বিশ্বসাহিত্য

অথার পুরস্কারের দীর্ঘ তালিকা প্রকাশ

শেয়ার
অথার পুরস্কারের দীর্ঘ তালিকা প্রকাশ

২০২৫ সালের অথার পুরস্কারের দীর্ঘ তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে এ মাসের ৮ তারিখে। ভারতের নারী লেখকদের ইংরেজিতে লেখা বইয়ের স্বীকৃতি হিসেবে দেওয়া হয় অথার পুরস্কার। এ পুরস্কারের প্রবর্তক জেকে পেপার এবং টাইমস অব ইন্ডিয়া। কথাসাহিত্য, প্রবন্ধ সাহিত্য, শিশুসাহিত্য এবং প্রথম প্রকাশিত বইয়ের জন্য দেওয়া হয় এ পুরস্কার।

ভারতে নারী লেখকদের জন্য দেওয়া জাতীয় পর্যায়ের সর্বোচ্চ মানের এ পুরস্কার প্রবর্তন করা হয় ২০১৮ সালে। ২০২৩ সালের নভেম্বর থেকে ২০২৪ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে ভারতে প্রকাশ করা নারী লেখকদের বই ২০২৫ সালের পুরস্কারের প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে।

এ বছরের পুরস্কারের জন্য প্রতিযোগিতা করতে জমা পড়ে দুই হাজারের বেশি বই। দীর্ঘ তালিকায় রয়েছে মোট ৩৪টি বই।

সাহিত্যজগতে মূল্যবোধ ও সৃজনশীলতা তৈরিতে ভূমিকা রাখা নারীদের মূল্যায়ন করার একটা প্রয়াস হিসেবে দেখা হয় এ পুরস্কারকে। বিচারকদের হাতে এসে পৌঁছতে বইগুলো আরো অনেক পর্যায়ের পর্যবেক্ষণের মধ্য দিয়ে এসেছে। এবারের পুরস্কারের সাহিত্য পরিচালক জয়া ভট্টাচার্য রোজ বলেন, ‘আমরা আজ দ্বিতীয় শিল্প বিপ্লবের মধ্যে আছি।’ তথ্য-প্রযুক্তির বিস্তার এত বৃহৎ পরিসরে ঘটছে যে শুধু মানুষের ক্ষমতা নিয়ে তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলা প্রায় অসম্ভব।
বেশির ভাগ নারীর জন্য সময় হলো একটা নমনীয় সত্তা; সময়কে নিজেদের মতো করে ব্যবহার করতে হয়। এভাবেই লেখার সময় বের করা সম্ভব। ২০২৫ সালের তালিকায় থাকা লেখকরা বৈচিত্র্যময় বিষয় নিয়ে চিন্তা উসকে দেওয়ার মতো বই লিখেছেন।’ উল্লেখ্য, ২০২৫ সালের অথার পুরস্কার চূড়ান্ত বিজয়ীর হাতে তুলে দেওয়া হবে দিল্লিতে মার্চের ২১ তারিখে।

 

অথার পুরস্কারের দীর্ঘ তালিকা প্রকাশ

নিরো পুরস্কার পেলেন যাঁরা 

ব্রিটেন ও আয়ারল্যান্ডের সেরা সাহিত্যের স্বীকৃতি হিসেবে নির্বাচিত বইয়ের জন্য ২০২৪ সালের নিরো পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছে গত ৫ মার্চ।

কথাসাহিত্য, গদ্যসাহিত্য, শিশুতোষ কথাসাহিত্য এবং প্রথম প্রকাশিত কথাসাহিত্যের জন্য দেওয়া হয় নিরো সাহিত্য পুরস্কার। সব রকমের রুচির পাঠকদের জন্য উঁচু মানের বই বাছাই করা হয় এ পুরস্কারের মাধ্যমে। কয়েক শ বইয়ের মধ্য থেকে  লেখক, সাংবাদিক এবং বই বিক্রেতারা বছরের সেরা বই বাছাই করেছেন এবারের পুরস্কারের জন্য। এবারের পুরস্কারপ্রাপ্ত বইগুলোর মধ্যে রয়েছে লক্ষণীয় বৈচিত্র্য। কথাসাহিত্যের পুরস্কার পাওয়া উপন্যাসটা লেখা হয়েছে ধাঁধালো আবহের মধ্যে লোমহর্ষক লোককাহিনির মিশ্রণ ঘটিয়ে। অন্যদিকে লোককাহিনির সঙ্গে বিজ্ঞানের উপাদান মিশিয়ে লেখা উপন্যাস পেয়েছে শিশুতোষ কথাসাহিত্যের পুরস্কার। লেখকের প্রথম প্রকাশিত কথাসাহিত্যের বইটিতে আছে ডার্ক কমেডি। আর নৌকাডুবির পর ১১৮ দিন সমুদ্রে টিকে থাকা দম্পতির সত্যি ঘটনার ওপর লেখা বই পেয়েছে গদ্যসাহিত্যের পুরস্কার। কথাসাহিত্যে এবারের পুরস্কার পেয়েছেন অ্যাডাম এস লেসলি। তাঁর উপন্যাসের নাম ‘লস্ট ইন দ্য গার্ডেন’। সোফি এমহার্স্ট পেয়েছেন গদ্যসাহিত্যের পুরস্কার। তাঁর বইয়ের নাম ‘মরিস অ্যান্ড মেরালিন : অ্যান এক্সট্রা-অর্ডিনারি স্ট্রু স্টোরি অব শিপরেক সারভাইভাল অ্যান্ড লাভ’। শিশুতোষ কথাসাহিত্যের পুরস্কার পেয়েছেন লিজ হায়দার। তাঁর বইয়ের নাম ‘দ্য টুয়েলভ’। প্রথম প্রকাশিত বই ‘ওয়াইল্ড হর্সেস’ উপন্যাসের জন্য নিরো পুরস্কার পেয়েছেন কথাসাহিত্যিক কলিন ব্যারেট। উল্লেখ্য, ২০২৩ সালের ১ ডিসেম্বর থেকে ২০২৪ সালের ৩০ নভেম্বরের মধ্যে প্রকাশ করা বই বিবেচনায় রাখা হয়েছে। 

