কাজের সুবিধার্থে শিল্পীদের পছন্দ ডিজিটাল ক্যানভাস। প্রায় ৩০ বছর ধরে বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হচ্ছে কম্পিউটার গ্রাফিকস, এখন শৌখিন শিল্পীরাও আঁকাআঁকির জন্য স্কেচবই ফেলে বেছে নিচ্ছেন ট্যাবলেট। ডিজিটাল শিল্পী হিসেবে ক্যারিয়ারও গড়ছেন অনেকে।
ডিজিটাল শিল্পকর্মের আছে বেশ কয়েকটি রকম ফের।
মোটাদাগে একে দুই ধরনে ভাগ করা যায়, টুডি ও থ্রিডি। টুডি আর্টের তুলনায় থ্রিডি কাজ শেখা বেশ কঠিন, শক্তিশালী হার্ডওয়্যারের প্রয়োজনীয়তাও বেশি। মূলত তিন ধরনের আর্ট কাজে লাগিয়ে তৈরি হয় ডিজিটাল কোলাজ, এনিমেশন, কম্পিউটার জেনারেটেড গ্রাফিকস থেকে শুরু করে অনেক ধরনের ভার্চুয়াল শিল্পকর্ম। এর মধ্যে আছে—
ভেক্টর ইলাস্ট্রেশন : সরল জ্যামিতিক আকৃতি ব্যবহার করে চিত্রকর্ম বা পটভূমি তৈরি করাকেই বলা হয় ভেক্টর ইলাস্ট্রেশন বা আর্ট।
বিভিন্ন ধরনের গ্রাফিক ডিজাইন তৈরিতে এর ব্যবহার বেশি, শিল্পকর্ম সৃষ্টিতেও ভেক্টর আর্টের জনপ্রিয়তা বাড়ছে। মার্কেটিং ও বিজ্ঞাপন তৈরিতে ভেক্টর আর্ট বহুল ব্যবহৃত। এখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের জন্য ফটোকার্ড তৈরি এবং ওয়েবসাইট ডিজাইনেও দৃষ্টিনন্দন ভেক্টর আর্ট ব্যবহৃত হয়। ভেক্টর আর্টের একটি বড় সুবিধা, ছবির মান নষ্ট না করেই ইচ্ছামতো ছোট বা বড় করা যায়। ফলে ব্যানার বা পোস্টার তৈরিতে ভেক্টর আর্ট অপরিহার্য। সফটওয়্যার ও ওয়েবসাইটের ইন্টারফেস ও আইকন তৈরিতেও ভেক্টর আর্ট সমাদৃত।
ডিজিটাল পেইন্টিং : রংতুলি আর ক্যানভাসের ডিজিটাল সংস্করণ ব্যবহার করে চিত্রকর্ম তৈরি করেন অনেক শিল্পী। জলরং, তেল বা রেখাচিত্র—সব কিছুই করা যায় ডিজিটালি। ডিজিটাল ক্যানভাসে আঁকার বড় সুবিধা হলো ভুল ঠিক করা সহজ, পাশাপাশি রং বা ক্যানভাস কেনার প্রয়োজনীয়তা নেই।
শিল্পকর্মগুলো সংরক্ষণেও বাড়তি জায়গার দরকার হয় না। ফলে শিল্পীদের মধ্যে ডিজিটাল পেইন্টিংয়ের জনপ্রিয়তা বাড়ছে। ওয়েবসাইট বা অন্যান্য ভার্চুয়াল স্পেস সাজানোর পাশাপাশি অনেক শিল্পী ডিজিটাল পেইন্টিং বা স্কেচের প্রিন্টও বিক্রি করেন। বাস্তব ক্যানভাসে আঁকার দক্ষতা বাড়ানোর জন্যও প্র্যাকটিস করতে এ প্রযুক্তি ব্যবহার করেন কেউ কেউ।
