<p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">নেত্রকোনা জেলার বড়তলী গ্রাম থেকে এক তরুণ এসে ভর্তি হলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে। পড়াশোনা তেমন ভালো চলছে না। মিটিং-মিছিল লেগেই থাকে সর্বক্ষণ। স্বাধীনতা আন্দোলনের এক উত্তুঙ্গ মুহূর্তের ছবি একের পর এক তাঁর চোখের সামনে দিয়ে ভেসে যাচ্ছে। সেই তরুণও তো ওই জ্বলজ্বলে-ঝাঁঝালো ছবির অংশ।</span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">একদিন রিকশা চেপে কোথাও যাচ্ছেন ঝাঁঝালো-চোখের সেই তরুণ। হঠাৎ একটি মিছিল সামনে চলে এলো। মিছিলকারীদের ছত্রভঙ্গ করার জন্য পুলিশ লাঠিপেটা ও ধাওয়া শুরু করল। হঠাৎ রিকশাচালক বলল, </span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">‘</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">মার, মার শালারে। প্রেমের জন্য কোনো কোনো সময় মার্ডারও করা যায়।</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">’</span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">কথাটা সেই তরুণের হৃদয়ে এক নবতর অভিঘাত সৃষ্টি করল। হৃদয়ের কোনো এক প্রকোষ্ঠে থেকে গেল নিশ্চুপ।</span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">বিষয়টি হৃদয় ও মস্তিষ্ক থেকে যায়ই না। একদিন রাতে লেখা হয়ে যায় একটা কবিতা। এরই মধ্যে অগ্রজ ও সমকালীন কবি-লেখকদের সঙ্গেও চেনা-জানা হয়ে গেছে তাঁর। আহমদ ছফা কবিতাটি দেখে কোনো মন্তব্য করলেন না। আরেক  কবি হুমায়ুন কবিরকে সঙ্গে নিয়ে সোজা চলে গেলেন দৈনিক পাকিস্তান পত্রিকার দপ্তরে। পেছনে পেছনে দুরু দুরু বক্ষে সেই তরুণ। সফেদ চুলের এক কবির কাছে কবিতা দিয়ে চুপ করে থাকলেন তিনজন। অগ্রজ সেই কবি কবিতায় চোখ বুলাতে লাগলেন, </span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">‘</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়/এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়/ মিছিলের সব হাত/কণ্ঠ/পা/এক নয়.../কোনো কোনো প্রেম আছে প্রেমিককে খুনি হতে হয়/যদি কেউ ভালোবেসে খুনি হতে চান/তাই হয়ে যান/উত্কৃষ্ট সময় কিন্তু আজ বয়ে যায়।</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">’</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"> সফেদ চুলের সেই কবি, আহসান হাবীব, যিনি তৎকালীন দৈনিক পাকিস্তানের সাহিত্য সম্পাদক ছিলেন, যিনি জীবৎকালেই হয়ে উঠেছিলেন কিংবদন্তি, তিনি মিষ্টি করে হেসে বললেন, </span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">‘</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">এই কবিতাটি ছাপা যাবে না। ছাপলে আমার চাকরিটা চলে যাবে। পত্রিকা বন্ধও হয়ে যেতে পারে। তবে একটা কথা বলি, হেলালের আর কোনো কবিতা না লিখলেও চলবে।</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">’</span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">‘</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">’</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"> নামীয় সেই কবিতা কবি আহসান হাবীব দৈনিক পাকিস্তানের সাহিত্য পাতার জন্য নিষিদ্ধ করলেও বাংলা কবিতার পাঠক এই কবিতাকে এবং কবিকে নিষিদ্ধ করেনি। তার প্রমাণও পাওয়া গেল অচিরেই। টিএসসির দেয়ালে লিখিত (চিকা মারা) হওয়ার পর স্বাধীনতাকামী প্রতিটি বাঙালির হৃদয়ে ছাপা হয়ে গিয়েছিল সেই কবিতা। হয়ে উঠেছিল এক অভিনব অস্ত্র</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">—</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">যার নাম দেওয়া যেতে পারে দেয়ালাস্ত্র (দেয়াল-অস্ত্র)।</span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">শুধু তাই নয়, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সব কিছুর পরিবর্তন হয়, প্রয়োজনের ধরন পরিবর্তন হয়ে যায়, প্রাসঙ্গিকতার পরিবর্তন হয়, জনরুচি এক রকম থাকে না</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">—</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">তাতে একসময়ের প্রবল জনপ্রিয়ও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে গুরুত্ব হারায়। হেলাল হাফিজের ক্ষেত্রে তেমনটি দেখা যায় না। ১৯৮৬ সালে প্রকাশিত তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ </span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">‘</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">যে