জুমার দিনের গুরুত্বপূর্ণ ৮ আমল

ইসলামী জীবন ডেস্ক
ইসলামী জীবন ডেস্ক
শেয়ার
জুমার দিনের গুরুত্বপূর্ণ ৮ আমল
সংগৃহীত ছবি

ইসলামে জুমার দিনটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ দিন হিসেবে বিবেচিত। পবিত্র কোরআনে জুমার দিন দ্রুত মসজিদে গমনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তা ছাড়া হাদিসে গুরুত্বপূর্ণ আমলের কথাও এসেছে। ইরশাদ হয়েছে, ‘হে মুমিনরা! জুমার দিন নামাজের আজান হলে তোমরা আল্লাহর স্মরণে ধাবিত হও এবং বেচাবিক্রি বন্ধ কোরো, তা তোমাদের জন্য উত্তম, যদি তোমরা বুঝো।

এরপর নামাজ শেষ হলে ভূপৃষ্ঠে ছড়িয়ে পড়ো এবং আল্লাহর অনুগ্রহ (জীবিকা) অনুসন্ধান করো এবং আল্লাহকে অধিক স্মরণ করো, যাতে তোমরা সফলকাম হও।’ (সুরা : জুমা, আয়াত : ৯-১০)

জুমার দিনের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ আমল সম্পর্কে নিম্নে আলোচনা করা হলো— 

১. জুমার দিনের বিশেষ মর্যাদা

আবু লুবাবা বিন আবদুল মুনজির (রা.) থেকে বর্ণিত, হাদিসে রাসুলুল্লাহ (সা.) জুমার দিনের পাঁচটি বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করেছেন। সেগুলো হলো—এক. আল্লাহ তাআলা এই দিনে আদম (আ.)-কে সৃষ্টি করেছেন। দুই. আল্লাহ তাআলা এই দিনে আদম (আ.)-কে জমিনে অবতরণ করিয়েছেন।

তিন. এই দিনে আদম (আ.)-কে মৃত্যু দিয়েছেন। চার. এই দিনে এমন একটি সময় আছে, যখন বান্দা আল্লাহর কাছে যা কিছুই প্রার্থনা করবে তিনি তা দেবেন। যতক্ষণ সে হারাম কিছু প্রার্থনা করবে না। পাঁচ. এই দিনে কিয়ামত সংঘটিত হবে।
’ (ইবনে মাজাহ, হাদিস : ৮৯৫)

২. জুমার নামাজ আদায়

সালমান ফারসি থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি জুমার দিন গোসল করল, সাধ্যমতো পবিত্রতা অর্জন করল, তেল ব্যবহার করল, ঘর থেকে সুগন্ধি ব্যবহার করল, অতঃপর মসজিদে এলো, সেখানে দুজন মুসল্লির মধ্যে ফাঁক করে সামনে এগিয়ে না যায়, নির্দিষ্ট পরিমাণ নামাজ পড়ল, অতঃপর ইমাম কথা শুরু করলে চুপ থাকল; তাহলে আল্লাহ তাআলা তাঁর দুই জুমার মধ্যবর্তী সময়ের গুনাহ মাফ করবেন।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৮৮৩)

অন্য হাদিসে এসেছে, আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ, এক জুমা থেকে পরবর্তী জুমা, এক রমজান থেকে পরবর্তী রমজান মধ্যবর্তী সময়ের পাপ মোচন করে; যদি সেই ব্যক্তি সব ধরনের কবিরা গুনাহ থেকে বিরত থাকে।’ (মুসলিম, হাদিস : ২৩৩)

৩. জুমার দিন গোসল করা

জুমার দিন গোসল করা ও আগে আগে মসজিদে যাওয়া অত্যন্ত সওয়াবের কাজ। আউস বিন আউস সাকাফি (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি জুমার দিন ভালো করে গোসল করল, দ্রুততর সময়ে মসজিদে গেল ও (ইমামের) কাছাকাছি বসে মনোযোগসহ (খুতবা) শুনল, তাঁর জন্য প্রতি কদমের বদলে এক বছরের রোজা ও নামাজের সওয়াব থাকবে।’ (আবু দাউদ, হাদিস : ৩৪৫)

