কত যে কাজ তার হিসাব নেই। এদিকে বেলা বাড়ছে। জোয়ারের পানি দেখে বোঝা যাচ্ছে না কিছু। কুয়ো পাখি ডেকে গেছে কয়েকবার। এবাদতরা অবশ্য হেসে উড়িয়ে দেয়। বলে—পাখির মাথার ঠিক নাই।
সেই পাখির মতো দুলালের ডেরাও এই নদী-সাগরের কোলে তাই পানির এই গতি চিরদিনের সঙ্গী। শুধু সে নয়, তার চৌদ্দপুরুষেরই নাড়ি পোঁতা এই অঞ্চলে। নোনা হাওয়া আর জল-কাদার আদরে বেড়ে ওঠা মেটে রঙের শক্তপোক্ত শরীর। তবে জোয়ার থেমে গেলে বর্ধিষ্ণু চরের বুকে আটকে যাওয়া ট্রলার সেসবের ধার ধারবে না। আজকাল জনাপাঁচেক জোয়ান হাত লাগালেও হিমশিম খেতে হয়।
ভোরবেলা থেকে গোছগাছ শুরু হয়েছিল। কিন্তু শেষমেশ আম্মার জোরাজুরিতে থালাভর্তি ভাতের সঙ্গে কইয়ের লাল ঝোল আর সোনা রঙের ডাল ভরপেট খেয়ে শরীর নাড়াতে বেগ পেতে হয়েছে দুলালের। কপালে থ্যাবড়ানো কাজল মেখে আর ফুলতোলা জামা পরে কোলে কোলে ঘুরছিল দু’মাস বয়েসি কন্যা। তাকে হাঁটুতে শুইয়ে কিছুক্ষণ উঠানে রোদও পোহাতে হয়েছে। এসব সেরে বাড়ির বাইরে পা রাখতে রাখতে সূর্যটা ঠিক মাঝ আকাশে চড়ে বসেছিল। গতকাল বিকেল থেকেই আকাশে কিছু পোয়াতি মেঘের আনাগোনা। কে জানত তারা ঝরে পড়ার জন্য ঠিক ওই সময়টার অপেক্ষায় ছিল!
বেকায়দার বৃষ্টিতে ছাতাটা মেলে দিয়ে একবার পেছনে ফিরে তাকিয়েছে দুলাল। বাঁখালীর বেড়ার ফোকর দিয়ে কলমির লকলকে সবুজ লতাগুলো তখন মাথা তুলে আকাশের দিকে মুখ করে দুলছিল। আম্মার গলায় কাশির দমক। ওই অবস্থাতেই উঠানের এ মাথা থেকে ও মাথা ছুটছিল মানুষটা। মেলে দেওয়া কাপড়, কাঁথা-বালিশ, কড়কড়ে শুঁটকি মাছগুলো সব বৃষ্টিতে ভিজছে। বড় অবেলার বৃষ্টি। চোখের সামনে আচানক ঝাঁ ঝাঁ দুপুরটা একেবারে ভিজে সপসপে হয়ে গেল।
‘কই গ্যালি রে আবাগীর বেটি’ পেছনে ফেলে দুলাল এগিয়ে যায় আর সাত-পাঁচ ভাবে। আবার মাস পাঁচেকের জন্য সংসার ছাড়া, পাখির মতোন মুক্ত জীবন। দুলাল আজকাল মেনেই নিয়েছে সংসারকর্ম তার জন্য নয়। বড় গোলমেলে এ জায়গা। এর চেয়ে সাগরলতা আর বুনো শিমের জমিনই ভালো। তবু সেই মাসচারেকের স্বাধীন জীবন ফেলে তাকে ফিরে আসতে হয় এই দোজখখানায়। তার ওপর যোগ হয় নতুন পিছুটান। কন্যার মুখ, বুকের ভেতর পদ্মপাতার জলের মতো যে টলমল করে যায় দিনরাত।
