<p>আহমদ রফিক ভাষাসংগ্রামী, রবীন্দ্র গবেষক, চিন্তক ও প্রাবন্ধিক। ১৯২৯ সালের ১২ সেপ্টেম্বর কুমিল্লার শাহবাজপুরে তাঁর জন্ম। ব্রিটিশ, পাকিস্তান আর বাংলাদেশ—এই তিনটি সময় প্রত্যক্ষ করেছেন। দেশভাগের বছর (১৯৪৭) নড়াইল মহকুমা হাই স্কুল থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। চিত্রা নদীর স্বচ্ছ জলধারা আর দু’ধারে বসবাসরত মানুষের সংস্পর্শে তাঁর মানসলোকে অসাম্প্রদায়িকতার বীজ উপ্ত হয় সেই বিভাজনের কালেও। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের ছাত্র হিসেবে তিনি যখন পড়ছিলেন, তখন পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের ভাষার ওপর আধিপত্য বিস্তারের প্রত্যক্ষ চেষ্টা করে এবং এ কারণেই ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি সৃষ্টি হয়। এই সংগ্রামে আহমদ রফিক ছিলেন সামনের সারিতে। জীবনের প্রথম থেকেই তিনি মেহনতি মানুষের মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামকে সামনে রেখেছিলেন। আহমদ রফিক আমাদের সাংস্কৃতিক আন্দোলনের একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব। যে কারণে পরবর্তী সময়ে, বিশেষ করে স্বাধীন বাংলাদেশে যখন স্বৈরাচারী শক্তি রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে, তখন বাংলাদেশের মানুষের যে সাংস্কৃতিক লড়াই, সেই লড়াইয়ে তাঁকে সামনের সারিতে পাওয়া গেছে। আশির দশকে রবীন্দ্রনাথের ওপর খানিকটা পাকিস্তানি কায়দায় আধিপত্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেছিল তৎকালীন শাসকগোষ্ঠী। এ সময় রবীন্দ্রচর্চা কেন্দ্র ট্রাস্টের তিনি প্রতিষ্ঠাতা। রবীন্দ্রনাথ ও রবীন্দ্রনাথের আদর্শ চর্চা ও বিস্তারের জন্য কাজ করেন। কালের কণ্ঠ’র পক্ষে তাঁর মুখোমুখি হয়েছিলেন আলী হাবিব। এখানে বলে রাখা ভালো, এটা ঠিক গতানুগতিক সাক্ষাৎকার নয়। এই একটি সাক্ষাৎকারের জন্য একাধিকবার তাঁর কাছে যেতে হয়েছে। তিনি তাঁর অভিজ্ঞতা, দর্শন, রাজনৈতিক বিশ্বাস ইত্যাদি নিয়ে কথা বলেছেন</p> <p> </p> <p><strong>কালের কণ্ঠ :</strong> আপনার  কথা শুনতে এসেছি। আপনার ছেলেবেলা, বেড়ে ওঠা, লেখাপড়া, জীবনের এতটা পথ হেঁটে আসা—এসব নিয়ে কথা বলব। আপনার অভিজ্ঞতার কথা শুনব। একটু স্মৃতি রোমন্থন বলতে পারেন।</p> <p><strong>আহমদ রফিক :</strong> এখন তো চট করে ভুলে যাই। আবার পরক্ষণেই ডলফিনের মতো ভেসে ওঠে।</p> <p> </p> <p><strong>কালের কণ্ঠ :</strong> এখন সময় কাটে কী করে?</p> <p><strong>আহমদ রফিক :</strong> শরীরটা, বিশেষ করে চোখ নিয়ে সমস্যায় আছি। তার পরও কিছু কিছু লিখছি।</p> <p> </p> <p><strong>কালের কণ্ঠ : </strong>নতুন বই কিছু বেরিয়েছে এ বছর?</p> <p><strong>আহমদ রফিক : </strong>নতুন বই নেই। তবে গত বছরও বই বেরিয়েছে। বিচ্ছিন্ন ভাবনা। এখন একটা উপন্যাস লেখার কাজে হাত দিয়েছি। এটা এক ধরনের ফ্যান্টাসি বলতে পারো। আজকাল ফ্যান্টাসিতে পেয়ে বসেছে। উপন্যাসটা খুব যন্ত্রণা দিচ্ছে। মনে হচ্ছে শেষ হয়ে যাবে, শেষ হচ্ছে না। অন্যদিকে মোড় নিচ্ছে। কোনখানে গিয়ে থামবে বলতে পারছি না। কোথায় গিয়ে কিভাবে শেষ হবে, তা-ও জানি না।</p> <p> </p> <p><strong>কালের কণ্ঠ :</strong> উপন্যাসের বিষয় তাহলে কী, ফ্যান্টাসি?</p> <p><strong>আহমদ রফিক :</strong> না, ফ্যান্টাসি নয়। উপন্যাসের বিষয় বিপ্লব।</p> <p> </p> <p><strong>কালের কণ্ঠ :</strong> যে বিপ্লবটা আপনারা সম্পন্ন করতে পারেননি, সেই বিপ্লবের কথা বলেছেন?</p> <p><strong>আহমদ রফিক : </strong>হ্যাঁ, সেটাই।</p> <p> </p> <p><strong>কালের কণ্ঠ : </strong>উপন্যাসের পটভূমি কত সাল থেকে শুরু?</p> <p><strong>আহমদ রফিক :</strong> এখানে একটা ফ্যাঁকড়া আছে। সেটা হচ্ছে, এর শুরুটা রাজনৈতিক নয়, পারিবারিক। এর বেশি এখন বলতে পারছি না। বলাটা ঠিক হবে না। তুমি বলতে পারো, আপনি তো জীবন শেষ করে ফেলেছেন। এখনো যদি শাস্ত্রীয় সংগীতের ওস্তাদদের মতো এটা গোপন রেখে যান, তাহলে তো এটা গোপনই থাকবে। কেউ জানবে না। কিন্তু আমি যখন একটা শপথ করেছি, সেটা রক্ষা করা আমার কর্তব্যের মধ্যে পড়ে।</p> <p> </p> <p><strong>কালের কণ্ঠ :</strong> আপনার বাড়ির কাছের নদী তো মেঘনা। ওখানে কত বছর পর্যন্ত কেটেছে?