<p>উপমহাদেশে ফুটবলের প্রচলন, শৈশব অবস্থায় লালন-পালন, খেলার প্রসার এবং জনপ্রিয়তা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে পূর্ববঙ্গের ফুটবল সংগঠক, রাজা-জমিদারদের পৃষ্ঠপোষকতা, ক্রীড়ানুরাগী-শিক্ষাব্রতী সমাজ, খেলোয়াড়দের মাঠে অসাধারণ সাফল্য ও গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা এবং দর্শকদের ভালোবাসা ও অনুরাগ ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছে। একটি চিহ্নিত সময়ে ফুটবল মাঠে স্থানীয় খেলোয়াড়দের সাফল্য ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা-আন্দোলনকে শুধু উজ্জীবিত করেনি, মনে আস্থা ও বিশ্বাসের জন্ম দিয়েছে। মানুষ ভাবতে পেরেছে, খেলার মাঠে যখন ইংরেজদের পরাজিত করা সম্ভব হয়েছে তখন রাজনীতিতেও পরাজিত করা সম্ভব হবে। পরাধীনতার শিকল ছিঁড়বে। ফুটবল মাঠে দর্শক ভিড় জমাত নিছক আনন্দ পাওয়ার জন্য শুধু নয়, সামাজিক গৌরব অর্জনের জন্যও।</p> <p>ইংরেজদের আনা ফুটবল কলকাতার মাটিতে গড়ানোর পরপরই ঢাকা এবং এর আশপাশে মাঠে গড়াতে সময় নেয়নি। ষাটের দশকে ঢাকার গ্যারিসন মাঠে ইউরোপীয় সাহেব সৈনিক ও বেসামরিকদের মধ্যে অনুষ্ঠিত ফুটবল ম্যাচের ছবি ব্রিটিশ মিউজিয়ামে সংরক্ষিত আছে। ১৯০৪ সালে আন্তর্জাতিক ফুটবল সংস্থা (ফিফা) প্রতিষ্ঠার আগে ১৮৯৮ থেকে ১৯০৩ সালের মধ্যে ঢাকায় ওয়ারী ক্লাব (১৮৯৮), ভিক্টোরিয়া স্পোর্টিং ক্লাব (১৯০৩), ইস্ট অ্যান্ড ক্লাব (১৮৮৬), আরমানিটোলা, লক্ষ্মীবাজার, মাহুতটুলী, হাটখোলা এসি, রমনা এসিসহ বিভিন্ন ক্লাব স্থাপিত হয়েছে। গঠিত হয়েছে ফুটবল ক্লাব জেলা ও মহকুমা শহরের বিভিন্ন স্থানে। যেমন—রংপুরের তাজহাট ক্লাব, নাটোর ক্লাব, বগুড়ার টাউন ক্লাব প্রভৃতি। বিভিন্ন স্থানে স্থাপিত ক্লাবগুলো ফুটবলের পৃষ্ঠপোষকতা করেছে। ফুটবলের প্রসার ঘটিয়েছে।</p> <p>ফুটবলের সঙ্গে পরিচিত পূর্ববঙ্গের বাঙালিদের ১৫০ বছর আগের। আগামী বছর (২০১৮) রাশিয়া বিশ্বকাপ ফুটবলের চূড়ান্ত পর্বে খেলার জন্য যে দেশগুলো গৌরবের সঙ্গে এরই মধ্যে কোয়ালিফাই করেছে, তাদের দিকে তাকালে দেখা যাবে, এদের বেশির ভাগ দেশই ফুটবলের সঙ্গে পরিচিত হয়েছে আমাদের সময়ে অথবা অনেক পরে। এখন সেসব দেশের ফুটবল কোথায়, আর ঐতিহ্য ও সোনালি অতীত থাকা সত্ত্বেও আমরা কোথায় সীমাবদ্ধ গণ্ডিতে মুখ থুবড়ে পড়ে আছি।</p> <p>১৮৯২ সালে গঠিত হয়েছে এসইএফএ। এসইএফএ গঠিত হওয়ার পর ঢাকা জেলা স্পোর্টিং ইউনিয়নকে সরাসরি স্বীকৃতি দিয়েছে। আর এই স্বীকৃতি ছিল একান্ত প্রাপ্য। কেননা তখন ঢাকার এবং পূর্ববঙ্গের ফুটবল ছিল অনেক বেশি জমজমাট। পূর্ববঙ্গের বিভিন্ন স্থানের খেলোয়াড়রাই ছিলেন কলকাতার ফুটবলের আসল প্রাণ। ১৮৯৪ সালে ব্রিটিশ জার্নাল লিখেছে, ‘কলকাতার ফুটবলে ফুটবলার জোগান দেওয়ার উর্বর ভূমি হলো পূর্ব বাংলা।’