<p>পৃথিবীতে যত বড় বড় ইনকিলাব ও বিপ্লব এসেছে সেগুলো রাষ্ট্র বা সরকারের মাধ্যমে হয়নি, বরং তা এসেছে জনগণের হাত ধরে। জনসাধারণের দৃঢ় ইচ্ছা, প্রতিজ্ঞা ও ত্যাগের বিনিময়েই যুগে যুগে বিপ্লব ঘটেছে। যখন জনসাধারণ একবার দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়ে এই সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয় যে আমাদের মুক্ত হতে হবে, স্বাধীন হতে হবে, তখন সরকার জনসাধারণকে রাজনৈতিক মুক্তি দিতে বাধ্য। অথচ আমরা জনসাধারণ এই আশায় বসে আছি যে কোনো দিন আমাদের দেশে একটি সুষ্ঠু রাষ্ট্রব্যবস্থা আসবে, ন্যায়পরায়ণ সরকার আসবে, জনগণের মুক্তিদাতা নেতৃত্ব আসবে, যারা দেশটাকে দুর্নীতিমুক্ত করবে।</p> <p>নির্বাচন হয়, সরকার আসে, সরকার যায়; কিন্তু আমাদের সেই কাঙ্ক্ষিত মুক্তি মেলে না। এমন অবস্থায় মুসলিম জনসাধারণের প্রতি একান্ত নিবেদন হলো, দেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের আশায় বসে না থেকে আমরা প্রত্যেকে নিজ নিজ উদ্যোগে একত্র হয়ে নিজেদের মুক্ত করার চিন্তা করি। অন্যায়, দুর্নীতি ও খোদাদ্রোহের পথ থেকে সরিয়ে কিভাবে ন্যায়-ইনসাফ ও আল্লাহ তাআলার বাধ্যতার পথে আমরা সমাজটাকে ফিরিয়ে আনতে পারি, সেই চেষ্টা করা।</p> <p>সংকট মোকাবেলায় ব্যবসায়ীসমাজের করণীয়</p> <p>ব্যবসায়ীসমাজ যেকোনো দেশের মেরুদণ্ডতুল্য। যদি তারা মজবুত থাকে, দেশ ও জাতির কল্যাণে কাজ করার দৃঢ় ইচ্ছা রাখে, তাহলে তারা সরকারব্যবস্থার মধ্যে প্রভাব ফেলতে পারে। সরকারকে সঠিক পথে আনতে তারা তাদের প্রভাব কাজে লাগাতে পারে। অর্থনৈতিকভাবে আমাদের যে সংকট আছে, তা নিরসনে যদি ব্যবসায়ীরা নিজেদের মধ্যে সমন্বয় করে তা মোকাবেলার চেষ্টা করে তাহলে এর সমাধান সহজ। যেমন—আমাদের দেশে বিনিয়োগ মাধ্যম ও ডলার সংকট আছে।</p> <p>এখন যদি প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে বিদেশি পণ্য আমদানি বাড়ানো হয় তাহলে সংকট আরো প্রকট হবে। কিন্তু এই বিবেচনায় সরকার বিদেশি পণ্য আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে পারে না, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক আইন এবং সংস্থার চাপের কারণে। ধরুন, আইএমএফ দেশকে ঋণ দেওয়ার সময় সরকার থেকে এই ওয়াদা নেয় যে বিদেশি পণ্য আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া যাবে না। তেমনি বিভিন্ন দেশ ও সংস্থা ঋণ দিতে এই শর্তারোপ করে দিচ্ছে। তাই সরকার ডলার সংকট মোকাবেলায় আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা দিতে পারে না।</p> <p>কিন্তু দেশের জনগণ তো বিদেশি পণ্য ব্যবহারে বাধ্য নয়, জনগণকে তো কেউ বিদেশি পণ্য ব্যবহার করতে বাধ্য করছে না। তেমনি ব্যবসায়ীদের তো কেউ বিদেশি পণ্য আমদানি করতে বাধ্য করছে না। তাই যদি ব্যবসায়ী ভাইয়েরা এবং জনসাধারণ এ ব্যাপারে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয় যে আমরা বিদেশি পণ্য ব্যবহার করব না এবং আমদানিও করব না; বিশেষ করে বিলাসী পণ্য ত্যাগ করব। শুধু অত্যন্ত প্রয়োজনীয় জিনিসই আমদানি করব। বিশেষভাবে ওই সব দেশ থেকে কোনো আমদানি করব না, যারা মুসলিম নিধন ও হত্যাযজ্ঞে জালিমদের সহযোগিতা করছে।</p> <p>বিদেশনির্ভরতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে</p> <p>ব্যবসায়ী ভাইয়েরা, এই পরিকল্পনা নিতে হবে যে আমরা আমাদের দেশীয় পণ্যগুলোর প্রচার-প্রসার করব এবং তার মানোন্নয়নের চেষ্টা করব। বাইরের দেশ থেকে যে মানের পণ্য আসছে, আমাদের শিল্প-কারখানাগুলো চেষ্টা করবে, যেন আমরা এর চেয়েও ভালো মানের পণ্য বানাতে পারি, যাতে ভোক্তারা বিদেশি পণ্য থেকে মুখ ফিরিয়ে দেশি পণ্যে আগ্রহী হয়। এ অবস্থায় আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সরকারকে যত শর্তই লাগিয়ে দেওয়া হোক, আমরা নিজেরা চাইলে আমাদের দেশের উন্নয়নে আমরা নিজ উদ্যোগে বিদেশি পণ্য ত্যাগ করে বিকল্প দেশি পণ্যের মাধ্যমে দেশকে এগিয়ে নিতে পারি। এ ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক বাধা-বিপত্তি আমাদের ক্ষতি করতে পারবে না।