<p>সিগারেট প্যাকেটের গায়ে আমদানীকৃত অবৈধ ব্যান্ডরোল বা ট্যাক্স স্ট্যাম্প ব্যবহার করে শুল্ক ফাঁকি দিচ্ছে অসাধু উৎপাদনকারী ও ব্যবসায়ীরা। এতে প্রতিবছর বড় অঙ্কের রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার। পাশাপাশি নকল ব্যান্ডরোল ব্যবহারের মাধ্যমে নিম্নমানের সিগারেট বিক্রি করায় বাড়ছে স্বাস্থ্যঝুঁকিও। ব্যান্ডরোলের অবৈধ ব্যবহার বন্ধ করা গেলে সরকারের তামাক খাত থেকে রাজস্ব বাড়ার পাশাপাশি ধূমপায়ীর সংখ্যাও কমবে বলে আশা করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।</p> <p>কর আদায়ে স্ট্যাম্প ও ব্যান্ডরোলের নকল ও অবৈধ ব্যবহারে প্রতিবছর দুই হাজার কোটি টাকার বেশি রাজস্ব হারাচ্ছে বলে বিভিন্ন গবেষণায় উঠে এসেছে। বাংলাদেশ নেটওয়ার্ক ফর টোব্যাকো ট্যাক্স পলিসি (বিএনটিটিপি) ও ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির টোব্যাকো কন্ট্রোল অ্যান্ড রিসার্চ সেলের গবেষণায়ও রাজস্ব ফাঁকির এই তথ্য উঠে আসে।</p> <p>সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, সরকারের রাজস্বের সবচেয়ে বড় উৎস সিগারেট খাত, যেখান থেকে গত অর্থবছরে এসেছে প্রায় ২৮ হাজার কোটি টাকা, যা পুরো রাজস্ব আয়ের প্রায় ১১ শতাংশ এবং ভ্যাট থেকে পাওয়া রাজস্বের এক-তৃতীয়াংশ। বাংলাদেশে সিগারেটের মূল্য এবং করহার গড়ে ৭৭ শতাংশ। এই করের মধ্যে আছে সম্পূরক শুল্ক, মূল্য সংযোজন কর ও হেলথ সারচার্জ। ব্যান্ডরোল ব্যবহার করে নিম্নমানের সিগারেট প্রত্যন্ত এলাকায় সরকার নির্ধারিত মূল্যের থেকেও অনেক কম দামে বিক্রি করা হচ্ছে। এতে একদিকে যেমন রাজস্ব বঞ্চিত হচ্ছে সরকার, অন্যদিকে স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ছে। অন্যদিকে বেশি মুনাফার আশায় দেশে অবৈধ ব্যান্ডরোলের ব্যবহার বাড়ছে। নিম্নস্তরের প্রতি ১০ শলাকার প্যাকেটের দাম সর্বনিম্ন নির্ধারণ করা হয়েছে ৩৯ টাকা, এতে সর্বমোট ৭৩ শতাংশ কর আদায় করে সরকার পায় ২৮.৪৭ টাকা। কিন্তু ব্যান্ডরোল বা ট্যাক্স স্ট্যাম্প নকল করে কেউ যদি সিগারেট বাজারজাত করে, তাহলে বাজারজাতকারীর এই ২৮.৪৭ টাকা পুরোটাই লাভ। তাঁদের মতে, প্রতিবছর বাজেটে সিগারেটের দাম বাড়ে। এর সুযোগে বাড়ে অবৈধ সিগারেটের বাজার। করোনা মহামারির আগে এই ধরনের ১০-১২টি কারখানা ছিল, যা এখন ২৫টির বেশি। এই ধরনের অসাধু ব্যবসায়ীরা রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে স্থানীয়ভাবে অবৈধ সিগারেট উৎপাদন করছে এবং বিক্রির জন্য প্রত্যন্ত অঞ্চল বেছে নিচ্ছে। কারণ সেখানে নজরদারি কম। ব্যবসায়ীরা বাজার থেকে বিভিন্ন লোভনীয় প্রস্তাব দিয়ে পুরনো প্যাকেট থেকে ট্যাক্স স্ট্যাম্প সংগ্রহ করে ফের ব্যবহার করে, এ ছাড়া উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে ব্যান্ডরোল বা ট্যাক্স স্ট্যাম্প নকল করে সিগারেট বাজারজাত করে।