<p>পরিকল্পনা করেই মানবতাবিরোধী অপরাধ ঘটানো হয়। নিকৃষ্টতম যেসব ঘটনা এখন পর্যন্ত ঘটানো হয়েছে, সেসব খুবই উৎকট ও বিবমিষাকর। বিশ্ববাসীর মনে সেসব ঘটনা বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরি করে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় আরমেনীয়দের ওপর গণহত্যা চালায় উসমানীয় (অটোমান) শাসকরা। গণহত্যার ভয়াবহতম অধ্যায়টি রচনা করেছে জার্মানির নািস বাহিনী।</p> <p>গণহত্যার বিষয়টি নিয়ে যাঁরা নতুন পাঠ শুরু করেছেন তাঁদের কাছে মিয়ানমারের তত্পরতাকে ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি বলে মনে হতেই পারে। তাতমাদো নামে পরিচিত দেশটির সেনাবাহিনীর দাবি, মুসলিম রোহিঙ্গাদের বিদ্রোহী সংগঠন আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মির (এআরএসএ) হামলার পর তাদের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করে তারা। এআরএসএ হামলা চালিয়েছে ২০১৬ সালের অক্টোবরে এবং ২০১৭ সালের আগস্টে। কিন্তু তাতমাদো রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে নির্মূল করার ছক কষেছে কয়েক দশক ধরে। পাশ্চাত্যের ইসলামভীতি ও একে মোকাবেলা করার পরিপ্রেক্ষিতে তাতমাদো রোহিঙ্গা নির্মূলের ষড়যন্ত্র বাস্তবায়ন করে চলেছে।</p> <p>১৯৪৮ সালে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য থেকে স্বাধীন হয় বার্মা। তখন কিছু রোহিঙ্গা স্বাধীন মুসলিম রাষ্ট্রের দাবি জানিয়েছিল। রাখাইন রাজ্য নামের এলাকাটিকেই নিজের দেশ হিসেবে চেয়েছিল তারা—‘আরাকান’ নামে। তাদেরই বংশধরদের দেশছাড়া করার পরিকল্পনা করে তাতমাদো। গণহত্যা এর একটি অংশ। অন্য ব্যবস্থার চিন্তাও তারা করে রাখে, সেটি হলো হাজার হাজার রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশে ঠেলে দেওয়া।</p> <p>তাতমাদো যখন নিশ্চিত হবে পরিকল্পনা অনুযায়ী যথেষ্ট ধ্বংসযজ্ঞ তারা চালাতে সক্ষম হয়েছে, জনগোষ্ঠীটির ক্রমবর্ধমান হার থামাতে পেরেছে, তখন হয়তো বাংলাদেশ থেকে কিছু রোহিঙ্গা দেশে ফিরতে পারবে। রাখাইনদের মধ্যে আশঙ্কা দেখা দিয়েছিল, রোহিঙ্গারা হয়তো সংখ্যার দিক থেকে দ্রুতই তাদের ছাড়িয়ে যাবে। এই পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৮২ সালে নতুন করে নাগরিকত্ব আইন প্রণয়ন করে মিয়ানমার। তাতে বলা হয়, ১৮২৩ সালে ব্রিটিশ শাসন শুরুর আগে যারা ওই অঞ্চলে বাস করত শুধু তারাই মিয়ানমারের নাগরিক বলে গণ্য হবে। এ আইনের দোহাই দিয়ে তাতমাদো রোহিঙ্গাদের রাষ্ট্রহীন জনগোষ্ঠীতে পরিণত করেছে।</p> <p>উসমানীয়রা বা নািসরা মাত্র কয়েক বছরের মধ্যে সংখ্যালঘুদের নিশ্চিহ্ন করার চেষ্টা করেছিল। তাতমাদো তা করেনি। তারা নৃশংসতা, নির্যাতন চালিয়েছে সময় নিয়ে, ধৈর্য ধরে। নব্বইয়ের দশকের গোড়ার দিকে সামরিক জান্তা বার্মার নাম বদলে মিয়ানমার করে। জাতীয়তাবাদী এজেন্ডা বাস্তবায়নই ছিল এর মূল উদ্দেশ্য। ওই সময় ধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ডের আশঙ্কায় বাংলাদেশে পালিয়ে যায় প্রায় আড়াই লাখ রোহিঙ্গা। তাদের বেশির ভাগকেই আর ফিরিয়ে নেওয়া হয়নি।