♦ ফাহমিদা দ্যুতি

 

 

মন্তব্য

সম্পর্কিত খবর

বই আলোচনা

‘ঘষা কাঁচে’ ক্রীড়াঙ্গনের বিস্মৃত তারকারা

    সৈকত কবির সায়ক
শেয়ার
‘ঘষা কাঁচে’ ক্রীড়াঙ্গনের বিস্মৃত তারকারা

প্রচ্ছদে কালোর আবহ, শিরোনামে একটি প্রতীকী ভাবনা ‘ঘষা কাঁচে’—সময়ের ধুলোমলিন ঘষা কাঁচের ভেতর দিয়ে সদ্য-অতীত জীবন। বইটির পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে স্পষ্ট হয়ে ওঠে, এটি নিছক ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণা নয়। সাবলীল গদ্যে লেখা বইটি সম্পর্কে লেখক নিজেই বলেছেন—এটি ‘ঝকঝকে সকালের ক্লান্তিহীন গতিময়তার প্রতিশ্রুতি’, কিন্তু একই সঙ্গে ‘বিষাদের আবছায়া’ও রয়েছে এর পরতে পরতে। এই দ্বৈত অনুভূতিই পাঠককে আকৃষ্ট করে।

kk বাংলাদেশের ক্রীড়াজগতে কত শত কিংবদন্তি রয়েছেন, যাঁদের নাম ইতিহাসের পাতায় খুব বেশি উচ্চারিত হয় না। মূলধারার আলোচনায় তাঁদের সাফল্য কিংবা সংগ্রামের কথা উঠে আসে না, অথচ তাঁদের অবদান কম নয়। ঠিক এমনই কিছু বিস্মৃতপ্রায় ক্রীড়াবিদের গল্প তুলে এনেছেন তরুণ লেখক বইটির শুরুতে।

ইভান ইকরামের সাংবাদিকতা জীবনের ছাপ পড়েছে বইয়ের প্রতিটি অধ্যায়ে।

বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনের আড়ালে থাকা অনেক গল্প তিনি অনুসন্ধানী নয়, বরং ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণা হিসেবেই তুলে ধরেছেন। ক্রিকেট ও ফুটবলের বাইরে গিয়ে তিনি ভলিবল, দাবা, অ্যাথলেটিকস এবং প্যারা-স্পোর্টসের বিস্মৃতপ্রায় ক্রীড়াবিদদের কথা বলেছেন।

ক্রীড়াবিদদের জীবন শুধু মাঠের পারফরম্যান্সে সীমাবদ্ধ নয়, তাঁদের লড়াই শুরু হয় মাঠের বাইরেও। সেই লড়াই কখনো প্রতিষ্ঠার, কখনো স্বীকৃতির, কখনোবা নিছক জীবনধারণের।

পাঠকের সামনে ফুটে ওঠে এক ভিন্ন জগৎ, যেখানে ওয়াহিদুল গণির স্পিন, রকিবুল হাসানের সাহস কিংবা নিয়াজ মোরশেদের দাবার চাল এক নতুন ব্যাখ্যা পায়। ফুটবল কোচ ওয়াজেদ গাজী, ভলিবল তারকা ইয়াদ আলি কিংবা কমনওয়েলথ পদকজয়ী আব্দুস সাত্তার নিনির গল্পগুলো যেন শুধুই তাঁদের ব্যক্তিগত সাফল্যের নয়, বরং সময়ের কাছে হারিয়ে যাওয়া অধ্যায়ের পুনরুদ্ধার।

লেখকের স্মৃতির ঝাঁপি থেকে উঠে আসে ময়মনসিংহের এক অজপাড়া গাঁয়ের গল্প, যেখানে ফুটবল খেলে বদলে গেছে পুরো একটি গ্রামের চেহারা। কলসিন্দুরের সেই মেয়েরা, যারা সমাজের গত্বাঁধা দৃষ্টিভঙ্গিকে ভেঙে নতুন এক দিগন্ত উন্মোচিত করেছে। কে জানত, ছোট্ট একটি বল বদলে দিতে পারে একদল কিশোরীর জীবন, বদলে দিতে পারে একটি অঞ্চলের ভবিষ্যৎ! অথচ এমন ঘটনা কতবার ঘটে, কজনই বা সে কথা জানে!

সাংবাদিকতার জীবনও যে কতখানি ঘটনাবহুল, তা লেখকের নিজস্ব অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে ফুটে উঠেছে।

কখনো মাঠের সীমানায় দাঁড়িয়ে দেখা খেলা, কখনো খেলোয়াড়দের সঙ্গে কাটানো মুহূর্ত, কখনোবা দূর-দূরান্তে সফর—এসবের বর্ণনায় জীবনধর্মী এক আখ্যানের স্বাদ পাওয়া যায়। মাঠের উন্মাদনা, গ্যালারির শ্বাসরুদ্ধকর মুহূর্ত, ক্রীড়াবিদের ক্লান্ত-অবসন্ন মুখ কিংবা বিজয়ের হাসি—সব কিছুই অনুভব করা যায় লেখকের ভাষার গভীরতায়।

