<p>জ্ঞানগর্ভ ও উপদেশে ভরা আল-কোরআন জীবনের জন্য অপরিহার্য একটি গাইড বই। মানুষ কোথায় কখন কী করবে, কেন করবে, কিভাবে করবে—সব বিস্তারিত বলে দেওয়া হয়েছে কোরআনে। আল-কোরআন তথা আল্লাহ প্রদত্ত আসমানি কিতাবের হিদায়াতের বাইরে কোনো জীবনদর্শন নেই, কোনো ধর্মদর্শন নেই, কোনো মুক্তির পথ নেই। মানবজাতির সূচনালগ্নেই এ কথাটি জানিয়ে দেওয়া হয়েছে।</p> <p>বাবা আদম (আ.) ও মা হাওয়া (আ.)-কে আল্লাহ যখন পৃথিবীতে বিচরণের জন্য পাঠিয়েছেন, তখন আল্লাহ জনিয়ে দিয়েছেন, ‘আমি তাদের বলেছিলাম, তোমরা সবাই এখান থেকে দুনিয়ায় যাও। তারপর তোমাদের মঙ্গলের জন্য আমি অবশ্যই যুগে যুগে সত্যপথের দিকনির্দেশনা প্রেরণ করব। তখন যারা এই দিকনির্দেশনা অর্থাৎ কিতাবের বিধি-বিধান অনুসরণ করবে, তাদের কোনো ভয় বা দুঃখ থাকবে না। আর যারা এই কিতাবের নৈতিক বিধি-বিধান অস্বীকার করবে, তারাই জাহান্নামের আগুনে পুড়বে। সেখানেই থাকবে তারা চিরকাল।’ (সুরা : বাকারাহ, আয়াত ৩৮-৩৯)</p> <p>তার মানে দুনিয়ার জীবনে শান্তি আর আখিরাতের জীবনে মুক্তির জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে যুগে যুগে হিদায়াত এসেছে। সেই হিদায়াত যারা মেনে চলবে, তাদের কোনো ভয় নেই। আর যারা অস্বীকার করবে, তাদের কোনো রক্ষা নেই। উম্মতে মুহাম্মদির জন্য সর্বশেষ আসমানি হিদায়াতের নাম আল-কোরআন। ব্যক্তিজীবন থেকে শুরু করে পরিবার-সমাজ-রাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক জীবনে ন্যায়-ইনসাফ-শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য কোরআনের বিকল্প নেই। একইভাবে আখিরাতের মুক্তির জন্য মানুষের কাছে কোরআন এক অপরিহার্য গ্রন্থ। আল্লাহ বলেন, ‘হে নবী! এই কোরআন অনুসরণ যিনি তোমার ওপর ফরজ করেছেন, তিনি অবশ্যই তোমাকে চূড়ান্ত গন্তব্যে ফিরিয়ে আনবেন। যারা সত্য অস্বীকার করছে তাদের বলো, আমার প্রতিপালক খুব ভালো করে জানেন, কে সত্য ধর্ম নিয়ে এসেছে আর কে সুস্পষ্ট বিভ্রান্তিতে লিপ্ত।’ (সুরা : কাসাস, আয়াত : ৮৫)</p> <p>কোরআন অনুসরণ শুধু আল্লাহ ফরজই করেননি; এই ফরজ কে কতটুকু আন্তরিকতার সঙ্গে পালন করেছে, সেটাও কিয়ামতের দিন আল্লাহ জিজ্ঞেস করবেন। এর পরই ফয়সালা হবে তার জন্য জান্নাত না জাহান্নাম অপেক্ষা করছে। আল্লাহ বলেন, ‘তোমার ওপর যে ওহি নাজিল হয়েছে, তা অনুসরণে অটল থাকো। তুমি সাফল্যের সরলপথেই আছ। নিঃসন্দেহে এই কোরআন তোমার ও তোমার অনুসারীদের জন্য অত্যন্ত সম্মানের বিষয়। কিন্তু সময় হলে তোমাদের অবশ্যই জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে এই কোরআন নিয়ে তোমরা কী করেছ।’ (সুরা : জুখরুফ, আয়াত : ৪৩-৪৪)</p> <p>মানুষ অজ্ঞ। সে নিজের পরিচয়ই জানে না। মানুষ অন্ধ। সে নিজের স্রষ্টাকেই চেনে না। কোরআন মানুষের চোখ খুলে দেয়। তাকে জানিয়ে দেয় তার পরিচয়। জানিয়ে দেয় প্রভুর পরিচয়। তার গলায় পরিয়ে দেয় ঈমানের মালা। যুগে যুগে রাসুলদের দাওয়াতি মিশন ছিল এটাই। আল্লাহকে চেনানো। কোরআনে আল্লাহ বলেন—রাসুলরা বলল, ‘আল্লাহর অস্তিত্ব ও একত্বের বিষয়ে কি কোনো সন্দেহ থাকতে পারে? যিনি মহাকাশ ও পৃথিবীর সব কিছুর সৃষ্টিকর্তা? তিনি তোমাদের ডাকছেন, যাতে তিনি তোমাদের অতীতের সব পাপ মোচন করতে পারেন এবং নির্দিষ্ট মেয়াদ পর্যন্ত ভালো কাজ করার সুযোগ দিতে পারেন।’ (সুরা : ইবরাহিম, আয়াত : ১০)</p> <p>কোরআনের দাওয়াত খুব জটিল কোনো বিষয় নয়; বরং মানুষ যেন মানুষ হতে পারে, তার জীবনে যেন কোনো বিকৃতি না আসে অথবা যে বিকৃতি এসেছে সেটা যেন সংশোধন হয়ে যায়—এটাই কোরআনের উদ্দেশ্য। ফলে সুস্থ-স্বাভাবিক জীবনের জন্যও কোরআন অপরিহার্য। আল্লাহ বলেন, ‘আসলে বিবেক প্রয়োগ করে সত্য না জানার কারণে সীমালঙ্ঘনকারীরা নিজেদের কামনা-বাসনার অনুসরণ করে। এ কারণে আল্লাহ যাকে পথভ্রষ্ট হতে দেন, কে তাকে সৎপথ দেখাবে? ওরা কারো সাহায্যও পাবে না। অতএব হে বিশ্বাসীরা! তোমরা সকল মিথ্যা পরিত্যাগ করে একনিষ্ঠভাবে ধর্মের ওপর নিজেদের কায়েম রাখো। আল্লাহ যে প্রকৃতিতে মানুষ সৃষ্টি করেছেন, সেই সৎ প্রকৃতির অনুসরণ করো। আল্লাহর সৃষ্ট এই প্রকৃতিকে দূষিত-বিকৃত কোরো না। এটাই সত্য ধর্ম, সর্বোচ্চ ধর্মবিধান। কিন্তু বেশির ভাগ মানুষই তা জানে না।’ (সুরা : রুম, আয়াত : ২৯-৩০)</p> <p>আল-কোরআনের প্রথম আয়াত নাজিল হয় ৬১০ সালে আর শেষ আয়াত ৬৩২ সালে। ধাপে ধাপে খণ্ডে খণ্ডে দীর্ঘ ২৩ বছরে পরিপূর্ণতা পায় আল-কোরআন। প্রথম আয়াত নাজিল হওয়ার পরই স্পষ্ট হয়ে ওঠে এর আকর্ষণী ক্ষমতা। অবিদ্যা বা জাহিলিয়াতের অন্ধকারে নিমজ্জিত মানুষগুলো আলোর সন্ধান পায়। সেই আলোয় বদলাতে শুরু করে তারা। পিতৃপুরুষের হাজার বছরের সংস্কার ও ধর্মান্ধতার বৃত্ত ভেঙে তারা লাভ করে মুক্ত বিশ্বাস ও সঠিক জীবনদৃষ্টি।