<p>বিশ্বজুড়ে জলবায়ু পরিবর্তন রোধে নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে জোর দিচ্ছে দেশগুলো। পারমাণবিক শক্তি তার অন্যতম একটি উৎস। পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের চুল্লির নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ থাকলেও বিশ্বের দেশগুলো এখন দীর্ঘ মেয়াদে ও টেকসই বিদ্যুৎ সরবরাহে পারমাণবিক শক্তিতে ঝুঁকছে। আন্তর্জাতিক জ্বালানি সংস্থা (আইইএ) তাদের সর্বশেষ প্রতিবেদনে জানায়, পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদনে সাম্প্রতিক দেশগুলোতে নীতি সহায়তা বেড়েছে।</p> <p><img alt="বিশ্বে বিদ্যুৎ উৎপাদনে বাড়ছে পারমাণবিক শক্তির ব্যবহার" height="292" src="https://asset.kalerkantho.com/public/news_images/share/photo/shares/1.Print/2024/12 December/26-12-2024/Rif/05-01-2024-p9-9.jpg" style="float:left" width="300" />প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২৩ সালে অন্তত ১৪ দেশের বিদ্যুৎ চাহিদার কমপক্ষে এক-চতুর্থাংশ এসেছে পারমাণবিক শক্তি থেকে। বর্তমানে ফ্রান্সের প্রায় ৭০ শতাংশ বিদ্যুৎ আসে পারমাণবিক শক্তি থেকে। এ ছাড়া ইউক্রেন, স্লোভাকিয়া ও হাঙ্গেরির ৫০ শতাংশ বিদ্যুৎ আসে পারমাণবিক শক্তি থেকে। জাপানও তার বিদ্যুৎ চাহিদা পূরণে এক-চতুর্থাংশ পেয়ে থাকে পরমাণু জ্বালানি থেকে। দেশটির বিদ্যুৎ চাহিদা পূরণে পারমাণবিক শক্তির ওপর ক্রমে নির্ভরশীলতা বাড়ছে।</p> <p>আইইএ বলছে, ২০২৩ সালে বিশ্বে পারমাণবিক শক্তি থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়েছে ৪১৬ গিগাওয়াট। ২০৫০ সাল নাগাদ এই সক্ষমতা বেড়ে হবে ৬৪৭ গিগাওয়াট। সংস্থার মতে, বর্তমান বিশ্বে ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনা ও দেশগুলোর মধ্যে বিভক্তি জ্বালানি নিরাপত্তা ও কার্বন গ্যাস নির্গমন কমানোর ক্ষেত্রে বড় ধরনের ঝুঁকি তৈরি করছে। যদিও আগামী বছরগুলোতে বিশ্ব জ্বালানির নতুন বাজারে প্রবেশ করবে। </p> <p>আইইএর টেকসই প্রযুক্তি ও পূর্বাভাসবিষয়ক পরিচালক লরা কজি বলেন, ‘২০২৫ সালে আমরা পারমাণবিক বিদ্যুৎ সক্ষমতার নতুন রেকর্ড দেখতে পাব। আমরা দেখতে পাব অনেক দেশই পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদনে ঝুঁকছে। এ নিয়ে দেশগুলো তাদের নীতির পরবর্তন করছে। মূলত চীন থেকে ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্র সব দেশই দীর্ঘ মেয়াদে বিদ্যুৎ চাহিদা পূরণে পারমাণবিক শক্তিতে ঝুঁকছে।’ </p> <p>প্রতিবেদনে বলা হয়, আগামী দিনে পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদনসক্ষমতা বৃদ্ধিতে নেতৃত্ব দেবে উদীয়মান ও উন্নয়নশীল দেশগুলো। বিশেষত, ২০৩৫ সাল নাগাদ পারমাণবিক বিদ্যুতে সক্ষমতার ৪০ শতাংশই যোগ করবে চীন। ফলে ২০৩০ সাল নাগাদ চীন হবে বিশ্বের সবচেয়ে বড় পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী দেশ।  </p> <p>২০২৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ২০টিরও বেশি দেশ জানিয়েছে, তারা ২০৫০ সাল নাগাদ পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদনসক্ষমতা বর্তমানের তিন গুণ করবে। বিশেষত ইউরোপীয় দেশগুলো এতে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। ওয়ার্ল্ড নিউক্লিয়ার অ্যাসোসিয়েশনের মহাপরিচালক সামা বিলবাও ওয়াই লিয়ন বলেন, ‘এই প্রতিবেদন স্পষ্ট করছে আগামী দিন নির্মল ও নির্ভরযোগ্য বিদ্যুতের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উৎসব হবে পারমাণবিক শক্তি।  </p> <p>ওয়ার্ল্ড নিউক্লিয়ার অ্যাসোসিয়েশনের তথ্য অনুযায়ী, পারমাণবিক শক্তি ব্যবহারকারী দেশের মধ্যে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, চীন, ফ্রান্স, রাশিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া, কানাডা, ইউক্রেন, জার্মানি, জাপান, স্পেন, সুইডেন, বেলজিয়াম, যুক্তরাজ্য, ভারত, চেক প্রজাতন্ত্র, ফিনল্যান্ড, সুইজারল্যান্ড, বুলগেরিয়া, পাকিস্তান, হাঙ্গেরি, স্লোভাকিয়া, ব্রাজিল, দক্ষিণ আফ্রিকা, মেক্সিকো, রোমানিয়া, আর্জেন্টিনা, সংযুক্ত আরব আমিরাত, বেলারুশ, স্লোভেনিয়া, নেদারল্যান্ডস, ইরান ও আর্মেনিয়া অন্যতম।</p> <p>বড় প্রযুক্তির কম্পানিগুলো পারমাণবিক বিদ্যুতে ঝুঁকছে : গুগল বা মাইক্রোসফটের মতো বড় বড় প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলো এখন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) ওপর অনেকটাই নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে। এসব জায়ান্ট কম্পানি এআইয়ের তথ্যকেন্দ্রগুলো (ডাটা সেন্টার) সার্বক্ষণিক সচল রাখতে পারমাণবিক শক্তির দিকে ঝুঁকতে শুরু করেছে। মাইক্রোসফট ও গুগল এরই মধ্যে আমেরিকার বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে পারমাণবিক বিদ্যুৎ সরবরাহের চুক্তি সেরে ফেলেছে। একই পথে হেঁটেছে অ্যামাজনও। বিশ্বের এসব বড় প্রযুক্তি সংস্থাগুলোর দাবি, এতে যে অতিরিক্ত শক্তি মিলবে, তা অনলাইন তথ্যকেন্দ্রগুলোকে সচল রাখতে ব্যবহার করা হবে।</p> <p>গুগলের শক্তি ও জলবায়ু দপ্তরের সিনিয়র ডিরেক্টর মাইকেল টেরেল বলেছেন, ‘আমাদের বিদ্যুৎ পরিবাহী গ্রিডের জন্য এ ধরনের পরিষ্কার ও নির্ভরযোগ্য শক্তির উৎসর প্রয়োজন, যা এআইয়ের মতো প্রযুক্তিকে আরো উন্নতমানের করে তুলতে সহায়ক হিসেবে কাজ করবে।’ পরমাণু শক্তিই যে একমাত্র বিকল্প, তা কোনো রকম রাখঢাক না করেই স্পষ্ট করেছেন গুগলের সিনিয়র ডিরেক্টর। তিনি বলছেন, ‘আমরা মনে করি যে পরমাণু শক্তি আমাদের চাহিদা মেটানোর ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে পারবে, যা সময়োপযোগী। তা ছাড়া এটা নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই হাতে পাব আমরা। গুগল জানিয়েছে, ২০৩০ সালের মধ্যে কায়রস পাওয়ারের থেকে প্রথম পারমাণবিক চুল্লি হাতে পাবে তারা। ২০৩৫ সাল নাগাদ যা বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে পারবে বলে মনে করা হচ্ছে।’ </p> <p>এ বছরের সেপ্টেম্বরে কনস্টেলেশন নামের আমেরিকার আর এক বিদ্যুৎ সংস্থার সঙ্গে চুক্তি সেরে ফেলেছে মাইক্রোসফট। ওই প্রতিষ্ঠানটি মাইক্রোসফটকে পরমাণু বিদ্যুৎ সরবরাহ করবে। পরমাণু শক্তির জন্য ৫০ কোটি ডলার বিনিয়োগের কথা ঘোষণা করেছে অ্যামাজন। ‘ডোমিনিয়ান এনার্জি’ নামের প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি সেরে ফেলেছে এই অনলাইন ই-কমার্স সংস্থা। ডোমিনিয়ান এনার্জি ছোট আকারের পরমাণু চুল্লি তৈরি করে থাকে।</p> <p>বিশ্লেষকরা বলছেন, বিশ্বের বড় প্রযুক্তি সংস্থাগুলোকে বর্তমান সময়ে বিদ্যুতের উৎস সন্ধানে নেমে প্রবল চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হচ্ছে। কারণ প্রচলিত বিদ্যুৎ ব্যবহার করলে কার্বণ নিঃসরণের পরিমাণ বাড়বে। এগুলোকে জলবায়ু পরিবর্তনের মূল হোতা বলেও চিহ্নিত করা হয়। অন্যদিকে বিদ্যুতের অফুরন্ত জোগান ছাড়া ‘ক্লাউড কম্পিউটিং’ ও ‘এআই অ্যাপ্লিকেশনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া কঠিন।</p> <p>অনেক তথ্য-প্রযুক্তি সংস্থা গুগল, মাইক্রসফট ও অ্যামাজনের থেকে ‘গ্রাফিক্স প্রসেসিং ইউনিটস’-এ সজ্জিত সার্ভার ভাড়া নিয়ে থাকে, যা বেশ ব্যয়বহুল। এই সার্ভারগুলো চালানোর জন্যেও নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুতের প্রয়োজন। দ্বিতীয়ত, ‘চ্যাটজিপিটি’র মতো ওপেন এআইয়ের চাহিদা আমজনতার মধ্যে দিন দিন বাড়ছে। এই চাহিদা বৃদ্ধির পরোক্ষ প্রভাব পড়ছে বড় প্রযুক্তি সংস্থাগুলোর ওপর। সেখানে বিদ্যুতের চাহিদা প্রবলভাবে বেড়ে গেছে।</p> <p>এআইয়ের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ডাটা সেন্টার, কৃত্রিম মেধা ও ক্রিপ্টোকারেন্সিকে সচল রাখতে ২০২২ সালে বিশ্বব্যাপী বিদ্যুতের চাহিদা ছিল ঘণ্টায় ৪৬০ টেরাওয়াট। ২০২৬ সালের মধ্যে যা দ্বিগুণের বেশি বৃদ্ধি পেয়ে ঘণ্টায় হাজার টেরাওয়াটে গিয়ে পৌঁছবে বলে মনে করা হচ্ছে। এই অবস্থায় কার্বন নির্গমন কমানো এবং বিদ্যুতের চাহিদা পূরণ দুটো মিলেই বড় প্রতিষ্ঠানগুলো পরমাণু বিদ্যুতে জোর দিচ্ছে।</p> <p>পারমাণবিক বিদ্যুতে কেন্দ্রের দুর্ঘটনা : পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের দুর্ঘটনা নিয়ে বিশ্বে ভীতি রয়েছে। সর্বশেষ জাপানের ফুকুশিমা বিদ্যুৎ কেন্দ্রে দুর্ঘটনাসহ বিশ্বে এ পর্যন্ত পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে তিনটি বড় দুর্ঘটনা ঘটেছে।</p> <p>পারমাণবিক কেন্দ্রে দুর্ঘটনায় তেজস্ক্রিয়তা ছড়িয়ে পড়লে দীর্ঘ মেয়াদে এর প্রভাব থাকে বলেই বিশ্বব্যাপী পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নিয়ে ভয় ও আতঙ্ক রয়েছে। তবে ফুকুশিমায় দুর্ঘটনার পর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে দুর্ঘটনার ঝুঁকি কমাতে নিরাপত্তাব্যবস্থা বাড়ানো হয়েছে। রাশিয়ার ভিভিআর ১২০০ মডেলের বিদ্যুৎ কেন্দ্রে দুর্ঘটনা রোধে পাঁচটি স্তরে নিরাপত্তা নিশ্চিতের ব্যবস্থা করা হয়েছে।</p> <p>সূত্র : আইইএ, ওয়ার্ল্ড নিউক্লিয়ার অ্যাসোসিয়েশন।</p>