</p> <p><strong>আহমদ রফিক : </strong>ওখানে শৈশব কেটেছে। কৈশোরের এক-দুই বছর। মাঝখানে মা যখন জিদ ধরলেন বাড়িতে যাবেন, তখন যেতে হলো তাঁর সঙ্গে। কেউ যাবে না। আমি তো সব সময় এই কাজে ছিলাম। কেউ নেই তো রফিক যাও। তোমার খুব পছন্দের মানুষ, শ্রদ্ধেয় মানুষ, আমার সেজদা—তিনি বললেন, আমি যেতে পারব না। তো, আমি গেলাম মায়ের সঙ্গে। ওখানকার স্কুলে ভর্তি হলাম। পড়লাম। খুব বাজে রেজাল্ট করলাম। এরপর গেলাম আরেকটা স্কুলে। নড়াইলে। নড়াইল আমার বড়দার কর্মক্ষেত্র। নড়াইল স্কুলটা তখন খুব ভালো অবস্থায় ছিল না। দু-একজন ছাড়া ভালো শিক্ষকও ছিলেন না।</p> <p> </p> <p><strong>কালের কণ্ঠ :</strong> কিন্তু নড়াইল জায়গাটা তো অসাধারণ।</p> <p><strong>আহমদ রফিক :</strong> নড়াইল জায়গাটা অসাধারণ। আমার তারুণ্যের দিনগুলো চিত্রা নদীর পারে পারে ভরে আছে। অসাধারণ বাঁকফেরা নদী। সেই নদীর ধারে ধারে আমার তরুণবেলার ইতিকথা লেখা আছে।</p> <p><strong>কালের কণ্ঠ : </strong>নড়াইলে অসাধারণ একটা অসাম্প্রদায়িক ও সাংস্কৃতিক পরিবেশ ছিল।</p> <p><strong>আহমদ রফিক :</strong> হ্যাঁ, নড়াইলের একটা অসাধারণ অসাম্প্রদায়িক চরিত্র ছিল। সেটা আমি নিজেও গিয়ে দেখেছি। আমি যখন প্রথম গেলাম, তখন আমাকে ভর্তি করে দিল একটা মক্তবে। আমি পাঠশালায় দ্বিতীয় থেকে তৃতীয় শ্রেণিতে উঠে নড়াইলে চলে যাই। দুই বছর আরবি উর্দু, অঙ্ক আর সামান্য ইতিহাস ও বাংলা পড়াল।</p> <p> </p> <p><strong>কালের কণ্ঠ : </strong>নড়াইলে তো অসাধারণ বন্ধু পেয়েছেন আপনি।</p> <p><strong>আহমদ রফিক :</strong> অসাধারণ বন্ধু দেবু, দেবব্রত বসু। অমন বন্ধু হয় না।</p> <p> </p> <p><strong>কালের কণ্ঠ : </strong>নড়াইলের ওই সময়ের রাজনৈতিক আবহ নিয়ে বলুন।</p> <p><strong>আহমদ রফিক : </strong>রাজনৈতিক আবহ খুব ভালো ছিল। প্রথম যখন গেলাম, তখন তো খুবই ভালো। যদিও হিন্দুপ্রধান এলাকা, তবু এটা অনায়াসে বলা যায়। ওয়ালিউর রহমান সাহেব কংগ্রেসের রাজনীতি করতেন। আফসারউদ্দিন মোক্তার প্রজা পার্টি করতেন। পরে কংগ্রেসে যোগ দিলেন। মালেক সাহেব উকিল প্রথমে প্রজা পার্টি, পরে কংগ্রেসে যোগ দেন। অনেক পরে রোধ হয় মুসলিম লীগে যোগ দেন। কালান্দার সাহেব ছিলেন কড়া মুসলিম লীগার। কড়া মুসলিম লীগার হলেও তিনি কারো সঙ্গে দ্বন্দ্বে যেতেন না। সব মিলিয়ে একটা শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান ছিল। ভাবটা এমন, ‘যে যার মতো করে চলো, কারোরটাতে কারো হাত দেওয়ার দরকার নেই। আমরা আছি বেশ আছি, ভালো আছি।’ এটা একটা ভালো রাজনৈতিক অবস্থান। আমি প্রথম নড়াইলে গিয়ে দেখেছি। পরে মায়ের সঙ্গে চলে এলাম। আবার গেলাম ১৯৪২ সালে। তখনো দেখেছি।</p> <p>১৯৪২ সালে আগস্ট আন্দোলন হয়েছিল। একটা অসাধারণ আন্দোলন। ওটা আমি মনেপ্রাণে গ্রহণ করেছি ওই বয়সেই, এবং পরেও। রাহুল সাংকৃত্যায়ন যদি এই আন্দোলনে নামতে পারেন এবং এই আন্দোলনে নেতৃত্বে অংশগ্রহণ করতে পারেন, সেখানে আমি কোন ছার! সবচেয়ে বড় কথা, এই আন্দোলন সেক্যুলার আন্দোলন ছিল। এই আন্দোলনকে কংগ্রেস তাদের আন্দোলন দাবি করেছে শুরু থেকেই। কারণ আন্দোলন শুরু করেছিলেন মহাত্মা গান্ধী। সেটা ছিল কুইট ইন্ডিয়া, ইংরেজ ভারত ছাড়ো। তারপর যখন এটাতে সামান্য সহিংসতা দেখা দিল, তখন গান্ধী এটা থেকে সরে গেলেন। বললেন, ‘এই আন্দোলন আমি শুরু করেছিলাম। কিন্তু এই আন্দোলনের চরিত্র বদলে গেছে। এটা আমার আন্দোলন নয়। আমি এটা থেকে নিজেকে তুলে নিলাম।’ এ অবস্থায় বামপন্থীরা এই আন্দোলনটাকে গ্রহণ করল। যেমন—আরএসপিআই। আরএসপিআই মানে হচ্ছে রেভল্যুশনারি সোশ্যালিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়া। কমিউনিস্ট না কিন্তু, সোশ্যালিস্ট। সোশ্যালিস্ট হলেও তারা কিন্তু জনসাধারণের মাটিকে স্পর্শ করে গেছে। তোমরা যদি সতীনাথ ভাদুড়ির উপন্যাস ‘জাগরি’ পড়ো, তাহলে কিছুটা ছবি পাবে সেখানে। ওটা অবশ্য কংগ্রেসের পয়েন্ট অব ভিউ থেকে লেখা।</p> <p> </p> <p><strong><img alt="আহমদ রফিক" height="204" src="https://cdn.kalerkantho.com/public/news_images/share/photo/shares/1.Print/2024/04.April/05-04-2024/EID-2024/1/kk-m-1a.jpg" style="float:left" width="300" />কালের কণ্ঠ :</strong> কমিউনিস্ট পার্টির একটা ভূমিকার কথা আছে। আপনি কি তার সঙ্গে একমত।</p> <p><strong>আহমদ রফিক :</strong> না, বইতে কমিউনিস্ট পার্টির যে অ্যাটিটিউড, আমি সেটা মানি না। তবে এই আন্দোলনের এসেন্সটা আমি আগাগোড়া মানি। এখনো মানি। এখনো মনে করি, ১৯৪২ সালে এই আন্দোলনটাকে যদি কমিউনিস্ট পার্টি সমর্থন করত, অন্য পার্টিগুলো সমর্থন করত, তাহলে দু-তিন বছরের মধ্যেই ইংরেজকে চাট্টিবাটি গোটাতে হতো। সেটা হয়নি বিচ্ছিন্নতার কারণে, ভিন্ন ভিন্ন মতের কারণে।