শরিয়তের দ্বিতীয় প্রধান উৎস সুন্নাহ বা হাদিস। হাদিস পবিত্র কোরআনের ব্যাখ্যাস্বরূপ। কোরআনের বিধি-বিধানগুলোর রূপরেখাও তুল ধরা হয়েছে হাদিসের মাধ্যমে। তাই হাদিস ছাড়া পরিপূর্ণভাবে দ্বিন পালন করা সম্ভব নয়।
শরিয়তের দ্বিতীয় প্রধান উৎস সুন্নাহ বা হাদিস। হাদিস পবিত্র কোরআনের ব্যাখ্যাস্বরূপ। কোরআনের বিধি-বিধানগুলোর রূপরেখাও তুল ধরা হয়েছে হাদিসের মাধ্যমে। তাই হাদিস ছাড়া পরিপূর্ণভাবে দ্বিন পালন করা সম্ভব নয়।
হাদিস আল্লাহর অনুগ্রহ
পবিত্র কোরআনের মতো হাদিসও সমগ্র মানবজাতির জন্য মহান আল্লাহর অনুগ্রহ। আল্লাহ তাআলা এই অনুগ্রহের প্রতি ইঙ্গিত করে বলেন, ‘তিনিই উম্মিদের (নিরক্ষরদের) মধ্যে একজন রাসুল পাঠিয়েছেন তাদের মধ্যে থেকে, যে তাদের কাছে আবৃত্তি করে তার আয়াতগুলো, তাদেরকে পবিত্র করে এবং শিক্ষা দেয় কিতাব ও হিকমত; ইতিপূর্বে তারা ছিল ঘোর বিভ্রান্তিতে।
হাদিস কেন মুখস্থ করবে?
সুন্নাহ বা হাদিস মুসলিম উম্মাহর প্রতি মহানবী (সা.)-এর পবিত্র আমানত। মুসলমান হাদিস মুখস্থ করবে তা সংরক্ষণের জন্য এবং পরবর্তী উম্মতের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য।
অন্য হাদিসে রাসুলুল্লাহ (সা.) আরো স্পষ্ট করেছেন। আবদুল্লাহ ইবনু আব্বাস (রা.) বলেন, ‘রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা ভালোভাবে জ্ঞানের কথা শুনে রেখো। কেননা লোকেরা তোমাদের কাছ থেকে তা শুনবে। অতঃপর তোমাদের কাছ থেকে যারা শুনবে, তাদের কাছ থেকেও পরবর্তীরা শুনবে।
হাদিস মুখস্থ করার পুরস্কার
মহানবী (সা.) হাদিস মুখস্থ করার একাধিক পুরস্কার ঘোষণা করেছেন। যার কয়েকটি হলো—
১. চেহারা উজ্জ্বল হবে : যে ব্যক্তি হাদিস মুখস্থ করবে এবং তা অন্যের কাছে পৌঁছে দেবে, আল্লাহ তাঁর চেহারা উজ্জ্বল করবেন। জায়েদ বিন সাবিত (রা.) বলেন, ‘আমি রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে বলতে শুনেছি, যে ব্যক্তি আমার কাছ থেকে হাদিস শুনে তা মুখস্থ রাখল এবং অন্যের নিকটও তা পৌঁছে দিল, আল্লাহ তাকে চির উজ্জ্বল করে রাখবেন। জ্ঞানের অনেক বাহক তার চেয়ে অধিক সমঝদার লোকের কাছে তা বহন করে নিয়ে যায়; যদিও জ্ঞানের বহু বাহক নিজেরা জ্ঞানী নয়।’ (সুনানু আবি দাউদ, হাদিস : ৩৬৬০)
২. শাফায়াত লাভ : যে ব্যক্তি হাদিস মুখস্থ করবে, তা চর্চা করবে এবং সে অনুযায়ী আমল করবে, কিয়ামতের দিন রাসুলুল্লাহ (সা.) তাঁর জন্য সুপারিশ করবেন। তিনি বলেন, ‘আমার উম্মতের ভেতর যে দ্বিনি বিষয়ে ৪০টি হাদিস মুখস্থ করবে কিয়ামতের দিন আল্লাহ তাকে ফকিহ হিসেবে ওঠাবেন। আমি কিয়ামতের দিন তার জন্য সুপারিশকারী ও সাক্ষী হবো।’ (শুআবুল ঈসান : ২/৭৪২)
