মার্কিন বহুজাতিক প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান ওরাকলে চাকরি পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার! কিভাবে সুযোগ পেলেন?
আমি প্রায় পাঁচ বছর অ্যামাজনে কাজ করেছি। সেখানে ভয়েস অ্যাসিস্ট্যান্ট অ্যালেক্সার কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) টিমে সিনিয়র অ্যাপ্লায়েড সায়েন্টিস্ট হিসেবে কর্মরত ছিলাম। এক পর্যায়ে মনে হলো, ক্যারিয়ার উন্নয়নের গতি ধীর হয়ে আসছে, নতুন কিছু করা উচিত। এদিকে ওরাকল থেকে প্রস্তাব পেয়ে ই-মেইলে তাদের সঙ্গে কথাবার্তা হয়।
এরপর প্রিন্সিপাল অ্যাপ্লায়েড সায়েন্টিস্ট পদে ইন্টারভিউর তারিখ ঠিক করা হয়। ইন্টারভিউ ভালো হওয়ায় তারা আমাকে চাকরির অফার করে। এর মাসখানেক পর সেখানে যোগ দিই।
বাছাই প্রক্রিয়া কয়টি ধাপে হয়েছে? কী কী প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে?
আন্তর্জাতিক শীর্ষ পর্যায়ের প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলোতে সাধারণত দুই থেকে চার রাউন্ডে ইন্টারভিউ হয়।
প্রথমে হায়ারিং ম্যানেজারের সঙ্গে মিটিং হয়। এখানে চাকরিপ্রার্থীর কাজের অভিজ্ঞতা ও দক্ষতা নিয়ে আলোচনা হয়। একই সঙ্গে ম্যানেজার তাঁর টিম কী নিয়ে কাজ করে, প্রার্থী যোগ দিলে কী কী করতে পারবে, টিমের কাজের রীতি কেমন, এসব নিয়েও ধারণা দেন। এই মিটিংয়ে যদি দুই পক্ষই আশ্বস্ত হয়, তাহলে দ্বিতীয় রাউন্ডের ইন্টারভিউ হয়।
সেখানে টিমের একজন বিজ্ঞানী প্রার্থীর প্রযুক্তিগত দক্ষতা এবং অভিজ্ঞতা নিয়ে বিভিন্ন প্রশ্ন করে বোঝার চেষ্টা করেন, প্রার্থীর প্রয়োজনীয় দক্ষতা আছে কি না। আমার ক্ষেত্রে ন্যাচরাল ল্যাংগুয়েজ প্রসেসিং, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স, মেশিন লার্নিং, লার্জ ল্যাংগুয়েজ মডেল নিয়ে প্রশ্ন করা হয়েছিল। এই রাউন্ডে ভালো করলে পরের রাউন্ডে (অনসাইট) যাওয়ার সুযোগ হয়। সেখানে সাধারণত পাঁচজন কর্মকর্তা এক ঘণ্টা করে মোট পাঁচ ঘণ্টা ইন্টারভিউ নেন। সেটা এক দিনেও হতে পারে, আবার পর পর দুই দিনেও হতে পারে।
সেখানে প্রযুক্তিগত দক্ষতার পাশাপাশি আচরণগত দক্ষতারও পরীক্ষা নেওয়া হয়।
বিদেশি প্রতিষ্ঠানে চাকরি পেতে চ্যালেঞ্জ কী কী?
আমি স্টুডেন্ট ভিসা নিয়ে আমেরিকায় পড়তে এসেছি। ইউনিভার্সিটি অব হিউস্টনে পিএইচডি করে চাকরিতে ঢুকেছি। আমার কাছে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ মনে হয়েছে, ইমিগ্রেশন ও ভিসার জটিলতা। আমেরিকায় চাকরি করতে হলে এইচওয়ানবি (ওয়ার্ক পারমিট) ভিসা নিতে হয়। এটার জন্য এইচওয়ানবি ভিসা স্পন্সর করে—এমন প্রতিষ্ঠান দরকার হয়। খুব কম প্রতিষ্ঠানই এটা করে থাকে। একদিন সকালে অফিসে গিয়ে হয়তো দেখবেন আপনার চাকরিটা নেই! এমন অহরহ হচ্ছে। চাকরি হারানোর পর ৬০ দিনের মধ্যে নতুন চাকরি না পেলে এইচওয়ানবি ভিসা বাতিল হয়ে যায়। আরেকটা চ্যালেঞ্জ—কমিউনিকেশন স্কিল। মানুষের সামনে উপস্থাপনা, তাদের সামনে কথা বলা, পেশাগত নেটওয়ার্ক তৈরি, ক্রিটিক্যাল রাইটিং, নিয়োগকর্তার কাছে নিজের অভিজ্ঞতা ঠিকঠাক তুলে ধরা—এসব যোগ্যতা অনেকেরই নেই। প্রার্থীদের বড় একটি অংশ ঠিকমতো একটা প্রফেশনাল ই-মেইল লিখতে পারে না, সিভি বানাতে পারে না।
প্রিন্সিপাল অ্যাপ্লায়েড সায়েন্টিস্টের কাজ কী? সারা বিশ্বে এই পদের সুযোগ কেমন?