৪. মসজিদে প্রথমে প্রবেশ করা

জুমার দিন মসজিদে আগে প্রবেশ করা ও মনোযোগ দিয়ে খুতবা শোনার বিশেষ গুরুত্ব আছে।

রাসুল (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি জুমার দিন গোসল করল, অতঃপর প্রথমে মসজিদে গেল সে যেন একটি উট কোরবানি করল। যে এরপর মসজিদে গেল, সে যেন একটি গরু কোরবানি করল। আর যে এরপর ঢুকল, সে যেন ছাগল কোরবানি করল, এরপর যে ঢুকল সে যেন মুরগি কোরবানি করল, আর যে এরপর ঢুকল সে ডিম সদকা করল। অতঃপর ইমাম খুতবার জন্য এলে ফেরেশতারা আলোচনা শোনা শুরু করে।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৮৪১)

৫. জুমার দিন দোয়া কবুল হয়

জুমার দিন একটি সময় আছে, যখন মানুষ আল্লাহর কাছে কোনো দোয়া করলে আল্লাহ তা কবুল করেন। জাবের (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেন, ‘জুমার দিন কোনো মুসলিম আল্লাহর কাছে ভালো কিছুর দোয়া করলে আল্লাহ তাকে তা দেন। তোমরা সময়টি আসরের পর অনুসন্ধান কোরো।’ (আবু দাউদ, হাদিস নম্বর : ১০৪৮)

জাবের ইবনে আবদুল্লাহ (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘জুমার দিনের বারো ঘণ্টার মধ্যে এমন একটি মুহূর্ত রয়েছে যদি কোনো মুসলিম এ সময় আল্লাহর কাছে কিছু প্রার্থনা করে, তাহলে মহান ও সর্বশক্তিমান আল্লাহ তাকে দান করেন। এই মুহূর্তটি তোমরা আছরের শেষ সময়ে অনুসন্ধান কোরো। (আবু দাউদ, হাদিস : ১০৪৮)

৬. সুরা কাহাফ পাঠ

জুমার অন্যতম আমল সুরা কাহাফ পাঠ করা। আবু সাইদ খুদরি (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি জুমার দিন সুরা কাহাফ পড়বে তা দুই জুমার মধ্যবর্তী সময়ে তার জন্য আলোকিত হয়ে থাকবে। আর যে ব্যক্তি এই সুরার শেষ ১০ আয়াত পাঠ করবে অতঃপর দাজ্জাল বের হলে তার কোনো ক্ষতি করতে পারবে না।’ (সহিহ তারগিব, হাদিস : ১৪৭৩, আল মুসতাদরাক : ২/৩৯৯)

৭. গুনাহ মাফ হয়

সালমান ফারসি থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি জুমার দিন গোসল করল, সাধ্যমতো পবিত্র হলো, তেল ব্যবহার করল, ঘর থেকে সুগন্ধি ব্যবহার করল, অতঃপর মসজিদে এলো, সেখানে দুজন মুসল্লির মধ্যে ফাঁক করে সামনে এগিয়ে যায় না, নির্দিষ্ট পরিমাণ নামাজ পড়ল, অতঃপর ইমাম কথা শুরু করলে চুপ থাকল; তাহলে আল্লাহ তাআলা তাঁর দুই জুমার মধ্যবর্তী সময়ের গুনাহ মাফ করেন।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৮৮৩)

