<p>বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশ হওয়ার সাথে সাথে আগামীর কর্মসংস্থান নির্ভর করছে ডিজিটাল ট্রান্সফরমেশনের উপর। প্রযুক্তির কারণে বিশ্ব জুড়ে অর্থনীতিতে এসেছে ব্যপক পরিবর্তন, বাংলাদেশের প্রযুক্তি কাজে লাগাতে অনেক সুযোগ থাকলেও একইসাথে রয়েছে কিছু চ্যালেঞ্জও। বাংলাদেশের ডিজিটাল ট্রান্সফরমেশনকে ত্বরান্বিত করতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে প্রবাসী বাংলাদেশিরা। বিদেশে কর্মরত প্রবাসীদের অভিজ্ঞতা, জ্ঞান এবং তাদের উদ্ভাবনী চিন্তার বিস্তারের মাধ্যমে ডিজিটাল যুগের কর্মসংস্থান তৈরিতে সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারে।</p> <p><strong>প্রবাসী বিশেষজ্ঞদের ভূমিকা  </strong><br /> বাংলাদেশি যে প্রবাসীরা  উন্নত দেশগুলোতে বা ডিজিটাল অর্থনীতিতে কাজ করছে এবং যারা অত্যাধুনিক প্রযুক্তি, শিল্পখাত বিষয়ে অভিজ্ঞ তাদের জ্ঞানকে কাজে লাগালে দেশের ডিজিটাল বিকাশ আরও দ্রুত ঘটবে। যেমন, সিলিকন ভ্যালি, লন্ডনের প্রযুক্তি বা সিঙ্গাপুরের উদ্ভাবনী কেন্দ্রগুলোতে অনেক বাংলাদেশি বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত আছেন। নতুন সব আবিষ্কার অথবা আগামীর প্রযুক্তি সম্পর্কে এই প্রবাসীরা অনেক বেশি ধারণা রাখে। তাদের এই অভিজ্ঞতা দেশের জাতীয় শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ কর্মসূচি গঠনে সহায়ক হিসেবে বিবেচনা করা গেলে প্রবাসীদের সম্ভাবনা সম্পূর্ণরূপে প্রতিফলিত হবে। </p> <p>বৈশ্বিক মান এবং বর্তমান শিল্পখাতের চাহিদা অনুযায়ী শিক্ষাক্রম তৈরী করতে প্রবাসী বিশেষজ্ঞদের মতামত  নিলে ফলপ্রসূ হবে। যেখানে আর্টিফিশিয়াল ইনটেলিজেন্স, ব্লকচেইন এবং সাইবার সিকিউরিটির মতো প্রযুক্তিগত কোর্স অন্তর্ভুক্ত করা এই ডিজিটাল যুগে অত্যন্ত জরুরী। পাশাপাশি এমন একটি প্ল্যাটফর্ম তৈরি করা উচিত যেখানে স্থানীয় পেশাদার এবং শিক্ষার্থীদের কাছে প্রবাসীরা তাদের অভিজ্ঞতা এবং জ্ঞান তুলে ধরতে পারবে। এক্ষেত্রে পারস্পরিক অভিজ্ঞতা আলোচনা করার জন্য অনলাইন ওয়েবিনার, ভার্চুয়াল ওয়ার্কশপ এবং মেন্টরশিপ প্রোগ্রামগুলো সহায়ক হতে পারে। </p> <p>এছাড়া, চাকরির বাজারের চাহিদা অনুযায়ী প্রশিক্ষণ কর্মসূচি তৈরির জন্য সরকার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং বেসরকারী সংস্থাগুলোকে যৌথ উদ্যোগে কাজ করতে উৎসাহিত করতে হবে। শিক্ষার্থীদের ইন্টার্নশিপ এবং ব্যবহারিক প্রশিক্ষণের সুযোগগুলো এমন উদ্যোগের মাধ্যমে আরও সহজ হয়ে উঠতে পারে।</p> <p><strong>ভবিষ্যতের জন্য ডিজিটাল স্কিল</strong><br /> বিশ্বজুড়ে কর্মসংস্থানগুলোতে ভবিষ্যতের জন্য ডিজিটাল স্কিল বা দক্ষতার চাহিদা নিঃসন্দেহে অপরিহার্য। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের মতে, ২০২৫ সালের মধ্যে মানুষ এবং মেশিনের মধ্যে শ্রম বিভাজনের ফলে ৮৫ মিলিয়নেরও বেশি চাকরি চলে যেতে পারে। অন্যদিকে ৯৭ মিলিয়ন নতুন চাকরির প্রয়োজন উদ্ভূত হতে পারে যেখানে কর্মসংস্থান বিভাজিত হবে মানুষ, মেশিন এবং অ্যালগরিদম মধ্যে। তাই বাংলাদেশের কর্মীদের মধ্যে ডিজিটাল দক্ষতা গড়ে তোলা ছাড়া কোন বিকল্প নেই।</p> <p>বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর প্রতিবেদনে, ২০২১ সালের হিসাব অনুযায়ী বেকারত্বের হার ৪.