<p>ইসলামী পরিবার হলো এমন একটি পরিবার, যা ইসলামের শিক্ষার ওপর ভিত্তি করে পরিচালিত হয় এবং এর সদস্যরা ইসলামের নীতিমালা অনুসরণ করে জীবনযাপন করে। ইসলামী পরিবারে পারস্পরিক শ্রদ্ধা, দায়িত্ববোধ, আদর্শ মূল্যবোধ ও নৈতিকতার গুরুত্ব দেওয়া হয়। এ ধরনের পরিবারে পিতা-মাতা, সন্তান এবং অন্য সদস্যরা কোরআন ও হাদিসের নির্দেশনা মেনে চলতে চেষ্টা করে। ইসলামে পারিবারিক সম্প্রীতির গুরুত্ব অত্যন্ত বেশি। ইসলামের মূল শিক্ষা হলো মানবজীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে শান্তি, ভ্রাতৃত্ব ও সৌহার্দ্য প্রতিষ্ঠা করা।</p> <p>পারিবারিক সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্য প্রতিষ্ঠার জন্য নির্দিষ্ট কিছু নীতি রয়েছে, যা পারিবারিক জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যেমন—<br /> পারস্পরিক সম্মান ও ভালোবাসা : ইসলামে পরিবারের সদস্যদের মধ্যে পরস্পরের প্রতি সম্মান ও ভালোবাসা প্রদর্শনের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। কোরআনে আল্লাহ বলেছেন, ‘তোমাদের স্ত্রীর মধ্যে তিনি ভালোবাসা এবং দয়া সৃষ্টি করেছেন।’ (সুরা : রুম, আয়াত : ২১)</p> <p>এই আয়াত থেকে বোঝা যায়, পারিবারিক জীবনকে সুখী ও শান্তিপূর্ণ রাখার জন্য প্রেম ও সহানুভূতি অপরিহার্য।</p> <p>শান্তি ও ক্ষমার শিক্ষা : পারিবারিক সম্পর্কের ভিত্তি শান্তি ও ক্ষমার ওপর গড়ে ওঠে। পারিবারিক জীবনে যে ভুলত্রুটি বা মতপার্থক্য দেখা দেয়, সেগুলো ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখার শিক্ষা দেয় ইসলাম। আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা ক্ষমা করো এবং সহনশীল হও, আল্লাহ ক্ষমাশীলদের ভালোবাসেন।’ (সুরা : নূর, আয়াত : ২২)</p> <p>পারস্পরিক সাহায্য ও সহযোগিতা : পারিবারিক জীবনে সহযোগিতা ও সাহায্যের গুরুত্ব অপরিসীম। মহানবী (সা.) নিজে পারিবারিক কাজে সাহায্য করতেন এবং পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে সময় কাটাতেন। পরিবারের সদস্যদের মধ্যে বোঝাপড়া ও দায়িত্ব ভাগাভাগির মাধ্যমে সৌহার্দ্য বজায় থাকে।</p> <p>সংযম ও ধৈর্য : ইসলামে পরিবারে সংযম ও ধৈর্যের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। পারিবারিক জীবনে যেকোনো সমস্যায় শান্ত ও ধৈর্যশীল মনোভাব প্রদর্শন করার শিক্ষাই ইসলাম প্রদান করে। ধৈর্যের মাধ্যমে পারিবারিক সম্পর্কগুলো আরো মজবুত হয় এবং অসন্তোষ বা বিভেদ দূর করা সম্ভব।</p> <p>দায়িত্বশীলতা ও পারিবারিক কর্তব্য : ইসলামে প্রতিটি পরিবারের সদস্যের জন্য নির্দিষ্ট কিছু দায়িত্ব ও কর্তব্য নির্ধারিত হয়েছে। পিতামাতার প্রতি সন্তানের কর্তব্য, সন্তানের প্রতি মাতা-পিতার দায়িত্ব এবং স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক দায়িত্বগুলো পালন করাই পারিবারিক সম্প্রীতির ভিত্তি গড়ে তোলে।</p> <p>নরম স্বভাব ও স্নেহপ্রবণ আচরণ : নরম স্বভাব ও স্নেহপ্রবণ আচরণ পারিবারিক সম্পর্ককে আরো সুদৃঢ় করে। মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘তোমাদের মধ্যে সর্বোত্তম সেই ব্যক্তি, যে তার পরিবারের প্রতি উত্তম।’ (তিরমিজি)</p> <p>এই শিক্ষা অনুযায়ী পরিবারের প্রতি নরম মনের এবং স্নেহশীল মনোভাব প্রদর্শন করতে উৎসাহিত করা হয়েছে।</p> <p>নৈতিকতা ও শিষ্টাচারের শিক্ষা : পারিবারিক সম্প্রীতির জন্য পরিবারের সদস্যদের মধ্যে নৈতিকতা, শিষ্টাচার, এবং আন্তরিকতার শিক্ষা দেওয়া অত্যন্ত জরুরি। ইসলামে এই শিক্ষা দেওয়া হয়েছে, যেন প্রত্যেক সদস্য অন্য সদস্যদের প্রতি সদয়, ভদ্র ও শালীন আচরণ করে। এটি পারিবারিক সম্পর্ককে আরো মজবুত ও স্থায়ী করে তোলে।