<div> রাজনৈতিক ও বিদেশি চাপের মুখে রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকায় (ইপিজেড) শ্রমিক সংগঠন করার সুযোগ দেওয়া হচ্ছে। একই সঙ্গে শ্রমিকরা পাচ্ছেন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে দরকষাকষির সুযোগ। এসব বিধান রেখে ‘বাংলাদেশ ইপিজেড শ্রম আইন, ২০১৪’-এর খসড়ায় নীতিগত অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা। এ অনুমোদনপ্রক্রিয়ায় মন্ত্রীদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। বৈঠকে কয়েকজন মন্ত্রী এ বিষয়ে আরো চিন্তা-ভাবনা করার পরামর্শ দেন। পাশাপাশি তাঁরা প্রস্তাবিত আইনের বিভিন্ন দুর্বল দিকের প্রতি প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।</div> <div> প্রয়োজনীয় পরিমার্জন শেষে এবং আইন মন্ত্রণালয়ের ভেটিং নিয়ে আইনটি আবারও মন্ত্রিসভায় চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য উপস্থাপন করা হবে। গতকাল সোমবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে সচিবালয়ে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভার বৈঠক শেষে একজন সিনিয়র মন্ত্রী কালের কণ্ঠকে এ তথ্য জানান।</div> <div> ইপিজেড আইনের খসড়া ছাড়াও গতকাল মন্ত্রিসভায় রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো আইন ২০১৪ এবং বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি নিয়ন্ত্রণ (সংশোধন) আইন ২০১৪-এর নীতিগত অনুমোদন দেওয়া হয়। বৈঠক সূত্রে জানা যায়, মন্ত্রিসভা বৈঠকে জিএসপি সুবিধা নিয়েও আলোচনা হয়েছে। প্রসঙ্গটি তুলেছিলেন স্থানীয় সরকারমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম। তিনি বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদের কাছে জানতে চান জিএসপির সর্বশেষ অবস্থা। প্রধানমন্ত্রী ওই সময় মন্ত্রীদের বলেন জিএসপি নিয়ে উদ্বেগ না দেখাতে। তিনি বলেন, ‘জিএসপির হার খুবই কম। আর এটি ফিরিয়ে আনতে যুক্তরাষ্ট্রের যেহেতু আইনি বাধা রয়েছে, তাই আমাদের উদ্বেগ দেখানোর প্রয়োজন নেই।’ </div> <div> ইপিজেডগুলোতে শ্রমিকদের সংগঠন করার সুযোগ দিতে দীর্ঘদিন ধরে তাগাদা ছিল বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের ক্রেতা দেশগুলোর। বাংলাদেশের বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠনও এ নিয়ে আন্দোলন করে আসছে। তাদের বক্তব্য হচ্ছে, এক দেশে দুই নীতি চালু থাকতে পারে না। এ ছাড়া গত বছর জুন মাসে বাংলাদেশের জিএসপি স্থগিত করে যুক্তরাষ্ট্র। এ সুবিধা ফিরে পাওয়ার জন্য যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে ১৩ দফা শর্ত দেয়। গত এক বছরে বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে যেসব দ্বিপক্ষীয় বৈঠক হয়েছে সেগুলোতে ওই ১৩ দফা পালন করার তাগিদ দেওয়া হয়। ওই ১৩ দফার ৭ নম্বর দফায় বলা হয়েছে, ইপিজেডে কারখানার শ্রমিকরা যাতে দেশের অন্যান্য স্থানের শ্রমিকদের মতো সংগঠন ও দরকষাকষির অধিকার পায় সে জন্য দ্রুত আন্তর্জাতিক মানের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ ইপিজেড আইন প্রণয়নের অঙ্গীকার করতে হবে বা বর্তমান আইন বাতিল করতে হবে।