</p> <p>আজ থেকে ৮০ বছর আগে, ১৯৩৭ সালের ২১ নভেম্বর, ইংলিশ ফুটবলে চ্যাম্পিয়ন দল আইলিংটন কোরিন্থিয়ান্স এফসি ঢাকার পল্টন মাঠে ঢাকা একাদশের কাছে ১-০ গোলে পরাজিত হয়। এটাই প্রথম কোনো ইংলিশ ফুটবল ক্লাবের ভারতবর্ষের মাটিতে প্রথম পরাজয়। আর সেই পরাজয় ঢাকায়। কোরিন্থিয়ান্স দলের নেতৃত্ব দেন ই বি ক্লার্ক। প্রথমবারের মতো ভারতে খেলতে এসে ৩৬টি খেলায় জয়লাভের পর ঢাকা একাদশের কাছে প্রথম পরাজয় মেনে নিতে বাধ্য হয় ইংলিশ দল। ঢাকা দলের পক্ষে একমাত্র গোলটি করেছেন আক্রমণভাগের খেলোয়াড় পাখি সেন। পাখি সেনের বাড়ি কিশোরগঞ্জে। তিনি তখন জগন্নাথ কলেজের ছাত্র। ঢাকা একাদশের কাছে পরাজয়ের খবর সেই সময়কার ব্রিটিশ পত্রপত্রিকা গুরুত্ব দিয়েই প্রকাশ করে। এখনকার প্রজন্মের কাছে এই গৌরবোজ্জ্বল বিজয়কে গল্পের মতোই মনে হবে। কেন বাঘা সোমের প্রশিক্ষণে বাস্তবে ঢাকা একাদশের তরুণ খেলোয়াড়, যাঁদের বেশির ভাগই ছিল বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্র; তারা মাঠে বাঘের মতো লড়াই করে বিজয় নিশ্চিত করে। কোরিন্থিয়ান্স দলের অধিনায়ক ঢাকায় সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে তাঁর বক্তব্যে বলেছেন, ‘এযাবৎ বাংলার রয়েল বেঙ্গল টাইগারের কথা বইপত্রে পড়েছি, শুনেছি, জু-তে খাঁচায় দেখেছি। আমার সৌভাগ্য সেই রয়েল বেঙ্গল টাইগারের সঙ্গে মাঠে আমার এবং দলের সবার পরিচয় ঘটেছে।’</p> <p>প্রথম ম্যাচে ঢাকা একাদশ জয়লাভ করলেও ২২ নভেম্বর ১৯৩৭ দ্বিতীয় ম্যাচে পরাজিত হয় ১-০ গোলে। ঢাকা নগরী মেতে উঠেছিল শক্তিশালী বিদেশি দলের বিপক্ষে এই দুই ম্যাচকে ঘিরে। দুই আনার টিকিটে হাজার হাজার মানুষ মাঠে ছুটে এসে খেলা দেখেছে মিঠে রোদের শীতের অপরাহ্নে। বিজয়ী ঢাকা একাদশের অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করেন মেডিক্যাল স্কুলের ছাত্র এস মিত্র।</p> <p>এ প্রসঙ্গে আরো কিছু আলোচনার আগে আমাদের পূর্ববঙ্গের ফুটবলারদের আরেকটি গৌরব কৃতিকে (২৬ বছর আগে ১৯৯১ সালের ২৯ জুলাই) স্মরণ করতে চাই। সেটা প্রথমবারের মতো আইএফএ শিল্ডে (১৮৯৩ থেকে শুরু) স্থানীয় দল হিসেবে মোহনবাগান ক্লাবের (১৮৮৯ সালের ১৫ আগস্ট স্থাপিত) প্রথম শিল্ড বিজয়। এই জয় ভারতবর্ষের ফুটবল ইতিহাসে মাইলফলক হয়ে আছে। ইংরেজ সৈনিক দলের বিপক্ষে ভারতের বাঙালি খেলোয়াড়দের প্রথম শিরোপা জয়। আর এই জয়ের মাঠে ফুটবলশিল্পীদের মধ্যে আটজন ছিলেন আমাদের পূর্ববঙ্গের বিভিন্ন স্থানের, বিভিন্ন পেশার এবং ছাত্র। বিজয়ী মোহনবাগান ক্লাবের অধিনায়ক ছিলেন ফরিদপুরের শিবদাশ ভাদুড়ী। বিজয়সূচক গোলটি করেছেন ময়মনসিংহের অভিলাষ ঘোষ।