<p>দেশের বড় একটি অংশ এখনো বন্যাকবলিত। ডুবে গেছে গ্রামের পর গ্রাম। বেশির ভাগ লোকজনই বাধ্য হয়ে নিজের ঘরবাড়ি ছেড়ে আশ্রয় নিয়েছে বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্রে। চরম ভোগান্তিতে পড়েছে সর্বস্তরের মানুষ, বৃদ্ধ, শিশু, শারীরিক প্রতিবন্ধীসহ গর্ভবতী নারীরাও। এ ছাড়াও বন্যার কবলে পড়ে চারদিকে শুধু ধ্বংসস্তূপ। সহায়-সম্বল হারিয়ে মানুষ হচ্ছে নিঃস্ব, হারিয়েছে মাঠের ফসল, গবাদি পশু, পুকুরের মাছ, বাড়িঘর ইত্যাদি সব কিছু।</p> <p>এরই মধ্যে পানি নামতে শুরু করেছে, অতিবৃষ্টিও থেমেছে। আর এ সময়ে বেড়েই চলেছে মানুষের নানা রকম স্বাস্থ্যঝুঁকি। এ ধরনের দুর্যোগপূর্ণ সময়টাতে দেখা দিতে পারে নানা রকমের রোগবালাই। এমনকি মহামারি আকারে কিছু রোগ দেখা দিতে পারে। আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে গৃহপালিত পশুপাখিসহ নানা ধরনের লোকজনের চাপে ও জনসমাগমের কারণে পয়োনিষ্কাশনের অসুবিধা, বিশুদ্ধ পানি,  খাবারের অভাবসহ সব মিলিয়ে বিভিন্ন ধরনের স্বাস্থ্যঝুঁকি বেড়েই চলেছে। এসব বিষয়ে আগে থেকেই আমাদের সতর্কতা ও সাবধানতার বিকল্প নেই।</p> <p> </p> <p><strong>পানিবাহিত রোগ</strong></p> <p>বন্যাকবলিত এলাকায় প্রকট হয়ে ওঠে বিশুদ্ধ পানির অভাব। টিউবওয়েল নিমজ্জিত হয়ে যাওয়া ও পানি ফোটাতে না পারা, পানি বিশুদ্ধকরণের উপকরণ বা ট্যাবলেটের দুষ্প্রাপ্যতা ও অন্যান্য সমস্যায় এসব হচ্ছে। তা ছাড়া বন্যার পানিতে মানুষ ও পশুপাখির মলমূত্র, আবর্জনা, এমনকি মৃতদেহের অবশেষও মিশে যায়। সে কারণে ছড়িয়ে পড়ে নানা জীবাণু। বন্যার সময়ে দূষিত খাবার পানি আর খাবারের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে ডায়রিয়া, আমাশয়, কলেরাসহ পানিবাহিত রোগ যেমন—টাইফয়েড, প্যরাটাইফয়েড, জন্ডিস; বিশেষ করে বাচ্চাদের বিভিন্ন ভাইরাসজনিত ডাইরিয়া এ সময়ে সবচেয়ে বেশি দেখা দেয়।</p> <p>ডায়রিয়া হলে শরীর থেকে পানি ও লবণ বেরিয়ে যায়। তাই লবণ ও পানির অভাব পূরণ করাই এটির প্রধান চিকিৎসা। ডায়রিয়া বা কলেরা হলে প্রথম করণীয় মুখে খাওয়ার স্যালাইন পান করা। যতবার বমি বা পাতলা পায়খানা হবে, ততবার স্যালাইন খেতে হবে। মুখে স্যালাইন খেতে না পারলে, জ্বর হলে, পায়খানার সঙ্গে রক্তপাত হলে বা তীব্র পানিশূন্যতা দেখা দিলে হাসপাতালে ভর্তি হতে হবে। ছোট শিশু মায়ের দুধ পান চালিয়ে যাবে। অন্যরা স্বাভাবিক খাবার খাবে।