৮. দরুদ পাঠ

জুমার দিন নবীজি (সা.)-এর ওপর বেশি বেশি দরুদ পাঠ করা কর্তব্য। আউস বিন আবি আউস (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘তোমাদের দিনগুলোর মধ্যে জুমার দিন সর্বোত্তম। এই দিনে আদম (আ.)-কে সৃষ্টি করা হয়েছে। এই দিনে তিনি ইন্তেকাল করেছেন। এই দিনে শিঙায় ফুঁ দেওয়া হবে এবং এই দিনে সবাইকে বেহুঁশ করা হবে। অতএব, তোমরা এই দিনে আমার ওপর বেশি পরিমাণ দরুদ পড়ো। কারণ জুমার দিনে তোমাদের দরুদ আমার কাছে পেশ করা হয়।’ সাহাবারা বললেন, আমাদের দরুদ আপনার কাছে কিভাবে পেশ করা হবে, অথচ আপনার দেহ একসময় নিঃশেষ হয়ে যাবে? তিনি বলেন, ‘আল্লাহ জমিনের জন্য আমার দেহের ভক্ষণ নিষিদ্ধ করেছেন।’ (আবু দাউদ, হাদিস : ১০৪৭)

মন্তব্য

সম্পর্কিত খবর

ইসলামে শোক পালনের নিয়ম

শরিফ আহমাদ
শরিফ আহমাদ
শেয়ার
ইসলামে শোক পালনের নিয়ম
সংগৃহীত ছবি

প্রিয়জনের মৃত্যুতে শোক প্রকাশ একটি স্বাভাবিক আবেগ। ইসলাম এটাকে নিষিদ্ধ করেনি। তবে এর জন্য নির্দিষ্ট সীমারেখা নির্ধারণ করে দিয়েছে। এর দ্বারা মানুষের মন প্রশান্ত এবং আল্লাহর প্রতি ধৈর্যশীল হয়।

এসংক্রান্ত কয়েকটি নিয়ম-কানুন উল্লেখ করা হলো—

শোক পালনের সময়সীমা

মৃত ব্যক্তির আত্মীয়-স্বজনের জন্য তিন দিন পর্যন্ত শোক পালন করার অনুমতি আছে। তবে স্ত্রীর জন্য স্বামীর মৃত্যুতে চার মাস ১০ দিন শোক পালন করতে হবে। এর চেয়ে বেশিদিন শোক পালন করা ইসলামসম্মত নয়।

জয়নাব বিনতে আবু সালামা (রা.) বলেন, যখন শাম (সিরিয়া) থেকে আবু সুফিয়ান (রা.)-এর মৃত্যু সংবাদ পৌঁছল, তার তৃতীয় দিন উম্মে হাবিবা (রা.) হলুদ বর্ণের সুগন্ধি আনালেন এবং তাঁর উভয় গাল ও বাহুতে মাখলেন।

তারপর বলেন, অবশ্য আমার এর কোনো প্রয়োজন ছিল না, যদি আমি নবী করিম (সা.)-কে এ কথা বলতে না শুনতাম, যে স্ত্রীলোক আল্লাহ এবং কিয়ামতের দিনের প্রতি ঈমান রাখে তার পক্ষে স্বামী ছাড়া অন্য কোনো মৃত ব্যক্তির জন্য তিন দিনের বেশি শোক পালন করা হালাল নয়। অবশ্য স্বামীর জন্য সে চার মাস ১০ দিন শোক পালন করবে। (বুখারি, হাদিস : ১২৮০; মুসলিম, হাদিস : ৩৫৯১)

নীরবে কান্না করা জায়েজ

শোক পালনের সময় নীরবে কান্না করা জায়েজ। এটা মৃত ব্যক্তির প্রতি ভালোবাসা, দুঃখ ও প্রার্থনা প্রকাশ করে।

ইবরাহিম (রা.)-এর ইন্তেকালে রাসুল (সা.) নিঃশব্দে কান্না করেছেন। তখন আবদুর রহমান ইবনে আওফ (রা.) বলেন, হে আল্লাহর রাসুল! আর আপনিও (কাঁদছেন?) তখন তিনি বলেন, ইবনে আওফ! এ হচ্ছে মায়া-মমতা।

তারপর পুনর্বার অশ্রু ঝরতে থাকল, এরপর তিনি বলেন, অশ্রু প্রবাহিত হয় আর হৃদয় হয় ব্যথিত। তবে আমরা মুখে তাই বলি, যা আমাদের রব পছন্দ করেন। আর হে ইবরাহিম! তোমার বিচ্ছেদে আমরা অবশ্যই শোকাভিভূত।