</p> <p> </p> <p><strong>কালের কণ্ঠ : </strong>আপনার মনে প্রগতিশীলতার বীজ তো নড়াইলে থাকতেই বোনা হয়ে গেল। সেই প্রগতিশীল রাজনীতির আবেদন নিয়ে আপনি নড়াইলে তৃণমূলের মানুষের কাছেও গেছেন। তখন মানুষের মধ্যে এত লেখাপড়ার চল ছিল না। এত গণমাধ্যম ছিল না। তখন মানুষের সমর্থন কেমন পেয়েছেন?</p> <p><strong>আহমদ রফিক :</strong> আন্দোলনে সাধারণ মানুষের সমর্থন পুরোপুরি ছিল। চিত্রা নদীতে তখন অনেক লঞ্চ চলত। ওই লঞ্চে আমি ও আমার বন্ধু দেবু, আমরা দুজন সিগারেটের কৌটার মুখ বন্ধ করে চাঁদা তুলেছি। লঞ্চে যখন গিয়েছি, প্রথমে প্রশ্ন করেছে, আপনারা কোন পার্টি? দালাল পার্টি, না আন্দোলনের পার্টি। এটা একটা বড় জিনিস।</p> <p> </p> <p><strong>কালের কণ্ঠ : </strong>ওই সময়ে মানুষের এই সচেতনতার জায়গাটা তৈরি হলো কী করে?</p> <p><strong>আহমদ রফিক : </strong>মানুষ যখন ক্রমাগত ধাক্কা খেতে থাকে, তখন কিছু পরিমাণ সচেতনতা আপনাআপনি তৈরি হয়। রাজনৈতিক নেতারা যতই তাত্ত্বিকভাবে নিক না কেন, সাধারণ মানুষ কিন্তু সরাসরি স্বাধীনতা চেয়েছে। একটা আন্দোলন যদি তৃণমূলকে ছুঁয়ে যায়, তখন সেটা মধ্যবিত্ত কতটা গ্রহণ করল না করল তাতে কিছু এসে যায় না। মধ্যবিত্তরা তখন বাধ্য হয়েই সে আন্দোলনে যোগ দেয়। রাজনৈতিকভাবে যারা সচেতন, তারা যোগ দেয়। রাজনৈতিকভাবে যারা সচেতন না, তারা ধাক্কা খেয়ে যোগ দেয়। এই ধাক্কা খাওয়াদের মধ্যে আবার দুই দল আছে। এক দল আন্দোলনের এসেন্সটা গ্রহণ করে। আরেক দল এসেন্সটা গ্রহণ করতে গিয়ে ভুল করে, ভুল জায়গাটাকে ধরে। আমি ভুল জায়গাটাকে ধরিনি। আমি নেতাজি সুভাষ বোসের ফরোয়ার্ড ব্লকের যে সংগঠন, সেই সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে নড়াইলে সংগঠন তৈরি করেছিলাম। সে উপলক্ষে নড়াইল, লোহাগড়া, লক্ষ্মীপাশা—এসব জায়গায় গেলাম। আমি, দেবু, সঙ্গে আরো পাঁচ কি ছয়জন।</p> <p> </p> <p><strong>কালের কণ্ঠ : </strong>আপনি সারা জীবন প্রগতিশীল আন্দোলনের সঙ্গে ছিলেন। প্রগতিশীল রাজনীতিতে আত্মনিয়োগ করেছেন। বাংলাদেশে প্রগতিশীল ধারাটা বিকশিত হতে পারল না কেন?</p> <p><strong>আহমদ রফিক :</strong> প্রগতিশীল ধারাটা মার খেয়ে গেল এই জন্য যে প্রগতিশীলরা নানা ভাগে বিভক্ত হয়ে গেল। এটা একটা বড় কারণ।</p> <p> </p> <p><strong><img alt="আহমদ রফিক" height="224" src="https://cdn.kalerkantho.com/public/news_images/share/photo/shares/1.Print/2024/04.April/05-04-2024/EID-2024/1/kk-m-1b.jpg" style="float:left" width="300" />কালের কণ্ঠ :</strong> যে সময়টা আপনারা পার হয়ে এসেছেন, আপনার কিশোরবেলা থেকেই তো এক ধরনের রাজনীতির সঙ্গে আছেন আপনি। বিপ্লবের একটা আবহ তৈরি হয়েছে। বলতে গেলে মধ্যবিত্ত বাঙালি বা নিম্নমধ্যবিত্ত—তারা তো তখন রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত। আবার এই শ্রেণিটাই সমাজের সবচেয়ে বড় অনুঘটক, তার পরও বিপ্লব কেন সম্পন্ন হলো না।</p> <p><strong>আহমদ রফিক :</strong> বিপ্লব কেন সম্পন্ন হলো না, এককথায় তার জবাব, তারা সিদ্ধান্তেই পৌঁছতে পারল না। কোন পথটা নিতে হবে, কোন পথ ধরে চলে আমরা সামাজিক পরিবর্তনটা ঘটাতে পারব, এ ব্যাপারে বিভিন্ন গ্রুপ একমত হতে পারেনি। তেমনি আবার যাঁরা নির্ভরযোগ্য, তাঁরাও ঠিক করতে পারেননি আমরা কোন লাইনটা ধরব—মার্ক্সবাদী লাইন, না বিপ্লবী লাইন, না জাতীয়তাবাদী লাইন। আমার মনে হয়, সব মিলিয়ে এক ধরনের ধোঁয়াশা তৈরি হলো। নানা সংগঠন তৈরি হলো। বিপ্লবটা একসময় হারিয়ে গেল। অথবা জাতীয়বাদী চেতনা, যেটা সঠিক পথ ধরতে পারত, সেটাও হারিয়ে গেল বলে মনে হয়।</p> <p> </p> <p><strong>কালের কণ্ঠ : </strong>আপনি দুটি ধারার কথা বললেন—বিপ্লবী ধারা ও জাতীয়তাবাদী ধারা। ভারতীয় উপমহাদেশের প্রেক্ষাপটে কোন ধারাটি উপযুক্ত আজকের দিনে?</p> <p><strong>আহমদ রফিক :</strong> বিপ্লবী ধারার চেয়ে জাতীয়তাবাদী ধারার সম্ভাবনা ছিল বেশি। কিন্তু তারা নানা ভাগে বিভক্ত হয়ে গেল। ধরো যদি রাসবিহারী বসু বা তাঁর পরের যাঁরা, তাঁদের কথা বলি, তাহলে দেখা যায়, জাতীয়তাবাদকে সঠিক পথে নিয়ে যাওয়ার মতো মেধা থাকলেও তাঁদের বাস্তব চিন্তা-ভাবনার মধ্যে অনেক ফারাক ছিল। সে জন্য তাঁরা নানা কাজে একমত হতে পারেননি। এই ফারাকটা যে ছিল, সেটা ইচ্ছাকৃত না, এটা সময়ের দান। এ উপমহাদেশের শিক্ষিত মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত মিলে একটা সম্ভাবনা তৈরি করেছিল। সেখানে হঠাৎ করে বিপ্লববাদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠল। এর জন্য ইউরোপের নানা আন্দোলন দায়ী। ইতিহাসের নানা অনুষঙ্গ যুক্ত হলো। আমাদের এখানে তার ছিটেফোঁটা প্রভাব ফেলল। সেই প্রভাবটাকে আমরা এখানে কাজে লাগাতে পারিনি। আমাদের মধ্যে হিন্দু-মুসলমান প্রভেদ তৈরি হয়ে গেল। আমাদের সর্বনাশের বড় কারণ সাম্প্রদায়িকতা। এটা কেউ অস্বীকার করতে পারবে না।