</p> <p>বিবাদ এড়িয়ে চলা এবং পারস্পরিক বোঝাপড়া বৃদ্ধি : পারিবারিক জীবনে ছোটখাটো বিরোধ এড়িয়ে চলা এবং পারস্পরিক বোঝাপড়া বাড়ানোর প্রতি গুরুত্ব দেয় ইসলাম। কোরআন ও হাদিসে বারবার শান্তিপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখার এবং বিবাদ বা কলহ এড়িয়ে চলার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, যা পারিবারিক শান্তি ও সম্প্রীতি রক্ষায় সহায়ক।</p> <p>পরিবারে প্রয়োজন অনুযায়ী পরামর্শ : ইসলামে পারিবারিক সম্পর্কগুলোতে পারস্পরিক পরামর্শের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। পরিবারের প্রধান সিদ্ধান্তগুলোতে সদস্যদের মতামত নেওয়া তাদের মধ্যে সম্মান ও সম্প্রীতি বৃদ্ধি করে। কোরআনে বলা হয়েছে, ‘তাদের পরামর্শ করো এবং তারপর আল্লাহর ওপর ভরসা করো।’ (সুরা : আলে ইমরান, আয়াত : ১৫৯)</p> <p>পরিবারের সদস্যদের সময় দেওয়া ও মানসিক সমর্থন প্রদান : ইসলামে পারিবারিক জীবনে সদস্যদের সময় দেওয়ার ওপর বিশেষভাবে গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। প্রিয় নবী (সা.) নিজেই পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে সময় কাটাতেন এবং তাদের সঙ্গে কথা বলতেন। মানসিক সমর্থন দিয়ে একজন আরেকজনকে সাহায্য করার মাধ্যমে পারিবারিক বন্ধন দৃঢ় হয় এবং পারস্পরিক আস্থা বৃদ্ধি পায়।</p> <p>অর্থনৈতিক সহায়তা ও প্রয়োজন মেটানো : ইসলামে পরিবারের প্রত্যেক সদস্যের অর্থনৈতিক চাহিদা মেটানোর ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। স্বামী হিসেবে একজন পুরুষকে তার স্ত্রীর ও সন্তানদের প্রয়োজন মেটাতে বলা হয়েছে। আল্লাহ কোরআনে বলেছেন, ‘পুরুষরা নারীদের তত্ত্বাবধায়ক...।’ (সুরা : নিসা, আয়াত : ৩৪)</p> <p>প্রয়োজন পূরণ করলে পরিবারের সদস্যদের মধ্যে নির্ভরশীলতা ও প্রশান্তি আসে, যা পারিবারিক সৌহার্দ্যকে আরো বাড়িয়ে তোলে।</p> <p>শান্তিপূর্ণ পরিবেশ নিশ্চিত করা : ইসলামে একটি শান্তিপূর্ণ এবং সংগঠিত পরিবেশ বজায় রাখার গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। পারিবারিক জীবনে শান্তি ও সংগঠনের অভাব হলে ছোটখাটো সমস্যাগুলো বড় আকার ধারণ করতে পারে। ইসলাম শেখায়, পারিবারিক জীবনে রাগ ও উত্তেজনা নিয়ন্ত্রণ করে একটি শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বজায় রাখা।</p> <p>সতর্কভাবে শব্দ ব্যবহার করা : ইসলামে কথোপকথনের সময় কোমল ও শালীন ভাষা ব্যবহারের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। পারিবারিক জীবনে শব্দ ব্যবহারে সতর্কতা থাকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ কঠোর কথা সম্পর্কের মধ্যে কষ্ট ও দুঃখ সৃষ্টি করতে পারে। আল্লাহ কোরআনে বলেছেন, ‘মানুষের সঙ্গে সুন্দর কথা বলো..।’ (সুরা : বাকারাহ, আয়াত ৮৩)</p> <p>পরস্পরের প্রতি কৃতজ্ঞতা ও প্রশংসা করা : ইসলামে কৃতজ্ঞতা ও প্রশংসার শিক্ষা দেওয়া হয়েছে, যা পারিবারিক সম্পর্ককে আরো দৃঢ় করে। মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি মানুষের প্রতি কৃতজ্ঞ নয়, সে আল্লাহর প্রতিও কৃতজ্ঞ নয়।’ (তিরমিজি)</p> <p>পরিবারের সদস্যদের পরস্পরের ভালো কাজের জন্য প্রশংসা করা হলে সম্পর্ক আরো দৃঢ় হয় এবং তাদের মধ্যে সম্মানবোধ বৃদ্ধি পায়।</p> <p>আদব বা শিষ্টাচার শেখানো ও পালন করা : ইসলাম শিক্ষা দেয় যে পরিবারের প্রত্যেক সদস্যকে আদব বা শিষ্টাচার শেখাতে হবে। এটি পারিবারিক সম্পর্কের ভিত্তিকে মজবুত করে এবং সদস্যদের মধ্যে শৃঙ্খলা বজায় রাখে। মহানবী (সা.) বলেন, ‘তোমার পরিবারকে সুন্দর চরিত্র শেখাও।’ (বুখারি)</p> <p>পরিবারের আনন্দ ও দুঃখ ভাগাভাগি করা : ইসলামে পারিবারিক সম্পর্কের জন্য আনন্দ ও দুঃখ ভাগাভাগি করার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। পরিবারের একজন সদস্যের সুখ-দুঃখে অন্যরা সমানভাবে অংশ নিলে পারস্পরিক ভালোবাসা বৃদ্ধি পায় এবং সম্পর্ক দৃঢ় হয়। মহানবী (সা.) তাঁর সাহাবিদের দুঃখ-কষ্টে সমব্যথী হতেন এবং তাঁদের সুখে আনন্দ প্রকাশ করতেন।</p>