৩. আলেমের মর্যাদা লাভ : হাদিস মুখস্থকারী পরকালে আলেম ও ফকিহের মর্যাদা লাভ করবে। মহানবী (সা.) বলেন, ‘আমার উম্মতের যে ব্যক্তি দ্বিনি বিষয়ে ৪০টি হাদিস মুখস্থ করবে, কিয়ামতের দিন আল্লাহ তাকে ফকিহ আলেম হিসেবে ওঠাবেন।’ (সহিহ ইবনে হিব্বান : ১/১৬২)
৪. মৌলিক জ্ঞান লাভ : রাসুলুল্লাহ (সা.) হাদিসকে ইসলামের মৌলিক জ্ঞান হিসেবে উল্লেখ করেছেন। আবদুল্লাহ ইবনু আমর ইবনুল আস (রা.) থেকে বর্ণিত, মহানবী (সা.) বলেন, ‘(মৌলিক ইসলামী) জ্ঞান তিন প্রকার। এগুলো ছাড়া যা আছে তা অতিরিক্ত। ক. মুহকাম আয়াতগুলো, ২. প্রতিষ্ঠিত হাদিস, ৩ ন্যায্যভাবে সম্পত্তি বণ্টনের জ্ঞান।’ (সুনানু আবি দাউদ, হাদিস : ২৮৮৫)
সাহাবিরা হাদিস মুখস্থ করতেন : মহানবী (সা.)-এর সাহাবিরা হাদিস মুখস্থ করতেন। তাঁরা লিখে রাখার চেয়ে তা মুখস্থ করতেই বেশি পছন্দ করতেন। আবু বুরদা (রহ.) বলেন, ‘আবু মুসা আশআরি (রা.) আমাদের কাছে হাদিস বর্ণনা করতেন। আমরা তা লিখে রাখতে চাইলাম। তিনি বললেন, তোমরা আমার কাছ থেকে যা শুনেছ তা কি লেখো? আমরা বললাম, হ্যাঁ। তিনি বললেন, আমাদের কাছে তা নিয়ে এসো। এরপর তিনি আনতে বললেন এবং তা ধুয়ে ফেললেন। তিনি বললেন, আমাদের থেকে মুখস্থ করো যেমন আমরা মুখস্থ করেছি।’ (হুজ্জিয়াতুল হাদিস, পৃষ্ঠা-৩৯৭)
আল্লাহ সবাইকে হাদিসের মর্যাদা ও গুরুত্ব অনুধাবন করার তাওফিক দিন। আমিন।
সম্পর্কিত খবর
সালাম শান্তির প্রতীক। মুমিনের পাপমোচন ও সওয়াব লাভের মাধ্যম। মিরাজের রজনীতে মহান আল্লাহ রাসুল (সা.)-কে যেসব বস্তু বা বিষয় উপহার দিয়েছেন, এর মধ্যে সালাম অন্যতম। তিনি বলেছেন, ‘আসসালামু আলাইকা আইয়্যুহান্নাবিয়্যু ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহু’।
সালামের মাধ্যমে শান্তির বার্তা দিয়ে অপর ভাইকে অভিবাদন জানানো জান্নাতিদের কাজ। ইসলাম ধর্মে এর গুরুত্ব অপরিসীম। প্রিয় নবী (সা.) এই কাজটিকে ইসলামের শ্রেষ্ঠ কাজ বলে আখ্যায়িত করেছেন। মুমিনরা জান্নাতে যাওয়ার সময় ফেরেশতারা তাদের সালামের মাধ্যমে অভিবাদন জানাবেন।
এরপর জান্নাতেও সালামের প্রচলন থাকবে। “সেখানে তাদের অভিবাদন হবে ‘সালাম’।” (সুরা : ইউনুস, আয়াত : ১০)
এরপর জান্নাতে স্বয়ং রাব্বুল আলামিন জান্নাতিদের সালাম দেবেন।