</p> <p> </p> <p><strong>কালের কণ্ঠ :</strong> আরেকটা প্রশ্ন। বিপ্লব কিংবা জাতীয়তাবাদী ধারা, কোনোটাই সেই অর্থে সফল হলো না। কেন?  নেতৃত্বের ব্যর্থতা, নাকি সমাজ সেটা নিতে পারল না?</p> <p><strong>আহমদ রফিক :</strong> আমি বলব দুটোই কারণ। নেতৃত্ব দিতে পারেনি। নেতৃত্বের ব্যর্থতা ছিল। তা না হলে সিপাহি বিদ্রোহের মতো একটা মাটিখোঁড়া বিদ্রোহ ব্যর্থ হয়ে গেল কেন? সিপাহি বিদ্রোহ তো সারা ভারতে, ব্যারাকপুর থেকে পেশোয়ার পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছিল। এটা ব্যর্থ হলো কেন? এই বিদ্রোহে হিন্দু-মুসলমান সমানভাবে সংশ্লিষ্ট ছিল। রানি লক্ষ্মী বাঈ তাঁর জীবনটা দিয়ে দিলেন। তাঁর বিশাল বড় রাজত্ব দিয়ে দিলেন। এটা নিয়েও তো মার্ক্সবাদীরা ভিন্নমত পোষণ করত। একদল মনে করত এটা মাটিখোঁড়া বিদ্রোহ, আরেক দল মনে করত এটা সাধারণ বিদ্রোহ। আবার সমাজও নিতে পারেনি।</p> <p> </p> <p><strong>কালের কণ্ঠ : </strong>আপনি সাম্প্রদায়িকতা নিয়ে বলছিলেন। সাম্প্রদায়িকতা কি ইংরেজদের তৈরি?</p> <p><strong>আহমদ রফিক :</strong> না, পুরোপুরি নয়। এটা আমাদের মধ্যে আগে থেকেই ছিল। ইংরেজরা আমাদের মধ্যকার সাম্প্রদায়িকতার সুযোগ নিয়েছে।</p> <p> </p> <p><strong>কালের কণ্ঠ : </strong>তাহলে তো বলতে হবে, আমাদের এই উপমহাদেশের সংখ্যাগুরু দুই সম্প্রদায়ই সাম্প্রদায়িক ছিল। আর ইংরেজরা সেই সুযোগটা ধূর্ততার সঙ্গেই নিয়েছে?</p> <p><strong>আহমদ রফিক : </strong>একটা সঠিক শব্দ বলেছ, ধূর্ততা। একদম ঠিক। ইংরেজরা সুযোগটা খুব ধূর্ততার সঙ্গে নিয়েছে। আমাদের মধ্যে বিভাজন না থাকলে ব্রিটিশরা তো এখানে ঢুকতেই পারে না। তুমি যদি বিলেতের উদাহরণই ধরো, তাহলে দেখবে যখন কোনো গণ্ডগোল দেখা দেয়, ভালো করে বললে সংকট দেখা দেয়, তখন সবাই কিন্তু এক হয়ে যায়। একত্র হয়ে দেশকে রক্ষা করবে কী করে, সেটাকেই প্রাধান্য দেয়। আমাদের তো সেই শুভবুদ্ধি ছিল না। আমি মনে করি সেই মেধাও ছিল না। অথবা মেধা ভিন্নমুখী ছিল, সঠিক জায়গায় পৌঁছতে পারেনি। এই ছোট ইংল্যান্ড এত দূর থেকে এসে এত বড় একটা দেশ দখল করে নিল? কেরানি ক্লাইভ লর্ড ক্লাইভ হয়ে গেল।</p> <p> </p> <p><strong>কালের কণ্ঠ : </strong>ব্রিটিশরা আর কিছু দিক আর না দিক, এই উপমহাদেশে প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়ার দিকটি তৈরি করে দিয়েছে?</p> <p><strong>আহমদ রফিক :</strong> তাদের ইতিবাচক দিক একটাই, আধুনিক শিক্ষার সঙ্গে তারা আমাদের পরিচিত করে গেল।</p> <p> </p> <p><strong>কালের কণ্ঠ :</strong> কিন্তু আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হয়েও আমরা কেন সাম্প্রদায়িক থেকে গেলাম?</p> <p><strong>আহমদ রফিক :</strong> সাম্প্রদায়িক থাকা আর দেশ রক্ষা করা—দুটো ভিন্ন জিনিস।</p> <p> </p> <p><strong>কালের কণ্ঠ : </strong>একটার সঙ্গে তো আরেকটার সম্পর্ক রয়েছে। সাম্প্রদায়িকতা থাকলে তো দেশটা নষ্ট হয়।</p> <p>আহমদ রফিক : সাম্প্রদায়িকতার সঙ্গে সম্পর্ক তো আছেই। সাম্প্রদায়িকতা না থাকলে এই সমস্যাগুলো থাকত না। প্রশ্ন হলো, আমরা রাজনীতি করতে পারলাম, দেশাত্মবোধক গান তৈরি করতে পারলাম, দেশাত্মবোধক চিন্তা লালন করতে পারলাম, মেধার জায়গা তৈরি করতে পারলাম, কিন্তু তাকে সঠিক জায়গায় নিয়ে একটা সঠিক পথ তৈরি করতে পারলাম না। রণনীতি, রণকৌশল তৈরি করতে পারলাম না।</p> <p> </p> <p><strong><img alt="আহমদ রফিক" height="281" src="https://cdn.kalerkantho.com/public/news_images/share/photo/shares/1.Print/2024/04.April/05-04-2024/EID-2024/1/kk-m-1c.jpg" style="float:left" width="300" />কালের কণ্ঠ : </strong>অসাম্প্রদায়িকতার ধারণা সাধারণ মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য রাজনৈতিক দলগুলো কি ভূমিকা রাখতে পেরেছে?