</div> <div> ইপিজেড আইন বাতিল বা যুগোপযোগী করার জন্য আইএলওর সঙ্গে সমন্বয় করে ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠন করতে হবে।</div> <div> গতকাল বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন মন্ত্রিপরিষদসচিব মোশাররাফ হোসাইন ভূঁইঞা। ওই সময় সাংবাদিকরা জানতে চান সরকার রাজনৈতিক বা আন্তর্জাতিক চাপে পড়ে এ আইন করছে কি না। জবাবে মন্ত্রিপরিষদসচিব বলেন, ‘সরকার তো দাতাদের চাপে চলে না, সরকার মানুষের প্রত্যাশা পূরণের জন্য কাজ করে।’</div> <div> সচিব এ কথা বললেও মন্ত্রীরা বলছেন ভিন্নকথা। মন্ত্রীদের মতে, রাজনৈতিক চাপে পড়েই সরকার এ আইন করছে। তাদের জন্যই সরকার যে প্রতিশ্রুতি দিয়ে বিনিয়োগকারীদের এ দেশে এনেছিল, এখন তা থেকে দূরে সরে যাচ্ছে।</div> <div> একাধিক মন্ত্রী কালের কণ্ঠকে জানান, আইনটি পাস হলে শ্রমিকরা ‘শ্রমিক কল্যাণ সমিতি’ নামে শ্রমিক সংগঠন করতে পারবেন। শুধু তা-ই নয়, তাঁদের কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বার্গেনিং বা যৌথ দরকষাকষির সুযোগ দেওয়া হচ্ছে। এ দুটি বিধান খুব গুরুত্বপূর্ণ। কারণ দেশের অন্যান্য এলাকায় শ্রমিকরা এ দুটি সুবিধা ভোগ করছেন। আর এ সুবিধা ভোগ করার পরিণতি কী তা সবাই দেখছে।</div> <div> ইপিজেডে ট্রেড ইউনিয়ন চালু হতে যাচ্ছে কি না জানতে চাইলে এক মন্ত্রী কালের কণ্ঠকে বলেন, পুরোপুরি ট্রেড ইউনিয়ন নয়। কারণ ইপিজেডের বাইরের কারখানাগুলোতে তিনটি শ্রমিক সংগঠন থাকে। তাদের যৌথ প্রতিনিধিদল দরকষাকষিতে অংশ নেয় সিবিএর মাধ্যমে। খসড়া আইনে ইপিজেডের কারখানাগুলোতে শ্রমিকদের সমিতির নামে একটি সংগঠনই থাকবে। এ সমিতি করারও সুযোগ সীমিত রাখা হয়েছে। সমিতি করতে চাইলে কোনো প্রতিষ্ঠানের শতকরা ৩০ ভাগ শ্রমিককে ইপিজেড কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করতে হবে। আবেদনকারীদের মধ্যে ভোটের ব্যবস্থা করা হবে এবং তাঁদের মধ্যে শতকরা ৫০ ভাগ সমিতি করার পক্ষে ভোট দিলে সমিতি অনুমোদন পাবে। শ্রমিক কল্যাণ সমিতি করতে চাইলে বেপজার কাছে নিবন্ধন করতে হবে।</div> <div> বৈঠক সূত্রে জানা যায়, একজন মন্ত্রী ইপিজেডের কারখানা পরিদর্শনের সুযোগ শ্রম অধিদপ্তরের হাতে ন্যস্ত করার পক্ষে বলেন বৈঠকে। কিন্তু তাঁর সেই প্রস্তাব নাকচ হয়ে গেছে। ইপিজেডের জন্য আলাদা পরিদর্শক থাকবে। নতুন আইন অনুযায়ী ইপিজেডে শ্রম আদালত হবে। আপিল আদালতও থাকবে। এসব প্রশাসনিক খরচ বহন করার জন্য একটি ফান্ড গঠন করার কথা রয়েছে খসড়া আইনে। ফান্ডের ব্যবস্থা রাখার বিষয়ে একজন মন্ত্রী বৈঠকে বলেন, সরকারি কর্মচারীরা বেতন পান। তাঁদের খরচ নির্বাহের জন্য আলাদা ফান্ড থাকা ঠিক হবে না।