(বুখারি, হাদিস : ১২২৫)

শোকের দিনে রান্নাবান্না

মৃত ব্যক্তির বাড়িতে চুলা জ্বালানো বা রান্নাবান্না করা নিষিদ্ধ নয়। অন্যান্য দিনের মতো সেদিনও রান্না করা যাবে। তবে প্রতিবেশীদের দায়িত্ব হলো মৃতের বাড়ির লোকদের খাবারের ব্যবস্থা করা। জাফর (রা.)-এর ইন্তেকালের খবর আসার পর নবী করিম (সা.) (আহলে বায়তকে) বলেন, তোমরা জাফরের পরিবার-পরিজনের জন্য খাবার তৈরি করো। কেননা তাদের ওপর এমন এক বিপদ এসে পড়েছে, যা তাদের রান্নাবান্না করে খেতে বাধা সৃষ্টি করবে। (তিরমিজি,হাদিস : ৯৯৮; আবু দাউদ, হাদিস : ৩১৩২)

শোক পালনে নিষিদ্ধ কাজ

শোক পালনের ক্ষেত্রে কিছু সীমারেখা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে, যা শোক পালনকে একটি সুশৃঙ্খল ও ইসলামী আদর্শের মধ্যে রাখে। শোক পালনের দিনে কিছু কিছু কাজ করতে নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

এক. চিৎকার, মাতম ও বুক চাপড়ানো নিষিদ্ধ। নবী করিম (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘যারা শোকে গালে চাপড়ায়, জামার বুক ছিঁড়ে ফেলে এবং জাহেলি যুগের মতো চিৎকার দেয়, তারা আমাদের তরিকাভুক্ত নয়।’ (বুখারি, হাদিস : ১২১৯)

দুই. ইদ্দতের সময় সাজসজ্জা করা নিষিদ্ধ। উম্মে সালামা (রা.) থেকে বর্ণিত আছে যে একজন নারীর স্বামী মৃত্যুবরণ করলে তার পরিবারের লোকেরা তার আঁখিযুগল নষ্ট হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করল। তারা রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে এসে তার সুরমা ব্যবহারের অনুমতি প্রার্থনা করল। তিনি বললেন, সুরমা ব্যবহার করতে পারবে না।

তোমাদের অনেকেই (জাহেলি যুগে) তার নিকৃষ্ট কাপড় বা নিকৃষ্ট ঘরে অবস্থান করত। যখন এক বছর অতিক্রান্ত হতো আর কোনো কুকুর সেদিকে যেত, তখন সে বিষ্ঠা নিক্ষেপ করত। কাজেই চার মাস ১০ দিন অতিবাহিত না হওয়া পর্যন্ত সুরমা ব্যবহার করতে পারবে না। (বুখারি, হাদিস : ৫৩৩৮)

তিন. প্রচলিত নিয়মে মৃত ব্যক্তির বাড়িতে দাওয়াতের আয়োজন করা। সাহাবায়ে কিরামের যুগ থেকেই এটিকে নিষিদ্ধ ও মন্দ কাজ গণ্য করা হতো। জাবির (রা.) বলেন, আমরা মৃতের দাফন কার্য শেষ হওয়ার পর তার বাড়িতে একত্র হওয়া এবং (আগতদের জন্য) খাবারের আয়োজন করাকে নিয়াহা (নিষিদ্ধ পন্থায় শোক পালন) এর অন্তর্ভুক্ত গণ্য করতাম। (মুসনাদে আহমাদ, হাদিস : ৬৯০৫; ইবনে মাজাহ, হাদিস : ১৬১২)

শোক প্রকাশ করার সময় সংযম ও ধৈর্য বজায় রেখে আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞ থাকা এবং ইসলামী নিয়ম অনুযায়ী কাজ করা মুমিনদের দায়িত্ব। এ ব্যাপারে সবার সতর্ক হওয়া উচিত।

