‘খেয়া’র কবি সেলিম সারোয়ার সংখ্যা প্রসঙ্গে
‘কবিতা এক অলোক-সামান্যা ভার্জিন/প্রতিটি সঙ্গম শেষে কুমারীত্ব ফিরে আসে যার;/আজীবন সুদূর্লভা পরনারী, দূরূহ শঙ্খিনী/যার মন পেতে হলে যেতে হয় মানচিত্রহীন/অগস্ত্যযাত্রায় একা’—এই কবিতা পড়লে মনে হয়, কবি সেলিম সারোয়ার একজন রোমান্টিক কবি, মধ্য ষাটে যাঁর শুরু। একমাত্র কাব্যগ্রন্থ ‘বেজে ওঠো, মাতাল মল্লার’ দিয়েই জানান দিয়েছেন সে কথা। তাঁর কবিতার কথা বলতে গিয়ে অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেছেন, ‘সেলিম সারোয়ারের কবিতায় তার নিজস্ব একটা স্বর আছে, সুরও রয়েছে, তার অনুভূতি গভীর কিন্তু প্রকাশ অত্যন্ত সংযত এবং তার শব্দচয়ন ও উপমায় এমন একটি প্রাণবন্ত স্নিগ্ধতা রয়েছে, যেখানে সে মৌলিক এবং তার সে মৌলিকতা পাঠকের জন্য হৃদয়স্পর্শী।’ সত্যি, ‘খেয়া’য় প্রকাশিত কবিতাগুলো পড়ে তা-ই মনে হলো।
সেলিম সারোয়ারের লেখায় আছে তীব্র আবেগ, প্রেম, ক্রোধ ও ভালোবাসা। কবি হাসান হাফিজ বলেন, ‘মনন-মেধা ও স্নায়ুর শ্রম ঘাম রক্ত রসের মিশেলে নির্মিত হয় একেকটি কবিতা। এর আধেক হয়তো বহু সাধনায় ত্যাগে ছোঁয়া যায়, বাকিটা থেকে যায় অধরা। বোধের, উপলব্ধিরও অগম্য বুঝিবা। বিরলপ্রজ কবি সেলিম সারোয়ারের কবিতা সেই নান্দনিকতায় মণ্ডিত, নির্মিতির চমৎকারিত্বে এবং লাবণ্যে উদ্ভাসিত। তাঁর শিল্পায়নের কুশলতায় মনস্ক পাঠককে যুগপৎ রোমাঞ্চিত, ঋদ্ধ করে। শুদ্ধতার অন্বেষণে কবি সতৃষ্ণ অভিযাত্রায় নিমজ্জমান।’
কবি সেলিম সারোয়ার ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপক হওয়ার সুবাদে বিশ্বসাহিত্য তাঁর নখদর্পণে।
তিনি অনুবাদ করেছেন শেকসপিয়ারের সনেটসমগ্র। তাঁর অসাধারণ এই অনুবাদে পাঠকরা মুগ্ধ হন শেকসপিয়ারের সনেট পড়ে। অনুবাদ প্রসঙ্গে তিনি শেকসপিয়ারের সনেটসমগ্র ভূমিকায় বলেন, ‘পাঠকের জন্য একজন মৃত বা অন্ততপক্ষে অনুপস্থিত অনুবাদকই সবচেয়ে উত্তম অনুবাদক। মূল লেখকের কণ্ঠ অনুবাদকের গলার নতুন সরগমে যত কম চাপা পড়ে ততই ভালো। কিন্তু অনুবাদক যখন একজন রবীন্দ্রনাথ, সত্যেন দত্ত, নজরুল ইসলাম বা সুধীন দত্ত তখন বিভ্রান্ত পাঠক স্থির করতে পারে না কার কণ্ঠ সে সত্যি সত্যি শুনতে চায়—মূল লেখকের না অনুবাদকের, যা কখনো কখনো মূলের চেয়ে শ্রুতিমধুর। বর্তমান অনুবাদে পাঠকের জন্য সেই উভয় সংকটের অবকাশ নেই।’ আসলেই তাই। তাঁর পশ্চিমা সাহিত্যতত্ত্বের ওপর কিছু অসাধারণ প্রবন্ধ, যা আমাদের জন্য সোনালি আকর। সাহিত্যের এই তিনটি ক্ষেত্রেই তিনি স্বমহিমায় উজ্জ্বল হওয়া সত্ত্বেও নিজের সৃষ্টি নিয়ে তিনি উদাসীন। থাকতে চান অড়ালে। ‘খেয়া’ সেই আড়ালের গুণিজনকে এবার নিয়ে এলো পাঠকের সামনে। প্রকাশ করল কবি সেলিম সারোয়ার সংখ্যা। ‘খেয়া’র এই সংখ্যায় আছে তাঁর নিজের রচনাসহ অগ্রজ-বন্ধু-অনুজের মূল্যায়ন। লিখেছেন সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, গোলাম ফারুক খান, মুজিবুল হক কবীর, আহমদ বশীর, সোহরাব হাসান, হাসান হাফিজ, সৈয়দ কামরুল হাসান, করীম রেজা, আবুল হোসেন কামরান, আলম খোরশেদ, কামরুল হাসান, সরকার মাসুদ, মেহেদী ইকবাল, পুলক হাসান, নূরুল ইসলাম শিশির, মাসুদুল হক, বিনয় বর্মন, কাজল কানন, ওবায়েদ আকাশ, চারু হক, রাকিবুল রকি, মেজবাহ উদ্দিন, মনি হায়দার ও নাহিদা সুলতানা। ‘খেয়া’র এই সংখ্যা নিয়ে সম্পাদক পুলক হাসান বলেছেন, ‘আয়োজনে তাঁর নিজের রচনা ও তাঁর সৃজন নিয়ে অগ্রজ থেকে অনুজতুল্য সাহিত্য-সারথিদের নিজ নিজ অবস্থান থেকে বৈচিত্র্যময় মূল্যায়নে আমরা সমৃদ্ধই বোধ করছি। আরও একটি কারণে তাঁকে নিয়ে এই আয়োজন আমরা জরুরি মনে করছি। সেটা হচ্ছে নতুন প্রজন্মের সঙ্গে তাঁকে একটু গভীরভাবে পরিচয় করিয়ে দেওয়া। যেহেতু তিনি খ্যাতির মধ্যগগন থেকে জীবিকার প্রয়োজনে স্বেচ্ছায় চলে গিয়েছিলেন দূরে, নির্বাসনে। তাই তাঁর সৃজনপ্রতিভা ও মনীষা সম্পর্কে সেভাবে জানার সুযোগ হয়তো তাদের হয়নি। তবে এটি প্রকাশে পাঠকের মধ্যে তাঁকে নিয়ে যদি কিছু নতুন কৌতূহল তৈরি হয় তাহলেই আমাদের শ্রম সার্থক মনে করব।’
খেয়া : সম্পাদক - পুলক হাসান। প্রচ্ছদ : কবির প্রতিকৃতি অবলম্বনে। মূল্য : ৩৫০ টাকা।
রিহাম হাসান
পাহাড়ের আইন জানাবে যে বই
পার্বত্য চট্টগ্রাম বাংলাদেশের একটি বিশেষ ভূখণ্ড, যা তার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, সমৃদ্ধ ঐতিহ্য এবং ভিন্ন সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যের জন্য পরিচিত। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অনেকটা অংশ জুড়ে রয়েছে দেশের দক্ষিণাঞ্চলে অবস্থিত তিনটি জেলা—রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান। এ অঞ্চলের আইনগত কাঠামো ও প্রশাসনিক কার্যক্রমও অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় অনেকটাই ভিন্ন ও বৈচিত্র্যময়। কিন্তু সমতলে বসে পাহাড়ের সেই বাস্তবতা অনুভব করা খুব সহজ নয়।
দেশের প্রচলিত যেসব আইন-কানুন রয়েছে তা এই তিন পার্বত্য জেলার জন্য পুরোপুরি প্রযোজ্য নয়, যা এই অঞ্চলকে আরো বেশি স্বতন্ত্র করে তুলেছে। একটি দেশের আইন অনেকটাই সেই দেশের প্রতিবিম্ব। কারণ আইন দেখে ওই অঞ্চলের জনগণের জনমিতিক গঠন, আচরণ এবং ভূমির মালিকানার ধরন ও ব্যবহার, খাদ্যাভ্যাস, অপরাধ প্রবণতাসহ অনেক বিষয়েই ধারণা পাওয়া যায়।
তাই শুধু পার্বত্য অঞ্চলে বসবাসকারীরাই নয়, সমতলের অধিবাসীদেরও পার্বত্য আইন সম্পর্কে ধারণা রাখা জরুরি। কিন্তু এ বিষয়টিই অজ্ঞাত কারণে তেমন গুরুত্ব পায়নি। ফলে সাধারণের পক্ষে পার্বত্য অঞ্চলের আইন ও বিধি সম্পর্কে ধারণা পাওয়া সত্যি দুরূহ। এই সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে উঠতে বিশেষভাবে সাহায্য করবে শাহ্ মোজাহিদ উদ্দিন রচিত ভিন্ন ধারার বই ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক আইন, বিধি ও পরিপত্র’।