বাক্যের কারুকাজে সহজ-সাবলীল অথচ গভীর এক প্রকাশভঙ্গি। অল্প কথায় অনেক কিছু বলার মুনশিয়ানা লেখকের কলমে স্পষ্ট। কোথাও কোনো অতিরিক্ত ব্যাখ্যা নেই, কোথাও আবার ছোট্ট একটি বাক্যে গভীর জীবনবোধ। ক্রীড়ার প্রতি ভালোবাসা, খেলোয়াড়দের প্রতি মমতা আর জীবনের প্রতি তাঁর গভীর দৃষ্টিভঙ্গি একসঙ্গে মিলে এক মায়াবী গদ্য সৃষ্টি করেছে। ইভান ইকরাম একজন ক্রীড়া সাংবাদিক হিসেবে যে দায়বদ্ধতা দেখিয়েছেন, তা প্রশংসনীয়। তাঁর অন্তর্মুখী দৃষ্টি ও ঝরঝরে গদ্য বইটিকে করেছে স্বতন্ত্র।

 

মন্তব্য

শেকসপিয়ারের প্রেমের কবিতার

    আদি কপি আবিষ্কার
শেয়ার
শেকসপিয়ারের প্রেমের কবিতার

কয়েক শ বছর পরে শেকসপিয়ারের হাতে লেখা প্রেমের কবিতার কপি পাওয়া গেছে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সপ্তদশ শতকের কবিতা সংকলনে। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের আধুনিক ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপক ড. লিয়াহ ভেরোনিজ উইলিয়াম শেকসপিয়ারের ১১৬ নম্বর সনেটের এই কপিটা পেয়েছেন। অক্সফোর্ডের অ্যাশমোলিয়ান জাদুঘরের প্রতিষ্ঠাতা এলিয়াস অ্যাশমোলের কাজকর্ম এবং স্মৃতিবিজড়িত ফাইলপত্রের মধ্যে পাওয়া গেছে কবিতাটা। অক্সফোর্ডের শেকসপিয়ার বিশেষজ্ঞ প্রফেসর এমা স্মিথ বলেন, ‘এই চাঞ্চল্যকর আবিষ্কার শেকসপিয়ারের মৃত্যু-পরবর্তী দশকগুলোতে তাঁর জনপ্রিয়তা সম্পর্কে জানতে গবেষকদের জন্য 

শেকসপিয়ারের প্রেমের কবিতার

সহায়ক হবে।

’ বিভিন্ন লেখকদের বিবিধ বিষয়ে লেখা পাণ্ডুলিপির মধ্যে এই কবিতটা পেয়েছেন ড. ভেরোনিজ। তিনি বলেন, ‘পাণ্ডুলিপির পাতা ওল্টানোর সময় হঠাৎ আমার নজরে আসে, এটা ১১৬ নম্বর সনেটের একটা ব্যতিক্রমী চেহারার কপি। উনিশ শতকে সাজানো একটা ক্যাটালগে কবিতাটা পাই। কবিতাটার গায়ে শেকসপিয়ারের নাম ছিল না।
তবে স্পষ্টভাবেই লেখা ছিল, ‘অন কন্সট্যান্সি ইন লাভ’। কবিতাটার অ্যাশমোলের ভার্সনে একটা পঙক্তিতে কয়েকটা কথার পরিবর্তন বা হেরফের করা হয়েছে। আদি কবিতার সঙ্গে পার্থক্য এইটুকুই। ড. ভেরোনিজ মনে করেন, প্রথম পঙক্তিতে  এই সামান্য পরির্তন এবং শেকসপিয়ারের নাম উল্লেখ না থাকার কারণে এ কবিতাটা এত দিন ১১৬ নম্বর সনেটের আদি কপি হিসেবে পরিচয় পায়নি ।
১৬৪০-এর দশক অর্থাৎ রয়েলিস্ট এবং পার্লামেন্টারিয়ানদের মধ্যে সংঘটিত গৃহযুদ্ধের দশকের ‘রাজনৈতিক তাড়না’ তকমা পাওয়া লেখা হিসেবে বিবিধ লেখার মধ্যে পড়েছিল এটা। অ্যাশমোল ছিলেন রাজতন্ত্রের সমর্থক। গবেষকদের মতে, তিনি যে পরিবর্তনটুকু এনেছেন তার কারণে কবিতাটা পুরোপুরি প্রেমের কবিতা না থেকে কিছুটা ধর্মীয় ভাব এবং রাজনৈতিক আনুগত্যের বৈশিষ্ট্য পেয়েছে।

♦ আল মনসুর

মন্তব্য

বুদ্ধিবৃত্তিক সমাজ নির্মাণের হাতিয়ার বিতর্ক

    বহুমুখী চিন্তার বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে নব্বইয়ের দশকে হাসান আহমেদ চৌধুরী কিরণ বেছে নিয়েছিলেন বিতর্ক। কেটে গেছে তিন দশক। জনমানসে কতটুকু ভূমিকা রেখেছে বিতর্ক? এসব প্রশ্ন সামনে রেখেই শিলালিপির জন্য তাঁর সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন অলকানন্দা রায়
শেয়ার
বুদ্ধিবৃত্তিক সমাজ নির্মাণের হাতিয়ার বিতর্ক

আপনি কিভাবে বিতর্কের জগতে প্রবেশ করলেন? এখনো কিভাবে বিতর্কের মাঝেই নিজেকে উজ্জীবিত রেখেছেন?