</p> <p>সন্ত্রাসবিরোধী লড়াই মিয়ানমারকে রোহিঙ্গাবিরোধী অভিযান চালানোর সুযোগ করে দিয়েছে। তারা বলছে, তাতমাদো ইসলামপন্থী সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে লড়ছে, গণহত্যা চালাচ্ছে না। ২০১২ সালের গ্রীষ্মে রাখাইনের রাজধানী সিতুতে জাতিগত দাঙ্গা শুরু হলে হাজার হাজার রোহিঙ্গাকে বন্দি করা হয়। মিয়ানমার সরকার বলে, রাখাইন দাঙ্গাবাজদের হাত থেকে তাদের রক্ষা করার জন্যই এ ব্যবস্থা; যদিও তাতমাদো রাখাইন দাঙ্গাবাজদের আটক করেনি। তারা বরং রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশনের (আরএসও) সদস্যদের ধাওয়া করেছিল।</p> <p>হত্যার বদলে বন্দি করার এই কৌশল তাতমাদোকে রোহিঙ্গাবিষয়ক ‘কিসসা’ সাজাতে সহায়তা করেছে। জাতিসংঘ ও হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এ তত্পরতার নিন্দা জানালেও বেশির ভাগ পর্যবেক্ষক গণহত্যার অভিযোগ তোলেননি। সেবার তাতমাদো রোহিঙ্গাদের চাপে ফেলে দেশছাড়া করতে চেয়েছিল, সহিংসতা চালিয়ে নয়। ২০১৬ ও ২০১৭ সালে তারা ১৯৪৮ সালে শুরু করা কাজ শেষ করার সুযোগ পায়। এআরএসএর উপস্থিতির অজুহাত দেখিয়ে প্রত্যক্ষ গণহত্যার সুযোগ পেয়ে যায়। নিরস্ত্র রোহিঙ্গাদের হত্যা-ধর্ষণ-নির্যাতন করে, বাড়িঘর-ফসলের মাঠ পুড়িয়েও দাবি করা হয়, তারা সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়েছে। কোনো বেসামরিক লোকের মৃত্যু হয়নি। আসলে সন্ত্রাসবিরোধী লড়াইয়ের নামে মুসলিমবিরোধী লড়াই চালাচ্ছে তারা।</p> <p>রোহিঙ্গাদের সঙ্গে আলোচনায় বসার কোনো ইচ্ছা তাতমাদোর নেই। অনেকবার আলোচনার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে তারা। এআরএসএ দুর্বল সংগঠন; পাতানির মালয় বা মিন্দানাওয়ের মোরোদের মতো জোর তাদের নেই। মিয়ানমার সেনাবাহিনী তাদের আমলে নিতে চায় না।</p> <p>রাখাইনের রোহিঙ্গা শামসু আনোয়ারের মতে, সংকটের একমাত্র সমাধান জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী মোতায়েন করা, সেফ জোন প্রতিষ্ঠা করা। অন্য কোনো উদ্যোগ ব্যর্থ হতে বাধ্য। কারণ সেনাবাহিনী জাতি-নির্মূলের নীলনকশা ধরেই হাঁটবে। রোহিঙ্গারা আশা করেছিল মিয়ানমারে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে। সে আশায়ই সু চির দলকে সমর্থন দেয় তারা। কিন্তু এনএলডি বা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় কেউই তাদের আশা পূরণ করেনি।</p> <p>এআরএসএ ভুল হিসাব কষে হামলা চালিয়েছে। তাতমাদোর তাতে পোয়াবারো। তারা সুযোগ পেয়েছে এ কথা বলার যে আত্মরক্ষার জন্য অভিযান চালাচ্ছে তারা। এআরএসএ যতবার এমন হামলা চালাবে রোহিঙ্গাদের হত্যার জন্য ততবার সুযোগ নেবে তাতমাদো। এটাই তাদের নকশা।</p> <p> </p> <p><strong>লেখক :</strong> ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক। মুসলিম বিশ্বের সংঘাত বিষয়ে লেখালেখি করেন</p> <p><strong>সূত্র : </strong>দ্য ডিপ্লোম্যাট অনলাইন</p> <p>ভাষান্তর : <strong>তামান্না মিনহাজ</strong></p>