<p style="text-align: justify;">রাজধানীর মিরপুর ১৩ নম্বর সেকশন এলাকার বাসিন্দা সুমাইয়া ইসলাম লিপির বড় ভাই মো. রনি ১৪ বছর ধরে সৌদি আরবে কাজ করছেন। দেশটি থেকে বোন লিপির মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস (এমএফএস) বিকাশের ব্যক্তিগত হিসাব নম্বরে চলতি বছরের মে, জুন ও জুলাই মাসে মোট ২৪ বার ট্রানজেকশনের (লেনদেন) মাধ্যমে এক লাখ ৬১ হাজার ১২০ টাকা পাঠিয়েছেন রনি। আর এই পুরো টাকাই তিনি পাঠিয়েছেন ডিজিটাল হুন্ডির মাধ্যমে। বৈধভাবে ব্যাংকিং চ্যানেলে টাকা পাঠানো জটিল বলে ভাই ডিজিটাল হুন্ডিতে টাকা পাঠান বলে জানান লিপি।</p> <p style="text-align: justify;">গত শুক্রবার তিনি সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, ‘কয়েক বছর ধরে অল্প পরিমাণ টাকা হলে ভাইয়া আমার বিকাশ নম্বরে পাঠান। হুন্ডি কী তা আমরা জানি না। বিদেশ থেকে ব্যাংকের মাধ্যমে দেশে টাকা পাঠানো জটিল। সরকারের উচিত, এসব জটিলতা দূর করা। তাহলে সবাই ব্যাংকের মাধ্যমে বৈধভাবে দেশে টাকা পাঠাবে।’</p> <p style="text-align: justify;">রাজধানীর উত্তরার বাসিন্দা সোনিয়া বেগমের স্বামী ১০ বছর ধরে সৌদি আরবে থাকেন। সেখান থেকে চলতি বছরের মে, জুন ও জুলাই মাসে সোনিয়ার ব্যক্তিগত বিকাশ হিসাব নম্বরে তার স্বামী মোট দুই লাখ ২২ হাজার টাকা পাঠিয়েছেন। সোনিয়া তার স্বামীর বরাতে জানিয়েছেন, ব্যাংকের মাধ্যমে দেশে টাকা পাঠানোর প্রক্রিয়া জটিল। তাৎক্ষণিক টাকা আসে না। এ জন্য জরুরি প্রয়োজন হলে বিকাশে টাকা পাঠান তার স্বামী। আর টাকার পরিমাণ বেশি হলে ব্যাংকের মাধ্যমে পাঠান।</p> <p style="text-align: justify;">শুধু লিপির ভাই বা সোনিয়ার স্বামী নন, এভাবেই লাখ লাখ প্রবাসী ডিজিটাল হুন্ডির মাধ্যমে দেশে স্বজনদের কাছে টাকা পাঠাচ্ছেন। ফলে সরকার হারাচ্ছে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা (রেমিট্যান্স)।</p> <p style="text-align: justify;">তবে প্রবাসীদের স্বজনদের দাবি, তারা হুন্ডি কী, তা বোঝেন না। ব্যাংকের মাধ্যমে দেশে টাকা পাঠানো ঝামেলা ও সময়সাপেক্ষ হওয়ায় এমএফএসের মাধ্যমে টাকা পাঠাচ্ছেন প্রবাসীরা। আর এজেন্টদের হুন্ডি কারবারে জড়ানোর বিষয়ে এমএফএস প্রতিষ্ঠানগুলোর দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা বলছেন, কোনো লেনদেন সন্দেহজনক মনে হলে এবং কোনো হিসাব নম্বরের কার্যবিধি সন্দেহজনক মনে হলে, সেগুলো সম্পর্কে বাংলাদেশ আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিটে (বিএফআইইউ) নিয়মিত দুটি প্রতিবেদন দেন তারা। যে তদন্তগুলো হয় তা মূলত তাদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতেই।</p> <p style="text-align: justify;">পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) ফিন্যান্সিয়াল ক্রাইম ইউনিটের কর্মকর্তারা বলছেন, অবৈধ হুন্ডি কারবারে এমএফএস প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করা হচ্ছে। মূলত তিনটি গ্রুপে ভাগ হয়ে কাজটি করে থাকে চক্রগুলো। প্রথম গ্রুপ বিদেশে অবস্থান করে প্রথমে প্রবাসীদের কাছ থেকে বৈদেশিক মুদ্রা সংগ্রহ করে। এরপর দেশ থেকে যারা টাকা পাচার করতে চায়, তাদের দেয়। দ্বিতীয় গ্রুপ পাচারকারী বা তার সহযোগীর কাছ থেকে দেশীয় মুদ্রায় ওই অর্থ সংগ্রহ করে এমএফএস এজেন্টকে দেয়।</p> <p style="text-align: justify;">সবশেষে তৃতীয় গ্রুপ এমএফএস এজেন্টের মাধ্যমে প্রবাসীর কাছ থেকে পাওয়া নম্বরে সেই অর্থ দেশীয় মুদ্রায় পরিশোধ করে। এর বিনিময়ে ওই সব এজেন্ট বড় অঙ্কের কমিশন পাচ্ছে, যা মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে দণ্ডনীয় অপরাধ। প্রাথমিক পর্যায়ে এমএফএস সেবা বিকাশ, নগদ, রকেট ও উপায়-এর এজেন্টরা এই অবৈধ হুন্ডি কারবারে জড়িত বলে চিহ্নিত করা হয়েছে।</p> <p style="text-align: justify;">সিআইডির হিসাবে শুধু হুন্ডির কারণে এ বছরের মে, জুন, জুলাই ও আগস্ট মাসে ২৫ হাজার কোটি টাকার রেমিট্যান্স (বৈদেশিক মুদ্রা) থেকে বঞ্চিত হয়েছে দেশ। আর একই কারণে এক বছরে প্রায় সাত দশমিক আট বিলিয়ন ডলার বা ৭৫ হাজার কোটি টাকা দেশেই আসেনি।</p> <p style="text-align: justify;">রাজধানীর খিলগাঁওয়ের বিকাশ এজেন্ট ‘এসএম মনি মুক্তা ট্রেডার্স’-এর এজেন্ট হিসাব নম্বরে চলতি বছরের এপ্রিল থেকে জুলাই মাসে ছয় হাজার ৪৭৯টি ট্রানজেকশনের মাধ্যমে পাঁচ কোটি ৩৯ লাখ ৬৬ হাজার ২৫৩ টাকা ‘ক্যাশ ইন’ হয়। একই এলাকার বিকাশ এজেন্ট ‘সানজিদা এন্টারপ্রাইজ’ ও ‘আকরাম ফার্মেসি’র এজেন্ট হিসাব নম্বরে ওই চার মাসে মোট ছয় কোটি ৫৮ লাখ চার হাজার ৪৩৮ টাকা ‘ক্যাশ ইন’ করা হয়। এ তিনটি প্রতিষ্ঠানেরই মালিক কুমিল্লার মুরাদনগরের মো. আব্দুল বাছির। তিনি এই টাকার অধিকাংশই প্রবাসে অবস্থানরত বাংলাদেশিদের আত্মীয়স্বজনদের বিকাশ হিসাবে ক্যাশ ইন করেছেন।</p> <p style="text-align: justify;">চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশের (সিএমপি) কোতোয়ালি থানা এলাকার বিকাশ এজেন্ট ‘জয় কম্পিউটার’-এর এজেন্ট হিসাব নম্বরে গত এপ্রিল থেকে আগস্ট মাস পর্যন্ত সাত হাজার ৮২৫টি ট্রানজেকশনের মাধ্যমে ছয় কোটি ছয় লাখ ২৪ হাজার ৮৫৪ টাকা ক্যাশ ইন করা হয়। প্রতিষ্ঠানের মালিক রূপণ কান্তি দাস জয়। এই এজেন্ট নম্বরটির অধিকাংশ ক্যাশ ইন করা হয় প্রবাসে অবস্থানরত বাংলাদেশিদের আত্মীয়স্বজনদের বিকাশ হিসাবে।</p> <p style="text-align: justify;">আব্দুল বাছির ও রূপণ কান্তি দাসের মতোই রাজধানীর গুলশান থানা এলাকার শাহজাদপুরের আবুল হাসান নামে এক বিকাশ এজেন্টের ‘নাবিল কালেকশন’-এর হিসাব থেকে তিন মাসে ছয় কোটি ৫৯ লাখ টাকা ক্যাশ ইন হয়েছে। আর মোহাম্মদপুরে ফজলে রাব্বি নামে আরেক বিকাশ এজেন্ট ‘রাব্বি টেলিকম’-এর হিসাব থেকে তিন মাসে ক্যাশ ইন হয়েছে ছয় কোটি ৫৬ লাখ টাকা। এসব টাকার অধিকাংশ প্রবাসীদের স্বজনদের হিসাবে ক্যাশ ইন হয়েছে। এসব ঘটনায় মানি লন্ডারিং (মুদ্রা পাচার) প্রতিরোধ আইনে আলাদা চারটি মামলা হয়েছে। মামলায় ৪৩ জনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাতপরিচয় ৪৪ জনকে আসামি করা হয়েছে। তাদের মধ্যে গ্রেপ্তার হয়েছেন ১৭ জন।