<p>মানবজাতির স্বভাবগত পরিচ্ছন্নতা, মানসিক ভারসাম্য এবং চারিত্রিক পবিত্রতার অন্যতম উপায় হলো বিয়ে। পবিত্র, পরিচ্ছন্ন, সংযত ও সুশৃঙ্খল জীবনের জন্য বিয়ের বিকল্প নেই। ইসলামের দৃষ্টিতে বিয়ে শুধু জৈবিক প্রয়োজন পূরণের মাধ্যম নয়, বরং একটি মহান ইবাদত ও ধর্মীয় অনুশাসন এবং আচারের অন্যতম অংশ। এ জন্য ইসলামে বিয়ের যথেষ্ট গুরুত্ব ও তাৎপর্য রয়েছে।</p> <p>১. প্রজন্মের ধারাবাহিকতা রক্ষা</p> <p>বিয়ের মাধ্যমে গড়ে ওঠে নারী-পুরুষের শান্তি-সুখের পরিবার। এরপর পরিবারে জন্ম নেয় ভালোবাসার সেতুবন্ধ মানব শিশু। সেই শিশু একসময় পূর্ণ মানবে পরিণত হয়। এভাবেই মানব প্রজন্মের ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকে। আল্লাহ বলেন, ‘হে মানুষ! আমি তোমাদের সৃষ্টি করেছি এক পুরুষ ও এক নারী থেকে, পরে তোমাদের বিভক্ত করেছি বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে, যাতে তোমরা একে অপরের সঙ্গে পরিচিত হতে পারো।’ (সুরা : হুজরাত, আয়াত : ১৩)</p> <p>আল্লাহ আরো বলেন, ‘হে মানুষ! তোমরা তোমাদের প্রতিপালককে ভয় করো, যিনি তোমাদের এক ব্যক্তি থেকেই সৃষ্টি করেছেন এবং যিনি তা থেকে তার স্ত্রী সৃষ্টি করেন, যিনি তাদের দুজন থেকে বহু নর-নারী ছড়িয়ে দেন।’ (সুরা : নিসা, আয়াত : ১)</p> <p>২. দৃষ্টি অবনমিত করে</p> <p>শারীরিক, মানসিক ও চারিত্রিক পবিত্রতা অনেকটা নির্ভর করে বিয়ের ওপর। নিখুঁত ইবাদতের জন্য এসব পবিত্রতা একান্ত প্রয়োজন। বিয়ের উপকারিতা ও বিয়ের বিকল্প দুটিই হাদিসে বলে দেওয়া হয়েছে। আবদুল্লাহ ইবন মাসউদ (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) আমাদের বলেছেন, ‘হে যুবক সম্প্রদায়! তোমাদের মধ্যে যে সামর্থ্য রাখে সে যেন বিয়ে করে। কারণ বিয়ে দৃষ্টিকে অবনমিত করে এবং লজ্জাস্থানকে হেফাজত করে। আর যে বিয়ের সামর্থ্য রাখে না সে যেন রোজা পালন করে। কারণ রোযা যৌন প্রবৃত্তি নিবৃত করে।’(বুখারি, হাদিস : ৫০৫৬; মুসলিম, হাদিস : ১৪০০)</p> <p>৩. নবী-রাসুলদের সুন্নত</p> <p>ইসলামের দৃষ্টিতে বিয়ে কেবল একটি উৎসাহিত বিষয়ই নয়, বরং নবী-রাসুলদের সুন্নত। ইয়াহইয়া (আ.) ও ঈসা (আ.) ছাড়া সব নবী-রাসুল বিয়ে করেছেন। আবু আইযুব (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘চারটি জিনিস নবী-রাসুলদের সুন্নত। লজ্জাবোধ, সুগন্ধি ব্যবহার, মেসওয়াক ও বিয়ে।’ (তিরমিজি, হাদিস : ১০৮০)</p> <p>আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘বিয়ে আমার সুন্নত। যে আমার সুন্নতের ওপর আমল করে না সে আমার দলভুক্ত নয়।’ (ইবনু মাজাহ, হাদিস : ১৮৪৬)</p> <p>৪. আল্লাহর অনুগ্রহ লাভ</p> <p>বিয়ে মহান আল্লাহর অনুগ্রহ পাওয়ার মাধ্যম। এর জন্য প্রয়োজন আল্লাহর ওপর ভরসা এবং নিজের চারিত্রিক পবিত্রতা রক্ষার সদিচ্ছা। আল্লাহ বলেন, ‘আর তোমাদের মধ্যে যে ছেলেদের স্ত্রী নেই এবং যে মেয়েদের স্বামী নেই, তাদের এবং তোমাদের দাস-দাসীদের মধ্যে যারা সৎ তাদের বিয়ে দিয়ে দাও। যদি তারা অভাবগ্রস্ত থাকে আল্লাহ নিজ অনুগ্রহে তাদের ধনী করে দেবেন। আর আল্লাহ প্রাচুর্যময় ও সর্বজ্ঞ।’ (সুরা : নূর, আয়াত : ৩২)</p> <p>৫. শান্তি ও সুশৃঙ্খল জীবন</p> <p>বিয়ে মানসিক প্রশান্তি, স্বাভাবিক ও সুশৃঙ্খল জীবনের অন্যতম মাধ্যম। বিয়ের মাধ্যমে দুটি পরিবারের মধ্যে সখ্য, ভালোবাসা ও দায়িত্ব-কর্তব্যবোধ সৃষ্টি হয়। আল্লাহ বলেন, ‘আর তাঁর নিদর্শনাবলির মধ্যে রয়েছে যে তিনি তোমাদের জন্য তোমাদের মধ্যে থেকে সৃষ্টি করেছেন তোমাদের সঙ্গিনীদের, যাতে তোমরা তাদের কাছে শান্তি পাও এবং তোমাদের মধ্যে পারস্পরিক ভালোবাসা ও দয়া সৃষ্টি করেছেন। চিন্তাশীল সম্প্রদায়ের জন্য তাতে অবশ্যই বহু নিদর্শন আছে।’ (সুরা : রুম, আয়াত : ২১)</p> <p>৬. বিয়ে যেভাবে বরকতময় হয়</p> <p>সর্বোত্তম, কল্যাণকর ও বরকতময় বিয়ে হলো, যা খুব স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় সহজসাধ্যভাবে অল্প খরচে অনুষ্ঠিত হয়। জমকালো আয়োজন, জৌলুসপূর্ণ আলোকসজ্জা, গান-বাদ্য এবং খরচের অসুস্থ প্রতিযোগিতা বিয়ের বরকত নষ্ট করে। উমর ইবনে খাত্তাব (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘সর্বোত্তম  বিয়ে হলো যা সহজসাধ্য হয়।’ (মুসনাদ আহমাদ, হাদিস : ২৪৫২৯)</p> <p>৭. বিয়ের ক্ষেত্রে ধার্মিকতা</p> <p>সাধারণত বিয়ের ক্ষেত্রে সৌন্দর্য, সম্পদ ও বংশ মর্যাদা দেখা হয়। এগুলোর কোনোটি টেকসই প্রশান্তি নিশ্চিত করতে পারে না। প্রশান্তির জন্য প্রয়োজন নৈতিকতা, দায়িত্ব সচেতনতা, কর্তব্যবোধ, কল্যাণকামিতা, অল্পে তুষ্টতা, পরকালকে অগ্রাধিকার দেওয়া ইত্যাদি। এসব রয়েছে দ্বিনের মধ্যে। এ জন্য বিয়ের ক্ষেত্রে রাসুলুল্লাহ (সা.) ধার্মিকতাকে অগ্রাধিকার দিতে বলেছেন। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী (সা.) বলেন, ‘চারটি গুণ দেখে মেয়েদের বিয়ে করা হয়। তার সম্পদ, বংশ, সৌন্দর্য ও ধার্মিকতা। তোমরা ধার্মিকতাকে প্রাধান্য দাও।’ (বুখারি, হাদিস : ৪৮০২; মুসলিম, হাদিস : ১৪৬৬)</p> <p>(৮) বিয়ের বয়স</p> <p>ইসলাম বাল্যবিবাহকে নিরুৎসাহ করলেও বিয়ের বয়সের ক্ষেত্রে কোনো সীমারেখা নির্ধারণ করেনি; বরং শারীরিক, আর্থিক ও সামাজিকভাবে সক্ষমতা অর্জনকেই বিয়ের যোগ্যতার মাপকাঠি নির্ধারণ করেছে। অঞ্চলভেদে পরিবেশ-পরিস্থিতি অনুযায়ী বিয়ের সমীচীন বয়সসীমা নির্ধারণ করা যেতে পারে। তবে বিশেষ অবস্থায় এ বয়সসীমা শিথিলও হতে পারে। যেমন—কোনো ব্যক্তির যৌনসংক্রান্ত অনাচারে লিপ্ত হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা থাকলে এবং অন্যান্য সামর্থ্য অর্জিত হলে তার বিয়েতে বাধা দেওয়া ইসলামের দৃষ্টিতে কোনোভাবে সমীচীন নয়। এভাবে কোনো নারী শারীরিক, মানসিকভাবে পূর্ণতা লাভ করার পর সুযোগ্য পাত্র পাওয়া গেলে তার অভিভাবকদের দ্রুত বিয়ের আয়োজন করতে উৎসাহিত করা হয়েছে। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যখন এমন কোনো ব্যক্তি তোমাদের কাছে বিয়ের প্রস্তাব পেশ করে, যার দ্বিনদারি ও চারিত্রিক দিক তোমাদের মুগ্ধ করে, তখন তোমরা ওই ব্যক্তির সঙ্গে বিয়ে দাও। যদি তোমরা তা না করো তাহলে সমাজে বিরাট ফিতনা-ফ্যাসাদ ও বিপর্যয় দেখা দেবে।’ (তিরমিজি, হাদিস : ১০৮৪)</p> <p>(৯) পারিবারিক সম্মতি</p> <p>বিয়ে একটি পারিবারিক বন্ধন। পারিবারিক মূল্যবোধের জায়গা থেকে পরিবারের সদস্যদের অভিমত ও বংশীয় মর্যাদা পারিবারিক বন্ধনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। পারিবারিকভাবে বিয়ে হলে উভয়েরই দায়বদ্ধতা ও জবাবদিহি থাকে। উভয় পরিবারের সহযোগিতা ও আন্তরিকতায় বিয়ে টেকসই ও স্থায়ী হয়। পক্ষান্তরে অভিভাবকদের অজান্তে বা অসম্মতিতে বিয়ে করা হলে পরিবারের সহযোগিতা ও আন্তরিকতা না থাকার ফলে যৌবনের উন্মাদনা কেটে গেলে সম্পর্কের টানাপড়েন শুরু হতে দেখা যায়। কাজেই পারিবারিক সম্মতি ছাড়া বিয়েশাদি একেবারেই অনুচিত। আবু মুসা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘অভিভাবক ছাড়া বিয়ে সংঘটিত হয় না।’ (তিরমিজি, হাদিস : ১১০১)</p> <p>১০. সামাজিক প্রচার</p> <p>মানুষের কাছে বিয়ের বার্তা পৌঁছানো গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। বিয়ের বার্তা সমাজের মানুষকে জানানো আবশ্যকীয় কর্তব্য। মানুষ যেন তাদের সম্পর্কে স্বচ্ছ সুন্দর ধারণা রাখে। তাদের জন্য বরকতের দোয়া করে। বিয়েতে সামর্থ্যবান তরুণরা উদ্বুদ্ধ হয়। অভিভাবক সচেতন হয়ে সন্তানের নির্মল ভবিষ্যতে সজাগ হয়। মুহাম্মাদ ইবনু জুমাহি (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘হারাম (ব্যভিচার) ও হালালের (বিয়ে) মধ্যে পার্থক্য হলো ঘোষণা ও দফ ব্যবহার।’ (তিরমিজি, হাদিস : ১০৮৮)</p> <p>দফ হলো—যার এক পাশ খোলা। বাজালে ঢ্যাব ঢ্যাব শব্দ হয়। জানান দেওয়ার জন্য এটি বাজানো হয়। এটি কোনো বাদ্যযন্ত্রের পর্যায়ে পড়ে না। ‘আওনুল বারী’ গ্রন্থে বলা হয়েছে—এর আওয়াজ স্পষ্ট ও চিকন নয় এবং সুরেলা ও আনন্দদায়কও নয়। কোনো দফের আওয়াজ যদি চিকন ও আকর্ষণীয় হয় তা আর দফ থাকবে না; বাদ্যযন্ত্রে পরিণত হবে। (আওনুল বারী : ২/৩৫৭)</p> <p>পরিশেষে বলা যায়, সুন্নাহ পালন, পাপ থেকে বেঁচে থাকা এবং চারিত্রিক পবিত্রতা রক্ষার্থে বিয়ে অন্যতম ইবাদত হিসেবে পরিগণিত। সে ক্ষেত্রে সামর্থ্যবানদের জন্য পারিবারিকভাবে সুন্নাহমাফিক বিয়ের আয়োজন জীবনের প্রশান্তি নিশ্চিত করতে পারে, অন্যথায় রোজা পালনের মাধ্যমে সংযত জীবন যাপন করে পরিবেশ-পরিস্থিতি অনুকূলে করার চেষ্টা ও দোয়া অব্যাহত রাখতে হবে।</p> <p><em>লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, আরবি বিভাগ</em></p> <p><em>রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।</em></p> <p> </p>