রাজিয়ার কথাও সে ভাবে। বের হওয়ার মুখে মানুষটার দেখা মেলেনি। মেয়েমানুষের এত তেজ ভালো কিছু নয়। কিন্তু দুলালেরও অপরাধবোধ হয়। কথার পিঠে কথায় একেবারে মাদি কাঁকড়ার মতো কামড়ে ধরলেও ওই তেজ, চোখের আগুন খানিক পরে দুটো মিষ্টি কথাতেই ঠাণ্ডা হয়ে যায়। কেন যে অশান্তির সময় এ কথা তার মনে থাকে না আর পরে এই নিয়ে আফসোসের শেষও থাকে না। বড় হিসেবের জায়গা এ সংসার। কথা বলো হিসাব করে, রাগ বা সোহাগ যা-ই হোক তাতেও হিসাব।
এই ট্রলারের জীবনটাও হিসাবেরই। কত মণ বস্তা, কত পার্সেন্ট বন বিভাগের কর এসব চলছে রাত আর দিন। প্রয়োজনীয় রসদ আর রাতের রান্নার জোগাড়যন্ত্র দেখে দিয়ে গলুইয়ে বসতে বসতে দুলালের তবু মনে হয় এই জলজ সংসারটাই বেশ। হিসাবের ভাগফল না মিললেও কেউ কড়া চাউনি ছুড়ে দেয় না। আর যদি দেয়ও তাতে দুলালের কিছু যায় আসে না। কারণ সে জানে টাকা-পয়সা হলো দুদিনের আমদানি। লোকসান নিয়ে তাই এত হিসাবের কিছু নেই।
স্রোতের সঙ্গে ট্রলারটা চলেছে চমৎকার গতিতে। খুব একটা দেরি হয়নি এখনো। নির্ভার মনে পানির ওপর চোখ রাখে দুলাল। কে যে নাম রেখেছিল কেউ জানে না, কিন্তু সত্যিই বড় সুন্দর এই রূপের গাঙ। শেষ আশ্বিনের দিগন্তরেখায় পাপড়ি মেলা ফুল হলদে রঙের ছটা ছড়াচ্ছে। মমরোজ আর এবাদত রোদের আঁচে বসে আলাপে মশগুল। বিষয়বস্তু সেই একই। এ বছরের ফলন। সরিষা চাষিদের কপাল খুলল বলে। কার্তিক আসে কি আসেনি তাতেই দুপারজুড়ে ভরা ফলন।
একজন হাঁক দেয়—অ বড়ভাই, মুঠা কত?
ওপার থেকে উত্তর ভেসে আসে। প্রতি উত্তরে কিছু একটা বলে মমরোজও।
পাশেই কাঁকড়াবোঝাই নৌকা। ঢেকে রাখা ঝাঁপি, তবু ওরা চেনে সেই লাল, হলুদ, কালো ছোপছোপ নকশা। উত্সুক চোখে তাকায় সবাই। ফেরার পথে নিশ্চিন্তে সদাই চলে। এখন হাতে যা আছে সব পাই পাই হিসাব রাখা চাই। তবু সঙ্গীরা দরদাম করতে ছাড়ে না। বেজায় চড়া না হলে দুয়েক বেলা অন্তত ভালোমন্দ খাওয়া যেতেই পারে জলের বুকে বসবাসের সময়টায়। আজ অবশ্য ওদের রান্নার টান নেই। এই তো দুপুরের আয়োজন চলছে পুরোদমে। বোধ হয় সিঁদুরকৌটা থেকে কেনা পারশে মাছের ঝোল আর আলুভর্তা।
সরষের হলুদ থেকে চোখ ফেরায় দুলাল। খালের বুকে শরীর জুড়ানো হাওয়া। বড় ঘুম পায় তার। ছইয়ের ভেতরে পাটাতনে গামছা পেতে গা এলিয়ে দেয় সে। ঘুম আর জাগরণের বিভ্রমে ডোবে। খালের ঠোঁটার দুপারজুড়ে হলদে সবুজ ডুরে শাড়ি মেলে রেখেছে রাজিয়া। আম্মা বলছে—অ লাতুরির মা, কাপড় তোল। দেখতে একেবারে দু’মাসের কন্যাটির মতোন, ভ্যাবাচেকা খেয়ে উড়ে গিয়ে হেঁতালের আড়ালে বসতেই চাক ভেঙে আকাশে মৌপোকার দল দানা পাকাতে শুরু করে।