স্কুল-কলেজ জীবন থেকেই আমার বিতর্কচর্চার লড়াই শুরু। তবে সেই লড়াইটা সমৃদ্ধি লাভ করে নব্বইয়ের দশকে। আশির দশকে ঢাকা কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন ভর্তি হই রাষ্ট্রক্ষমতায় তখন সামরিক সরকার হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। সারা দেশে সামরিক সরকারবিরোধী আন্দোলনের ঢেউ।

বিতর্ক নিয়ে এরশাদবিরোধী আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ি আমি নিজেও। গড়ে তুলি ঢাকা ইউনিভার্সিটি ডিবেটিং সোসাইটি। সাধারণ সম্পাদক হিসেবে নেতৃত্বে থাকি। একঝাঁক তরুণকে সঙ্গে নিয়ে বিতর্কের লড়াইটা ছড়িয়ে দিতে সক্ষম হই।

 

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বিতর্কের ধারা এবং শৈলী কিভাবে পরিবর্তিত হয়েছে? কিভাবে এই পরিবর্তনগুলোর সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিয়েছেন?

বিতর্ক একটা চলমান বিষয়। বিতর্ককে আকর্ষণীয় করতে নতুন নতুন ফর্ম ব্যবহার করা হয়। এখানে ব্যক্তির প্রাপ্তির চেয়ে সামাজিক দায়বদ্ধতার বিষয়টিকে বেশি প্রাধান্য দেওয়া হয়। এখানে মূল লক্ষ হলো—তরুণদের একমুখী চিন্তার বিপরীতে বহুমুখী চিন্তার বহিঃপ্রকাশ ঘটানো।

এ কারণেই নব্বইয়ের দশকের শেষে বেসরকারি টেলিভিশনে বিতর্কের সূচনা ঘটে আমার হাত ধরেই। নব্বইয়ের দশকের শেষলগ্নে প্রথম বেসরকারি টেলিভিশন এটিএন বাংলায় আমার পরিকল্পনা, উপস্থাপনা ও নির্দেশনায় শুরু করি বিতর্ক প্রতিযোগিতা। প্রথম প্রথম বিষয়ভিত্তিক বিতর্ক নিয়ে কাজ করি। এরপর রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিবর্তনের কথা ভেবে সংসদীয় ধারায় শুরু করি ছায়া সংসদের আদলে বিতর্ক প্রতিযোগিতা, যা এখনো চলমান আছে।

বিতর্ককে আপনি কিভাবে একটি শৈল্পিক অভিব্যক্তি হিসেবে দেখেন? বিতর্কের মাধ্যমে কিভাবে সাহিত্যিক মূল্যবোধ প্রকাশ করা যায়?

বিতর্ক চর্চা, অনুশীলন হলো সমাজের আয়না।

সমাজে যেকোনো বিষয় নিয়ে যত বেশি বিতর্ক হয় তাতে সমাজ, রাষ্ট্রই বেশি লাভবান হয়। সমাজের সব ক্ষেত্রে এক ধরনের জবাবদিহি উত্তরোত্তর বাড়ে। প্রথাগত চিন্তা-ভাবনা থেকে তরুণ প্রজন্মের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন হয়। তরুণ প্রজন্মের মাঝে মূল্যবোধ, দেশপ্রেম, সদিচ্ছা তৈরি হয়। আসলে সমাজে-রাষ্ট্রে কী হচ্ছে, কেন হচ্ছে তা জানা ও বিশ্লেষণের অন্যতম মাধ্যম হলো বিতর্ক। যেখানে নানা মতের সম্মিলন ঘটে। যেখানে শুধুই যুক্তি দিয়ে বিষয়গুলো তুলে ধরা হয়। যেখানে আবেগের চেয়ে বাস্তবতার আলোকে বিষয়গুলো প্রাধান্য পায়। বিষয়গুলোকে শুধুই তথ্য-উপাত্ত দিয়ে গভীরভাবে তুলে ধরতে হয়। এ সব মিলিয়েই বিতর্কের শৈল্পিক রূপটি ফুটে ওঠে। এখানে যুক্তি, পাল্টা যুক্তি, তথ্য, উপস্থাপন সব একসঙ্গে তুলে ধরতে হয়। সাহিত্যের মাধ্যমে মানুষের মূল্যবোধ গড়ে ওঠে এবং তা বিকশিত হয়। সাহিত্যের মাধ্যমে মানুষের ভালো চরিত্রের গুণাবলি বিকশিত হয় এবং  মানবিক মূল্যবোধের উন্নয়ন ঘটে।

 

বিতর্কচর্চার সঙ্গে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সম্পর্কটা কিভাবে দেখেন?

বিতর্কচর্চার প্রসার বৃদ্ধিতে, বিতার্কিক তৈরিতে আমরা অনেক দিন ধরে নিরলসভাবে কাজ করছি। আমরা চাই বিতর্কচর্চাটা শিক্ষার মূল শ্রোতধারায় অন্তর্ভুক্ত হোক। এখন পর্যন্ত সেটা কিন্তু হয়নি। আগেও বলেছি কো-কারিকুলার হিসেবে বিতর্কটাকে পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করা হোক। আমরা লক্ষ করছি, এ বছর পরিমার্জিত বা সংশোধিত পাঠ্যপুস্তকে ব্যাবহারিক ও উন্নয়নমূলক অনেক ধরনের শিক্ষা যুক্ত করা হয়েছে। অথচ ব্যাবহারিক শিক্ষার চেয়ে জরুরি বিষয় শিক্ষার্থীর ভেতরের বিকাশ। এখানে বিতর্ক শিক্ষা একজন শিক্ষার্থীর মেধা-মনন বিকাশে বড় ভূমিকা রাখতে পারে।

 

বিতর্ক প্রতিযোগিতায় নতুন প্রজন্ম সম্পৃক্ততাকে কতটা গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন?