সালাম এক মুসলমানের সঙ্গে অপর মুসলমানের সদ্ব্যবহারের অন্যতম মাধ্যম। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, এক মুসলমানের সঙ্গে অপর মুসলমানের ছয়টি সদ্ব্যবহারের বিষয় রয়েছে : তার মধ্যে অন্যতম হলো, কারো সঙ্গে দেখা হলে তাকে সালাম করবে। (তিরমিজি, হাদিস : ২৭৩৬)
আমাদের সমাজে সালামের প্রচলন থাকলেও আমরা অনেক সময় অপরিচিত ব্যক্তিদের সালাম দিই না। কিংবা পরিচিতদের মধ্যে নির্দিষ্ট কিছু লোকের বাইরে অন্যদের সালাম দিই না।
তিনি বলেন, আল্লাহ তাআলা সত্য বলেছেন এবং তাঁর রাসুল (সা.) পূর্ণরূপে পৌঁছে দিয়েছেন। আমরা নামাজ শেষ করলে তিনি ফিরে গিয়ে তাঁর অন্দরমহলে চলে গেলেন এবং আমরা তাঁর (ফিরে আসার) অপেক্ষায় স্বস্থানে বসে থাকলাম। শেষে তিনি বের হয়ে এলেন। আমাদের কতক কতককে বলল, তোমাদের কে তাঁকে জিজ্ঞেস করবে? তারিক (রহ.) বলেন, আমি তাঁকে জিজ্ঞেস করব। অতএব, তিনি জিজ্ঞেস করলে আবদুল্লাহ (রা.) বলেন, মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘কিয়ামতের নিকটবর্তী কালে লোক বিশেষকে নির্দিষ্ট করে সালাম দেওয়ার প্রচলন হবে এবং ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটবে, ফলে স্বামীর ব্যবসায়ে স্ত্রীও সহযোগিতা করবে। রক্ত সম্পর্কীয় আত্মীয়তা ছিন্ন করা হবে। জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রসার ঘটবে, মিথ্যা সাক্ষ্যদানের প্রচলন হবে এবং সত্য সাক্ষ্য গোপন করা হবে।’ (আদাবুল মুফরাদ, হাদিস : ১০৫৯)
অন্য হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, ইবনে মাসউদ (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) বলেছেন, কিয়ামতের আলামতগুলোর একটি হলো, মানুষ কেবল পরিচিত মানুষদেরই সালাম করবে।
(মুসনদে আহমদ, হাদিস : ৩৮৪৮)
অথচ নবীজি (সা.) তাঁর উম্মতদের পরিচিত-অপরিচিত সবাইকে সালাম দিতে উদ্বুদ্ধ করেছেন। হাদিস শরিফে ইরশাদ হয়েছে, আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা.) থেকে বর্ণিত, এক ব্যক্তি রাসুল (সা.)-কে প্রশ্ন করল যে কোন ইসলাম উত্তম? রাসুল (সা.) বলেন, তুমি লোকদের পানাহার করাবে এবং পরিচিত-অপরিচিত সবাইকে সালাম করবে। (মুসলিম, হাদিস : ৬৫)
এমনকি কারো সঙ্গে দেখা হলে তার সালাম পাওয়ার অপেক্ষা না করে আগে সালাম দেওয়ার মধ্যে বিশেষ ফজিলত রয়েছে।
হজরত আবু উমামাহ (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, মানুষের মধ্যে আল্লাহর কাছে সর্বাধিক উত্তম ওই ব্যক্তি, যে আগে সালাম দেয়। (আবু দাউদ, হাদিস : ৫১৯৭)