থ্রিডি মডেলিং : থ্রিডি আর্টের প্রথম ধাপ মডেল তৈরি। মডেলের সঙ্গে ভিজ্যুয়াল ইফেক্ট জুড়ে তৈরি হয় সব ধরনের থ্রিডি গ্রাফিকস, সেটা হতে পারে খুব সাধারণ প্রডাক্ট শোকেস থেকে শুরু করে বিলিয়ন ডলার বাজেটের ভিডিও গেম। ভাস্কর্য তৈরি আর থ্রিডি মডেলিংয়ের কার্যপ্রণালী অনেকটা একইরকম। প্রতিটি মডেল শুরু হয় একটি কিউব বা স্ফিয়ার থেকে। এর সঙ্গে নতুন অংশ জোড়া দিয়ে অথবা সেটা টেনে নতুন আকার দিয়ে ধীরে ধীরে তৈরি করা হয় পূর্ণাঙ্গ মডেল। একে বলা হয় মেশ বা কার্ভ মডেলিং। ভেক্টর আর্টের মতো থ্রিডি মডেলও প্রয়োজন অনুযায়ী ছোট-বড় করা যায়। বেশির ভাগ থ্রিডি মডেল তৈরিতে রেফারেন্স ছবি ব্যবহার করেন শিল্পী, তবে এখন থ্রিডি স্ক্যানিং প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে প্রাথমিক একটি মডেল তৈরি করে এরপর সেটি পরিমার্জন করার মাধ্যমে মডেলিং করাই জনপ্রিয় হয়ে উঠছে।
সফটওয়্যার
ওয়েবসেবা ক্যানভা টুডি গ্রাফিকস শিল্পীদের মধ্যে বেশ জনপ্রিয়। বিশেষত সফটওয়্যার ইন্টারফেস, ওয়েবসাইট ডিজাইন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের জন্য ফটোকার্ড তৈরি এবং নানা বিজ্ঞাপন তৈরিতে এটি বহুল ব্যবহৃত। ভেক্টর গ্রাফিকস তৈরির জন্য ইলাস্ট্রেটর ও ইংকস্কেপ, থ্রিডি মডেলিংয়ের জন্য ব্লেন্ডার ও অটোডেস্ক মায়া এবং ডিজিটাল পেইন্টিং করার জন্য আডবি ফটোশপ, ক্রিতা ও প্রোক্রিয়েটের মতো সফটওয়্যার ব্যবহৃত হয়ে থাকে। নির্মাতা প্রতিষ্ঠান অ্যাফিনিটির তৈরি ডিজাইনার, ফটো ও পাবলিশার সফটওয়্যারগুলো ধীরে ধীরে আডবির সফটওয়্যারের বিকল্প হয়ে উঠছে।
হার্ডওয়্যার
ডিজিটাল আর্ট নিয়ে কাজ করার জন্য কিছুটা শক্তিশালী হার্ডওয়্যার প্রয়োজন। টুডি আর্ট করতে চাইলে প্রয়োজন গ্রাফিকস ট্যাবলেট। ডিজিটাল ক্যানভাসে আঁকার জন্য এই হার্ডওয়্যারে আছে টাচপ্যাড ও ডিজিটাল কলম। ডিজিটাল পেইন্টিংয়ের জন্য গ্রাফিকস ট্যাবলেট অপরিহার্য, ভেক্টর ইলাস্ট্রেশন করার জন্যও এটি খুবই কাজের। গ্রাফিকস ট্যাবলেট বাজারে সবচেয়ে প্রতিষ্ঠিত ব্র্যান্ড ওয়াকম, তবে এ প্রতিষ্ঠানের হার্ডওয়্যারের মূল্য প্রায় সাত হাজার টাকা থেকে শুরু। কম বাজেটে কাজ শুরু করতে চাইলে হুইয়নের গ্রাফিকস ট্যাবলেটগুলোও খুবই কাজের, দামও কম, আড়াই হাজার টাকা থেকে শুরু।
প্রতিটি ডিজিটাল আর্ট সফটওয়্যার চালনার জন্য অনেক র্যাম এবং শক্তিশালী প্রসেসর প্রয়োজন। তাই অন্তত ৬ কোরের আধুনিক প্রসেসর এবং ১৬ জিবি র্যাম পিসিতে থাকতে হবে। যারা থ্রিডি মডেলিং নিয়ে কাজ করতে আগ্রহী তাদের পিসিতে আলাদা গ্রাফিকস কার্ডও প্রয়োজন।