লেখক জেলা প্রশাসক ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে বান্দরবান পার্বত্য জেলায় কাজ করার সময়ই পার্বত্য অঞ্চলের প্রযোজ্য আইন-কানুনের সান্নিধ্য লাভ করেন। ফলে তাঁর সুযোগ হয়েছে খুব কাছ থেকে পাহাড়ি জনপদের জীবনযাত্রা দেখার এবং এসংক্রান্ত আইন-কানুন হাতে-কলমে প্রয়োগের।
পার্বত্য অঞ্চলের প্রচলিত আইন, সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপট ও প্রশাসনিক বাস্তবতার মধ্যে সেতুবন্ধ স্থাপনের মাধ্যমে স্থানীয় জনগণের অধিকার সুরক্ষিত রেখে তাদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে সরকারি নীতি বাস্তবায়ন করাই সে সময় আন্তরিকভাবে চেষ্টা করেছেন তিনি। বইটির ভূমিকায় লেখক তেমনটিই উল্লেখ করেছেন। এরই ফলে এই জনপদের মানুষ ও পার্বত্য তিন জেলায় কার্যকর স্বতন্ত্র যেসব আইন রয়েছে, ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার আলোকে তিনি সেগুলোরই চমৎকার এক সম্মিলন ঘটিয়েছেন নতুন এই বইটিতে। এ বই প্রশাসনে কর্মরতদের আইনানুগ দায়িত্ব পালনে যেমন সহায়ক হবে, তেমনি পার্বত্য অঞ্চলের সরকারি সেবাগ্রহীতাদের সেবা গ্রহণের প্রক্রিয়া বা উপায়গুলো সম্পর্কেও পাঠকের জ্ঞান আরো ঋদ্ধ করবে।
‘পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক আইন, বিধি ও পরিপত্র’ বইটি পাঠ করে পাহাড়ে বসবাসকারী বিভিন্ন জাতি-গোষ্ঠীর সমাজব্যবস্থায় নেতৃত্ব দানকারী হেডম্যান ও চিফদের দায়িত্ব, কর্তব্য, ভূমিকা ও নিয়োগ বিষয়ক আইনের নির্দেশনাগুলোও পাঠক জেনে নিতে পারবে।
এ ছাড়া পার্বত্য অঞ্চলে আইন প্রয়োগে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান, পার্বত্য চট্টগ্রাম রেগুলেশন, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি এবং তৎপরবর্তী আইনসহ স্থানীয় প্রথা ও রীতির মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, যা করতে নতুন এই বইটি বিশেষভাবে সহায়ক হবে।
সার্বিক বিবেচনায় পার্বত্য অঞ্চলে প্রচলিত আইনগুলোকে প্রথমবারের মতো এক মলাটে নিয়ে আসার যে মহতী উদ্যোগ লেখক শাহ্ মোজাহিদ উদ্দিন নিয়েছেন, তাতে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর প্রতি তাঁর আন্তরিকতা ও দেশের প্রতি দায়িত্বশীলতারই পরিচয় মেলে।
পাশাপাশি আইন-কানুনের মতো কঠিন বিষয়কে লেখক বইটিতে সরল গদ্যে উপস্থাপনের মাধ্যমে সাধারণ মানুষকেও আইন জানার প্রতি আগ্রহী করার চেষ্টা করেছেন। নিশ্চয়ই আইনি ধারণা দেওয়ার এই প্রচেষ্টা আগামী দিনেও অবিরত থাকবে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক আইন, বিধি ও পরিপত্র : শাহ্ মোজাহিদ উদ্দিন। প্রচ্ছদ : ধ্রুব এষ। প্রকাশক : আদি প্রকাশনী। প্রকাশকাল : ১ জানুয়ারি ২০২৫। মূল্য : ৮৯৯ টাকা
সানজিদা সুলতানা সোমা