</p> <p><strong>আহমদ রফিক :</strong> খুব সুন্দর একটি প্রশ্ন করেছ। ১৯৪৭ সালে যখন দেশভাগ হয় তখন গান্ধী নেহরু বলেছিলেন, আমরা দেশভাগ মেনে নিলাম শুধু একটি কারণে, যাতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বন্ধ হয়। কিন্তু ভারত বা পাকিস্তান, কোথাও দাঙ্গা বন্ধ হয়নি। অসাম্প্রদায়িকতার ধারণা মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো ছাড়া কেউ এগিয়ে আসেনি। কমিউনিস্ট পার্টিও এটাকে আলাদা ইস্যু হিসেবে নেয়নি। সাম্প্রদায়িকতা যে এই উপমহাদেশের জন্য আলাদা এবং গুরুত্বপূর্ণ একটা ইস্যু, এটা কোনো রাজনৈতিক দল সেভাবে নেয়নি। মানুষকে সচেতন করার চেষ্টাটা কিন্তু ছিল না। এই অসাম্প্রদায়িকতার দিকগুলো যে রাজনৈতিকভাবে এবং সংগঠনগতভাবে দাঁড়িয়ে সমাজকে সচেতন করা, দাঙ্গাবিরোধী করা, সহিংসতাবিরোধী করা, সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী করা—এই চেষ্টাটা কিন্তু হয়নি। এক একটা ঘটনা ঘটেছে, সেই ঘটনার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। ঘটনা বন্ধ হয়েছে। তারা মনে করেছে ফুরিয়ে গেল।</p> <p> </p> <p><strong>কালের কণ্ঠ : </strong>স্বাধীন বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িকতার বিষয়টি কিভাবে দেখছেন আপনি?</p> <p><strong>আহমদ রফিক :</strong> স্বাধীন বাংলাদেশেও সাম্প্রদায়িকতার প্রশ্নে অবস্থার কোনো হেরফের নেই। এখনো তো দেখছি সেই গুজব রটনা, হামলা, বিশেষ করে অপেক্ষাকৃত দরিদ্র বা নিম্নবর্গীয় সংখ্যালঘুদের ভিটা-জমি বা সম্পদ হরণের জন্য সাম্প্রদায়িক সহিংসতা হয়। বাংলাদেশি সমাজে সাম্প্রদায়িকতার বিষয়টি এবং রাজনৈতিক দলগুলোর এ সম্পর্কে ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তাই খুবই প্রাসঙ্গিক। মুখোশধারী জামায়াত-শিবিরকর্মীসহ অনেকের ভূমিকাই প্রশ্নের ঊর্ধ্বে নয়।</p> <p> </p> <p><strong>কালের কণ্ঠ : </strong>এখান থেকে উত্তরণের উপায় কী?</p> <p><strong>আহমদ রফিক :</strong> প্রশাসন থেকে রাজনৈতিক অঙ্গন ও সমাজের প্রতিটি শক্তিকে সম্প্রীতি বাস্তবায়নে গণতান্ত্রিক ও মানবিক ভূমিকা রাখতে হবে। আমি মনে করি, ছাত্র-শিক্ষক, রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন ও সচেতন শিক্ষিত শ্রেণির সমন্বিত চেষ্টায় নিরাপত্তার কাজটি নিশ্চিত করা সম্ভব। সবার আগে দরকার শপথ নিয়ে মাঠে নামা। তাৎক্ষণিক ও দীর্ঘস্থায়ী কর্মসূচিতে সক্রিয় হতে হবে। শেষ কথা হচ্ছে, বাংলাদেশের সেক্যুলার সংবিধানই আমাদের রক্ষাকবচ।</p> <p> </p> <p><strong>কালের কণ্ঠ : </strong>একটু ভিন্ন প্রসঙ্গে যাই। আপনি তো হরগঙ্গা কলেজে গেলেন ম্যাট্রিকুলেশনের পর।</p> <p><strong>আহমদ রফিক: </strong>হ্যাঁ, ম্যাট্রিকুলেশনের পর। ওখানে দেড় বছর থাকলাম চাচার বাসায়। সেখানে মোটামুটি মার্ক্সবাদী চিন্তা-ভাবনার সঙ্গে পরিচয়।</p> <p> </p> <p><strong>কালের কণ্ঠ :</strong> আপনার শিক্ষাজীবন নিয়ে একটু কথা বলি। আপনি চিকিৎসাবিজ্ঞান নিয়ে পড়েছেন। কিন্তু চিকিৎসা পেশায় আসতে পারেননি। ছোটবেলা থেকেই কি চিকিৎসক হওয়ার স্বপ্ন দেখতেন?</p> <p><strong>আহমদ রফিক : </strong>আমার ছেলেবেলা থেকে, ঠিক ছেলেবেলা নয়, ম্যাট্রিক পরীক্ষারও আগে, যখন ক্লাস নাইন-টেনে পড়ি, তখন মনে হয়েছিল, আমি ভবিষ্যতে ইতিহাস নিয়ে পড়াশোনা করব। সেটা হলো না। আমার শিক্ষার্থীজীবনটা একটা ট্র্যাজেডি। সেখানে পারিবারিক ব্যাপারটাই বড়। পারিবারিক সিদ্ধান্তের কারণে আমার পছন্দের জায়গায় যেতে পারলাম না। আমার কথার জড়তার কারণে চিন্তা করা হলো, মেডিক্যাল পড়তে হবে আমাকে। সেখানে অন্তত অধ্যাপনা না করলেও চলবে। কোনো গবেষণা না করলেও চলবে। পাঁচ টাকা ফির ডাক্তারি করে অন্তত জীবন চলে যাবে। ম্যাট্রিকে, ইন্টারমিডিয়েটে আমার কিন্তু খুব ভালো রেজাল্ট ছিল। আমি ম্যাট্রিকে ৮১ শতাংশ নম্বর পেয়েছিলাম। ইন্টারমিডিয়েটে ৭০ শতাংশ। তার পরও ঠিক করা হলো যে আমি ডাক্তারি পড়ব। পড়লাম। আমার শিক্ষার্থীজীবনের এত সুফল কোনো কাজে লাগল না।</p> <p> </p> <p><strong>কালের কণ্ঠ : </strong>তখন কি চিকিৎসকদের ফি পাঁচ টাকা ছিল।</p> <p><strong>আহমদ রফিক : </strong>বললাম বটে পাঁচ টাকার ডাক্তার। কিন্তু এই পাঁচ টাকার এক অসাধারণ একজন মেধাবী প্র্যাকটিশনার। ডা. নন্দী। ওয়ারীতে বসতেন। পাঁচ টাকা ফি নিয়ে তিনি রোগী দেখতেন। মোনায়েম খাঁ তাঁকে দেশ থেকে বিতাড়িত করেছিলেন। তাঁর বাড়ির বারান্দায় শুয়ে-বসে থেকে অনেকে চিকিৎসা নিয়ে যেতেন। মানুষ হিসেবেও তিনি ছিলেন অসাধারণ। এ রকম চিকিৎসক দেখা যায় না। তাঁর সঙ্গে আমার একটা ঘনিষ্ঠতা তৈরি হয়েছিল নানা কারণে। তাঁর কাছে আমার ঋণেরও শেষ নেই। অনেক পরামর্শ পেয়েছি তাঁর কাছ থেকে। আমাকে মাঝেমধ্যেই বলতেন, তুমি পাকিস্তান মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনে সময় দিচ্ছ না। চাকরি করছ করো, কিন্তু এখানেও সময় দাও।