বাংলাদেশের দুর্বল অর্থনীতি রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর আরো আশঙ্কাজনক অবস্থায় আছে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আসছে না। বরং যে হার চলছে তা আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ধারণার চেয়েও অনেক বেশি। ব্যাংক খাতে সুশাসন ফেরানোসহ রাজস্ব আয় বাড়ানোর উদ্যোগেও চ্যালেঞ্জ রয়েছে।
এসবের প্রভাবে চলতি অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি কমে ৩.৮ শতাংশে এসে ঠেকবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে সংস্থাটি। তাদের মতে, অন্তর্বর্তী সরকার সফল না হলে তার প্রভাব পরবর্তী রাজনৈতিক সরকারের ওপর পড়বে। এসব আশঙ্কার কথা জানিয়েছেন আইএমএফের রিভিউ মিশন প্রধান ক্রিস পাপাজর্জিও। তবে তিনি জানান, এমন পরিস্থিতিতেও বাংলাদেশের জন্য চলমান ঋণ কর্মসূচির আওতায় চতুর্থ কিস্তিতে ৬৪ কোটি ৫০ লাখ ডলার আগামী বোর্ডসভায় ছাড় করবে সংস্থাটি।
আরো পড়ুন
ঢাকা ও আশপাশের এলাকায় যেমন থাকবে আবহাওয়া
গতকাল বৃহস্পতিবার অর্থ মন্ত্রণালয়ে সংবাদ সম্মেলনে চলমান ঋণের কিস্তি আর আর্থিক খাতের নানা প্রসঙ্গে সংস্থার পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেন আইএমএফ প্রতিনিধিদলের প্রধান। আর্থিক খাত পুনর্গঠনের রোডম্যাপ প্রণয়নসহ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বাধীনতা নিশ্চিতের গুরুত্ব তুলে ধরেন তিনি।
তবে এই আশঙ্কার সঙ্গে ভিন্নমত প্রকাশ করেছেন অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, আইএমএফের উদ্বেগ থাকলেও খুব একটা খারাপ নেই অর্থনীতি।
যদিও সংকট উত্তরণে রয়েছে চ্যালেঞ্জ। আইএমএফের কাছ থেকে অতিরিক্ত ৩০০ কোটি ডলার পাওয়ার আশাবাদও ছিল অর্থ উপদেষ্টার বক্তব্যে।
এসব নিয়ে কথা বলেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান। তিনি বলেন, সংস্থাটির পরামর্শ মতে জ্বালানিতে ভর্তুকির সংস্কৃতি থেকে বের হয়ে আসছে সরকার। নতুন করে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হবে না।
আরো পড়ুন
আজ ২০ ডিসেম্বর, দিনটি কেমন যাবে আপনার?
করোনাকালীন ২০১৯-২০ অর্থবছরে দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ছিল ৩.৫১ শতাংশ। সেটি ছিল একটি বিশেষ পরিস্থিতি। এর পর জিডিপি প্রবৃদ্ধি উন্নতি হয়েছে। কিন্তু চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জন্য বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস ৩.৮ শতাংশে নামিয়েছে আইএমএফ।
এর আগে গত অক্টোবরে সংস্থাটি প্রক্ষেপণ করেছিল প্রবৃদ্ধি সাড়ে ৪ শতাংশ হবে। এখন আইএমএফ জানায়, গণ-অভ্যুত্থান, বন্যা এবং কঠোর নীতির কারণে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে প্রকৃত জিডিপি প্রবৃদ্ধি কমে ৩.৮ শতাংশ হবে বলে অনুমান। তবে ২০২৫-২৬ অর্থবছরে তা ৬.৭ শতাংশে উঠবে বলে আশা করা হচ্ছে।
আরো পড়ুন
বাবরের রানে ফেরার রাতে সিরিজ পাকিস্তানের
আইএমএফ আরো অনুমান করছে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে দেশে মূল্যস্ফীতি বার্ষিক গড় হিসেবে প্রায় ১১ শতাংশ থাকবে। তবে কঠোর নীতি এবং সরবরাহের চাপ কমার ফলে ২০২৫-২৬ অর্থবছরে তা ৫ শতাংশে নেমে আসবে।
বাংলাদেশের বাজারে অব্যাহতভাবে খাদ্যমূল্য বৃদ্ধি ও নতুন টাকা ছাপিয়ে বাজারে ছাড়ার প্রভাব নিয়েও উদ্বেগ প্রকাশ করেছে আইএমএফ। এ জন্য অন্তর্বর্তী সরকারকে দ্রব্যমূল্য কমাতে কার্যকর উদ্যোগ নেওয়াসহ কর অব্যাহতি অপসারণ, অপ্রয়োজনীয় ব্যয়ের রাশ টেনে ধরা, মুদ্রা সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ, বিনিময় হার আরো নমনীয় এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ধরে রাখার পরামর্শ সংস্থাটির।
আরো পড়ুন
গুপ্ত হত্যা ও টার্গেট কিলিংয়ের প্রতিবাদে মানববন্ধন