</p> <p>ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির টোব্যাকো কন্ট্রোল অ্যান্ড রিসার্চ সেলের প্রকল্প পরিচালক ও সহযোগী অধ্যাপক বজলুল রহমান বলেন, নিম্ন ও মধ্যম স্তরের সিগারেটে নকল ব্যান্ডরোলের ব্যবহার সবচেয়ে বেশি। আর এমন পণ্য কিছুদিন বাদে নাম পাল্টায়। দেখা যায়, প্রত্যন্ত একটি এলাকায় কয়েক বছর ব্যবসা করল একটি নামে। অভিযান এড়াতে নাম পাল্টে দ্রুত সেখান থেকে আবার অন্যত্র চলে যাবে। দেশে সর্বনিম্ন ১০ শলাকার এক প্যাকেট সিগারেটের দাম ৩৯ টাকা নির্ধারিত। কিন্তু বাজার তদারকি করে দেখা যায়, এ বাজারগুলোতে ২০ থেকে ২৫ টাকায় এক প্যাকেট সিগারেট পাওয়া যাচ্ছে, যেখানে ভোক্তারা মাত্র ২ টাকা বা আড়াই টাকা দিয়েই এক শলাকা সিগারেট পাচ্ছে।</p> <p>গত ১০ বছরে নিম্নস্তরের সিগারেটের মূল্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, এই স্তরের মূল্য প্রায় ৪০০ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে এবং এতে করে অবৈধ সিগারেটের ব্যবসা রমরমা হচ্ছে। সম্প্রতি চট্টগ্রাম বন্দরে কাস্টম হাউসের একটি বিশেষ দল মিথ্যা ঘোষণায় এ-৪ পেপার স্টেশনারি কাগজ’ ঘোষণায় জাল ব্যান্ডরোল খালাসকালে একটি পণ্য চালান আটক করে দুই কনটেইনার অবৈধ নকল ব্যান্ডরোল আটক করেছে, চীন থেকে এসব নকল ব্যান্ডরোল এনে প্রায় ১৪৩ কোটি টাকা রাজস্ব ফাঁকি দেওয়ার চেষ্টা করেছে আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান। পরবর্তী সময়ে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ আমদানিকারকের নামে বিভাগীয় মামলা করে, যা নিয়ে বিভিন্ন তদন্ত কর্তৃপক্ষ কাজ করছে।</p> <p>খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করছেন, শুধু এনফোর্সমেন্টই যথেষ্ট নয়, সামঞ্জস্যপূর্ণ করনীতি জরুরি। ২০১৮-১৯ এবং ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেটে যখন নিম্ন ও মধ্যম স্তরের সিগারেটের খুচরা পর্যায়ে মূল্য তিন টাকা থেকে চার টাকা এবং পাঁচ থেকে সাত টাকায় চলে যায় তখন থেকে বাজারে অবৈধ সিগারেট আসা শুরু হয়। ওই অর্থবছরের বাজেট ঘোষণায় মধ্যম স্তরের সিগারেটের দাম বাড়ানোর ফলে ভোক্তারা মধ্যম স্তর থেকে নিম্ন স্তরে এবং কম দামি অবৈধ সিগারেটের দিকে ঝুঁকে পড়ে। তবে এনবিআর চেয়ারম্যান ২০২১-২২ অর্থবছরে রাজস্ব আহরণের কথা বিবেচনা করে তামাকপণ্যের ওপর সুচিন্তিত করনীতি আরোপ করেন।</p>