</p> <p>ওই সময়ে আমার করাচি যাওয়ার একটা প্রগ্রাম হলো। তখন তিনি আমাকে পিএমএ অর্থাৎ পাকিস্তান মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনে বসেই বললেন, ‘রফিক, আমি তোমাকে কিছু পরামর্শ দিই। ওরা, অর্থাৎ পশ্চিম পাকিস্তানিরা কিন্তু খুব ত্যাঁদোড়। ওরা ইংরেজি তোমার চেয়ে যতটা বেশি না জানে, হাবভাব এমন দেখাবে যে তারা বিরাট পণ্ডিত। তুমি একটা কাজ করবে, যা কিছু করবে, লিখে নিয়ে যাবে। তাহলে তোমাকে সহজে কাবু করতে পারবে না।’ আমি তাঁর পরামর্শ মেনে চলেছিলাম। আমি করাচিতে অ্যালবার্ট ডেভিড কম্পানিতে চাকরি করেছি।</p> <p>ওখানে, অর্থাৎ করাচিতে গিয়ে টের পেলাম, ডা. নন্দীর কথাই ঠিক। যদি সব কিছু লিখে নিয়ে না যেতাম, তাহলে মহা অসুবিধা হতো। করাচির সমুদ্রসৈকত, ক্লিফটন বিচে বেড়াতে বেড়াতে একদিন মোগল-পাঠানদের কথা মনে হলো। বিশেষ করে রবীন্দ্রনাথের কবিতার একটি লাইন, ‘যে পথ দিয়ে পাঠান এসেছিল/সে পথ দিয়ে ফিরল নাকো তারা।’</p> <p>এই ক্লিফটন বিচে বেড়াতে বেড়াতে একজনের সঙ্গে পরিচয় হলো। তিনি নেভিতে কাজ করতেন। সাধারণ সৈনিক। করাচি বন্দরে একটা ডেস্ট্রয়ার, যুদ্ধজাহাজ ছিল। আমি চিনি না। জিজ্ঞেস করলাম, এটা কী। বললেন, যুদ্ধজাহাজ। আমি বললাম, যুদ্ধ তো আমরা চাই না, শান্তি চাই। শান্তির মধ্য দিয়ে সব কিছু অর্জন করতে চাই। আমার কথা শুনে একটু চমকালেন তিনি। বললেন, আপনি আবার নতুন কথা বললেন। আপনাদের বাঙালিরা, পূর্ব পাকিস্তানিরা তো আলাদা হতে চায় এবং সেটা চায় ভারতীয় ও স্থানীয় হিন্দুদের প্ররোচনায়। আমি বললাম, এটা পুরোপুরি ভুল শুনেছেন। যা হোক, এই করাচি সমুদ্রসৈকতে ঘুরতে ঘরতেই আরেক ভদ্রমহিলার সঙ্গে সাক্ষাৎ হলো। সে আরেক অভিজ্ঞতা। ওই সময়ে একটা শান্তি সম্মেলন হয়েছিল। সেই শান্তি সম্মেলনের শান্তির ডাকটা আমি ওই ভদ্রমহিলার মুখে শুনেছি। তাঁর মুখে একটা গল্প শুনেছি। গল্পটা তোমারও জানা থাকার কথা। আনারকলির গল্প। সেই গল্পটা শুনে নতুন করে আকবর সম্পর্কে জানা। একজন অসাধারণ পুরুষ। আলেকজান্ডারকে যদি গ্রেট বলা হয়, তাহলে তাঁকে গ্রেটেস্ট বলতে হয়। কারণ তাঁর বহু কাজ অসাধারণ। তিনি সম্রাট আকবর। তাঁকে নিয়ে বলতে চাইছি এ জন্য যে আকবর দ্য গ্রেট বলা হয়। আমার ম্যাট্রিকের সিলেকশন বইতে একটা নিবন্ধ ছিল তাঁকে নিয়ে, যেটা পড়তে হতো। মুখস্থই প্রায় হয়ে গিয়েছিল। সবটা তো আর এখন মনে নেই। শুধু একটা লাইন মনে আছে—দ্য গ্রেট মুঘল ওয়াজ এ সর্ট অব ফেয়ারি টেলস ইন দ্য ওয়েস্ট। ফেয়ারি টেলস—  রূপকথার গল্পের মতোই ছিল সেটা। আমার কাছে সব সময় মনে হয়েছে, আকবরকে নিয়ে যথেষ্ট গবেষণার সুযোগ ছিল।</p> <p> </p> <p><strong>কালের কণ্ঠ :</strong> আমরা আবার রাজনীতি বিষয়ে আসি। এই যে আপনি বা আপনারা আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হলেন, ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন বা ভারত ছাড়ো আন্দোলন— ব্রিটিশরা ভারত ছেড়ে গেল, কিন্তু আন্দোলন কতটা সফল হলো? কিংবা কতটা স্বপ্নভঙ্গের কারণ হলো? যে স্বপ্ন দেখেছিলেন আপনারা, সেই স্বপ্ন কতটা পূরণ হলো? ভারত ভাগটা আপনি কিভাবে দেখছেন?</p> <p><strong>আহমদ রফিক : </strong>ভারত ভাগ আমি কোনোভাবেই সমর্থন করি না। সোভিয়েত ইউনিয়নে কমিউনিস্ট পার্টির ২৬তম কংগ্রেসে স্তালিন একটা তত্ত্ব দিয়েছিলেন। সেটা হচ্ছে, জাতিসত্তার আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার। সেটা যদি মেনে নেওয়া হতো, তাহলে গোটা ভারতের অবস্থান অন্য রকম হতো। অবশ্য তিনি ওই তত্ত্ব ভারতের জন্য দেননি, দিয়েছিলেন তাঁর দেশের জন্য। তাঁর দেশের জন্য মানে, জর্জিয়াম ইউক্রেন যেন যার যার মতো করে অত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার পায়। সেটা একটা অসাধারণ জিনিস ছিল। স্তালিনের এই উদ্যোগটা ভালো ছিল। আমাদের এখানে মওলানা ভাসানী এর পক্ষপাতী ছিলেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর পক্ষপাতী ছিলেন। জাতিসত্তার আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার হিসেবেই তো বাঙালির রাষ্ট্র গঠন।</p> <p> </p> <p><strong>কালের কণ্ঠ :</strong> ভারত ছাড়ো আন্দোলনের পথ ধরে পাকিস্তান হলো। এই বিভাজনটা কতটা সঠিক ছিল?