বিতর্ক প্রতিযোগিতা বরাবরই তথ্য-তত্ত্ব, চিন্তার এবং দৃষ্টিভঙ্গির এক অপূর্ব উপস্থাপন, যা জ্ঞান ও চিন্তাকে বিকশিত করে। ভাবনার জগেক বড় বেশি প্রসারিত করে। বিতর্কচর্চার প্রাণ হলো নতুন প্রজন্ম। এটিই সত্য, বিতর্কচর্চার মধ্য দিয়ে নতুন প্রজন্ম যেমন প্রতিনিয়ত যুক্তিশীল হয়ে ওঠে, তেমনি তাদের মাঝে একটি চমৎকার ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে ওঠে। এটি সত্য যে এ দেশটাকে সুন্দরভাবে গড়তে হলে দায়িত্ববান যুক্তিশীল নতুন প্রজন্ম দরকার। দেশপ্রেমিক নতুন প্রজন্ম দরকার। যে নতুন প্রজন্ম বদলে দেবে আগামীদিন, আনবে নতুন সুপ্রভাত।

 

একটি দুর্দান্ত বিতর্ক আয়োজন উপহার দিতে গিয়ে সংগঠক হিসেবে আপনাকে কী ধরনের দায়িত্ব পালন করতে হয়।

সংগঠক হিসেবে আসলে অনেক দায়িত্ব রয়েছে। প্রোগ্রাম কনসেপ্ট তৈরি থেকে উপস্থাপন, অতিথি নির্বাচন—সব কিছুই করতে হয়। তবে সংগঠক হিসেবে অনেক দায়িত্ব পালন করলেও আমি বিতর্কের থিমেটিক বিষয়গুলোকে বেশি প্রায়োরিটি দিই। বিশেষ করে টপিক সিলেকশনে আমি সমসাময়িক প্রেক্ষাপটের ভিত্তিতে করে থাকি। বিতর্কচর্চাকে আমি সব সময় সমাজ-রাষ্ট্র-রাজনীতির আয়না হিসেবে দেখতে চাই। সমসাময়িক বিষয়ের ওপর প্রতিযোগিতা আয়োজন করতে গিয়ে বিগত শাসনামলে ফ্যাসিস্ট সরকারের রোষানলে পড়ারও ঘটনা ঘটেছে। তবে এখন সেই ঝুঁকি নেই। তাই প্রেক্ষাপট বিবেচনায় যেকোনো বিষয়ের ওপর ছায়া সংসদটি আয়োজন করতে পারছি।

গণতান্ত্রিক সমাজ বিনির্মাণে বিতর্ক কতটা প্রভাব রাখতে পারে বলে আপনি মনে করেন?

বিতর্কের প্রভাব বিশাল। বিতর্ক হলো যুক্তি উপস্থাপন ও শোনার একটি বিকল্প জায়গা। যেখানে মতপ্রকাশের পূর্ণ স্বাধীনতা রয়েছে। যে কেউ স্বাধীনভাবে এখানে মতামত এবং নিজের কথাগুলো বলতে পারে। এই মতামতের মধ্য দিয়েই সমাজের ভালো-মন্দ চুলচেরা বিশ্লেষণ করা যায়। দেখুন, দেশের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আমরা প্রতিনিয়ত রাজনীতিবিদ এবং নীতিনির্ধারক এবং পর্যবেক্ষকদের কথা শুনছি। গণমাধ্যমগুলোও বিভিন্ন বিষয়ে মত প্রকাশ করছে, সংবাদ বিশ্লেষণ করছে। কিন্তু ‘বিতর্কের চর্চামূলক অনুষ্ঠানে আমরা রাজনৈতিক পরিচয়ের বাইরের নতুন প্রজন্মোর প্রতিনিধিদের চিন্তা-ভাবনার কথা বিশেষভাবে শুনতে পাচ্ছি। গণতান্ত্রিক সমাজ নির্মাণে এটির প্রভাব বিশাল।

 

আপনি অনেক দিন ধরে ডিবেট ফর ডেমোক্রেসি নামের একটি সংগঠনের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। এ সংগঠন নিয়ে আপনার ভবিষ্যৎ ভাবনার কথা জানতে চাই।

আমি আসলে স্বপ্নবাদী মানুষ। আমি স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসি। বিতর্ক নিয়ে আমার স্বপ্ন অনেক বড়। আমি বিশ্বাস করি বিতর্কচর্চা একটি গণতান্ত্রিক, বুদ্ধিবৃত্তিক সমাজ নির্মাণের প্রধানতম হাতিয়ার। বিতর্কের ব্যাপ্তি বাড়লে রাষ্ট্রসমাজ উপকৃত হয়। কিন্তু আমাদের দেশে এই শিল্পের এখন পর্যন্ত কোনো প্রাতিষ্ঠানিক রূপ গড়ে ওঠেনি। প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার জন্য আমরা অনেক আগেই একটি জাতীয় বিতর্কশালা বা একাডেমি নির্মাণের আহ্বান জানিয়েছে। এটি আমাদের প্রাণের দাবি। আমরা মনে করি, বিতর্কচর্চার প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে সরকার যদি এগিয়ে না আসে. তাহলে ডিবেট ফর ডেমোক্রেসি জনগণের সহায়তায় নিজেই উদ্যোগ গ্রহণ করবে। কেননা দেশে অনেক প্রতিষ্ঠান এভাবেই মানুষের সহায়তায় গড়ে উঠার নজির রয়েছে।

 

 

মন্তব্য

পতঙ্গ

    নিবেদিতা আইচ
শেয়ার
পতঙ্গ
অঙ্কন : তানভীর মালেক

পুব দিকে চোখ মেললেই একটা রুপালি রঙের সরু ফিতা ঝকমক করে ওঠে। ফিতার বুক ধরে কালো রঙের বিন্দুগুলো এপার-ওপার যাতায়াত করছে। নাম তার রূপের গাঙ। তাকেই লক্ষ করে আলপথ ধরে হাঁটতে থাকে সে।

