বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে স্বর্ণকারদের বলা হয় স্যাকরা। এরা হলেন সেই কারিগর, যাঁরা সোনা, রুপা ও অন্যান্য মূল্যবান ধাতুর অলঙ্কার তৈরি করেন। তাঁদের তৈরি চুড়ি, বাজুবন্দ, হার, হাঁসুলি, সীতাপাট, দুল, কানপাশা, নোলক, নথ, নাকছাবি, মলসহ নানাবিধ গয়না আজও নারীদের সৌন্দর্য বৃদ্ধির অন্যতম অনুষঙ্গ।
স্যাকরাদের ইতিহাস হাজার বছরের পুরনো।
মরক্কোতে এক লাখ ৪২ হাজার থেকে এক লাখ ৫০ হাজার বছর আগের কিছু ঝিনুকের গয়না পাওয়া যায়। ধারণা করা হয়, এটি ছিল আদিম মানব সমাজের প্রথম অলংকার। আর প্রথম স্বর্ণের গহনা পাওয়া গেছে প্রায় ছয় হাজার বছর আগের মিসরীয় সভ্যতায়। স্যাকরারা সেখানে রাজপরিবার ও পুরোহিতদের জন্য বিশেষ অলংকার তৈরি করতেন।
ভারতে স্যাকরাদের উল্লেখ পাওয়া যায় বৈদিক যুগে (১৫০০ খ্রিস্টপূর্ব), যখন তাঁরা শুধু অলংকারই নয়, দেব-দেবীর মূর্তিও নির্মাণ করতেন।
ভারতে স্যাকরা সম্প্রদায় ঐতিহ্যগতভাবে স্বর্ণকার, শাঁখরা, সুবর্ণকার নামে পরিচিত। বাংলায় এই সম্প্রদায়কে চারটি অনুসম্প্রদায়ে ভাগ করা হয়েছে—ব্রাহ্মণদেশী, দক্ষিণ রাঢ়ি, খলঙ্গি ও উত্তর রাঢ়ি। শুধু গয়না তৈরি নয়, একজন স্যাকরা কাজ সোনার বিশুদ্ধতা যাচাই, নতুন ডিজাইন তৈরি ও পুরনো গয়নাকে নতুন করে গড়ার।
অনেক পরিবারে প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম এই পেশা চলে আসছে। তাঁদের মধ্যে কিছু গোপন কৌশল বা ডিজাইন পরম্পরাগতভাবে মুখে মুখে শেখানো হয়, সাধারণত যা বাইরের কেউ জানে না। প্রাচীনকালে স্বর্ণকাররা সোনার বিশুদ্ধতা পরীক্ষার জন্য সেটিকে দাঁতে কামড় দিতেন। কারণ খাঁটি সোনা নরম হয় এবং এতে কামড়ের দাগ পড়ে যায়। অনেকেই আবার শব্দ শুনে সোনার বিশুদ্ধতা বুঝতে পারেন।
এটি তাঁদের দীর্ঘ অভিজ্ঞতার ফল।
প্রাচীনকালে সোনার পাতের ওজন ও আকার ঠিক রাখার জন্য স্যাকরারা গণিত ব্যবহার করতেন, যা আজকের আধুনিক ইঞ্জিনিয়ারদের মতোই নিখুঁত ছিল। ইউরোপ ও এশিয়ার অনেক রাজসভায় স্যাকরাদের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হিসেবে গণ্য করা হতো। অনেক সময় শত্রুদের কাছে গোপন তথ্য পৌঁছে দিতে তাঁরা গুপ্তচরের ভূমিকাও পালন করতেন।
স্যাকরারা আমাদের ঐতিহ্যকে ধরে রাখেন। তাঁরা সোনার পাতের মধ্যে শিল্পের একটি অনন্য দৃষ্টিভঙ্গি স্থাপন করেন, যা শতাব্দী ধরে চলে আসছে।