</p> <p><strong>আহমদ রফিক : </strong>এই বিভাজনটা নিয়ে অনেক জটিলতা আছে। ফজলুল হক সাহেব লাহোর প্রস্তাব না দিলে হয়তো পরিস্থিতি অন্য রকম হতো। বাঙালি মুসলমান কিন্তু পাকিস্তানের বাক্সে ভোট দিয়েছে। বিভাজনের পর দেখা গেল, সব কিছু পশ্চিম পাকিস্তানিরা নিয়ে নিচ্ছে। আমি তখন আমাদের গ্রামে। এক কৃষককে জিজ্ঞেস করলাম, পাকিস্তান যে হলো, আপনার প্রতিক্রিয়া কী? তিনি বললেন, ‘প্রতিক্রিয়া আবার কি! এখন শান্তির নহর বইয়া যাইব!’ জিজ্ঞাসা করলাম, কিভাবে বুঝলেন? তাঁর উত্তর, ‘জিন্নাহ সাহেব কইছে!’ জিন্নাহ সাহেবের কথা যে কত বড় মিথ্যা প্রতারণা, সেটা তো পরে বোঝা গেল।</p> <p> </p> <p><strong><img alt="আহমদ রফিক" height="325" src="https://cdn.kalerkantho.com/public/news_images/share/photo/shares/1.Print/2024/04.April/05-04-2024/EID-2024/1/kk-m-1d.jpg" style="float:left" width="300" />কালের কণ্ঠ :</strong> কিন্তু ফজলুল হক সাহেবের তো বড় অবদান কৃষকের জন্য।</p> <p><strong>আহমদ রফিক :</strong> অবশ্যই। এটা মানতে হবে। তিনি কৃষকের জন্য করেছেন। বাঙালি মধ্যবিত্ত তার ফল পেয়েছে। পশ্চাৎপদ বাঙালি মুসলমান মধ্যবিত্ত কখনো ভাবেনি যে সে শিবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে পড়বে, কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে পড়বে—পড়তে পেরেছে। হক সাহেব মুখ্যমন্ত্রিত্ব করতে পেরেছেন।</p> <p> </p> <p><strong>কালের কণ্ঠ : জিন্নাহ সাহেবের কথা মিথ্যা প্রতারণা, সেটা যখন বোঝা গেল, তখন তো এই সাধারণ মানুষই আগে বিদ্রোহ করেছে।</strong></p> <p><strong>আহমদ রফিক :</strong> করেছে, সেটা পরে। আগে মধ্যবিত্তরা করেছে। শিক্ষিত মধ্যবিত্তরা আগে বুঝতে পেরেছে যে এটা ভুল হয়ে গেল। আমি মনে করি, আসলে এটার পেছনে ভাষা আন্দোলন। ভাষা আন্দোলন আমাদের নানাভাবে শিক্ষিত করেছে। ভাষা আন্দোলনের জন্য আমাদের সত্যিকার অর্থে স্বাধীনতা পাওয়ার সুযোগ তৈরি হলো।</p> <p> </p> <p><strong>কালের কণ্ঠ : </strong>অর্থাৎ ভাষা আন্দোলনকে শুধুু ভাষা আন্দোলনে সীমাবদ্ধ রাখা যাবে না।</p> <p><strong>আহমদ রফিক :</strong> ভাষা আন্দোলনকে অন্যভাবে দেখতে হবে। ভাষা আন্দোলন শুধু যে রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই, কিংবা রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন বা রাষ্ট্রভাষার আন্দোলন—তা নয় কিন্তু। ভাষা আন্দোলনকে আমি সেইভাবে বিশ্লেষণ করতে চাই।</p> <p> </p> <p><strong>কালের কণ্ঠ : </strong>জাতীয়তাবোধের বীজটা ওই সময় বোনা হয়ে গেল। এর ১৮-১৯ বছরের মধ্যে আমরা স্বাধীনতাও পেয়ে গেলাম।</p> <p><strong>আহমদ রফিক :</strong> অবশ্যই।</p> <p> </p> <p><strong>কালের কণ্ঠ : </strong>ভাষা আন্দোলনের পুরোটা সময় তো প্রগতিশীল শক্তি জড়িত।</p> <p><strong>আহমদ রফিক :</strong> হ্যাঁ, সে তো বটেই।</p> <p> </p> <p><strong><img alt="আহমদ রফিক" height="366" src="https://cdn.kalerkantho.com/public/news_images/share/photo/shares/1.Print/2024/04.April/05-04-2024/EID-2024/1/kk-m-1e.jpg" style="float:left" width="300" />কালের কণ্ঠ : </strong>আপনি বললেন জাতীয়তাবোধের বীজটা ওই সময় বোনা হয়ে গেল। ভাষা আন্দোলনের পুরোটা সময় তো প্রগতিশীল শক্তি জড়িত। কিন্তু এরপর এই প্রগতিশীল শক্তিকে আমরা আর পাচ্ছি না কেন?</p> <p><strong>আহমদ রফিক :</strong> কারণ তারা তখন রাজনৈতিকভাবে নানা গ্রুমিংয়ে ছিল। তারা তখন চিন্তা করছে রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে। তারা চিন্তা করছে এটা জনগণের সুখ-সুবিধার জন্য কতটা কার্যকর হবে। তারা যদি তখন স্তালিনের জাতিসত্তার আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের কথাটা চিন্তা করত, তাহলে এই ভুলটা হতো না।</p> <p> </p> <p><strong>কালের কণ্ঠ : </strong>ভারত ভাগ হয়েছে। বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। এখন তো মনে হয় রাজনীতির ওই সংকুচিত পথ থেকে বেরিয়ে আসার সুযোগ আছে। সঠিক একটা জাতীয়তাবাদী আন্দোলন গড়ে তোলার সুযোগ আছে বাংলাদেশে।</p> <p><strong>আহমদ রফিক : </strong>সেই জাতীয়তাবাদী আন্দোলনটা কোন চরিত্রের হবে—সেটাই হচ্ছে বড় প্রশ্ন।</p> <p> </p> <p>কালের কণ্ঠ : একটা ক্ষেত্র তো তৈরি হয়ে আছে বলে মনে হয়?