আঁকাআঁকির জন্য আইপ্যাড খুবই জনপ্রিয়। উজ্জ্বল ও কালার অ্যাকুরেট ডিসপ্লে, নিখুঁত ডিজিটাল পেন এবং শক্তিশালী হার্ডওয়্যারের পাশাপাশি আডবি ও অ্যাফিনিটি দুই প্রতিষ্ঠানের পুরো সফটওয়্যার স্যুট এবং প্রোক্রিয়েটের মতো চমৎকার সফটওয়্যারের কারণেই জনপ্রিয় আইপ্যাড ও অ্যাপল পেনসিল।
আর্ট তুলে ধরার উপায়
ডিজিটাল শিল্পকর্ম তুলে ধরার জন্য পোর্টফোলিও তৈরি করা জরুরি। ওয়েবসাইট ডিজাইন বা বিজ্ঞাপনের জন্য ভেক্টর ইলাস্ট্রেশনের পোর্টফোলিও তৈরিতে জনপ্রিয় প্ল্যাটফর্ম বিহান্স। নিজস্ব ওয়েবসাইট তৈরি করেও কাজের শোকেস তৈরি করা যেতে পারে। ডিজিটাল পেইন্টিংয়ের জন্য বিহান্সের পাশাপাশি আর্টস্টেশনও জনপ্রিয়। যারা শুধু নির্দিষ্ট কাজের জন্য নয়, বরং নিজের শৈল্পিকতা তুলে ধরতে চায় তাদের জন্য আর্টস্টেশন আদর্শ। থ্রিডি মডেলিংয়ের জন্য পোর্টফোলিও তৈরি একটু জটিল। মডেলের রেন্ডার করা ছবি বিহান্স বা আর্টস্টেশনে আপলোড করার পাশাপাশি মডেল তৈরি এবং তার শোকেসের ওপর তৈরি ছোট ভিডিও ইউটিউবে আপলোড করা উচিত। অনেক থ্রিডি আর্টিস্ট কার্বনমেড ওয়েবসাইটটিতে মডেল আপলোড করেন। পোর্টফোলিও তৈরির পর অবশ্যই তা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করা উচিত। পিন্টারেস্ট বা রেডিটের মতো ফোরামেও আপলোড করে অনেকে।
কাজের ধরন
বিজ্ঞাপন সংস্থা, পণ্য প্রস্তুতকারী ও সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান, প্রকাশনী থেকে শুরু করে গণমাধ্যম—প্রতিটি প্রতিষ্ঠানেই আছে ডিজিটাল আর্টিস্টের প্রয়োজনীয়তা। বিভিন্ন ফ্রিল্যান্স কাজের প্ল্যাটফর্মেও ডিজিটাল আর্টিস্টদের জন্য কাজের অভাব নেই। সব ক্ষেত্রেই পোর্টফোলিও তৈরি সবচেয়ে জরুরি। ভেক্টর ইলাস্ট্রেশনের কাজ অপেক্ষাকৃত সহজ, ব্যবহারের ক্ষেত্রও অনেক।
ইউজার ইন্টারফেস ডিজাইনারদের কদর প্রতিনিয়ত বাড়ছে, ওয়েবসাইটের জন্য থিম তৈরিতেও ভেক্টর ইলাস্ট্রেশন প্রয়োজন। থ্রিডি মডেল ব্যবহার করে ভিজ্যুয়াল ইফেক্টস এবং ভিডিও গেম তৈরিত হয়। তবে এ ধরনের কাজের সুযোগ কিছুটা কম। বেশির ভাগ সময় থ্রিডি মডেল তৈরির জন্য খণ্ডকালীন নিয়োগ দেওয়া হয়, অর্থাৎ ফ্রিল্যান্স প্ল্যাটফর্মেই কাজ পাওয়া যাবে বেশি। ডিজিটাল পেইন্টিংয়ের বিক্রি অথবা পেইন্টিংয়ের জন্য কমিশন খুঁজে পাওয়ার সেরা মাধ্যমও অনলাইন ফ্রিল্যান্স প্ল্যাটফর্ম। ডিজিটাল আর্ট বিক্রির জন্য বেশ কিছু অনলাইন প্ল্যাটফর্ম আছে। সেখানে পোর্টফোলিওর সব ডিজাইন আপলোড করলে ক্রেতারা যেকোনো সময় কিনতে পারবে। তবে বেশির ভাগ শিল্পী একে উপরি রোজগারের পথ হিসেবে ব্যবহার করেন।