২ শতাংশ এবং তরুণদের মধ্যে বেকারত্বের হার উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি। আধুনিক চাকরির বাজারের জন্য যেমন যোগ্যতা থাকা দরকার সেটি এই তরুণদের একটি বড় অংশের মধ্যেই নেই। এমন অবস্থায় প্রবাসীদের থেকে ডিজিটাল স্কিল সম্পর্কে প্রশিক্ষণ গ্রহণের মাধ্যমে এই ব্যবধান দূর করা যেতে পারে।</p> <p>নির্দিষ্ট কোন কাজের জন্য ডিজিটাল স্কিল অর্জনের পাশাপাশি, আমাদের দৈনন্দিন জীবনেও ডিজিটালাইজেশনকে যুক্ত করার অনেক উপায় আছে। যেমন অনলাইন যোগাযোগ, ডিজিটাল আর্থিক পরিষেবা, ই-পরিষেবা এবং ই-কমার্স। এর মধ্যে একটি ভাল দৃষ্টান্ত হলো ডিজিটাল পেমেন্ট সিস্টেমের ব্যবহার, যেটি প্রবাসীদের সাথে স্থানীয় মানুষদের যুক্ত করতে সহায়ক হচ্ছে। স্থানীয় ব্যাঙ্ক এবং মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস (এমএফএস) এর সহযোগিতায় 'ট্যাপট্যাপ সেন্ড "-এর মতো অর্থ স্থানান্তরের অ্যাপগুলো ডিজিটাল সেবা গ্রহণের সুযোগ তৈরি করছে। এ ধরনের একীভূতকরণ কেবল আর্থিক লেনদেনকেই সহজ করে না, বরং ডিজিটাল অর্থনীতিতে আধুনিক আর্থিক পরিষেবার ব্যবহার বৃদ্ধি করতেও অবদান রাখে।</p> <p><strong>উদ্ভাবন ও শিল্পোদ্যোগের প্রসার</strong><br /> বিদেশে অনেক বাংলাদেশি নিজেরা প্রযুক্তিগত প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেছেন বা উদ্ভাবনী স্টার্টআপের সাথে যুক্ত আছেন। আবার বাংলাদেশেও এখন অনেকে উদ্যোক্তা হচ্ছে যাদের পথপ্রদর্শনে এগিয়ে আসতে পারে অভিজ্ঞ প্রবাসীরা।  ডিজিটাল মার্কেটিংয়ে বিশেষজ্ঞ প্রবাসী খালিদ ফারহান তেমনি একটি উদাহরণ। তিনি দেশের বাইরে তার পেশার জন্য স্বীকৃত এবং ডিজিটাল মার্কেটিংয়ের দুনিয়ায় তার জ্ঞানের জন্য পরিচিত। ডিজিটাল স্ট্র্যাটেজি এবং অনলাইন ব্যবসায়িক মডেল সম্পর্কে তার ধারণা বৈশ্বিক পর্যায়ের মানস্বরূপ, যেটি তিনি তার কনটেন্ট এবং কোর্সগুলোর মাধ্যমে ছড়িয়ে দিচ্ছে বাংলাদেশের ফ্রিল্যান্সার, স্থানীয় প্রতিষ্ঠান, নতুন উদ্যোক্তা এবং ব্যবসাগুলোর কাছে।</p> <p>উদ্যোক্তাদের যাত্রা, সাফল্য এবং চ্যালেঞ্জগুলো তুলে ধরার জন্য কোন প্ল্যাটফর্ম তৈরি করতে পারলে তরুণসমাজ ডিজিটাল খাতগুলো সম্পর্কে আরও আগ্রহী হয়ে উঠবে যা পরবর্তীতে তাদের ক্যারিয়ার তৈরি করতে অনুপ্রাণিত করবে। প্রবাসীদের পরিচালনায় ওয়ার্কশপ, ওয়েবিনার এবং স্টার্টআপ ইনকিউবেটরগুলো দেশের উদ্যোক্তাদের জন্য জরুরী। কারণ এর মাধ্যমেই প্রবাসীরা তাদের অর্জিত তথ্য এবং দক্ষতার প্রয়োজন তুলে ধরতে পারে। এছাড়া, বিনিয়োগকারী বা পরামর্শক হিসাবেও প্রবাসীরা স্থানীয় স্টার্টআপগুলোর সাথে কাজ করতে পারেন।    </p> <p>একটি সমৃদ্ধ ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে, বাংলাদেশকে অবশ্যই এমন একটি কাঠামো তৈরি করতে হবে যা উদ্ভাবন এবং ডিজিটাল দক্ষতার বিকাশকে তরান্বিত করে। প্রবাসী বাংলাদেশিদের জাতীয় শিক্ষা কর্মসূচির সাথে যুক্ত করার মাধ্যমে এমন একটি কর্মশক্তি তৈরি হতে পারে যারা ডিজিটাল বিশ্বে নিজেদের স্বাবলম্বী করবে এবং সমগ্র দেশের ডিজিটাল অর্থনীতিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবে। বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ কর্মসংস্থান নির্ভর করবে ডিজিটাল খাত বা প্রযুক্তি উপর এবং প্রবাসীরা সেই সম্ভাবনার এখন চাবিকাঠিস্বরূপ।</p> <h5><strong>লেখক : একজন নৃবিজ্ঞানী ও ইতিহাস গবেষক</strong></h5>