অর্থাৎ যে আগে সালাম দেবে সে আল্লাহর কাছে বেশি প্রিয় হবে। সে হিসেবে আমাদের সবারই উচিত কারো সঙ্গে দেখা হলে আগে সালাম দেওয়ার চেষ্টা করা। তদুপরি আমাদের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে যে কার আগে সালাম দেওয়া উচিত। সে ব্যাপারে দিকনির্দেশনা দিয়ে গেছেন প্রিয় নবী (সা.)। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, বয়ঃকনিষ্ঠ বয়োজ্যেষ্ঠকে, পদচারী উপবিষ্টকে এবং অল্পসংখ্যক অধিকসংখ্যককে সালাম দেবে। (বুখারি, হাদিস : ৬২৩১)
উপরোক্ত হাদিসে প্রিয় নবী (সা.) তিন শ্রেণির মানুষের সালামের আদব শিক্ষা দিয়েছেন। বয়ঃকনিষ্ঠরা বয়োজ্যেষ্ঠদের অর্থাৎ ছোটরা বড়দের। হাদিসের ভাষ্য অনুযায়ী বোঝা যায়, বয়সে ছোটদের উচিত বয়সে বড়দের আগে সালাম দেওয়া। কিন্তু বড়রাও চাইলে ছোটদের আগে সালাম করতে পারেন। কেননা সালাম আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের মাধ্যম। সুতরাং যে আগে সালাম দেবে, সে-ই আল্লাহর বেশি নিকটবর্তী হবে।
বহুল প্রচলিত প্রবচন :
‘অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে
তব ঘৃণা যেন তারে তৃণসম দহে।’
অর্থাৎ অন্যায়কারী ও অন্যায়ের সাহায্যকারী সমদোষী, ঘৃণিত। নিঃসন্দেহে অন্যায়কারী অপরাধী। কিন্তু আড়ালে-কৌশলে অন্যায়কারীকে সমর্থন ও সহায়তা আইনের চোখে অপরাধ না হলেও এখানে বিবেকের দায়মুক্তি নেই।
জীবিকার্জনের নিষিদ্ধ পদ্ধতি : ‘দুর্নীতি’। দুর্নীতি হলো পাপ-পতনের মাধ্যম এবং জাহান্নামে যাওয়ার কারণ হিসেবে যথেষ্ট। অথচ মানুষের দুরন্ত বাসনার সর্বগ্রাসী জিহ্বা শান্তির পৃথিবীতে কখনো বা অশান্তির জ্বলন্ত শিখায় ফুঁক দেয়।
রাষ্ট্রীয়, প্রাতিষ্ঠানিক, ব্যক্তিক অর্থসম্পদ আত্মসাৎ অন্যায়, অমার্জনীয় ও দণ্ডণীয় অপরাধ। ছলে-বলে, কৌশলে মালিকের অজ্ঞাতে অথবা ইচ্ছার বিরুদ্ধে দ্রব্য বা সেবা গ্রহণ, ব্যবহার, বিক্রয়, লোপাট, কুক্ষিগত বা বেদখল, লুটপাট ইত্যাদি ছ্যাঁচড়/ছিঁচকে, দুর্নীতি ও বাটপারির পর্যায়ভুক্ত। মহান আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা অন্যের সম্পদ অন্যায়ভাবে গ্রাস করো না।
প্রিয় নবী (সা.) সতর্ক করে বলেন, ‘যে দেহ হারামে গঠিত-পরিপুষ্ট তা জান্নাতে প্রবেশ করবে না, বরং জাহান্নামই তার উপযুক্ত ঠিকানা।’ (বাইহাকি)
অপরাধ দমনে ইসলামের অবস্থান অত্যন্ত কঠোর ও নিরপেক্ষ; পবিত্র কোরআনের বিঘোষিত নীতি ‘আল্লাহর বিধান কার্যকরণে তাদের প্রতি দয়া যেন তোমাদেরকে প্রভাবান্বিত না করে, তোমরা যদি আল্লাহ এবং পরকালে বিশ্বাসী হও।’
(সুরা : নুর, আয়াত : ২)