লেখক : খতিব ও মাদরাসা শিক্ষক, রায়পুর, লক্ষ্মীপুর

মন্তব্য

সাহাবিরা রমজানকে স্বাগত জানাতেন যেভাবে

আসআদ শাহীন
আসআদ শাহীন
শেয়ার
সাহাবিরা রমজানকে স্বাগত জানাতেন যেভাবে
সংগৃহীত ছবি

সাহাবায়ে কিরাম (রা.) রমজানকে অভ্যর্থনা জানাতে এক অপূর্ব দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন। তাঁদের জীবন ও কর্মে এই পবিত্র মাসের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ও প্রস্তুতির এক অনন্য চিত্র ফুটে উঠত। বহু বর্ণনায় পাওয়া যায় যে কিভাবে তাঁরা রমজানের আগমনের সংবাদ পেয়ে আনন্দিত হতেন, ইবাদত-বন্দেগিতে নিমগ্ন হয়ে যেতেন এবং আত্মশুদ্ধির এক নতুন অধ্যায় শুরু করতেন। নিচে তাঁদের কিছু স্মরণীয় রমজান প্রস্তুতির দৃষ্টান্ত তুলে ধরা হলো—

নবীজির (সা.) শুভ সংবাদ

প্রিয় নবী (সা.) সাহাবাদের রমজানের আগমনের সুসংবাদ দিতেন।

আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত আছে, রাসুলুল্লাহ (সা.) একবার সাহাবাদের উদ্দেশ্যে বলেন—‘তোমাদের কাছে রমজান উপস্থিত হয়েছে, যা একটি বরকতময় মাস। তোমাদের ওপর আল্লাহ তাআলা অত্র মাসের রোজা ফরজ করেছেন।

এ মাসের আগমনে জান্নাতের দরজাসমূহ খুলে দেওয়া হয়, জাহান্নামের দরজাসমূহ বন্ধ করে দেওয়া হয়, আর আল্লাহর অবাধ্য শয়তানদের গলায় লোহার বেড়ি পরানো হয়। এ মাসে একটি রাত রয়েছে, যা এক হাজার মাস অপেক্ষাও উত্তম।

যে ব্যক্তি সে রাতের কল্যাণ থেকে বঞ্চিত রয়ে গেল সে প্রকৃত বঞ্চিত রয়ে গেল।’ (সুনানে নাসাঈ, হাদিস : ২১০৬)

চাঁদ দেখা ও রমজানের প্রতীক্ষা

সাহাবায়ে কিরাম (রা.) রমজানের চাঁদ দেখার জন্য গভীর আগ্রহ ও ব্যাকুলতার সঙ্গে অপেক্ষা করতেন। রাতের আঁধারে বেরিয়ে আসতেন, আকাশের দিকে চেয়ে চাঁদের খোঁজ করতেন। তাঁদের হৃদয় রমজানের জন্য এতটাই উদগ্রীব থাকত যে চাঁদ দেখার মাধ্যমেই তাঁরা পবিত্র মাসের আগমনকে উপলব্ধি করতেন।

এটি রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর অন্যতম সুন্নাহ ছিল, যা সাহাবায়ে কিরাম (রা.) গভীর নিষ্ঠার সঙ্গে অনুসরণ করতেন। কেননা রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা চাঁদ দেখে রোজা শুরু করবে এবং চাঁদ দেখে ইফতার করবে। আকাশ যদি মেঘাচ্ছন্ন থাকে তাহলে শাবানের গণনা ৩০ দিন পূর্ণ করবে।’ (বুখারি, হাদিস : ১৯০৯)

পূর্ববর্তী রোজার কাজা আদায়

রমজানের প্রস্তুতির অংশ হিসেবে সাহাবায়ে কিরাম (রা.) পূর্ববর্তী বছরের কোনো রোজা যদি অনিবার্য কারণে ছুটে যেত, তবে তা রমজানের আগেই আদায় করে নিতেন। আয়েশা (রা.) উল্লেখ করেছেন যে তিনি বিগত রমজানের ছুটে যাওয়া রোজাগুলো শাবান মাসে আদায় করতেন।