</div> <div> খসড়া আইনে কোনো বিনিয়োগকারী আইন মেনে না চললে তাঁর রপ্তানি আদেশ বাতিল ও গ্যাস-বিদ্যুতের মতো ইউটিলিটি সার্ভিস বন্ধ রাখার বিধান রাখা হয়েছে। বৈঠক সূত্রে জানা যায়, এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে একজন মন্ত্রী বলেন, এ ধরনের বিধান বেপজার হাতে থাকা ঠিক নয়। কারণ রপ্তানি বন্ধের মতো সিদ্ধান্ত নেওয়ার এখতিয়ার বেপজার নয়। বিষয়টি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের হাতে থাকতে পারে। এ বিতর্কের সময় প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বেপজার হাতে থাকলেও কোনো সমস্যা নেই। কারণ বেপজার এ সিদ্ধান্ত আমার হাতেই অনুমোদিত হবে।’</div> <div> সূত্র মতে, বৈঠকে একজন মন্ত্রী জানতে চান সমিতির হাতে দরকষাকষির যে ক্ষমতা দেওয়া হচ্ছে, তা কে বা কারা চর্চা করবে, সমিতির সব সদস্য, নাকি নির্বাহী কমিটি? বিষয়টি আইনে পরিষ্কার করা হয়নি। ওই সময় প্রধানমন্ত্রী সমিতির নির্বাহী কমিটির হাতে এ দায়িত্ব দেওয়ার বিষয়টি খসড়া আইনে অন্তর্ভুক্ত করার নির্দেশ দেন।</div> <div> জানা যায়, বৈঠকে অন্য একজন মন্ত্রী বলেন, ‘খসড়া আইনটি প্রচলিত শ্রম আইনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। কিন্তু আমরা ইপিজেড করার সময় বিদেশি বিনিয়োগকারীদের বলেছিলাম, ইপিজেডে শ্রমিক সংগঠন থাকবে না। এখন এসে আমরা আমাদের আগের অবস্থান থেকে সরে যাচ্ছি। এ বিষয়টি তাঁদের মনোভাবে চিড় ধরাতে পারে।’ ওই সময় অন্য একজন মন্ত্রী জানান, স্টেকহোল্ডার বা অংশীদারদের সঙ্গে আলোচনা করেই এ খসড়া করা হয়েছে।</div> <div> ইপিজেড শ্রমিকরা বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬-এর আওতাবহির্ভূত এবং তাঁরা আলাদা দুটি নির্দেশিকা, ইপিজেড শ্রমিককল্যাণ সমিতি ও শিল্প সম্পর্ক আইন অনুযায়ী পরিচালিত হন। ইপিজেড শ্রমিকরা বেশি বেতন, অর্জিত ছুটি নগদায়নের সুবিধা, দুটি বোনাস, খাদ্য ভাতা, বিনা মূল্যে চিকিৎসার সুবিধা পেয়ে থাকেন। প্রস্তাবিত খসড়া আইনে ইপিজেড শ্রমিকদের চাকরির নিয়োগ শর্ত, প্রসূতিকল্যাণ সুবিধা, চাকরির শর্তগুলো, নিরাপত্তা ও কল্যাণমূলক ব্যবস্থা, কাজের পরিবেশ, কর্মঘণ্টা, ইপিজেড মজুরি বোর্ড, ইপিজেড শ্রম আদালত, পরিদর্শন, ছুটি, মজুরি ও পরিশোধ ইত্যাদি বিষয় অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।</div> <div> ব্যবস্থাপনায় দুর্নীতি ও অদক্ষতার পাশাপাশি বল্গাহীন শ্রমিক আন্দোলনে যখন রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প খাত বিপর্যস্ত, আশির দশকের সেই সময়ে বেসরকারি খাতকে বিনিয়োগে আকৃষ্ট করতে নানা ধরনের প্রণোদনা দেয় সরকার। বিদেশি বিনিয়োগের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে ১৯৮০ সালে তৈরি হয় বেপজা ও বৈদেশিক বেসরকারি বিনিয়োগ আইন। এসব আইনের আওতায় গড়ে ওঠে চট্টগ্রাম, ঢাকা ইপিজেড। ক্রমে আরো ছয়টি ইপিজেড গড়ে ওঠে বিভিন্ন স্থানে। এসব বিশেষায়িত শিল্পাঞ্চলে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের বাড়তি সুবিধা দেওয়ার পাশাপাশি শ্রমিক অসন্তোষমুক্ত কর্মপরিবেশের নিশ্চয়তাও দেওয়া হয়। রাষ্ট্রায়ত্ত কল-কারখানায় শ্রমিকদের অধিকারের অপব্যবহারের কারণে শিল্পোদ্যোক্তাদের কাছে তখন ট্রেড ইউনিয়নভীতি প্রবল