বর্ণিত আছে, বনু মাখযুমের এক মহিলা চুরি করেছিল। এ প্রসঙ্গেই প্রিয় নবী (সা.) বলেন, ‘নিশ্চয়ই তোমাদের পূর্বেকার লোকদের নীতিও ছিল যে যখন কোনো সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি চুরি করত, তখন তারা তাকে ছেড়ে দিত... আল্লাহর কসম! যদি মুহাম্মদের (সা.) কন্যা ফাতিমাও চুরি করে, তাহলে আমি অবশ্যই তার হাত কেটে দেব।’ (বুখারি)
ইসলামী অনুশাসনে অন্যায়ের পক্ষাবলম্বনের সুযোগ নেই।
প্রিয় নবী (সা.) বলেন, ‘তোমাদের মধ্যে যে কেউ কোনো অন্যায় হতে দেখলে যেন হাত দিয়ে প্রতিহত করে। যদি তা না পারে, তবে কথা দিয়ে; তা-ও না পারলে অন্তর দিয়ে (ঘৃণা করবে)। এটি ঈমানের দুর্বলতম স্তর।’ (মুসলিম)
আরেক হাদিসে প্রিয় নবী (সা.) বলেন, ‘যার হাতে আমার জীবন তাঁর শপথ করে বলছি, ‘তোমরা অবশ্যই ভালো কাজে মানুষকে আদেশ দেবে এবং অবশ্যই অন্যায় থেকে নিষেধ করবে। যদি তা না করো তাহলে আল্লাহ তোমাদের ওপর তাঁর পক্ষ থেকে শাস্তি পাঠাবেন। এরপর তোমরা তাঁর নিকট প্রার্থনা করলেও তিনি কবুল করবেন না।’ (তিরমিজি)
ন্যায়পরায়ণতা মহান আল্লাহর অনন্য গুণ; তিনিই ন্যায়বান বিচারকের সাহায্যকারী। প্রিয় নবী (স.) বলেন, ‘আল্লাহ ততক্ষণ পর্যন্ত বিচারকের সঙ্গে থাকেন, যতক্ষণ সে জুলুম না করে ন্যায়ের ওপর অটল থাকে। কিন্তু যখনই সে অন্যায় করে, তখন আল্লাহ তার থেকে মুক্ত হয়ে যান। তখন শয়তান তাকে ধরে ফেলে। তার সঙ্গী ও পরামর্শক হয়ে যায়।’ (তিরমিজি)
বিচারকাজে ন্যায়ের পক্ষাবলম্বন প্রিয় নবীর (সা.) আদর্শ। বিচারক তিন শ্রেণির এবং তাদের পরিণতি সম্পর্কে তিনি (সা.) বলেন, ‘বিচারক তিন শ্রেণির। তন্মধ্যে দুই শ্রেণি জাহান্নামি আর এক শ্রেণি জান্নাতি। যে বিচারক মানুষের অধিকার বুঝে সে অনুযায়ী বিচারকাজ করবে সে জান্নাতি। আর যে বিচারক মানুষের অধিকার বুঝেছে, কিন্তু তা অনুযায়ী বিচারকাজ করেনি এবং যে বিচারক মানুষের অধিকার না বুঝে মূর্খতাবশত বিচারকাজ করবে, তারা উভয়ে জাহান্নামি।’ (মুসান্নাফে আব্দুর রাজ্জাক)
কাজেই অপরাধীকে অন্যায়-অন্যায্য সহায়তা এবং বিচারকাজে মানবিকতার দোহাই দিয়ে যারা উৎকাচ গ্রহণ করে, তাদের জন্য সতর্কবার্তা ‘ঘুষদাতা ও গ্রহীতার প্রতি প্রিয় নবী (সা.) অভিসম্পাত করেছেন।’ (আহমাদ)
প্রিয় নবী (সা.) আরো বলেন, ‘ঘুষদাতা ও গ্রহীতা উভয়েই জাহান্নামি।’
মহান আল্লাহ আমাদের সবার সঠিক উপলব্ধি দান করুন। আমিন।
লেখক : সহকারী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান ইসলামিক স্টাডিজ, কাপাসিয়া ডিগ্রি কলেজ, কাপাসিয়া, গাজীপুর-১৭৩০