দস্যুর মতো হামলে পড়া বৃষ্টিটা এই মাত্র থেমে গেছে। আর ঝিলিক মারা রোদ উঠে গিয়ে চকচক করছে খুশিয়াল দুপুর।

‘অ কাকুউউ’। হাত নাড়ছে দুজন।

হাতের ছাউনিতে চোখ কুঁচকে দূরে চোখ মেলে দুলাল। এবাদত আর মমরোজ এসে গেছে সময়মতো। দ্রুত পা চালায় সে। ভাটা শুরু হওয়র আগে পৌঁছানো চাই।
নইলে মাঝপথেই রাত শেষ। তবে ট্রলারে পর্যাপ্ত রসদের জোগান না দেখে যাত্রা শুরু করা যাবে না তা বেলা যতই হোক না কেন।

আজ মানুষ কম। গোনজের আর রতনরা যোগ দেবে গাঙনার চর থেকে। বরফের ব্যবস্থাও সেখান থেকে হবে।

কত যে কাজ তার হিসাব নেই। এদিকে বেলা বাড়ছে। জোয়ারের পানি দেখে বোঝা যাচ্ছে না কিছু। কুয়ো পাখি ডেকে গেছে কয়েকবার। এবাদতরা অবশ্য হেসে উড়িয়ে দেয়। বলে—পাখির মাথার ঠিক নাই।

সেই পাখির মতো দুলালের ডেরাও এই নদী-সাগরের কোলে তাই পানির এই গতি চিরদিনের সঙ্গী। শুধু সে নয়, তার চৌদ্দপুরুষেরই নাড়ি পোঁতা এই অঞ্চলে। নোনা হাওয়া আর জল-কাদার আদরে বেড়ে ওঠা মেটে রঙের শক্তপোক্ত শরীর। তবে জোয়ার থেমে গেলে বর্ধিষ্ণু চরের বুকে আটকে যাওয়া ট্রলার সেসবের ধার ধারবে না। আজকাল জনাপাঁচেক জোয়ান হাত লাগালেও হিমশিম খেতে হয়।

ভোরবেলা থেকে গোছগাছ শুরু হয়েছিল। কিন্তু শেষমেশ আম্মার জোরাজুরিতে থালাভর্তি ভাতের সঙ্গে কইয়ের লাল ঝোল আর সোনা রঙের ডাল ভরপেট খেয়ে শরীর নাড়াতে বেগ পেতে হয়েছে দুলালের। কপালে থ্যাবড়ানো কাজল মেখে আর ফুলতোলা জামা পরে কোলে কোলে ঘুরছিল দু’মাস বয়েসি কন্যা। তাকে হাঁটুতে শুইয়ে কিছুক্ষণ উঠানে রোদও পোহাতে হয়েছে। এসব সেরে বাড়ির বাইরে পা রাখতে রাখতে সূর্যটা ঠিক মাঝ আকাশে চড়ে বসেছিল। গতকাল বিকেল থেকেই আকাশে কিছু পোয়াতি মেঘের আনাগোনা। কে জানত তারা ঝরে পড়ার জন্য ঠিক ওই সময়টার অপেক্ষায় ছিল!

বেকায়দার বৃষ্টিতে ছাতাটা মেলে দিয়ে একবার পেছনে ফিরে তাকিয়েছে দুলাল। বাঁখালীর বেড়ার ফোকর দিয়ে কলমির লকলকে সবুজ লতাগুলো তখন মাথা তুলে আকাশের দিকে মুখ করে দুলছিল। আম্মার গলায় কাশির দমক। ওই অবস্থাতেই উঠানের এ মাথা থেকে ও মাথা ছুটছিল মানুষটা। মেলে দেওয়া কাপড়, কাঁথা-বালিশ, কড়কড়ে শুঁটকি মাছগুলো সব বৃষ্টিতে ভিজছে। বড় অবেলার বৃষ্টি। চোখের সামনে আচানক ঝাঁ ঝাঁ দুপুরটা একেবারে ভিজে সপসপে হয়ে গেল।

‘কই গ্যালি রে আবাগীর বেটি’ পেছনে ফেলে দুলাল এগিয়ে যায় আর সাত-পাঁচ ভাবে। আবার মাস পাঁচেকের জন্য সংসার ছাড়া, পাখির মতোন মুক্ত জীবন। দুলাল আজকাল মেনেই নিয়েছে সংসারকর্ম তার জন্য নয়। বড় গোলমেলে এ জায়গা। এর চেয়ে সাগরলতা আর বুনো শিমের জমিনই ভালো। তবু সেই মাসচারেকের স্বাধীন জীবন ফেলে তাকে ফিরে আসতে হয় এই দোজখখানায়। তার ওপর যোগ হয় নতুন পিছুটান। কন্যার মুখ, বুকের ভেতর পদ্মপাতার জলের মতো যে টলমল করে যায় দিনরাত।

রাজিয়ার কথাও সে ভাবে। বের হওয়ার মুখে মানুষটার দেখা মেলেনি। মেয়েমানুষের এত তেজ ভালো কিছু নয়। কিন্তু দুলালেরও অপরাধবোধ হয়। কথার পিঠে কথায় একেবারে মাদি কাঁকড়ার মতো কামড়ে ধরলেও ওই তেজ, চোখের আগুন খানিক পরে দুটো মিষ্টি কথাতেই ঠাণ্ডা হয়ে যায়। কেন যে অশান্তির সময় এ কথা তার মনে থাকে না আর পরে এই নিয়ে আফসোসের শেষও থাকে না। বড় হিসেবের জায়গা এ সংসার। কথা বলো হিসাব করে, রাগ বা সোহাগ যা-ই হোক তাতেও হিসাব।