তিনি বলেন, ‘আমার ওপর রমজানের কিছু রোজা কাজা থাকত, কিন্তু আমি তা আদায় করতে পারতাম না, যতক্ষণ না শাবান মাস আসত।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ১৯৫০)

রমজানের আগমনের জন্য ছয় মাস দোয়া

সাহাবায়ে কিরাম (রা.) রমজানের জন্য এমনভাবে প্রস্তুতি নিতেন যে তাঁরা ছয় মাস আগে থেকেই আল্লাহর দরবারে দোয়া করতেন, যেন তিনি তাঁদের রমজান পর্যন্ত পৌঁছে দেন। তারপর, রমজানের পরবর্তী ছয় মাস তাঁরা আবার দোয়া করতেন, যেন আল্লাহ তাঁদের রোজা ও ইবাদত কবুল করেন। এভাবে তাঁদের পুরো বছরজুড়ে রমজানের ছোঁয়া লেগে থাকত। (আসরারুল মুহিব্বিন ফি রমাজান, পৃষ্ঠা-৪২)

সাহাবাদের মধ্যে অনেকেই বিশেষ কিছু দোয়া করতেন, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো—

উমর ইবনুল খাত্তাব (রা.) দোয়া করতেন : হে আল্লাহ! আমাদের বেশি দান করো, আমাদের কম দিয়ো না, আমাদের সম্মান ও মর্যাদা দাও, আমাদের লাঞ্ছিত কোরো না, আমাদের দান করো, বঞ্চিত কোরো না, আমাদের অগ্রগামী করো, আমাদের ওপর অন্য কাউকে অগ্রগামী কোরো না, আমাদের সুপ্রসন্ন করো এবং আমাদের ওপর সুপ্রসন্ন থাকো। (আল মুসতাদরিক আলাস সহিহাইন, হাদিস : ১৯৮৫)

উসাইদ বিন আবি তালিব (রা.) দোয়া করতেন : হে আল্লাহ! আমাদের পরিণাম সব বিষয়ে সুন্দর করো এবং আমাদের দুনিয়ার লাঞ্ছনা ও পরকালের শাস্তি থেকে রক্ষা করো। (আল জামিউস সগির, হাদিস : ১৪৫০)

হুসাইন ইবনে আলী (রা.) দোয়া করতেন : হে আল্লাহ! তুমি যাদের সঠিক পথে পরিচালিত করেছ, আমাদেরও তাদের সঙ্গে হেদায়াত দাও। তুমি যাদের নিরাপদে রেখেছ, আমাদেরও নিরাপদ রাখো। তুমি যাদের অভিভাবকত্ব গ্রহণ করেছ, আমাদেরও গ্রহণ করো। তুমি আমাদের যা দান করেছ, তাতে বরকত দাও।

তুমি যা ফয়সালা করেছ, তার অনিষ্ট থেকে আমাদের রক্ষা করো। তুমি ফয়সালা করো, কিন্তু তোমার বিরুদ্ধে কেউ ফয়সালা করতে পারে না। তুমি যার বন্ধু, সে কখনো লাঞ্ছিত হয় না। তুমি বরকতময়, তুমি মহান। (সহিহ ইবনে হিব্বান, হাদিস : ৭২২, আল ফিরদাউস বিমাসুরিল খিতাব, পৃষ্ঠা-৪৮৩)

শাবান মাসে নফল রোজার অভ্যাস

সাহাবায়ে কিরামের প্রস্তুতির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল শাবান মাসে বেশি বেশি নফল রোজা রাখা। শাবান ছিল রমজানের এক অনন্য প্রস্তুতি পর্ব, যেখানে রোজা, কোরআন তিলাওয়াত এবং অন্যান্য নেক আমলের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হতো। এই অভ্যাস তাদের রমজানের ইবাদতের জন্য মানসিক ও শারীরিকভাবে প্রস্তুত হতে সহায়তা করত। (নিদাউর রাইয়ান ফি ফিকহিস সওম ওয়া ফাজলি রমাজান, খণ্ড-১, পৃষ্ঠা-৪৭৯)