মহান স্রষ্টা যেভাবে মানুষকে সৃষ্টিজগতে কাজকর্মে সবচেয়ে সক্ষমতা দান করেছেন, তাদের শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন, তেমনি তিনি তাদেরকে অসংখ্য অগণিত নিয়ামত দান করেছেন। মানুষের প্রতি আল্লাহর সবচেয়ে বড় অনুগ্রহ হলো তিনি তাদের জ্ঞান-বুদ্ধি দান করেছেন। এই জ্ঞান-বুদ্ধির সাহায্যে মানুষ মানবসভ্যতার সূচনা থেকে আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের যুগ পর্যন্ত অসামান্য সব কর্মযজ্ঞ সম্পন্ন করেছে, সে নিজের চেয়ে শক্তিশালী প্রাণীকে অধীন করে তার দ্বারা উপকৃত হয়েছে। যুগে যুগে নিত্যনতুন আবিষ্কার ও উন্নয়নেও জ্ঞান-বুদ্ধি প্রধান অবলম্বন।
জ্ঞান, বুদ্ধি ও বিবেকই মানুষকে অন্যান্য সৃষ্টির ওপর শ্রেষ্ঠত্ব এবং তাকে নিয়ন্ত্রকের ভূমিকা দান করেছে। মানব ইতিহাস ও মানবসভ্যতার ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়—প্রত্যেক পরবর্তী প্রজন্ম পূর্ববর্তীদের দৃষ্টিভঙ্গি ও যুক্তি-দর্শন পেছনে ফেলে জ্ঞান-বিজ্ঞান, আবিষ্কার ও উদ্ভাবনের ময়দানে এগিয়ে গেছে। তারা মানবজীবনের জন্য প্রয়োজনীয় নতুন নতুন উপকরণ তৈরি করেছে, যা মানুষের জীবনকে সহজ করেছে। যে সময় থেকে মানবজাতির ইতিহাস সংরক্ষিত তখন থেকে আজ পর্যন্ত এই অগ্রযাত্রা কখনো থেমে যায়নি।
প্রতিটি সকাল নতুন আবিষ্কারের সাক্ষী হয়েছে এবং পেছনের অনুসন্ধান, বিশ্লেষণ ও জ্ঞানগত জিজ্ঞাসা ভুল প্রমাণিত হয়েছে। এই বাস্তবতা এক অনস্বীকার্য সত্যকে সামনে নিয়ে আসে তাহলো মানবীয় জ্ঞান-বুদ্ধির পরিবর্তন ভুল ও বিভ্রান্তির আশঙ্কা রাখে। মানবসভ্যতার হাজার বছরের ইতিহাস প্রমাণ করে মানবীয় জ্ঞান-বুদ্ধি সব উন্নতির পরও কোনো মানবীয় সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত ও সুস্থির বলা যায় না, বরং মানবীয় জ্ঞান-বুদ্ধি ও চিন্তা ক্রমাগত পরিবর্তনের ভেতর দিয়ে চলতে থাকে। আজকের বাস্তবতা আগামী দিনের মিথ্যায় পরিণত হয়।
এ জন্য মানবীয় জ্ঞান-বিজ্ঞানী পরবর্তী দক্ষ ব্যক্তি তার পূর্ববর্তীদের সিদ্ধান্তকে ভুল আখ্যা দেন এবং নিজের অনুসন্ধান ও সিদ্ধান্তকে চূড়ান্ত বলে ঘোষণা দেন। আবার আজকের বিজ্ঞানীরা যেখানে পৌঁছেছেন আগামী দিনের বিজ্ঞানীরা তাকে ভুল প্রমাণ করতে পারেন।
বিপরীতে মানবতার বন্ধু, মনুষ্যত্ব পছন্দকারী, মানুষের কল্যাণে উদগ্রীব ব্যক্তিদের জ্ঞান হলো চিরন্তন। মানবতার কল্যাণে নিবেদিত এসব মানুষকে বলা হয় নবী-রাসুল। তাঁদের জ্ঞান মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে ওহির মাধ্যমে প্রদত্ত।