ক্রিস পাপাজর্জিও বলেন, বাংলাদেশের বাজারে অব্যাহতভাবে খাদ্যমূল্য বাড়ছে, এ জন্য অন্তর্বর্তী সরকারকে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। সংস্থাটি মনে করে, মূল্যস্ফীতির চাপে বাংলাদেশের অর্থনীতি। এ জন্য প্রবৃদ্ধি কমবে। রাজস্ব আদায়ও কমেছে। রিজার্ভের অবস্থাও চাপের মুখে রয়েছে।
সরকার যে টাকা নতুন করে বাজারে ছেড়েছে সেটা দ্রুত বাজার থেকে তুলে নেবে বলে বাংলাদেশ ব্যাংক তাদের জানিয়েছে। তবে সেটা যদি না করে তাহলে মূল্যস্ফীতি আরো বাড়বে, যা দেশের সাধারণ মানুষের ভোগান্তি আরো বাড়াবে বলে মনে করে সংস্থাটি।
আইএমএফ বলছে, বাংলাদেশে কর রাজস্ব অনুপাত কম। তাই একটি স্বচ্ছ ও ন্যায্য রাজস্ব ব্যবস্থা গড়ে তুলতে জরুরি ভিত্তিতে রাজস্বসংক্রান্ত সংস্কার করতে হবে।
ব্যাংক খাতের দুর্বলতা দূর করার পরামর্শ দিয়ে আইএমএফ বলেছে, দ্রুত যেসব কাজ করতে হবে তার মধ্যে রয়েছে সঠিকভাবে খেলাপি ঋণ চিহ্নিত করা, বর্তমানে যেসব নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থা রয়েছে তার কার্যকর বাস্তবায়ন এবং আর্থিক খাতে পুনর্গঠনের জন্য একটি রোডম্যাপ বা পথনকশা তৈরি করা। আর্থিক খাতের সংস্কার কর্মসূচি সফলভাবে বাস্তবায়ন করতে বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বাধীনতা ও সুশাসন খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করে সংস্থাটি।
এ ছাড়া বিনিয়োগ পরিবেশ উন্নত করা, বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ানো এবং তৈরি পোশাকশিল্পের বাইরে রপ্তানি খাত আরো বৈচিত্র্যময় করতে স্বচ্ছতা নিশ্চিতের পাশাপাশি সুশাসন বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছে আইএমএফ। ঋণের চতুর্থ কিস্তি ছাড় ১০ ফেব্রুয়ারি চলমান ঋণ কর্মসূচির আওতায় আইএমএফ বাংলাদেশের জন্য চতুর্থ কিস্তিতে ৬৪ কোটি ৫০ লাখ ডলার ছাড় করতে আগামী ৫ ফেব্রুয়ারি সংস্থাটির নির্বাহী পর্ষদ বোর্ডসভায় উপস্থাপন করা হবে। বোর্ডে অনুমোদন হলে ১০ ফেব্রুয়ারি তা ছাড় করা হবে বলে জানিয়েছেন ক্রিস পাপাজর্জিও।
আরো পড়ুন
গবেষকরা নাকাল কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার চাহিদা মেটাতে
তবে চলমান ঋণের বাইরে আইএমএফের কাছে অতিরিক্ত ৩০০ কোটি ডলার চেয়েছিল বাংলাদেশ। সংস্থাটির প্রতিনিধিদলের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠকের পর শেষ পর্যন্ত মাত্র পৌনে এক বিলিয়ন (৭৫ কোটি) ডলারের চুক্তি হয়েছে। একই সঙ্গে চলমান ঋণের চতুর্থ কিস্তির অঙ্ক আগের কিস্তির চেয়ে প্রায় অর্ধেকে নেমেছে। যদিও এই কিস্তিতে অন্তত ১১০ কোটি ডলার ছাড় করার আবেদন করেছিল সরকার।
সূত্রে জানা গেছে, খেলাপি ঋণসহ বিভিন্ন আর্থিক তথ্য গোপন করে সূচকের উন্নতি এবং কঠিন শর্ত মেনে আইএমএফ থেকে ঋণ নিচ্ছিল ক্ষমতা হারানো আওয়ামী লীগ সরকার। তবে ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার এই নীতি থেকে সড়ে এসেছে। আর্থিক সূচক খারাপ হবে এটা জেনেও খেলাপি ঋণ, মূল্যস্ফীতি এবং ব্যালান্স অব পেমেন্টের প্রকৃত তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে। এতে সূচকগুলোতে ব্যাপক অবনতি হয়। আর আর্থিক সূচকের অবনতির কারণে ঋণে কঠোর শর্ত জুড়ে দেয় আইএমএফ। কঠিন শর্ত বিদ্যুৎ ও জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির মতো কঠিন শর্ত মানতে রাজি না হওয়ায় তিন বিলিয়নের ঋণ চুক্তি এক বিলিয়নের নিচে নেমে আসে।
২০২৩ সালের জানুয়ারিতে বাংলাদেশের জন্য ৪৭০ কোটি ডলার ঋণ অনুমোদন করে আইএমএফ। এ পর্যন্ত তিন কিস্তিতে ২৩০ কোটি ডলার ঋণ ছাড় করেছে সংস্থাটি। চতুর্থ কিস্তি ঋণ দেওয়ার আগে গত ৩ থেকে ১৮ ডিসেম্বর আইএমএফের ১৩ সদস্যের প্রতিনিধিদল বাংলাদেশ সফর করে। সফরে বাংলাদেশের পারফরম্যান্স ও বিদ্যমান ঋণের চতুর্থ কিস্তির কাঠামোগত সংস্কারের শর্ত পালন নিয়ে পর্যালোচনা করে দলটি।