এটা একটা টেকনিক্যাল লিডারশিপ রোল বা পদ। প্রতিষ্ঠানের প্রযুক্তিগত সমস্যা সমাধানের গতিপথ ডিজাইন করা এবং সেটা সমাধানের জন্য সিনিয়র এবং জুনিয়র সায়েন্টিস্টদের নেতৃত্ব দেওয়াই এই পদের মূল কাজ। এ ছাড়া দ্রুত পরিবর্তনশীল প্রযুক্তির সঙ্গে তাল মিলিয়ে প্রতিষ্ঠানের কর্মকৌশল নির্ধারণে সাহায্য করাও এই দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। জুনিয়র এবং সিনিয়র লেভেলে প্রজেক্ট ডেলিভারি করা মূল দায়িত্ব। আর প্রিন্সিপাল লেভেলে ভিশন ডেভেলপ করা এবং সেটার জন্য দীর্ঘ বা স্বল্প মেয়াদে কী ধরনের গবেষণা করা উচিত, সেটার পরিকল্পনা করতে হয়। প্রতিষ্ঠানভেদে এই পদকে স্টাফ সায়েন্টিস্টও বলা হয়।
ওরাকলের আগে কোথায় কোথায় কাজ করেছেন?
দেশে পড়াশোনা করেছি শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে। আমার বিভাগেই (সিএসই) গবেষক হিসেবে দুই বছর চাকরি করেছি বাংলা সার্চ ইঞ্জিন পিপীলিকা প্রজেক্টে। এরপর আমি চলে আসি যুক্তরাষ্ট্রে পিএইচডি করতে। আমার গবেষণার বিষয়বস্তু ছিল ন্যাচারাল ল্যাংগুয়েজ প্রসেসিং, ডিপ লার্নিং। পিএইচডি করার সময় আমি ইন্টেল, জেনারেল ইলেকট্রনিকস এবং অ্যামাজনে ইন্টার্নশিপ করেছি। তারপর পিএইচডি সম্পন্ন করে অ্যামাজনে যোগ দিই অ্যাপ্লায়েড সায়েন্টিস্ট হিসেবে। সেখানে প্রায় পাঁচ বছর চাকরি করেছি। সর্বশেষ যোগ দিই ওরাকলে।
যারা বিশ্বের প্রথম সারির আইটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতে চায়, তারা কিভাবে নিজেদের প্রস্তুত করবে? এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশিদের জন্য চ্যালেঞ্জ কী কী?
প্রতিদিন নিজের স্কিল নিয়ে কাজ করতে হবে, পড়াশোনা ঠিকমতো করতে হবে। নিজের স্কিল নিয়ে কাজ করতে করতে এক্সপার্ট হয়ে গেলে চাকরি খোঁজার কষ্ট করতে হয় না। এ যুগে অনেক কিছুই অনলাইনে শেখা যায়। আমিও অনেক কিছু অনলাইনে শিখেছি। আমি বাংলাদেশিদের জন্য আলাদা কোনো চ্যালেঞ্জ দেখছি না। পড়াশোনায় ভালো হলে বিশ্ববিদ্যালয় (পাবলিক) পর্যন্ত বিনা খরচায় পড়া যায়। তবে এটা ঠিক, বাংলাদেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিবেশ শিক্ষার্থীবান্ধব নয়। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে পরিবেশ নষ্ট করছে ‘রাজনীতি’।
এখন আন্তর্জাতিক চাকরির বাজারে কোন কোন দক্ষতার কর্মীদের চহিদা সবচেয়ে বেশি? কিভাবে এসব দক্ষতা অর্জন করা সম্ভব?
বর্তমানে এআইনির্ভর প্রযুক্তির দক্ষতার অনেক চাহিদা। এ ধরনের সফটওয়্যার নিয়ে কাজ জানা থাকলে বহু উপায়ে অর্থ উপার্জন করা সম্ভব। ইন্টারনেটে এগুলো শেখার প্রচুর ফ্রি রিসোর্স অনলাইনে পাওয়া যায়। নিয়মিত চর্চা করতে হবে। যাঁরা কম্পিউটার বিজ্ঞান বা প্রযুক্তি নিয়ে পড়াশোনা করেন, তাঁদের জন্য প্রগ্রামিং ভালোমতো শেখা, ডাটা স্ট্রাকচার এবং অ্যালগরিদমে দক্ষ হওয়া, প্রচুর প্রজেক্ট করে প্র্যাকটিক্যাল অভিজ্ঞতা অর্জন করা খুব জরুরি। আমি যখন পিএইচডি করতে আমেরিকায় আসি, তখন অনেক কিছু প্রথমবারের মতো জানতে পারি। আমার অসংখ্যবার আফসোস হয়েছে, ইশ! এগুলো যদি আমি দেশে থাকা অবস্থাতেই জানতাম তাহলে ক্যারিয়ারে হয়তো আরো ভালো করতে পারতাম। তাই সময় পেলে এই বিষয়গুলো নিয়ে অনলাইনে লেখালেখি করি, ভিডিও তৈরি করি।