</p> <p style="text-align: justify;">সিআইডির কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এমএফএস প্রতিষ্ঠানের পাঁচ হাজারেরও বেশি এজেন্ট হিসাবের সন্ধান পেয়েছে সিআইডির সাইবার ইন্টেলিজেন্স। এসব হিসাব থেকে অবৈধভাবে লেনদেন হচ্ছে। কয়েকটি চক্র অবৈধভাবে মোবাইল ব্যাংকিং সার্ভিস ব্যবহার করে ক্যাশ ইনের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা পাচার করছে। এজেন্টদের সহযোগিতায় অর্থ পাচারকারীরা বিদেশে স্থায়ী সম্পদ গড়াসহ অনলাইন জুয়া, মাদক কেনাবেচা, স্বর্ণ চোরাচালান, ইয়াবার কারবারসহ বিভিন্ন অবৈধ কারবার চালিয়ে আসছে।</p> <p style="text-align: justify;">বিএফআইইউর তদন্তের বরাত দিয়ে সিআইডির কর্মকর্তারা বলছেন, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, সিঙ্গাপুরসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বসবাসকারী প্রবাসীদের টাকা ডিজিটাল হুন্ডির মাধ্যমে দেশে আসার তথ্য উঠে এসেছে। এসব এমএফএস নম্বরের বেশির ভাগই বিকাশ, নগদ, রকেট ও উপায়ের নামে নিবন্ধিত।</p> <p style="text-align: justify;">এ প্রসঙ্গে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) ফিন্যান্সিয়াল ক্রাইম ইউনিটের বিশেষ পুলিশ সুপার (এসএসপি) মো. হুমায়ুন কবির বলেন, ‘হুন্ডি দেশের রিজার্ভের (বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ) জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সিআইডি হুন্ডি কার্যক্রম ঠেকাতে কাজ করে যাচ্ছে। হুন্ডি ঠেকানো গেলে দেশের রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়বে।’ ডিজিটাল হুন্ডির কারবারে জড়িত পাঁচ হাজার এমএফএস এজেন্টের বিষয়ে সিআইডি অনুসন্ধান করছে বলেও জানান এই পুলিশ কর্মকর্তা।</p> <p style="text-align: justify;">দেশে সবচেয়ে বেশি এমএফএস এজেন্ট রয়েছে বিকাশের। ডিজিটাল হুন্ডিতে এমএফএস এজেন্টদের জড়িত থাকার অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে বিকাশের হেড অব করপোরেট কমিউনিকেশনস শামসুদ্দিন হায়দার ডালিম সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, ‘আমাদের তিন লাখ এজেন্ট রয়েছে। যাদের বিরুদ্ধে এ ধরনের অবৈধ লেনদেনের অভিযোগ প্রমাণ হয়, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়। এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া।’</p> <p style="text-align: justify;">ডালিম আরো বলেন, ‘হুন্ডি আগেও ছিল। তবে তখন বাড়িতে গিয়ে টাকা পৌঁছে দিত। আর এখন টাকা পাঠিয়ে দিতে এজেন্টদের ব্যবহার করছে।’</p>