<p> এক লাখ টাকা যৌতুক হিসেবে চেয়েছিল সিরাজগঞ্জের তাড়াশ উপজেলার নওগাঁ ইউনিয়নের শাকই গ্রামের মনিরুল হক মনি। সেই টাকা না পেয়ে গত ১২ নভেম্বর স্ত্রী রিপা খাতুনকে পিটিয়ে হত্যা করে সে। যৌতুক না পেয়ে স্ত্রীকে হত্যার এমন আরো ঘটনা আছে। একই দাবিতে গত ৩১ অক্টোবর মাগুরার শালিখা উপজেলার নাঘোসা গ্রামের খালিদ হোসেন ডালিম তার স্ত্রী সাবিনা খাতুনকে পিটিয়ে হত্যা করে।</p> <p> সারা দেশেই প্রতিনিয়ত যৌতুকের বলি হচ্ছে নারী। যৌতুকের দাবিতে নারীর ওপর সহিংসতা সামাজিক ব্যাধিতে রূপ নিয়েছে- এ কথা ঘটা করে প্রচার করা হলেও এর প্রতিরোধে আইনের যথাযথ প্রয়োগ নেই। ফলে নারীকে নিগ্রহ-লাঞ্ছিত করার ঘটনা বাড়ছেই। গত বছর যৌতুকের কারণে হত্যা করা হয়েছে ২৪৫ জন নারীকে। আর গত অক্টোবরেই শুধু নির্যাতনের শিকার হয়েছে ৪০ জন নারী; তাদের মধ্যে ১৬ জনকে হত্যা করা হয়েছে।</p> <p> আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নারী নির্যাতন রোধে কঠোর আইন থাকলেও তেমন প্রয়োগ হয় না; হলেও অভিযোগ হালকাভাবে উপস্থাপন করা হয়। ফলে পর্যাপ্ত শাস্তি হয় না। তাই নির্যাতনও কমছে না; বরং বাড়ছে। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, যৌতুক নিরোধ আইন, এসিড সন্ত্রাস দমন আইন ও এসিড নিয়ন্ত্রণ আইনের সঠিক প্রয়োগ থাকলে নারী নির্যাতন অনেকাংশে কমত বলে তাঁরা মনে করেন।</p> <p> শুধু যৌতুকজনিত নির্যাতনই নয়, আরো নানা ছুতায় নারীর ওপর নির্যাতন চলে। সম্প্রতি প্রকাশিত বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) জরিপের ফলাফলে দেখা গেছে, বিবাহিত নারীদের ৮৭.৭ শতাংশ স্বামীর হাতে কোনো না কোনো সময়ে কোনো না কোনো নির্যাতনের শিকার হয়েছে। তাদের মধ্যে ৬৪.৬ শতাংশ শারীরিক নির্যাতন, ৩৬.৫ শতাংশ যৌন নির্যাতন, ৮১.৬ শতাংশ মানসিক নির্যাতন এবং ৫৩.২ শতাংশ অর্থনৈতিক নির্যাতনের শিকার হয়েছে।</p> <p> নারী ও শিশু আইন বিশেষজ্ঞ ড. নাহিদ ফেরদৌসী কালের কণ্ঠকে বলেন, দক্ষিণ এশিয়ায় সর্বপ্রথম ভারত যৌতুক সমস্যা নিয়ন্ত্রণ করার উদ্দেশ্যে ১৯৬১ সালে আইন পাস করে। এটি 'যৌতুক নিরোধ আইন-১৯৬১' নামে পরিচিত। পরে পাকিস্তান আমলে এ সম্পর্কিত আইন প্রণয়ন করা হলেও তা শুধু পশ্চিম অংশের জন্য প্রযোজ্য ছিল। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে যৌতুকের দাবিতে নারীর প্রতি আচরণ বর্বরতা নিষ্ঠুরতার দিকে এগোতে থাকলে তা প্রতিরোধের জন্য আইন প্রণয়ন করা হয়।</p> <p> নাহিদ ফেরদৌসী জানান, বাংলাদেশে বর্তমানে যৌতুক নিষিদ্ধ করার জন্য যেসব আইন আছে সেগুলো হচ্ছে যৌতুক নিষিদ্ধকরণ আইন, ১৯৮০ (সংশোধিত ১৯৮৪) এবং নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০ (সংশোধিত ২০০৩)। তিনি বলেন, ১৯৮০ সালের যৌতুক নিষিদ্ধকরণ আইনের ৩ ও ৪ ধারা অনুযায়ী যৌতুক নেওয়া ও দেওয়া দুটোই নিষিদ্ধ ও অপরাধ। যদি কেউ যৌতুক দেয় বা নেয় বা দেওয়া-নেওয়ায় সহায়তা করে তাহলে তারা সবাই আইন অনুযায়ী শাস্তি পাবে। কিন্তু সমস্যা হলো, এ আইনের প্রয়োগ নেই বললেই চলে। কোনো নারী নির্যাতনের শিকার হলে আদালতে যাচ্ছে বটে, কিন্তু আগে থেকে আইনটি সম্পর্কে তারা জানে না। আর এ বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকেও তেমন উদ্যোগ লক্ষ করা যায় না। ফলে যৌতুক নির্মূলের যে ব্যবস্থা আইনে বলা হয়েছে তার বাস্তবায়ন হচ্ছে না।