ভাটার আগেই নোঙর পরে ওদের। চরের নাম উলুর চর। উলু ঘাসের জাজিম পাতা আছে এইখানে। আর আছে বেগুনি সাগরলতা আর বুনো শিমের অনন্ত ঝোপ, পায়ের তলায় যাদের পেলে দুলালের মনে হয় এই তো বাড়ি ফিরলাম।
বেজায় ব্যস্ত সবাই। পুরোদমে মাছ কেনাবেচা চলছে। টাইগার চিংড়ি, শাপলাপাতা, রুপচাঁদা, কাইন, ছুরি, তোপসে—সবই আছে। একই তালে চলছে মাছ ধোয়া আর বরফ চাপা দিয়ে সংরক্ষণের চেষ্টা। ‘মরা-গোন’ কেবল শুরু, তাই বইশালেরা মাছ ধরবে না এই কদিন। দুদিন পর এ বছরের মতো মাছ ধরার অনুমতিও উঠে যাবে। শুধু সে কারণেও নয়, এ বছর মাছ কম হয়েছে, ফলে দরদাম করতে বেশ হিমশিমই খেতে হয় জেলেদের।
গোনজের আর মমরোজ ডাঙায় নেমে ঘাস পরিষ্কার করতে লেগে গেছে। তারপর উঁচু করে মাচা বাঁধার পালা। বাঁশের তৈরি চালনিগুলোও প্রস্তুত হতে হবে। কাল দুপুরের মধ্যেই মাছগুলো রোদ পোহাবে চালনিতে। এবার মমরোজরা ঠিক করেছে একটা রোদও বাদ দেবে না। যত রোদ তত ভালো শুঁটকি।
চোখের নিমেষে উলু ঘাসের সঙ্গে উজাড় হচ্ছে বুনো শিমের বাড়ন্ত সংসার। মনে হয় ডাকাতরা হামলে পড়ে চরের বুকটাকে খুবলে নিচ্ছে। দুলাল আকাশের ভাবগতিক বোঝার চেষ্টা করে। না, এদিকে মেঘের আনাগোনা নেই। সব ভেসে গেছে পের রূপের গাঙের আরেক পারে। সেদিকটায় হয়তো আরো কয়েক দফা ঝরবে, যেমন আজ ঘর ছাড়া দুপুরে ঝরেছে এক পশলা।
দক্ষিণের জঙ্গলটা কিছুটা অন্য রকম দেখায় এবার। পানির কাছে খসে পড়া বা ভেসে আসা বাদামি ডালপালা চোখে বিভ্রম ধরায়। ওর মনে আছে একটা সময় এদিকটায় কুমিরের খুব আনাগোনা ছিল। চেনাজানার মধ্যে অন্তত জনাতিনেক জোয়ানের জীবন গেছে কুমিরের পেটে। একজন এখনো খুঁড়িয়ে হাঁটে। নিউমার্কেটে সিগারেটের দোকানে বসত হাফিজুল, হাঁটুর পেছন থেকে মাংস খুবলে নিয়েছিল ওর। আট-ন’ফুট লম্বা ছিল সেই কুমির। উপস্থিত বুদ্ধির জোরে প্রাণে বেঁচে ফিরেছে ছেলেটা। মন্দের মধ্যে ভালো হলো ও রকম ধুন্ধুমারের পর বনস্যুদের উৎপাতটা থেমেছে এদিকটায়।