তাঁদের জ্ঞান চিরন্তন হওয়ায় পরবর্তী নবী-রাসুলরা পূর্ববর্তীদের জ্ঞানকে ভুল বলেননি, বরং তাঁরা পূর্ববর্তীদের সত্যায়ন করেছেন। চাই পরবর্তী ও পূর্ববর্তীদের ভেতর কয়েক শতাব্দীর পার্থক্য হোক না কেন; এমনকি উভয় নবী ও রাসুলের ভেতর জাতিগত ও ভৌগোলিক কোনো সাদৃশ্য না থাকলেও। এর দ্বারা প্রমাণিত হয় নবীদের নিয়ে আসা জ্ঞানগুলোয় ভুলের কোনো আশঙ্কা নেই এবং তা কল্পনাও করা যায় না। কেননা তাঁদের জ্ঞানের উৎস মহাবিশ্বের মহান স্রষ্টা। যিনি স্রষ্টা, তিনি তাঁর সৃষ্টি সম্পর্কে অজ্ঞাত হতে পারেন না। ইরশাদ হয়েছে, ‘যিনি সৃষ্টি করেছেন, তিনি কি জানেন না? তিনি সূক্ষ্মদর্শী, সম্যক অবগত।’ (সুরা : মুলক, আয়াত : ১৪)
নবী-রাসুল (আ.) বিভিন্ন যুগে ভিন্ন ভিন্ন এলাকায় এসেছিলেন। কখনো কখনো এমনও হয়েছে যে একই যুগ ও সময়ে পৃথক পৃথক এলাকার জন্য পৃথক পৃথক নবী পাঠানো হয়েছে। তাঁদের দায়িত্ব বিশেষ জাতি ও সম্প্রদায়ের ভেতর সীমাবদ্ধ ছিল। সবশেষে আল্লাহ সমগ্র সৃষ্টির জন্য এমন একজন নবী পাঠিয়েছেন, যিনি সব জাতি, সব যুগ ও দেশ-ভূখণ্ডের জন্য কিয়ামত পর্যন্ত যথেষ্ট। তিনি হলেন সর্বশেষ নবী মুহাম্মদ (সা.)। তিনি ছিলেন সমগ্র সৃষ্টির জন্য আল্লাহর অনুগ্রহস্বরূপ। আর যেহেতু তাঁর পর আর কোনো নবী আসবে না, তাই কিয়ামত পর্যন্ত তাঁর আনীত জ্ঞান ও প্রজ্ঞা সংরক্ষণের এক বিস্ময়কর ব্যবস্থাও আল্লাহ করেছেন।
তাঁর ওপর যে কিতাব অবতীর্ণ হয়েছে সেটা শুধু কাগজে নয়, বরং লাখো কোটি মানুষের অন্তরে সংরক্ষণ করা হয়েছে। আল্লাহ তা সংরক্ষণ করেছেন প্রতিটি নুকতা ও হরকতসহ। এরপর কোরআনের ব্যাখ্যায় মহানবী (সা.) যা কিছু বর্ণনা করেছেন তাও বিস্ময়কর উপায়ে সংরক্ষণ করা হয়েছে। পৃথিবীর আর কোনো গ্রন্থ এবং তাঁর ব্যাখ্যাকারীর জীবন পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে সংরক্ষণ করা হয়নি। এমনকি যাঁরা তাঁর জীবন, ইতিহাস ও বাণীগুলো বর্ণনা করেছেন তাঁদের জীবনচরিতও ইতিহাস সংরক্ষণ করেছে। কোনো সন্দেহ নেই এটা একটি অলৌকিক বিষয় ও মুজিজা।
নির্ভুল জ্ঞানের অধিকারী নবী-রাসুলদের একটি বৈশিষ্ট্য হলো তাঁরা মানুষের কাছে কোনো বিনিময় প্রত্যাশ্যা করতেন না। এ জন্য আল্লাহ তাঁদের অনুসরণের নির্দেশ দিয়ে বলেছেন, ‘তোমরা অনুসরণ করো তাদের, যারা তোমাদের কাছে কোনো প্রতিদান চায় না এবং যারা সৎপথপ্রাপ্ত।’ (সুরা : ইয়াসিন, আয়াত : ২১)
অর্থাৎ তোমরা তাদের কথা মান্য করো, যাদের জ্ঞান ও প্রজ্ঞা কিয়ামত পর্যন্ত প্রত্যেক যুগের সত্যের চূড়ান্ত মানদণ্ড।