নবী করিম (সা.) শাবান মাসে অধিক পরিমাণে রোজা রাখতেন। বলা হয়, এর কারণ হলো—এই মাসে মানুষ সাধারণত রোজার ব্যাপারে গাফিলতি করে। নবী করিম (সা.) স্বয়ং এ সম্পর্কে বলেছেন : এটি এমন একটি মাস, যা রজব ও রমজানের মধ্যবর্তী হওয়ায় অনেক মানুষ এর ব্যাপারে গাফেল থাকে। অথচ এটি এমন এক মাস, যখন মানুষের আমলসমূহ আল্লাহর দরবারে পেশ করা হয়। আমি চাই যে আমার আমল যখন আল্লাহর দরবারে পেশ করা হবে, তখন আমি রোজাদার থাকি। (সুনানে নাসাঈ, হাদিস : ২৩৫৭)

উম্মুল মুমিনিন আয়েশা (রা.) বর্ণনা করেন : আমি রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে শাবান মাসের চেয়ে বেশি কোনো মাসে রোজা রাখতে দেখিনি। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ১৯৭০)

সাহাবায়ে কিরামদের মধ্যে কেউ কেউ শাবানের রোজার প্রতি এতটাই গুরুত্ব দিতেন যে তারা রমজানের মতোই এ মাসের জন্য প্রস্তুতি নিতেন। যেমন—লুলুওয়াহ (রা.), যিনি আম্মার বিন ইয়াসির (রা.)-এর সেবিকা ছিলেন, বর্ণনা করেন, তিনি শাবান মাসের জন্য এমনভাবে প্রস্তুতি নিতেন, যেভাবে রমজানের জন্য প্রস্তুতি নেওয়া হয়। (আত-তাবসিরা, খণ্ড-২, পৃষ্ঠা-৪৭)

যেভাবে রমজানকে স্বাগত জানাব

মুসলমানদের জন্য রমজান মাসের আগমন এক মহা নিয়ামত, যা আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে এক বিশেষ দান। আল্লাহ তাঁর সে বান্দাকে কখনো ফিরিয়ে দেন না, যে অন্তর দিয়ে তাঁর দিকে ফিরে আসে এবং তাঁর সান্নিধ্য লাভের আকাঙ্ক্ষা করে। এটি স্পষ্ট হয় সেই ঘটনার আলোকে, যা আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণনা করেছেন—

একবার কুজাআ গোত্রের বালী গোত্রের দুই ব্যক্তি ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। তাঁদের একজন যুদ্ধক্ষেত্রে শহীদ হন, আর অন্যজন এক বছর পর ইন্তেকাল করেন। তালহা বিন উবাইদুল্লাহ (রা.) বলেন, আমি একবার স্বপ্নে জান্নাত দেখতে পেলাম এবং লক্ষ্য করলাম, যে ব্যক্তি পরে ইন্তেকাল করেছেন, তিনি শহীদের আগেই জান্নাতে প্রবেশ করেছেন! আমি এতে বিস্মিত হলাম। সকালে উঠে এ বিষয়ে নবী করিম (সা.)-এর কাছে বিষয়টি উপস্থাপন করলাম। রাসুলুল্লাহ (সা.) জিজ্ঞাসা করলেন, সে কি পরের বছর রমজান মাস পেয়েছিল না? সে কি ছয় হাজারেরও বেশি রাকাত নামাজ আদায় করেনি কিংবা আরো কিছু? (মুসনাদে আহমদ, হাদিস : ৮৩৯৯)

এই ঘটনা প্রমাণ করে যে রমজান মাস পাওয়া এবং তাতে ইবাদত-বন্দেগিতে নিমগ্ন থাকা কত বড় সৌভাগ্যের বিষয়। তাই যে ব্যক্তি সত্যিই রমজান মাসকে যথাযথভাবে পালনের জন্য প্রস্তুতি নিতে চায়, তার কিছু করণীয় হলো—

