দশম শতকের প্রথম ভাগে শ্রীহট্টের মৌলভীবাজারের জুড়ীতে (বর্তমানে উপজেলা) ‘চন্দ্রপুর বিশ্ববিদ্যালয়’ নামে একটি বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে ওঠে বলে অনেকে মনে করেন। সেখানে চতুর্বেদ, চান্দ্র ব্যাকরণ, হিন্দু শাস্ত্রবিদ্যা, হেতুবিদ্যা, চিকিৎসাশাস্ত্র, জ্যোতিষবিদ্যা, শল্যবিদ্যা, ধাতুবিদ্যা, শব্দবিদ্যাসহ নানা বিষয় পড়ানো হতো। সেই ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের’ পুরাকীর্তি অনুসন্ধানে আগামী সপ্তাহে জুড়ীতে আসছে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের একটি দল। বিশ্ববিদ্যালয়ের অস্তিত্ব থাকার বিষয়টি প্রমাণিত হলে এটি হবে পৃথিবীবিখ্যাত অক্সফোর্ড বা ক্যামব্রিজ থেকেও প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয়।
জুড়ীতে বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরাকীর্তি রয়েছে মর্মে কিছুদিন ধরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেকেই লেখালেখি করছেন। এই বিষয়ে সরেজমিন জরিপ ও পরিদর্শন প্রতিবেদন প্রয়োজন উল্লেখ করে সিলেট অঞ্চলের দায়িত্বপ্রাপ্ত চট্টগ্রাম ও কুমিল্লা প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের আঞ্চলিক পরিচালককে ১৫ জুলাই চিঠি দিয়েছেন প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. আমিরুজ্জামান।
জনশ্রুতি রয়েছে, জুড়ীতে এক বৌদ্ধ রাজার বসবাস ছিল। সেই চন্দ্র বংশীয় বৌদ্ধ রাজা শ্রীচন্দ্র আনুমানিক ৯৩৫ খ্রিস্টাব্দে জুড়ীর সাগরনাল গ্রামে ‘চন্দ্রপুর বিশ্ববিদ্যালয়’ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
শ্রীচন্দ্র এ জন্য ৪০০ পাটক জমি (এক পাটক=৫০ একর বা ১৫০ বিঘা) বিশ্ববিদ্যালয়ের নামে বরাদ্দ করেছিলেন। ড. রমেশ চন্দ্র মজুমদারের ‘বাংলাদেশের ইতিহাস’ গ্রন্থ মতে শ্রীচন্দ্রের শাসনামল ছিল ৯০৫-৯৫৫ সাল পর্যন্ত। তাঁর শাসন এলাকার মধ্যে ছিল মানিকগঞ্জ, ঢাকা, ফরিদপুরের পদ্মা তীরবর্তী এলাকা, শ্রীহট্ট অঞ্চল ও কুমিল্লা। যার রাজধানী ছিল বিক্রমপুর। মৌলভীবাজার জেলায় ১৯৬১ সালে একটি তাম্রশাসন (তামার পাতে লিখিত দলিল, রাজকীয় নির্দেশ খোদাই করে লেখা থাকত) আবিষ্কৃত হয়। যেটির তথ্য মতে, আনুমানিক ৯৩৫ খ্রিস্টাব্দে চন্দ্রপুর বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন রাজা শ্রীচন্দ্র।
প্রত্নতত্ত্ববিদ কমলাকান্ত গুপ্ত চৌধুরী তাঁর ‘Copper plates of Sylhet’ গ্রন্থে তাম্রশাসন সম্পর্কে আলোকপাত করতে গিয়ে এতদঞ্চলে চন্দ্রপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা উল্লেখ করেছেন। লেখক ও ব্যাংকার অমিতাভ পাল চৌধুরী এক প্রবন্ধে বিভিন্ন লেখককে উদ্ধৃত করে বলেছেন, শ্রীচন্দ্রের সাম্রাজ্য অনুসারে এতদঞ্চলে একটি বিশ্ববিদ্যালয় থাকার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। আবিষ্কৃত তাম্রশাসন অনুযায়ী খ্রিস্টীয় ১০ শতকের প্রথম ভাগে উত্তরে কুশিয়ারা নদী, দক্ষিণ ও পশ্চিমে মনু নদী এবং পূর্বে ইন্দেশরের পাহাড়ি অঞ্চল বা পাথরিয়া অঞ্চল এই সীমানার মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান ছিল।
জুড়ীর সাগরনাল ইউনিয়নের দীঘিরপার এলাকায় এটি ছিল বলে জোর ইঙ্গিত মেলে। কারণ এখানে কবর খুঁড়তে গেলে প্রাচীনকালে তৈরি বড় বড় ইটের টুকরা ও মাটির বাসন পাওয়া যায়। নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো এই চন্দ্রপুর বিশ্ববিদ্যালয়ও কোনো শাসকের রোষানলে পড়ে না অন্য কোনোভাবে ধ্বংস হয়েছিল তা জানা যায়নি। ভারতের বিহারের পাটনা জেলায় প্রত্নতাত্ত্বিক খননের ফলেই নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কৃত হয়েছে।