</p> <p>কলকাতা ফুটবল লীগ শুরু হয়েছে ১৮৯৮ সাল থেকে। আর ঢাকায় ফার্স্ট ডিভিশন ফুটবল লীগ শুরু হয় ১৯১৫ সাল থেকে। ঢাকার লীগে প্রথম থেকেই ওয়ারী, ভিক্টোরিয়া ইস্ট এন্ড ক্লাব, লক্ষ্মীবাজার, সেন্ট্রাল জেল, আরমানিটোলা, হাটখোলা এসি, মুসলিম ওয়ান্ডারার্স, মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব, ঢাকেশ্বরী কটন মিল, মনিপুর ফার্মসহ ১০-১১টি দল অংশ নিত। প্রতিবছর লীগে ‘রেলিগেশন’ হতো। দল উঠত, দল নামত। এ ছাড়া অনুষ্ঠিত হতো দ্বিতীয় ও তৃতীয় বিভাগ ফুটবল লীগ। ত্রিশ ও চল্লিশের দশকে রিজার্ভ লীগ ও অফিস লীগের খেলাও অনুষ্ঠিত হতো। ১৯২০ সাল থেকে স্যার রোনাল্ডস চ্যালেঞ্জ শিল্ডের খেলা শুরু হয়। ১৯৫৮ সালে আগা খান গোল্ডকাপ ইন্টারন্যাশনাল ফুটবল টুর্নামেন্ট শুরু করার পর এই শিল্ডের খেলার জমজমাট আসরের অবসান হয়েছে।</p> <p>ঢাকা একাদশ কোরিন্থিয়ান্স দলের বিপক্ষে যে অবিস্মরণীয় লড়াই করেছে, এর পেছনে কারণ হলো তৎকালীন ফুটবলে খেলোয়াড়দের খেলার মান এবং নিয়মিত চর্চা। ত্রিশ ও চল্লিশের দশকে নিজস্ব গণ্ডিতে শিল্ড ও কাপের খেলায় অংশগ্রহণ ছাড়াও কলকাতা ফুটবলের ‘ব্লুশিল্ড’ হিসেবে পরিচিত আইএফএ শিল্ডে অংশ নিত আমাদের এই পূর্ব বাংলার বিভিন্ন স্থান থেকে বিভিন্ন ক্লাব প্রতিবছর। উদাহরণস্বরূপ উল্লেখ করা যেতে পারে ১৯৪৪ সালে আইএফএ কর্তৃক প্রকাশিত স্মরণিকা। এ বছর ঢাকা ওয়ারী ক্লাব, ভিক্টোরিয়া স্পোর্টিং, বগুড়া টাউন ক্লাব, ফরিদপুর ক্লাব, খুলনা টাউন ক্লাব, বরিশাল ডিএফএ, কুষ্টিয়ার শিবকালী ক্লাব, খুলনা ইউনিয়ন স্পোর্টিং মুসলিম ক্লাব, হবিগঞ্জের ফ্রেন্ডস ক্লাব, ব্রাহ্মণবাড়িয়া টাউন ক্লাব (মোট ১১টি ক্লাব) অংশ নিয়েছে।</p> <p>কোরিন্থিয়ান্স দল কলকাতা থেকে গোয়ালন্দে পৌঁছে ঢাকায় এসেছে স্টিমারযোগে। অতিরিক্ত দল ঢাকায় অবস্থানকালে থেকেছে ঢাকা ক্লাবে। পর পর দুটি ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়েছে ঢাকা স্পোর্টিং অ্যাসোসিয়েশনের মাঠে। দুই দিনই রেফারির দায়িত্ব পালন করেছেন ঢাকা স্পোর্টিং অ্যাসোসিয়েশনের যুগ্ম সম্পাদক খাজা মোহাম্মদ আজমল। লাইনসম্যান : আর বসাক ও এস বসাক।</p> <p>২১ নভেম্বর কোরিন্থিয়ান্স দলের খেলোয়াড়রা হলেন উইং ফিল্ড, ম্যানিং, বুকলিন, ভ্যান্স, হুইটেকার, মিলার, ব্রেথওয়ে, আভেরি, ট্যারেন্ট শেরউড ও পিয়ার্স। ঢাকা একাদশ : রঞ্জিত বসু, রাখাল মজুমদার, জে সরকার, আর সেন, যোগ জীবন দত্ত, এস মিত্র, এস ঘোষ, পি মুখার্জি, এস কর, পাখি সেন ও বি রায় চৌধুরী। দ্বিতীয় ম্যাচে ঢাকা দলে যোগ জীবন দত্তের পরিবর্তে খেলেছেন সূর্য অহিগুহ রায়। অন্যদিকে সফরকারী দলের হয়ে দ্বিতীয় ম্যাচে অংশ নিয়েছেন : লংম্যান (গোলকিপার), মার্টন, ক্লার্ক, ভ্যান্স, হুইটেকার, রাইট, রিড, ব্রাথ বেরি, ট্যারেন্ট, আভেরি ও মিলার।</p> <p>খেলোয়াড় পরিবর্তনের মাধ্যমে মাঠে দলগত শক্তি বৃদ্ধি করে দ্বিতীয় ম্যাচে সফরকারী দল জয়ের স্বাদ নিয়েছে।</p> <p> </p> <p><strong>লেখক : </strong>কলামিস্ট ও বিশ্লেষক</p>