আধুনিক যুগে নতুন সভ্যতা ও সংস্কৃতি, জগত্জীবনের সামগ্রিক প্রশস্ততা যদিও মানবজীবনে ভোগ-বিলাসিতার পথ প্রশস্ত করেছে। তবে আমরা এটাও দেখছি যে এই উন্নয়ন ও অগ্রগতির ভেতরও মানুষের ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবন সীমাহীন অস্তিরতা ও বিশৃঙ্খলার শিকার। ভোগ-বিলাসে নিমজ্জিত মানুষ মানবীয় মূল্যবোধ ও গুণাবলি এবং মনুষ্যত্বের বৈশিষ্ট্য বিসর্জন দিয়ে পশুর বৈশিষ্ট্য ধারণ করেছে। এর সপক্ষে প্রমাণ হিসেবে যেকোনো দিনের একটি সংবাদপত্রই যথেষ্ট। যাতে প্রকাশিত হয় বিভিন্ন ধরনের হত্যা, আত্মসাৎ, নারীর সম্ভ্রমহানি, মানুষের অসহায়ত্ব, জীবনের প্রতি বিতৃষ্ণা থেকে আত্মহত্যার মতো অসংখ্য ঘটনা। এসবের সঙ্গে শুধু শিক্ষাদীক্ষাহীন মূর্খরাই জড়িত নয়, বরং উচ্চ শিক্ষিত বহু মানুষ এর সঙ্গে জড়িত। এমনকি যাদের কাঁধে সমাজকে অপরাধমুক্ত রাখার দায়িত্ব ন্যস্ত তারা নিজেরাও অসংখ্য অপরাধের হোতা।
এমন করুণ পরিস্থিতি যখন মানবতা নিজেই আত্মহত্যা করতে উদগ্রীব, তখন কোনো ভুলে ভরা শিক্ষা মানবজাতিকে মুক্তি দিতে পারবে না। মানবজাতির মুক্তির জন্য প্রয়োজন নবী-রাসুল (আ.)-এর শিক্ষা ও আদর্শ। আসমানি শিক্ষা মানবজাতির মুক্তি তরান্বিত করতে পারে। এর মাধ্যমেই মানুষের চূড়ান্ত কল্যাণ নিশ্চিত হতে পারে। অতীত ইতিহাসও সাক্ষ্য দেয় মানবজাতি যখনই বিপর্যয়ের মুখোমুখি হয়েছিল আসমানি শিক্ষার আশ্রয়ই তাদেরকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করেছিল। মহান আল্লাহ মুক্তি বার্তা দিয়ে বলেন, ‘তোমরা সবাই আল্লাহর রজ্জু দৃঢ়ভাবে ধরো এবং পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ো না। তোমাদের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহ স্মরণ করো : তোমরা ছিলে পরস্পর শত্রু এবং তিনি তোমাদের হৃদয়ে প্রীতির সঞ্চার করেন, ফলে তাঁর অনুগ্রহে তোমরা পরস্পর ভাই হয়ে গেলে। তোমরা ছিলে অগ্নিকুণ্ডের প্রান্তে, আল্লাহ তা থেকে তোমাদের রক্ষা করেছেন।’ (সুরা : আলে ইমরান, আয়াত : ১০৩)
আল্লাহ সবাইকে দ্বিনের ওপর চলার তাওফিক দিন। আমিন।
তামিরে হায়াত থেকে মো. আবদুল মজিদ মোল্লার ভাষান্তর
আজ সোমবার, ২০ জানুয়ারি ২০২৫, ৬ মাঘ ১৪৩১, ১৯ রজব ১৪৪৬।
ঢাকা ও এর পার্শ্ববর্তী এলাকার নামাজের সময়সূচি নিম্নরূপ-
জোহরের সময় শুরু - ১২টা ১০ মিনিট।
আসরের সময় শুরু - ৪টা ০১ মিনিট।
মাগরিব- ৫টা ৪০ মিনিট।
এশার সময় শুরু - ৬টা ৫৬ মিনিট।
আগামীকাল ফজর শুরু - ৫টা ২৩ মিনিট।
আজ ঢাকায় সূর্যাস্ত ৫টা ৩৬ মিনিটে এবং আগামীকাল সূর্যোদয় ৬টা ৪২ মিনিটে।
সূত্র : ইসলামিক রিসার্চ সেন্টার, বসুন্ধরা, ঢাকা।