</p> <p><strong>আহমদ রফিক :</strong> ক্ষেত্র সব সময় তৈরি হয়ে থাকে। ইতিহাস এই ভুলটা করে না। ক্ষেত্র তৈরি করে রাখে। আমরা সেই ক্ষেত্রকে ঠিকমতো ধরতে পারি না। আবার ধরলেও তাকে সঠিক জায়গায় নিয়ে যেতে পারি না। সঠিকভাবে লালন করতে পারি না। ওই যে বিদ্যাসাগর প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘আমরা আরম্ভ করি, শেষ করি না; আড়ম্বর করি, কাজ করি না; যাহা অনুষ্ঠান করি তাহা বিশ্বাস করি না; যাহা বিশ্বাস করি তাহা পালন করি না; ভূরিপরিমাণ বাক্যরচনা করিতে পারি, তিলপরিমাণ আত্মত্যাগ করিতে পারি না; আমরা অহংকার দেখাইয়া পরিতৃপ্ত থাকি, যোগ্যতালাভের চেষ্টা করি না; আমরা সকল কাজেই পরের প্রত্যাশা করি, অথচ পরের ত্রুটি লইয়া আকাশ বিদীর্ণ করিতে থাকি; পরের অনুকরণে আমাদের গর্ব, পরের অনুগ্রহে আমাদের সম্মান, পরের চক্ষে ধূলিনিক্ষেপ করিয়া আমাদের পলিটিকস্, এবং নিজের বাক্‌চাতুর্যে নিজের প্রতি ভক্তিবিহ্বল হইয়া উঠাই আমাদের জীবনের প্রধান উদ্দেশ্য।’ কথাগুলো একদম সঠিক। আমাদের মধ্যে যে মেধার অভাব তা কিন্তু না। মেধার অভাব থাকলে তো আমরা একজন বিদ্যাসাগরকে পেতাম না।</p> <p><strong>কালের কণ্ঠ : </strong>বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলন, ছেষট্টির গণ-আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান, সত্তরের নির্বাচন—এর পথ ধরে একাত্তরে আমরা স্বাধীন হলাম। সব কিছুতেই প্রগতিশীল শক্তির অংশগ্রহণ দেখেছি আমরা। কিন্তু আজকের বাংলাদেশে মাঝেমধ্যেই যে সাম্প্রদায়িক শক্তির মাথাচাড়া দিয়ে ওঠার চেষ্টা করতে দেখি, রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার হচ্ছে—এটা আমাদের কাঙ্ক্ষিত ছিল না। এর পেছনে কি প্রগতিশীল দলগুলোর ব্যর্থতা আছে?</p> <p><strong>আহমদ রফিক :</strong> প্রগতিশীল দলগুলোর ব্যর্থতা আছে। আবার আমি যদি বলি আওয়ামী লীগেরও ব্যর্থতা আছে।</p> <p> </p> <p><strong>কালের কণ্ঠ : </strong>আওয়ামী লীগ তো একটি জাতীয়তাবাদী ধারার দল। কিন্তু রাজনৈতিকভাবে প্রগতিশীল দলগুলোর যে ‘চেক অ্যান্ড ব্যালান্স’-এর জায়গায় থাকার কথা ছিল, তারা কি সেখানে থাকতে পেরেছে?</p> <p><strong>আহমদ রফিক :</strong> পারেনি। কারণ তারা তাদের রাজনীতিটাকে প্রাধান্য দিয়েছে। সে কারণেই পারেনি।</p> <p> </p> <p><strong>কালের কণ্ঠ :</strong> তাহলে একটা সম্পূরক প্রশ্ন করি, এই সব কথায় কথায় বিদেশি দূতাবাসে যায় বা বিদেশ থেকে বিবৃতি নিয়ে আসে?</p> <p><strong>আহমদ রফিক :</strong> আমরা যদি দেখি যে আমরা আমাদের শক্তি দিয়ে কিছু দাঁড় করাতে পারছি, সেটা তো আমাদের জন্য সব দিক থেকে ভালো।</p> <p> </p> <p><strong>কালের কণ্ঠ : </strong>এখন ভবিষ্যত্টা আপনি কী দেখতে পাচ্ছেন? আমাদের করণীয় কী?</p> <p><strong>আহমদ রফিক : </strong>ভবিষ্যত্টা আমি খুব উজ্জ্বল দেখি না। করণীয় আমি যেটা মনে করি, সেটা তো হওয়ার নয়। করণীয় হলো সব দলের মিলে যাওয়া। সব দল মিলে একটা সর্বদলীয় ঐক্য হোক। সেখানে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বে থাকুক। তারা মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়েছে, এটা তো মেনে নিতে হবে। অনেকে এটা মানতে চায় না। এটা না মানলে তো হবে না। এটা মেনে নিয়ে যদি একটা যুক্তফ্রন্ট করতে পারত, ১৯৫৪ সালের মতো, তাহলে আমার মনে হয়, দেশটা অনেক এগিয়ে যেত। আরেকটা কথা, কথায় কথায় আমরা যদি আইএমএফ ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের কাছে যাই, সেটাও কিন্তু চিন্তা করে দেখে নেওয়া উচিত। পদ্মা সেতু নিয়ে যত কথাই হোক না কেন, এটা যে নিজেদের শক্তিতে দাঁড়ানোর প্রতীক, আমি নিজে এটাকে সমর্থন করি। অন্যরা কী বলল, তাতে আমার কিছু এসে যায় না।</p> <p> </p> <p><strong>কালের কণ্ঠ : </strong>আমরা একটু আগেই নতুন জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের কথা বলছিলাম। শুরুটা কিভাবে করা যেতে পারে?</p> <p><strong>আহমদ রফিক :</strong> আন্দোলন শুরু করতে গেলে বড় প্রশ্ন আসবে অসাম্প্রদায়িকতা। অসাম্প্রদায়িকতাকে বড় করে তুলতে হবে। সেখান থেকে যাত্রা শুরু করতে হবে। সেখানে আমাদের মস্ত বড় গ্যাপ।</p> <p> </p> <p><strong>কালের কণ্ঠ : </strong>আরো অনেক কথা বলার ছিল, জানার ছিল, শোনার ছিল। আপনার অভিজ্ঞতার ঝুলি থেকে আরো অনেক কিছু নেওয়ার আছে। আবারও কথা হবে। আজ এখানেই শেষ করি। সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।</p> <p><strong>আহমদ রফিক :</strong> কথা হবে। আমিও অনেক কথা বলতে চাই। ভালো থেকো।<br /> </p>