এই ট্রলারের জীবনটাও হিসাবেরই। কত মণ বস্তা, কত পার্সেন্ট বন বিভাগের কর এসব চলছে রাত আর দিন। প্রয়োজনীয় রসদ আর রাতের রান্নার জোগাড়যন্ত্র দেখে দিয়ে গলুইয়ে বসতে বসতে দুলালের তবু মনে হয় এই জলজ সংসারটাই বেশ। হিসাবের ভাগফল না মিললেও কেউ কড়া চাউনি ছুড়ে দেয় না। আর যদি দেয়ও তাতে দুলালের কিছু যায় আসে না। কারণ সে জানে টাকা-পয়সা হলো দুদিনের আমদানি। লোকসান নিয়ে তাই এত হিসাবের কিছু নেই।

স্রোতের সঙ্গে ট্রলারটা চলেছে চমৎকার গতিতে। খুব একটা দেরি হয়নি এখনো। নির্ভার মনে পানির ওপর চোখ রাখে দুলাল। কে যে নাম রেখেছিল কেউ জানে না, কিন্তু সত্যিই বড় সুন্দর এই রূপের গাঙ। শেষ আশ্বিনের দিগন্তরেখায় পাপড়ি মেলা ফুল হলদে রঙের ছটা ছড়াচ্ছে। মমরোজ আর এবাদত রোদের আঁচে বসে আলাপে মশগুল। বিষয়বস্তু সেই একই। এ বছরের ফলন। সরিষা চাষিদের কপাল খুলল বলে। কার্তিক আসে কি আসেনি তাতেই দুপারজুড়ে ভরা ফলন।

একজন হাঁক দেয়—অ বড়ভাই, মুঠা কত?

ওপার থেকে উত্তর ভেসে আসে। প্রতি উত্তরে কিছু একটা বলে মমরোজও।

পাশেই কাঁকড়াবোঝাই নৌকা। ঢেকে রাখা ঝাঁপি, তবু ওরা চেনে সেই লাল, হলুদ, কালো ছোপছোপ নকশা। উত্সুক চোখে তাকায় সবাই। ফেরার পথে নিশ্চিন্তে সদাই চলে। এখন হাতে যা আছে সব পাই পাই হিসাব রাখা চাই। তবু সঙ্গীরা দরদাম করতে ছাড়ে না। বেজায় চড়া না হলে দুয়েক বেলা অন্তত ভালোমন্দ খাওয়া যেতেই পারে জলের বুকে বসবাসের সময়টায়। আজ অবশ্য ওদের রান্নার টান নেই। এই তো দুপুরের আয়োজন চলছে পুরোদমে। বোধ হয় সিঁদুরকৌটা থেকে কেনা পারশে মাছের ঝোল আর আলুভর্তা।

সরষের হলুদ থেকে চোখ ফেরায় দুলাল। খালের বুকে শরীর জুড়ানো হাওয়া। বড় ঘুম পায় তার। ছইয়ের ভেতরে পাটাতনে গামছা পেতে গা এলিয়ে দেয় সে। ঘুম আর জাগরণের বিভ্রমে ডোবে। খালের ঠোঁটার দুপারজুড়ে হলদে সবুজ ডুরে শাড়ি মেলে রেখেছে রাজিয়া। আম্মা বলছে—অ লাতুরির মা, কাপড় তোল। দেখতে একেবারে দু’মাসের কন্যাটির মতোন, ভ্যাবাচেকা খেয়ে উড়ে গিয়ে হেঁতালের আড়ালে বসতেই চাক ভেঙে আকাশে মৌপোকার দল দানা পাকাতে শুরু করে।

ভাটার আগেই নোঙর পরে ওদের। চরের নাম উলুর চর। উলু ঘাসের জাজিম পাতা আছে এইখানে। আর আছে বেগুনি সাগরলতা আর বুনো শিমের অনন্ত ঝোপ, পায়ের তলায় যাদের পেলে দুলালের মনে হয় এই তো বাড়ি ফিরলাম।

বেজায় ব্যস্ত সবাই। পুরোদমে মাছ কেনাবেচা চলছে। টাইগার চিংড়ি, শাপলাপাতা, রুপচাঁদা, কাইন, ছুরি, তোপসে—সবই আছে। একই তালে চলছে মাছ ধোয়া আর বরফ চাপা দিয়ে সংরক্ষণের চেষ্টা। ‘মরা-গোন’ কেবল শুরু, তাই বইশালেরা মাছ ধরবে না এই কদিন। দুদিন পর এ বছরের মতো মাছ ধরার অনুমতিও উঠে যাবে। শুধু সে কারণেও নয়, এ বছর মাছ কম হয়েছে, ফলে দরদাম করতে বেশ হিমশিমই খেতে হয় জেলেদের।

গোনজের আর মমরোজ ডাঙায় নেমে ঘাস পরিষ্কার করতে লেগে গেছে। তারপর উঁচু করে মাচা বাঁধার পালা। বাঁশের তৈরি চালনিগুলোও প্রস্তুত হতে হবে। কাল দুপুরের মধ্যেই মাছগুলো রোদ পোহাবে চালনিতে। এবার মমরোজরা ঠিক করেছে একটা রোদও বাদ দেবে না। যত রোদ তত ভালো শুঁটকি।

চোখের নিমেষে উলু ঘাসের সঙ্গে উজাড় হচ্ছে বুনো শিমের বাড়ন্ত সংসার। মনে হয় ডাকাতরা হামলে পড়ে চরের বুকটাকে খুবলে নিচ্ছে। দুলাল আকাশের ভাবগতিক বোঝার চেষ্টা করে। না, এদিকে মেঘের আনাগোনা নেই। সব ভেসে গেছে পের রূপের গাঙের আরেক পারে। সেদিকটায় হয়তো আরো কয়েক দফা ঝরবে, যেমন আজ ঘর ছাড়া দুপুরে ঝরেছে এক পশলা।

