<p>দেশের আর্থ-সামাজিক ও অবকাঠামো উন্নয়নে বিভিন্ন প্রকল্পে অর্থায়ন করে বিশেষ ভূমিকা রাখছে উন্নয়ন সহযোগীরা। বিদায়ি ২০২৩-২৪ অর্থবছরে সর্বোচ্চ ঋণ ছাড় করে দেশের পাশে ছিল বিশ্বব্যাংক। সদ্যোবিদায়ি ২০২৩-২৪ অর্থবছরে (জুলাই-জুন) ২১৫ কোটি ৪০ লাখ ডলার ছাড় করেছে তারা। বৈদেশিক ঋণের হালনাগাদ পরিস্থিতি নিয়ে সরকারের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) তৈরি করা সর্বশেষ প্রতিবেদনে এ তথ্য পাওয়া গেছে।</p> <p>ইআরডির প্রতিবেদন অনুসারে, ঋণের অর্থছাড়ে দ্বিতীয় স্থানে আছে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি)। এশিয়া অঞ্চলের এই ঋণদাতা সংস্থাটি অর্থ ছাড় করেছে ২১৩ কোটি ৫৭ লাখ ডলার। তৃতীয় স্থানে থাকা জাপান ছাড় করেছে ১৯১ কোটি ৮০ লাখ ডলার। চতুর্থ ও পঞ্চম স্থানে আছে যথাক্রমে রাশিয়া ও চীন। এই দুটি দেশ ছাড় করেছে যথাক্রমে ১২৯ কোটি ৫৮ লাখ ডলার ও ৩৯ কোটি সাত লাখ ডলার।</p> <p>এ ছাড়া প্রতিবেশী ভারত এই তালিকায় ষষ্ঠ স্থানে রয়েছে। দেশটি অর্থ ছাড় করেছে ২৯ কোটি ৭৯ লাখ ডলার। এ ছাড়া এআইআইবি অর্থ ছাড় করেছে ৬৪ কোটি ৪২ লাখ ডলার এবং অন্যান্য দেশ ও সংস্থা মিলিয়ে এসেছে আরো ১০৫ কোটি ৩৮ লাখ ডলার।</p> <p>ইআরডির তথ্য বলছে, উন্নয়ন সহযোগী দেশ ও সংস্থাগুলো বিদায়ি অর্থবছরে ঋণর প্রতিশ্রুতি দিয়েছে ১০৭২ কোটি ৩৩ লাখ ডলার। আর ঋণ ছাড় হয়েছে ৯৮৯ কোটি ১৯ লাখ ডলার।</p> <p>এদিকে বিদেশি ঋণ পরিশোধে গত অর্থবছরে খরচ হয়েছে ৩৩৫ কোটি ৭২ লাখ ডলার বা ৩৭ হাজার ৩০৭ কোটি ১৩ লাখ টাকা, যার মধ্যে শুধু সুদ পরিশোধ করতে হয়েছে ১৩৪ কোটি ৭২ লাখ ডলার। আগের অর্থবছরের চেয়ে এবার ৬৮ কোটি ডলার বা ১০ হাজার ৫৩৫ কোটি টাকা বেশি ঋণ পরিশোধ করতে হয়েছে।</p> <p>গত অর্থবছরে শুধু সুদ পরিশোধ বেড়েছে ৪১ কোটি ডলার বা প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার কোটি টাকা।</p> <p>জানা গেছে, বাংলাদেশকে বাজারভিত্তিক ঋণের জন্য উচ্চ সুদ পরিশোধ করতে হচ্ছে। ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধ পরিস্থিতে সিকিউরড ওভারনাইট ফিন্যান্সিং রেট (এসওএফআর) বেড়েছে। বর্তমানে এসওএফআর ৫ শতাংশের বেশি, যা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ পরিস্থিতির আগে ১ শতাংশের কম ছিল। আবার বাংলাদেশের বাজারভিত্তিক ঋণও ক্রমে বাড়ছে। এ কারণে বাংলাদেশকে এখন সুদ বাবদ বেশি অর্থ পরিশোধ করতে হচ্ছে।</p> <p>অর্থনীতিবিদরা বলছেন, ঋণ ব্যবহার করে রিটার্ন যাতে সময়মতো পাওয়া যায়, সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে। আর বৈদেশিক ঋণ পরিশোধে তো বৈদেশিক মুদ্রাই লাগবে। তাই বৈদেশিক মুদ্রা আসার ক্ষেত্রে যাতে কোনো প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি না হয়, সে জন্য পলিসিগুলো ঠিক রাখা দরকার। বৈদেশিক মুদ্রা না এলে তো পরিশোধে চাপ পড়বেই।