ছিল। ফলে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের এ ক্ষেত্রে আশ্বস্ত করা সরকারের জন্য জরুরি ছিল। কর অবকাশ, শুল্কমুক্ত আমদানি-রপ্তানি, উন্নত অবকাঠামোসহ নানা সুযোগ-সুবিধার পাশাপাশি শ্রমিক অসন্তোষমুক্ত কর্মপরিবেশের আশ্বাসে গত সাড়ে তিন দশকে দেশি-বিদেশি অনেক রপ্তানিমুখী প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে ইপিজেডগুলোতে। সেখানকার শ্রমিকদের মজুরিসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা ও কর্মপরিবেশ বাইরের কারখানার চেয়ে ভালো থাকায় শ্রম অসন্তোষ বিরল।</div> <div> বাংলাদেশ রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকা (বেপজা) কর্তৃপক্ষের গত ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত দেওয়া হিসাবে দেশের আটটি ইপিজেডে ৫৬৩টি প্রতিষ্ঠান শিল্প স্থাপন করেছে। এগুলোর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠান ১৭টি, যা ইপিজেডে চালু দেশি-বিদেশি মোট প্রতিষ্ঠানের মাত্র ৩ শতাংশ। ইপিজেডে মোট বিনিয়োগ তিন বিলিয়ন (৩০০ কোটি) ডলার। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের কম্পানিগুলোর বিনিয়োগ ১১ কোটি ৭০ লাখ ডলার, যা মোট বিনিয়োগের ৪ শতাংশেরও কম। দেশের আটটি ইপিজেডে তিন লাখ ৮২ হাজার শ্রমিক কাজ করে। যুক্তরাষ্ট্রের কম্পানিগুলোতে নিয়োজিত রয়েছে চার হাজার ৬৫০ শ্রমিক, যা ইপিজেডের মোট শ্রমশক্তির ১ শতাংশের কিছু বেশি। তবে একক দেশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের সবচেয়ে বড় বাজার। তাই যুক্তরাষ্ট্রের শ্রমিক সংগঠনের চাপে পড়েই পরিমার্জন করতে হয়েছে শ্রমসংক্রান্ত ইপিজেডের নিজস্ব বিধান। সেখানকার শক্তিশালী বস্ত্র শ্রমিক সংগঠনের চাপে বাংলাদেশের জন্য নির্ধারিত বাণিজ্য সুবিধার সঙ্গে ইপিজেডে শ্রমিকদের সংগঠন করার অধিকার যুক্ত করে যুক্তরাষ্ট্র সরকার। সরকার এ চাপ উপেক্ষা করতে পারেনি। ফলে ২০০৪ সালে ইপিজেড ওয়ার্কার্স অ্যাসোসিয়েশন আইন সংসদে পাস করে রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকার শ্রমিকদের জন্য সীমিত আকারে সংগঠন করার সুযোগ দেওয়া হয়। শ্রমিকদের সংগঠন করার অধিকার দেশের শ্রম আইনে থাকলেও বিদেশি বিনিয়োগকারীদের উদ্বেগের কারণে ইপিজেডগুলোকে এ আইনের বাইরে রাখা হয়েছে।</div> <div> আমেরিকান চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের (অ্যামচেম) সভাপতি আফতাব উল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এ আইন করতে যাওয়ার জন্য অ্যামচেমের পক্ষ থেকে আমি সরকারকে ধন্যবাদ জানাই। কারণ আমরা আইএলও, ডাব্লিউটিও এবং টিকফা অনুমোদনকারী দেশ। এ কারণে আমরা শ্রমিকদের স্বাধীনতা দিতে বাধ্য। বিষয়টি ইতিবাচকভাবে দেখা দরকার।’</div> <div> বেপজা সূত্রে জানা যায়, বেপজার অধীন আটটি ইপিজেড রয়েছে। এসব ইপিজেড রপ্তানিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। ইপিজেডগুলো টেনে আনছে বিদেশি বিনিয়োগ। এর ফলে কর্মসংস্থান বাড়ছে। রাজনৈতিক পরিস্থিতি আরো ইতিবাচক থাকলে রপ্তানি আয় আরো বেশি হতো।</div>