দক্ষিণের জঙ্গলটা কিছুটা অন্য রকম দেখায় এবার। পানির কাছে খসে পড়া বা ভেসে আসা বাদামি ডালপালা চোখে বিভ্রম ধরায়। ওর মনে আছে একটা সময় এদিকটায় কুমিরের খুব আনাগোনা ছিল। চেনাজানার মধ্যে অন্তত জনাতিনেক জোয়ানের জীবন গেছে কুমিরের পেটে। একজন এখনো খুঁড়িয়ে হাঁটে। নিউমার্কেটে সিগারেটের দোকানে বসত হাফিজুল, হাঁটুর পেছন থেকে মাংস খুবলে নিয়েছিল ওর। আট-ন’ফুট লম্বা ছিল সেই কুমির। উপস্থিত বুদ্ধির জোরে প্রাণে বেঁচে ফিরেছে ছেলেটা। মন্দের মধ্যে ভালো হলো ও রকম ধুন্ধুমারের পর বনস্যুদের উৎপাতটা থেমেছে এদিকটায়।

সত্য-মিথ্যা কত গল্প সেসব নিয়ে। ত্রিপলঘেরা পাকঘরটায় গোল হয়ে বসেছে সবাই। সেখানেও ঘুরেফিরে চলেই আসে পুরনো দিনের কথা। গল্পের চেয়ে দ্রুতগতিতে ভাত বাড়ে রতন। সিদ্ধ ভাতের সুঘ্রাণ আর ধোঁয়াচ্ছন্ন কুণ্ডলীতে মুখ ঢেকে যাচ্ছে সবার। হাতে হাতে মেলামাইনের থালা। সে থালায় ট্যালট্যালে ডাল আর কেওড়া-কাইনের ঝোল।

এবাদত দু’পা ছড়িয়ে বসে আছে। ক্ষতটা সারেনি ওর। রতন মুখে মুখে টোটকা বলে দেয়। এসব সে ভালোই জানে। তার এক ভায়রা ভাই মৌয়াল, দুধখালীর পারে বাড়ি তার। গেল বছর মৌ কাটতে গিয়ে সারা শরীরে হুল ফুটিয়ে একেবারে প্রাণ যায় যায় অবস্থা হয়েছিল।

এগিয়ে দেওয়া শিশিটা থেকে কয়েক ফোঁটা মধু নেয় এবাদত। আঙুলের ডগা দিয়ে ক্ষততে লাগায়। এবাদত বিয়ে করেনি এখনো। তাই ইয়ার্কির সুযোগ ছাড়ে না এত দিন পরও।

শালিডারে দেলি না, রতইন্যা! মধু দিয়া কী করতাম আমি?

রতন ফিকফিক হাসে কেবল। তারপর বলে— অত্ত বিরাট মুখ বাদ দিয়া পোকে বড় ভাইয়ের পায়ো কামড়াইলো ক্যা, কেউ আমারে কন তো!

এবাদতও খ্যা-খ্যা করে হাসে এবার।

রাতটা ঝুপ করে শুনসান হয়ে গেছে। শুধু মাচার বাইরে খসখস শব্দগুলো হয়তো সারা রাত চলবে। বুনো শুয়োরের দল ঘুরঘুর করছে। বিকালে একদল বানরও দূর থেকে জরিপ করে গেছে। ওদের আসবার খবরটা জঙ্গলের বাসিন্দাদের মধ্যে জানাজানি হয়ে গেছে।

সারা দিনের দৌড়ঝাঁপের পর শরীরটা একেবারে ছেড়ে দিচ্ছে দুলালের। নানা জায়গায় ব্যথা। রতন কি ব্যথার টোটকা জানে? জিজ্ঞেস করা হয়নি। মাচায় পাতা বিছানায় শুয়ে সঙ্গে আনা ভারী কাঁথাটা শরীরের ভাঁজে ভাঁজে লেপ্টে নেয়। আম্মার দোক্তার গন্ধ মেশা ওম আরামের পরত জমায় শিরায়-উপশিরায়।

চোখ বুজলেই দুলাল দেখতে পায় মাঘ মাসের মধ্যরাত। ভরা গোনে নৌকায় চলেছে ওরা। বইশাল মাঝি জোড়া ইলিশ ধরেছে জালে। নৌকার চেয়ে বড় সেই মাছ। গরম তেলে মাছ ভাজা হতে হতে গানের আসর জমে উঠেছে। ভীষণ দরাজ গলা গাইনের। কিন্তু ‘কেন বান্ধো দালান ঘর, রে মন আমার’ শেষ আর হয় না। গানের মাঝেই মুখটা বেঁকে যেতে থাকে লোকটার। দুলালের পরনে একটা বেঢপ হাফপ্যান্ট। কখন যে ডাঙায় নেমে পড়েছে সে নিজেও জানে না। কেবল উলু ঘাসের জঙ্গলের ভেতর দিয়ে উদ্ভ্রান্তের মতো সে ছুটে চলে। আর সেই ঘাস ক্রমশ তার মাথা ছাড়িয়ে যায়। সাগরলতার লকলকে জিভ গোড়ালি থেকে হাঁটু অবধি পেঁচিয়ে ধরছে তাকে। পেছনে তাকালে সে দেখতে পায় একঝাঁক পতঙ্গ লোকটার নিথর শরীরটাকে শূন্যে ভাসিয়ে নিয়ে চলেছে।

প্রাসঙ্গিক
মন্তব্য

সর্বশেষ সংবাদ