>কাউন্সেলিং সেশনে গোপনীয়তা রক্ষা করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এখানে ক্লায়েন্ট কাউন্সেলরের কাছে যেসব কথা বলবে সেসব কথা গোপন রাখা হয়। তবে তিনটি ক্ষেত্রে গোপনীয়তা ভাঙা হবে। প্রথমত, ক্লায়েন্টের যদি আত্মহত্যার প্রবণতা থাকে, তাহলে ক্লায়েন্টের মা-বাবা বা কাছের মানুষদের তার জীবন বাঁচানোর জন্যই তথ্যটি জানাতে হবে। দ্বিতীয়ত, ক্লায়েন্ট যদি কাউকে হত্যার পরিকল্পনা করে। তৃতীয়ত, যদি কখনো কোর্ট থেকে নির্দেশ আসে। তবে এ তথ্যগুলো জানানোর আগে অবশ্যই ক্লায়েন্টকে এ বিষয়ে বলে নেওয়া হবে।</p> <p>আমাদের দেশে কাউন্সেলিং করাতে হলে ফি দিতে হয় ৬০০ থেকে তিন হাজার টাকা পর্যন্ত। তবে কিছু কিছু জায়গায় বিনা মূল্যেও কাউন্সেলিংসেবা পাওয়া যায়। যেমন—ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, আইন ও সালিশ কেন্দ্র, আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য টিএসসির কাউন্সেলিং ও গাইডেন্স সেন্টারে।</p> <p>কাউন্সেলিং হলো মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য একটি পেশাগত প্রক্রিয়া। একজন পেশাদার কাউন্সেলরের এ পেশা চর্চা করার জন্য একাডেমিক শিক্ষার পাশাপাশি দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য প্রশিক্ষণ থাকতে হবে। কাউন্সেলররা দক্ষতার সঙ্গে ক্লায়েন্টদের আবেগ, চিন্তাভাবনা ও আচরণ নিয়ে কাজ করেন। কাউন্সেলিং নেওয়ার আগে কাউন্সেলরের যোগ্যতা সম্পর্কে জেনে নিন, যেন সঠিক সেবা পেতে পারেন।</p> <p>লেখকদ্বয় : গ্লোরিয়া রোজারিও, শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও</p> <p>প্রিয়াংকা শংকর দাস, কাউন্সেলর, হিলিং হার্ট কাউন্সেলিং ইউনিট, বসুন্ধরা, ঢাকা</p>