</p> <p>অন্যদিকে রপ্তানির ক্ষেত্রেও পশ্চিমা অনৈসলামিক দেশগুলো, যারা আমাদের থেকে পণ্য নেয় এবং আমাদের বিভিন্ন ব্যাবসায়িক সুবিধাও দেয়, তারা এর সঙ্গে তার সরকারের ওপর নিজেদের মনগড়া কিছু শর্ত আরোপ করে দেয়, যা আমাদের দেশ ও জাতির জন্য, বিশেষ করে মুসলিম জাতিসত্তার জন্য ক্ষতিকর, দ্বিন ও ঈমানের জন্য ক্ষতিকর।</p> <p>এসবের মোকাবেলায় যদি আমাদের ব্যবসায়ী ভাইয়েরা সমন্বিত পরিকল্পনা নেয় যে আমরা আমাদের রপ্তানি পণ্য মুসলিম দেশগুলোতে অধিক পাঠানোর চেষ্টা করব। মুসলিম দেশগুলোর সঙ্গে এবং সেখানকার ব্যবসায়ীদের সঙ্গে সুসম্পর্ক বাড়িয়ে আমাদের পণ্য মুসলিম দেশে প্রচার করব। তাহলে আমাদের পশ্চিমা বিশ্বের প্রতি মুখাপেক্ষী হতে হবে না এবং তাদের প্রদত্ত ইসলামবিরোধী শর্তাদি আমরা মেনে নিতে বাধ্য হব না। ব্যবসায়ীরা চাইলে এটি সম্ভব যে সরকারি উদ্যোগ ছাড়াও আমরা আমদানিনির্ভর না হয়ে স্বনির্ভর হব, আর রপ্তানির ক্ষেত্রে মুসলিম দেশগুলোতে রপ্তানিতে অগ্রসর হব।</p> <p>জাতির ভাগ্য পরিবর্তনে নিজ উদ্যোগে ভূমিকা রাখতে হবে</p> <p>সরকারি পর্যায়ে কী কাজ হচ্ছে না হচ্ছে তার আশায় বসে না থেকে আমরা প্রত্যেকে এই মুহূর্তে পরিশুদ্ধতার কাজ শুরু করে দিই। দেখুন, সরকারি পর্যায়ে সুদের ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা না থাকুক, কিন্তু আমরা আমাদের ডিপোজিটগুলো সুদবিহীন ব্যাংকগুলোতে করতে এবং তাদের থেকে ফিন্যান্সিং গ্রহণে আমাদের কে নিষেধ করছে? এমনকি ইসলামী ব্যাংকগুলোর মধ্য থেকেও যারা পূর্ণ শরিয়ত মানতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ তাদের সঙ্গে লেনদেন করুন। ইসলামী ব্যাংকগুলোকেও আপনারা স্বীয় ব্যাবসায়িক প্রভাবের মাধ্যমে পূর্ণ শরিয়ত মতে চলতে বাধ্য করুন এবং তাদের থেকে এ বিষয়ে ওয়াদা নিন। উভয় দিক থেকেই সহযোগিতা থাকলে ডিপোজিট ও ফিন্যান্সিং শরিয়ত মতে হওয়া সহজ হয়।</p> <p>দেখুন, এই সুদের অভিশাপ আমাদের ওপর এবং সমগ্র পৃথিবীর ওপর শত শত বছর ধরে চেপে আছে। এর কেন্দ্র আমাদের এখানে নয়, এর কেন্দ্র হলো নিউইয়র্ক ও ওয়ালস্ট্রিট। সেখানে বসে তারা এই সুদের কারবারের মাধ্যমে সমগ্র দুনিয়াকে গোলাম বানিয়ে রেখেছে। তাই একমুহূর্তেই এই সুদের গ্যাড়াকল থেকে বের হওয়া কঠিন। এর অর্থ এই নয় যে আমরা নিরাশ হয়ে হাত গুটিয়ে বসে থাকব। বরং আমরা ধীরে ধীরে পর্যায়ক্রমে সুদের শিকল ভেঙে বের হওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা চালাতে থাকব। আর এটি কেবল সরকারেরই দায়িত্ব নয়, বরং আমাদের ব্যবসায়ীসমাজকেও প্ল্যান করে এগোতে হবে। ধরুন, সরকার সুদ নিষিদ্ধ করল না, কিন্তু সব ব্যাংক যদি একমত হয়ে যায় এ কথার ওপর যে আমরা সুদভিত্তিক লেনদেন ও কারবার করব না; আমরা ইসলামী শরিয়ত মতে ডিপোজিট ও ফিন্যান্সিং করব, তাহলে তো সরকারি আইন ছাড়াও বেসরকারিভাবে এবং ব্যক্তিগত উদ্যোগে অন্তত দেশীয় পর্যায়ে সুদ থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব।</p> <p>মোটকথা, সংকট থেকে উত্তরণের জন্য আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করতে হবে। নিরাশ হওয়ার কারণ নেই। নৈরাশ্য কোনো সমাধান নয়। বরং আমরা নিজেদের পরিবর্তন করি, যাতে আমরা নিজেদের বিজাতিদের চাপিয়ে দেওয়া ব্যবস্থা থেকে উত্তরণ করতে পারি, গোলামির গ্যাড়াকল থেকে বেরোতে পারি।</p> <p><em>ভাষান্তর : মুফতি মাহমুদ হাসান</em><br />  </p>