সত্য-মিথ্যা কত গল্প সেসব নিয়ে। ত্রিপলঘেরা পাকঘরটায় গোল হয়ে বসেছে সবাই। সেখানেও ঘুরেফিরে চলেই আসে পুরনো দিনের কথা। গল্পের চেয়ে দ্রুতগতিতে ভাত বাড়ে রতন। সিদ্ধ ভাতের সুঘ্রাণ আর ধোঁয়াচ্ছন্ন কুণ্ডলীতে মুখ ঢেকে যাচ্ছে সবার। হাতে হাতে মেলামাইনের থালা। সে থালায় ট্যালট্যালে ডাল আর কেওড়া-কাইনের ঝোল।
এবাদত দু’পা ছড়িয়ে বসে আছে। ক্ষতটা সারেনি ওর। রতন মুখে মুখে টোটকা বলে দেয়। এসব সে ভালোই জানে। তার এক ভায়রা ভাই মৌয়াল, দুধখালীর পারে বাড়ি তার। গেল বছর মৌ কাটতে গিয়ে সারা শরীরে হুল ফুটিয়ে একেবারে প্রাণ যায় যায় অবস্থা হয়েছিল।
এগিয়ে দেওয়া শিশিটা থেকে কয়েক ফোঁটা মধু নেয় এবাদত। আঙুলের ডগা দিয়ে ক্ষততে লাগায়। এবাদত বিয়ে করেনি এখনো। তাই ইয়ার্কির সুযোগ ছাড়ে না এত দিন পরও।
শালিডারে দেলি না, রতইন্যা! মধু দিয়া কী করতাম আমি?
রতন ফিকফিক হাসে কেবল। তারপর বলে— অত্ত বিরাট মুখ বাদ দিয়া পোকে বড় ভাইয়ের পায়ো কামড়াইলো ক্যা, কেউ আমারে কন তো!
এবাদতও খ্যা-খ্যা করে হাসে এবার।
রাতটা ঝুপ করে শুনসান হয়ে গেছে। শুধু মাচার বাইরে খসখস শব্দগুলো হয়তো সারা রাত চলবে। বুনো শুয়োরের দল ঘুরঘুর করছে। বিকালে একদল বানরও দূর থেকে জরিপ করে গেছে। ওদের আসবার খবরটা জঙ্গলের বাসিন্দাদের মধ্যে জানাজানি হয়ে গেছে।
সারা দিনের দৌড়ঝাঁপের পর শরীরটা একেবারে ছেড়ে দিচ্ছে দুলালের। নানা জায়গায় ব্যথা। রতন কি ব্যথার টোটকা জানে? জিজ্ঞেস করা হয়নি। মাচায় পাতা বিছানায় শুয়ে সঙ্গে আনা ভারী কাঁথাটা শরীরের ভাঁজে ভাঁজে লেপ্টে নেয়। আম্মার দোক্তার গন্ধ মেশা ওম আরামের পরত জমায় শিরায়-উপশিরায়।
চোখ বুজলেই দুলাল দেখতে পায় মাঘ মাসের মধ্যরাত। ভরা গোনে নৌকায় চলেছে ওরা। বইশাল মাঝি জোড়া ইলিশ ধরেছে জালে। নৌকার চেয়ে বড় সেই মাছ। গরম তেলে মাছ ভাজা হতে হতে গানের আসর জমে উঠেছে। ভীষণ দরাজ গলা গাইনের। কিন্তু ‘কেন বান্ধো দালান ঘর, রে মন আমার’ শেষ আর হয় না। গানের মাঝেই মুখটা বেঁকে যেতে থাকে লোকটার। দুলালের পরনে একটা বেঢপ হাফপ্যান্ট। কখন যে ডাঙায় নেমে পড়েছে সে নিজেও জানে না। কেবল উলু ঘাসের জঙ্গলের ভেতর দিয়ে উদ্ভ্রান্তের মতো সে ছুটে চলে। আর সেই ঘাস ক্রমশ তার মাথা ছাড়িয়ে যায়। সাগরলতার লকলকে জিভ গোড়ালি থেকে হাঁটু অবধি পেঁচিয়ে ধরছে তাকে। পেছনে তাকালে সে দেখতে পায় একঝাঁক পতঙ্গ লোকটার নিথর শরীরটাকে শূন্যে ভাসিয়ে নিয়ে চলেছে।