স্থানীয় বাসিন্দা ও স্কুলশিক্ষক মো. মিফতাহ্ আহমেদ রিটন জানান, চন্দ্রপুর বিশ্ববিদ্যালয়টি ৯৩৫ খ্রিস্টাব্দে স্থাপিত হয় বলে জনশ্রুতিতে জানা যায়। চন্দ্রবংশের রাজা শ্রীচন্দ্র এটি প্রতিষ্ঠা করেন। যেহেতু, এটি আমাদের গ্রামে হওয়ায় এখানে বিভিন্ন সময় মাটি খুঁড়াখুঁড়ি করলে মাটির নিচ থেকে অতীতে ব্যবহার্য তৈজসপত্র বাসন, হাড়ি ও ইট পাওয়া যায়। কালের বিবর্তনে এই এলাকার দীঘিটি ভরাট হয়ে গেছে। আমরা সরকারের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। এটি নিয়ে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করলে বেরিয়ে আসতে পারে বিশ্ববিদ্যালয়ের ধ্বংসাবশেষ এবং এলাকাটি একটি পর্যটন এলাকা হিসেবে রূপান্তরিত হবে বলে মনে করি।
সিলেট ও চট্টগ্রাম বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রত্মতত্ত্ব অধিদপ্তরের আঞ্চলিক পরিচালক ড. আতাউর রহমান রবিবার দুপুরে মুঠোফোনে কালের কণ্ঠকে বলেন, প্রত্মতত্ত্ব অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের নির্দেশ মতে আগামী সপ্তাহে একটি টিম নিয়ে সরেজমিন ওই এলাকায় মাঠ জরিপ করতে যাব। তদন্ত সাপেক্ষে বাস্তবে ওই স্থানে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো পুরাকীর্তি আছে কিনা সেটা খতিয়ে দেখা হবে এবং প্রতিবেদন ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নিকট জমা দেওয়া হবে। সেখানে যদি কিছু থেকে থাকে তাহলে আগামী শুষ্ক মৌসুমে খনন কাজ চালিয়ে চন্দ্রপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ধ্বংসাবশেষ অনুসন্ধান করা হবে।
জুড়ী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আল-ইমরান রুহল ইসলাম রবিবার দুপুরে কালের কণ্ঠকে বলেন, জুড়ীর সাগরনালে চন্দ্রপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অস্তিত্ব রয়েছে বলে স্থানীয়দের কাছ থেকে শুনেছি। এটা নিয়ে পূর্ববর্তী সময়ে অনেক লেখালেখি হয়েছে। ওই এলাকার যে স্থানে বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরাকীর্তি রয়েছে সেখানে খনন কাজের মাধ্যমে যদি এর অস্থিত্ব পাওয়া যায় তাহলে শুধু জুড়ী নয় এই মৌলভীবাজার অঞ্চলের জন্য নতুন একটি ইতিহাস রচিত হবে। এটার অনুসন্ধান কাজে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে সবধরণের সহযোগিতা করবে জুড়ী উপজেলা প্রশাসন।
জানতে চাইলে কথা হয় প্রত্মতত্ত্ব অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (অতিরিক্ত সচিব) মো. হান্নান মিয়ার সাথে। তিনি রবিবার দুপুরে মুঠোফোনে কালের কণ্ঠকে বলেন, আমরা বিভিন্ন সময় অনেক কিংবদন্তী বিষয়ের খবর পাই। তেমনিভাবে জুড়ীতে চন্দ্রপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরাকীর্তি রয়েছে বলে খবর পেয়েছি। আমাদের মন্ত্রণালয়ের মাননীয় মন্ত্রী মহোদয় বিষয়টি আমাকে জানানোর পর খুবই গুরুত্বের সঙ্গে বিষয়টি নিয়েছি। আমি আমার আঞ্চলিক পরিচালককে বিষয়টি সরেজমিন তদন্ত করে প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য চিঠি দিয়েছি। প্রাথমিকভাবে তথ্য সংগ্রহের জন্য একটি টিম পাটাচ্ছি।
তিনি আরো বলেন, অনেক ঘটনা বিভিন্ন মাধ্যমে জানতে পেলেও বাস্তবে এর অস্থিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না। হয়তো সেখানে থাকতে পারে সেটা আমাদের অনুসন্ধান করতে হবে। সরেজমিন প্রতিবেদনে উল্লেখযোগ্য কিছু পাওয়া গেলে আমরা পরবর্তী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব। যদি সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরাকীর্তি পাওয়া যায় আর আমরা এটার ধার উন্মোচন করতে পারি তাহলে জাতীয় ঐতিহ্যের সন্ধানে বাংলাদেশের ইতিহাসে বড় একটি মাইলফলক নতুন করে যুক্ত হবে।