</p> <p>আল-কোরআন কেবল ব্যক্তিজীবনকেই পরিশুদ্ধ করে না, জাতিকেও বিশ্বের দুয়ারে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে ভূমিকা রাখে। কোরআনের প্রথম আয়াত নাজিল হওয়ার ৫০ বছরের মধ্যে মুসলমানরা তদানীন্তন পরাশক্তি রোমান ও পারস্য সাম্রাজ্যকে নিশ্চিহ্ন করে পরিণত হয় তখনকার একমাত্র পরাশক্তিতে। ‘আলিফ-লাম-মীম। রোমানরা নিকটবর্তী অঞ্চলে পরাজিত হয়েছে। কিন্তু এই পরাজয় সত্ত্বেও কয়েক বছরের মধ্যে ওরা বিজয়ী হবে। পূর্বের ও পরের সকল ফয়সালার এখতিয়ার শুধু আল্লাহর। একদিন আল্লাহর দেওয়া বিজয়ে বিশ্বাসীরা আনন্দিত হবে। তিনি যাকে ইচ্ছা বিজয় দান করেন। তিনি মহাপরাক্রমশালী, পরম দয়ালু। আল্লাহ বিজয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। আল্লাহ কখনো প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেন না। কিন্তু বেশির ভাগ মানুষই তা বোঝে না। ওরা পার্থিব জীবনের দৃশ্যমান বিষয়েই শুধু জানে। কিন্তু চূড়ান্ত নিগূঢ় সত্য সম্পর্কে ওদের কোনো জ্ঞানই নেই।’ (সুরা : রুম, আয়াত : ১-৭)</p> <p>ইতিহাস সাক্ষী! কোরআন ছাড়া আর কোনো গ্রন্থই প্রচারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মানুষের হৃদয়ে এত আলোড়ন সৃষ্টি করতে পারেনি, এত দ্রুত মানুষকে এমনভাবে বদলে দিতে পারেনি। কোরআন সরাসরি যাদের সামনে নাজিল হয়েছিল তাঁরাই শুধু আলোকিত হননি; ধর্মান্ধতা ও পাশবিকতার পরিবর্তে ধর্ম, মানবিকতা ও মুক্তবুদ্ধির এই স্রোত প্রবাহিত হয়েছে প্রজন্মের পর প্রজন্মে, শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে। ধর্ম, মানবিকতা ও মুক্তবুদ্ধির এই স্রোত ইতিহাসের মধ্যযুগে সৃষ্টি করেছিল এক আলোকোজ্জ্বল সভ্যতা। কোরআনের অনুসারীরা যখন শিল্প-সাহিত্য, জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চায় অবগাহন করছিল, তখন ইউরোপ ডুবে ছিল অজ্ঞতা ও ধর্মান্ধতার অন্ধকার যুগে।</p> <p>প্রাচ্যের এই আলোকোজ্জ্বল সভ্যতা থেকেই ইউরোপের দেশে দেশে কোরআনের মানবিকতা ও মুক্তবুদ্ধির বাণী পৌঁছতে থাকে বিভিন্নভাবে। ইউরোপে সূচনা হয় রেনেসাঁ বা মুক্তবুদ্ধির জাগরণ। নতুনভাবে শুরু হয় জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চা। এগোতে থাকে বিজ্ঞান। তাই নিঃসংশয়ে বলা যায়, কোরআন যে মানবিকতা, জ্ঞানচর্চা ও মুক্তবুদ্ধির শিক্ষা দিয়েছে, তারই ফল্গুধারায় লালিত হয়ে বিশ্ব প্রবেশ করেছে বর্তমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির যুগে। তাই অকপটে বলা যায়, জীবন-সভ্যতা ও প্রযুক্তির উৎকর্ষে কোরআনের ভূমিকা অপরিসীম।</p>