ফুটবল খেলা নিয়ে বিরোধের জেরে এক দশক আগে ঢাকার সরকারি ল্যাবরেটরি স্কুলের ছাত্র আয়াজ হক হত্যা মামলার আসামি ইনজামামুন ইসলাম ওরফে জিসানকে হেফাজতে নিয়ে নির্যাতনের ব্যাখ্যা জানতে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা সাহিদুল বিশ্বাসকে তলব করেছেন হাইকোর্ট।
আগামী ৯ ফেব্রুয়ারি সকাল সাড়ে ১০টায় তাঁকে আদালতে সশরীরে হাজির হতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তদন্তকারী সাহিদুল ইসলাম সে সময় রাজধানীর ধানমন্ডি থানায় ছিলেন। তাঁর পদবি ছিল উপপরিদর্শক (এসআই)।
চার বছর আগে বিচারিক আদালতের রায়ে আমৃত্যু সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া আসামি ইনজামামুন ইসলাম ওরফে জিসানকে হেফাজতে নিয়ে নির্মম নির্যাতনের অভিযোগ রয়েছে এই পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে।
আয়াজ হত্যা মামলার আপিল শুনানিতে তা উঠে আসলে রবিবার (২ ফেব্রুয়ারি) বিচারপতি মোস্তফা জামান ইসলাম ও বিচারপতি নাসরিন আক্তারের হাইকোর্ট বেঞ্চ তলবের আদেশ দেন।
আদালতের আদেশের বিষয়টি জানান আসামির পক্ষের আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘২০১৪ সালে জিসানকে দুইবার রিমান্ডে নিয়ে পুলিশ তার স্বীকারোক্তি আদায় করে।
নির্যাতনের পর জিসানের পায়ে পচন ধরে যায়। তখন তাকে ঢাকা মেডিকেল হাসপাতালের বার্ন এন্ড প্লাস্টিক সার্জারি বিভাগ ভর্তি করাতে হয়। সে সময় টানা ১৫ দিন চিকিৎসা নিতে হয়েছিল। চিকিৎসার পরও জিসান স্বভাবিক জীবন হারিয়ে ফেলে। এখন পর্যন্ত তার এক পা অনুভূতিহীন। এ বিষয়টি আদালতের সামনে তুলে ধরেছি, রেকর্ড থেকে দেখিয়েছি। এরপর আদালত তদন্তকারী কর্মকর্তা সাহিদুল বিশ্বাসকে তলব করে তার এমন আচরণের ব্যাখ্যা জানতে চেয়েছেন।’
২০১৪ সালের ১৩ জুলাই ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন জিসানকে দেখতে গিয়ে জাতীয় মানবধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান সাংবাদিকদের বলেছিলেন জিসানের প্রতি অমানবিক আচরণ করা হয়েছে। পুলিশ হেফাজতে এ ধরনের নির্যাতন মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন।
জিসানকে যারা নির্যাতন করেছেন, তাদের শনাক্ত করে শাস্তির আওতায় আনা উচিত।
সেই সময় একটি ইংরেজি দৈনিকে প্রকাশিত প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে শিশির মনির বলেন, ‘১০ লাখ টাকা ঘুষের বিনিময়ে এসআই সাহিদুল বিশ্বাস ১৫ বছর ৯ মাসের শিশু জিসানকে রিমান্ডে নিয়ে নির্মম নির্যাতন করে। তাকে প্রায় পঙ্গু করে ফেলা হয়। এখন পর্যন্ত হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাকে চিকিৎসা দিয়ে যাচ্ছে।’
আরেক প্রশ্নে এই আইনজীবী বলেন, ‘এসআই সাহিদুল বিশ্বাস বর্তমানে কোথায় আছেন, কোন পদে আছেন, তা আমরা জানি না। তবে রেকর্ডে তার ঠিকানা আছে। সে ঠিকানায় নোটিশ পাঠানো হবে। এই পুলিশ কর্মকর্তার হাজির নিশ্চিত করতে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছেও এ বিষয়ে চিঠি যাবে কোর্ট থেকে।’
তিনি বলেন, ‘আদালতকে এটিও বলবো যে, সাহিদুল বিশ্বাসের বিরুদ্ধে হেফাজতে নির্যাতন এবং মৃত্যু আইনে যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া হয়। কারণ এই মামলার ভুক্তোভোগী পক্ষ উচ্চ পর্যায়ের আরেকজন পুলিশ কর্মকর্তাকে ব্যবহার করে এই কাজ করিয়েছেন। শুধু তাই না, বিচারিক কর্মকাণ্ডেও তিনি বাধাগ্রস্ত করেছিলেন তখন। আমার বিশ্বাস, আগামী ৯ ফেব্রুয়ারি সব তথ্য বের হয়ে আসবে। কেন তিনি (সাহিদুল বিশ্বাস) নির্যাতনের আশ্রয় নিয়ছিলেন। কে তাকে নির্দেশ দিয়েছিল। আমরা সেই ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তার নামও তুলে আনতে চাই। এই মামলায় শুধুমাত্র প্রশাসনিক প্রক্রিয়াকেই ব্যবহার করা হয়নি, বিচারিক প্রক্রিয়াকেও অত্যন্ত উচ্চ মহলের হস্তক্ষেপে বিচার নির্ধারণ করার চেষ্টা করা হয়েছে।’
মামলার বিবরণে জানা যায়, ২০১৪ সালের ৯ জুন ঢাকা সিটি কলেজের প্রীতি ফুটবল টুর্নামেন্টের প্রস্তুতি ও খরচ বাবদ টাকা তোলা নিয়ে আয়াজের বড় ভাই ওই কলেজের বিজ্ঞান বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র আশদিন হকের সঙ্গে আসামিদের কথাকাটাকাটি ও ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া হয়।ওইদিন বিকালে জিগাতলা যাত্রী ছাউনির কাছে আয়াজকে একা পেয়ে এলোপাতাড়ি পিটিয়ে মারাত্মক জখম করে আসামিরা। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
এই ঘটনায় আয়াজের বাবা সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শহীদুল হক ধানমণ্ডি থানায় মামলা করেন। তদন্ত শেষে ২০১৫ সালের ১৩ মে ধানমণ্ডি থানার এসআই সাহিদুল বিশ্বাস আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন। পরের বছর ২৪ নভেম্বর ছয় আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন বিচারক। বিচার শেষে ২০২০ সালের ১০ ডিসেম্বর ঢাকার ৫ নম্বর বিশেষ জজ আদালতের বিচারক ইকবাল হোসেন রায় ঘোষণা করেন।
রায়ে আসামিদের মধ্যে ইনজামামুন ইসলাম ওরফে জিসানকে আমৃত্যু সশ্রম কারাদণ্ডের পাশাপাশি ১০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড দেওয়া হয়। আর তৌহিদুল ইসলাম, মশিউর রহমান আরাফ, তৌহিদুল ইসলাম শুভ, আবু সালেহ মো. নাসিম ও আরিফ হোসেন রিগ্যানকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের পাশাপাশি ১০ হাজার টাকা করে জরিমানা, অনাদায়ে আরও ৩ মাসের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। পরে এ রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আপিল করে জিসান এবং তৌহিদুল ইসলাম শুভ। দণ্ডিতদের মধ্যে জিসান কারাগারে, শুভ জামিনে আর অন্য আসামিরা পলাতক বলে জানান আইনজীবী শিশির মনির।