জলে আগুন জ্বলে</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">’</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"> আজও সমান জনপ্রিয়। </span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">এরপর তাঁর দীর্ঘ শীতনিদ্রা। কবিতা থেকে, দৃশ্য থেকে, প্রকাশ্য থেকে। কিন্তু পাঠকের স্মৃতি থেকে তিনি নিষ্ক্রান্তি পাননি কখনোই। দীর্ঘ ২৬ বছর পর ২০১২ সালে তিনি জনসমক্ষে আসেন। বের হয় তাঁর দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ </span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">‘</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">কবিতা একাত্তর।</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">’</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"> দ্বিভাষিক এই গ্রন্থটি প্রথম গ্রন্থের ৫৬টি কবিতার সঙ্গে আরো ১৫টি কবিতা যুক্ত করে প্রকাশ করা হয়। ২০১৯ সালের জুন মাসে পূর্বোক্ত কবিতার সঙ্গে আরো ১৭টি কবিতা যুক্ত করে প্রকাশিত হয় হেলাল হাফিজের কবিতাসমগ্র </span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">‘</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">এক জীবনের জন্মজখম।</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">’</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"> ২০১৯ সালে কবির দ্বিতীয় মৌলিক কাব্যগ্রন্থ বের হয় </span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">‘</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">বেদনাকে বলেছি কেঁদো না।</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">’</span></span> </span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">হেলাল হাফিজের কবিতার সঙ্গে লীন হয়ে আছে এই বাংলার স্পন্দন, আমাদের বাঙালি জাতির সবচেয়ে বড় ঘটনা একাত্তরের প্রতিটি দিনের ঝাঁঝালো যৌবন, বাঙালি নারীর রহস্য-রূপ, হৃদয়ের কোমল আর্তি, প্রেমিকের সরল আকুতি, মানুষে মানুষে দ্বিধাবিভক্তির তীর্যক আমূল বিদ্ধ তীর। তাইতো একটি কবিতার কয়েকটি লাইন হয়ে উঠেছিল স্বাধীনতাকামীদের স্লোগান। হয়ে উঠেছিল অভ্যুত্থানের তরঙ্গ সর্বত্র ছড়িয়ে দেওয়ার শৈল্পিক লিফলেট। এখনো সংকটে তাঁর কবিতার লাইন আমাদের নিজস্ব ভাষা হয়ে ওঠে। কবির জীবৎকালে তাঁরই রচিত পঙক্তি এ রকম প্রবাদের মর্যাদায় অভিষিক্ত হওয়াতে তিনি নিশ্চয়ই সুখী হয়েছিলেন!</span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">শিল্পের এই সুখ তাঁর হৃদয়ে থাকলেও ব্যক্তি-কবির সুখ তত দিনে থাকেনি। মায়ের মৃত্যু প্রথমে তাঁকে একাকী করে তোলে। এরপর প্রেমাষ্পদের সঙ্গে বিচ্ছেদ তাঁকে সত্যি সত্যি জ্বালিয়ে দেয়। জলও হয়ে যায় জ্বলন্ত।</span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">এই দহন তাঁকে যেমন আরো কবি করে তোলে, তেমনি তিনিও নিজেকে সরিয়ে নেন প্রকাশ্য পথ থেকে। বেছে নেন নিভৃতিকে। একসময় চলে যান সম্পূর্ণ লোকচক্ষুর অন্তরালে। </span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">নদী কি নারীর মতো/নারী কি পুতুল/নারী নীড়ের নাম/টবে ভুল ফুল?</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">’</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"> নারী মানেই তো অন্তহীন রহস্য। কবিও সেই প্রশ্নের ভেতরে রহস্য গেঁথে দেন। মায়ের মৃত্যু, প্রেমাষ্পদের সঙ্গে বিচ্ছেদের পর নারীকে নিয়ে দ্বিধান্বিত কবি। ঘর করলেন না। আড়ালের জীবনে নিজেকে জড়িয়েছেন অপ্রচলিতভাবে। রহস্যজনকভাবে। আত্মজীবনী বের হলে হয়তো বা সেই আলো-আঁধারীর জীবন নিয়ে জানা যাবে অনেক কিছু। তাঁকে নিয়ে পাঠকমহলে মিথ ও মিথ্যার দিকে তাকালে  মনে হয়</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">—</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">কবিতার বিবিধ রহস্যের যে জাল ও জলের কথা আমরা বলে থাকি</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">—</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">তার জীবন যেন তাই-ই। খুব সহজ করে যদি বলি, দুঃখের আরেক নাম নয়, মিথ ও মিথ্যার আরেক নাম নয়</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">—</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">আসলে কবিতার আরেক নাম হেলাল হাফিজ।</span></span></span></span></p>