</p> <p> </p> <p><strong>শ্বাসতন্ত্রের রোগ</strong></p> <p>এ সময় ঠাণ্ডা লাগা বা পানিতে অনেকক্ষণ থাকায় সর্দি-কাশি, জ্বর, নিউমোনিয়া, শ্বাসতন্ত্রের নানা রোগও দেখা দিতে পারে। যারা আগে থেকেই বিভিন্ন শ্বাসজনিত রোগে ভুগছে, তাদের সমস্যাটা আরো প্রকট আকার ধারণ করে।</p> <p>সাধারণ কাশি বা জ্বরে অ্যান্টিহিস্টামিন এবং প্যারাসিটামল জাতীয় ওষুধ সেবন করা যায়। হালকা গরম পানি পান বা ভাপ নিলে আরাম পাওয়া যাবে। শ্বাসকষ্ট হলে ইনহেলার বা নেবুলাইজার দরকার হতে পারে। যেকোনো প্রয়োজনে অবশ্যই মেডিক্যাল টিমের সহায়তা নেওয়া উচিত। শিশুদের বুকের খাঁচা দেবে যেতে থাকলে বা ঘড়ঘড় শব্দ হলে কিংবা নীল হয়ে গেলে দ্রুত হাসপাতালে নিতে হবে।</p> <p><br /> <strong>ত্বকের বা চর্মরোগ</strong></p> <p>বন্যার নোংরা পানির সংস্পর্শে আসায় ত্বকে ছত্রাক, ইসক্যাবিস বা খোসপাঁচড়াসহ নানা সমস্যা দেখা দিতে পারে। কারণ এ সময়ের নোংরা পানি বিভিন্ন জীবাণুর ধারক ও বাহক। আশ্রয়কেন্দ্রে গাদাগাদি করে বাস করায় ত্বকের রোগগুলো খুব দ্রুত ছড়ায়। যথাসম্ভব পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকতে হবে। ভেজা বা আধভেজা কাপড় গায়ে রাখা ঠিক নয়। বন্যার্তদের বিতরণে নিয়ে যাওয়া পোশাক অবশ্যই ধোয়া, পরিষ্কার ও শুকনা বা ইস্ত্রি করা হতে হবে। শিশুদের ডায়াপার ও নারীদের স্যানিটারি ন্যাপকিন ছয় ঘণ্টা পর পর বদলানো দরকার এবং যথাযথভাবে প্যাকেট করে ফেলা উচিত। ফেলার মতো জায়গা না পেলে আপাতত মুখবন্ধ ব্যাগে রেখে দেওয়া যায়।</p> <p> </p> <p><strong>চোখের রোগ</strong></p> <p>দূষিত পানির সঙ্গে এই সময়ে বায়ুদূষণ প্রবল আকার ধারণ করছে। এর ফলে বিভিন্ন ধরনের চোখের রোগের প্রকোপ বেড়ে যাচ্ছে, যেমন—কনজাংটিভাইটিস, ইউভিআইটিস, স্টাই, কর্নিয়ার ক্ষত ইত্যাদি। এসব রোগ থেকে পরিত্রাণের জন্য ঘন ঘন চোখ ঘষা থেকে বিরত থাকতে হবে, নোংরা হাতে বা ময়লা পানি দ্বারা চোখ স্পর্শ করা যাবে না। মুখ ধুতে হবে পরিষ্কার পানি দ্বারা। ব্যবহার্য রুমাল বা তোয়ালে কারো সঙ্গে শেয়ার করা উচিত হবে না।</p> <p> </p> <p><strong>শিশুর স্বাস্থ্যঝুঁকি</strong></p> <p>বন্যা এবং বন্যা-পরবর্তী সময়ের প্রভাবে লাখ লাখ শিশুর অপুষ্টিজনিত রোগ দেখা দিতে পারে। শিশুরা বিভিন্ন ডায়রিয়াসহ অন্যান্য রোগ যেমন—নিউমোনিয়া, শ্বাসযন্ত্রের প্রদাহ ইত্যাদিতে আক্রান্ত হচ্ছে। ইউনিসেফের তথ্য মতে, ভয়াবহ বন্যার ঝুঁকিতে প্রায় ২০ লাখ শিশু।