১. অন্তরে রমজান পালনের আগ্রহ ও ভালোবাসা সৃষ্টি করা। ২. বেশি বেশি নেক আমল করা, যেন রমজানে ইবাদতের জন্য আত্মা ও শরীর প্রস্তুত থাকে।

৩. কোরআন তিলাওয়াত, নফল নামাজ ও দোয়ার মাধ্যমে আত্মশুদ্ধির প্রচেষ্টা চালানো।

৪. অতীতের গুনাহের জন্য আল্লাহর দরবারে খাঁটি তাওবা করা।

৫. দরিদ্র ও অভাবীদের প্রতি সহানুভূতি দেখানো এবং দান-সদকার অভ্যাস গড়ে তোলা।

এভাবেই একজন মুসলিম রমজানের আগমনকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানাতে পারে এবং এ মাসের প্রতিটি মুহূর্ত কল্যাণময় করে তুলতে পারে। আল্লাহ তাআলা আমাদের রমজানকে স্বাগত জানিয়ে তাতে বেশি বেশি ইবাদত করার তাওফিক দান করুন। আমিন।

মন্তব্য
প্রশ্ন-উত্তর

দোয়া কুনুত না পড়ে রুকুতে গেলে কী করব?

ইসলামী জীবন ডেস্ক
ইসলামী জীবন ডেস্ক
শেয়ার
দোয়া কুনুত না পড়ে রুকুতে গেলে কী করব?
প্রতীকী ছবি

প্রশ্ন : দোয়ায়ে কুনুত না পড়ে রুকুতে চলে গেলে আবার দোয়ায়ে কুনুত পড়ার জন্য দাঁড়ানোর বিধান কী?

-ইশতিয়াক, সিলেট

উত্তর : দোয়ায়ে কুনুত না পড়ে রুকুতে চলে গেলে আবার দোয়ায়ে কুনুত পড়ার জন্য দাঁড়াবে না। যদি দাঁড়িয়ে যায় এবং কুনুত পড়ে তাহলে দ্বিতীয়বার রুকু না করে সিজদায় চলে যাবে এবং শেষে সিজদায়ে সাহু করে নেবে। (রদ্দুল মুহতার : ২/৮১, আহসানুল ফাতাওয়া : ৪/২৩, ফাতাওয়ায়ে ফকীহুল মিল্লাত : ৪/৪৬৬)

প্রাসঙ্গিক
মন্তব্য
হাদিসের বাণী

মাকে পিঠে বহন করে কাবাঘর তাওয়াফ

ইসলামী জীবন ডেস্ক
ইসলামী জীবন ডেস্ক
শেয়ার
মাকে পিঠে বহন করে কাবাঘর তাওয়াফ
ফাইল ছবি

আবু বুরদা (রহ.) বলেছেন, একদা তিনি আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা.)-এর সঙ্গে ছিলেন। তখন দেখা যায়, ইয়েমেনের এক ব্যক্তি তার মাকে পিঠে বহন করে বায়তুল্লাহ তাওয়াফ করছিল। আর বলছিল, ‘আমি তার জন্য তার অনুগত উটের মতো এবং আমি তার পাদানিতে আঘাত পেলেও তা সহ্য করি।’

অতঃপর তিনি ইবনে উমর (রা.)-কে বললেন, আপনি কি মনে করেন, আমি আমার মায়ের প্রতিদান দিতে পেরেছি? তিনি বললেন, ‘না।

‍তুমি তার একটি শ্বাসের প্রতিদানও দাওনি।’

অতঃপর ইবনে উমর (রা.) তাওয়াফ করলেন। তিনি মাকামে ইবরাহিমে পৌঁছে দুই রাকাত নামাজ পড়ার পর বললেন, ‘হে আবু মুসার সন্তান, প্রতি দুই রাকাত নামাজ আগের গুনাহের কাফফারা।’ (আল-আদাবুল মুফরাদ, হাদিস : ১২)

মন্তব্য

সর্বশেষ সংবাদ