</p> <p>সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, বৈদেশিক ঋণের দায়ভার ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। এ সময়ে টাকার বিনিময়হারের বড় ধরনের অবনমন হয়েছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে। ফলে বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের দিক থেকে আমরা ত্রিমাত্রিক চাপে আছি। সামনে টাকার অবমূল্যায়ন অব্যাহত থাকলে বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের চাপ আরো বাড়বে। বেসরকারি খাতের পক্ষে বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ করা কিছুটা সহজ। কারণ বেসরকারি খাত রপ্তানি করে ডলার আয় করতে পারে এবং সেই অর্থ দিয়ে বৈদেশিক মুদ্রায় ঋণ পরিশোধ করতে পারে। কিন্তু সরকার বৈদেশিক ঋণ নিয়ে যেসব প্রকল্প বাস্তবায়ন করে, তার আয় হয় মূলত টাকায়। তাই মুদ্রার বিনিময়হারের অবনমন ঋণ পরিশোধের ক্ষেত্রে সরকারের জন্য বাড়তি চ্যালেঞ্জ তৈরি করে।</p> <p>ঋণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত সমস্যায় পড়েনি। কিন্তু বিকাশমান পরিস্থিতিকে বিবেচনায় নিয়ে প্রকল্প নির্বাচনে অধিকতর সতর্কতা ও বাস্তবায়নে সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে। অতি মূল্যায়িত প্রকল্প ও বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে দীর্ঘসূত্রতা প্রকল্পের ব্যয় বৃদ্ধি করে। তাতে ঋণের খরচ বেড়ে যায়।</p> <p>ইআরডির তথ্যে দেখা যায়, ঋণদানে বিশ্বব্যাংক এগিয়ে থাকলেও বিদেশি সহায়তার প্রতিশ্রুতিতে এবার শীর্ষে আছে এডিবি। সংস্থাটি গত অর্থবছরে ২৯৪ কোটি ১২ লাখ ডলার ঋণ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। এ ছাড়া বিশ্বব্যাংক প্রতিশ্রুতি দিয়েছে ২৬১ কোটি ৮০ লাখ ডলার, জাপান প্রতিশ্রুতি দিয়েছে ২০৩ কোটি ৯১ লাখ ডলার আর এআইআইবি প্রতিশ্রুতি দিয়েছে ৪০ কোটি ডলারের। তবে গত অর্থবছরে কোনো ঋণের প্রতিশ্রুতি দেয়নি ভারত, চীন, রাশিয়া ও এআইআইবি।</p> <p>পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আগে বিশ্বব্যাংক-এডিবি থেকে আমরা ফিক্সড রেটে ঋণ পেতাম। এখন সেটা কমছে, যার কারণে আমাদের বাজারভিত্তিক সুদহারের ঋণ নিতে হচ্ছে। এই ঋণের কারণে শুধু সুদ পরিশোধের চাপ বাড়বে না; একই সঙ্গে আসল পরিশোধেও চাপ বাড়বে। কারণ বাজারভিত্তিক সুদহারের ঋণ পরিশোধের সময় কম থাকে। এই অবস্থায় বাজারভিত্তিক সুদহারের ঋণ নেওয়ার ক্ষেত্রে সরকারকে সতর্ক হতে হবে। যেসব প্রকল্পে রিটার্ন আসবে না, সেসব প্রকল্প না নেওয়াই ভালো।’</p>