</p> <p> </p> <p><strong>মানসিক রোগ</strong></p> <p>শারীরিক রোগের পাশাপাশি মানুষ তার সব কিছু হারিয়ে মারাত্মক মানসিক রোগের মধ্যে ভুগছে। যেমন—হতাশা, দুশ্চিন্তা, অনিদ্রা, টেনশন, ডিপ্রেশন, মানসিক অবসাদ, আতঙ্কগ্রস্থতা ইত্যাদি।</p> <p> </p> <p><strong>বন্যার পানিতে ডুবে যাওয়া</strong></p> <p>ডুবে যাওয়ার ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি শিশুদের।  এ ছাড়া সাধারণ মানুষসহ উদ্ধারকর্মী বা ত্রাণকর্মীরাও এ ঝুঁকির মধ্যে রয়েছেন।</p> <p> </p> <p><strong>সাপে কাটা</strong></p> <p>বন্যা ও বন্যা-পরবর্তী সময়ে সাপে কাটার ঝুঁকি ভয়াবহ আকার ধারণ করছে। তাই সাপে কাটার ঝুঁকি থেকে সতর্ক থাকতে হবে।</p> <p> </p> <p><strong>করণীয় ও আরো সতর্কতা </strong></p> <p>►   যথাসম্ভব ফলমূলসহ পচনশীল খাদ্যদ্রব্যের পরিবর্তে শুকনা খাবার খেতে হবে।</p> <p>►   নিরাপদ ও বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা করতে হবে।</p> <p>►   যত কষ্ট হোক, পানি বিশুদ্ধ না করে পান করবেন না।</p> <p>►   পানি ফুটিয়ে, ক্লোরিন ব্যবহার করে বা পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট ব্যবহার করে তা পান করতে হবে এবং রান্নার কাজেও ব্যবহার করতে হবে। তৈজসপত্র ধোয়ার কাজেও বন্যার নোংরা পানি ব্যবহার করা উচিত নয়।</p> <p>►   কোনোক্রমেই বিশুদ্ধ পানি পাওয়া না গেলে বিকল্প ব্যবস্থা করতে হবে। যেমন—বন্যার পানি পাতলা কাপড়ে একটা পাত্রে ছেঁকে নিতে হবে। ছেঁকে নেওয়ার পর ওই পানিতে বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট মিশিয়ে আধাঘণ্টা পরে তা পান করা যেতে পারে।</p> <p>►   বন্যার পানি শরীরে লাগলে পরিষ্কার পানি দিয়ে সেই জায়গা ধুয়ে ফেলুন।</p> <p>►   সবাইকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা যতটুকু সম্ভব মেনে চলতে হবে। খাবারের আগে সাবান দিয়ে হাত ধুতে হবে অথবা স্যানিটাইজার ব্যবহার করতে হবে।</p> <p>►   সম্ভব হলে প্রয়োজনীয় ওষুধ এবং খাবার স্যালাইন রাখতে হবে।</p> <p>►   যেকোনো অসুস্থতায় অবহেলা না করে মেডিক্যাল টিমের সহায়তা নিতে হবে।</p> <p>►   শিশু, বয়স্করা বা দীর্ঘমেয়াদি রোগাক্রান্ত ব্যক্তিসহ গর্ভবতী মহিলাদের দিকে বিশেষ নজর দিতে হবে।</p> <p>►   যাঁরা ত্রাণ নিয়ে যাবেন, তাঁরাও এসব বিষয়ে সতর্ক থাকুন। সম্ভব হলে গ্লাভস ও বুট জুতা পরুন।</p> <p>►   ঘরে ফেরার পরে বন্যা দূষিত প্রতিটি ঘর পরিষ্কার, জীবাণমুক্ত এবং শুকিয়ে নিন।</p> <p> </p>