</p> <p> বাংলাদেশ মহিলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট ফাওজিয়া করিম ফিরোজ কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমাদের দেশে নারীরা বেশির ভাগ সময় যৌতুকের কারণেই নির্যাতনের শিকার হয়। আরো অনেক কারণে নির্যাতনের শিকার হচ্ছে তারা। নির্যাতন কোনোভাইে কমানো যাচ্ছে না। এর পেছনে মূল কারণ আইনের সঠিক প্রয়োগ না হওয়া। নির্যাতনের শিকার হয়ে পরে আদালতে মামলা করছে অনেকে। কিন্তু এসব মামলার বিচার হচ্ছে অনেক বিলম্বে। অধিকাংশ অপরাধীই ছাড়া পেয়ে যায়। ফলে কোনোভাবেই এটি কমানো যাচ্ছে না।' তিনি আরো বলেন, 'একদিকে সমাজ নারী নির্যাতন প্রতিরোধের অন্তরায়; অন্যদিকে রাষ্ট্র সঠিক বিচার না করে উল্টো নির্যাতনকারীদের উসকে দিচ্ছে।'</p> <p> সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল অ্যাডভোকেট জান্নাতুল ফেরদৌসী রুপা কালের কণ্ঠকে বলেন, নারী ও শিশু নির্যাতন আইনের ১১ ধারার (ক) ও (খ) উপধারায় যৌতুকের শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে। সবর্ে্বাচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড; কিন্তু এর প্রয়োগ চোখে পড়ার মতো নয়। ফলে যৌতুকের কারণে নারী নির্যাতন কোনোভাবেই কমানো যাচ্ছে না।</p> <p> যৌতুক ছাড়াও ফতোয়া ও এসিড সন্ত্রাসের মাধ্যমেও নারী নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। গত জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ফতোয়ার নামে ২৩ জন নারী সহিংসতার শিকার হয়েছে। ২০১৩ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত মোট ২১ জন নারী এ জাতীয় ঘটনার শিকার হয়েছিল। সম্প্রতি মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, এ বছর এখন পর্যন্ত তিনজন নারী ফতোয়ার কারণে আত্মহত্যা করেছে; ৯ জন শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়েছে; একঘরে হয়েছেন ১৩ জন নারী।</p> <p> এসিড সারভাইভর্স ফাউন্ডেশনের হিসাবে, ১৯৯৯ সাল থেকে বাংলাদেশে তিন হাজারের বেশি এসিড হামলার ঘটনা ঘটেছে। সবচেয়ে বেশি ঘটেছে ২০০২ সালে। ওই বছর ৫০০ এসিড হামলার ঘটনা ঘটে। এরপর হামলার ঘটনা কমতে থাকে। ২০১১ সালে ৯১টি ও ২০১২ সালে ৯৮টি, ২০১৩ সালে ৮৫টি এবং এ বছরের অক্টোবর পর্যন্ত ৬৩টি ঘটনা ঘটেছে। আক্রান্তের শতকরা ৭০ জন নারী।</p> <p> নাহিদ ফেরদৌসী বলেন, ২০০৭ সালে এসিড সন্ত্রাস দমন আইন করা হয়েছে। বাস্তবে আইনি প্রতিকারের চিত্র অত্যন্ত উদ্বেগজনক। মামলা দায়ের ও পরিচালনার ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের জটিলতা রয়েছে। অপরাধ প্রমাণের পর শাস্তি দেওয়া হলেও তা কার্যকর হয় না। অপরাধীদের প্রভাব-প্রতিপত্তি, রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়া, আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কর্মকর্তার দায়িত্ব পালনে অবহেলা, আইনজীবীদের আইনগত সহায়তা প্রদান না করার কারণে অপরাধীরা নির্যাতনের উৎকট রূপ প্রকাশ করতে সাহস পাচ্ছে। তিনি বলেন, এ ছাড়া এসিডের সহজলভ্যতা অপরাধীদের প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতে সহায়তা করছে। আইনের কার্যকারিতা না থাকায় এমনটি হচ্ছে।</p> <p> বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের হিসাব অনুযায়ী, শুধু এ বছরের অক্টোবর মাসে মোট ৪২৩ জন নারী নির্যাতনের শিকার হয়েছে। ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে মোট ১০৩টি; তাদের মধ্যে গণধর্ষণের শিকার হয়েছে ১৯ জন। ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ১১ জনকে।</p> <p>  </p> <p>  </p>