<p style="text-align:justify">নারায়ণগঞ্জের মেধাবী স্কুলছাত্র তানভীর মোহাম্মদ ত্বকী ২০১৩ সালের ৬ মার্চ হত্যার শিকার হন। তবে এখনো এই হত্যাকাণ্ডের বিচার হয়নি। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর দ্রুত বিচারের প্রত্যাশা করছে ত্বকীর পরিবার। ত্বকী বেঁচে থাকলে আজ (জন্ম ৫ অক্টোবর, ১৯৯৫) ৩০ বছরে পা দিতেন। তাঁর বাবা <strong>রফিউর রাব্বী </strong>এবং মা <strong>রওনক রেহানার </strong>সাক্ষাৎকার নিয়েছেন <strong>রাশেদুল ইসলাম রাজু</strong></p> <p style="text-align:justify"><strong>কালের কণ্ঠ : </strong>ত্বকীকে মূলত কী কারণে হত্যা করা হয়েছে?</p> <p style="text-align:justify"><strong>রফিউর রাব্বী : </strong>ত্বকী হত্যার এক বছরের মাথায়, ২০১৪ সালের ৫ মার্চ র‌্যাব সংবাদ সম্মেলনে জানায়, আজমেরী ওসমানের নেতৃত্বে ১১ জন মিলে ত্বকীকে হত্যা করেছে এবং হত্যার কারণ হিসেবে তারা তিনটি বিষয় উল্লেখ করেছিল। প্রথম কারণ বলেছিল, ২০১১ <img alt="দ্রুত বিচারের অপেক্ষায় আছি" height="249" src="https://cdn.kalerkantho.com/public/news_images/share/photo/shares/1.Print/2024/10.October/05-10-2024/88000.jpg" style="float:left" width="165" />সালে নাসিক (নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন) নির্বাচনে সেলিনা হায়াত আইভীর কাছে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী শামীম ওসমান পরাজিত হন। নির্বাচনে আমি আইভীর পক্ষে ছিলাম। আইভী নাগরিক পরিষদের মাধ্যমে নির্বাচন করেন; পরিষদের সদস্যসচিব ছিলাম আমি।</p> <p style="text-align:justify">দ্বিতীয় কারণ বলেছে, ২০১১ সালের জুনে বাসভাড়া নিয়ে নারায়ণগঞ্জে আন্দোলন হয়েছিল। ঢাকা-নারায়ণগঞ্জের বাসভাড়া হঠাৎ ২২ টাকা থেকে ৩২ টাকা হয়ে যায়। বাসগুলো নিয়ন্ত্রণ করতেন শামীম ওসমান এবং তাঁর অনুসারীরা। তখন নারায়ণগঞ্জের বিভিন্ন সংগঠন মিলে ‘যাত্রী অধিকার সংরক্ষণ ফোরাম’ তৈরি করে।</p> <p style="text-align:justify">ফোরামের আহ্বায়ক করা হয় আমাকে। ফোরাম বাসভাড়া কমানোর দাবি জানায়। এর আগে এক পরিবহন মালিক র‌্যাবকে চিঠি দিয়ে বলছিলেন তাঁরা প্রতি মাসে নাসিম ওসমান ও শামীম ওসমানকে কত টাকা চাঁদা দেন।</p> <p style="text-align:justify">তখন পরিবহন মালিকরা আমাকে বলেছিলেন, ‘আপনারা চাঁদাটা বন্ধ করতে পারলে আমরা বাসভাড়া কমাতে পারব।’ এ নিয়ে আমরা আন্দোলন শুরু করলে বাসভাড়া কমিয়ে ২৭ টাকা করা হয়।</p> <p style="text-align:justify">তৃতীয় কারণ হিসেবে বলেছে, ২০১২ সালে নারায়ণগঞ্জ ১ নম্বর রেলগেট এলাকায় রেলওয়ের একটি জায়গা দখল করে নাসিম এবং তাঁর লোকজন একটি মার্কেটের নির্মাণকাজ শুরু করেছিলেন। তখন বিভিন্ন সংগঠন ‘ভূমি রক্ষা সম্মিলিত নাগরিক পরিষদ’ গঠন করেছিল। পরিষদের আহ্বায়ক করা হয়েছিল আমাকে। পরে এই আন্দোলন ঘিরে ব্যাপক সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এতে মার্কেটের নির্মাণকাজ বন্ধ ঘোষণা করা হয়। মূলত এই তিন কারণে ক্ষুব্ধ হয়ে তারা ত্বকীকে হত্যা করেছে।</p> <p style="text-align:justify"><strong>কালের কণ্ঠ : </strong>হত্যাকাণ্ডের দিন কী ঘটেছিল?  </p> <p style="text-align:justify"><strong>রওনক রেহানা : </strong>২০১৩ সালের ৬ মার্চ ত্বকী নিখোঁজ হয়। এদিন বিকেল ৪টার দিকে ত্বকী শহরের সুধীজন পাঠাগারে যেতে যখন বাসা থেকে বের হয়, তখন ত্বকীর বাবা এক কাজে ঢাকায় যান। পরে ত্বকীর বাবা সাড়ে ৬টার দিকে ত্বকীকে ফোন দিলে ফোনটি বন্ধ পান। তখন ত্বকীর বাবা আমাকে ফোন দিলে বলেন, ত্বকী এখনো বাসায় ফেরেনি। এর আগে ত্বকী কখনো এতক্ষণ বাইরে থাকেনি। ফলে আমরা চিন্তিত হয়ে পড়ি।</p> <p style="text-align:justify">রাত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ত্বকীর বাবা নারায়ণগঞ্জ সদর থানায় যান। রাত ১১টায় থানায় জিডি করে র‌্যাব-১১-এর কার্যালয়ে যান তিনি। দুই দিন পর ত্বকীর মরদেহ শীতলক্ষ্যা নদীর কুমুদিনী খালে পাওয়া যায়। পরে র‌্যাবের মাধ্যমে জানতে পারি, ১৬৪ ধারায় জবানবন্দিতে দুই ঘাতক সুলতান শওকত ভ্রমর ও ইউসুফ হোসেন লিটন বলেছিলেন, তাঁরা ত্বকীকে ওই দিন রাত ৯টার দিকে আল্লামা ইকবাল রোডের আজমেরী ওসমানের টর্চার সেল উইনার ফ্যাশনে নিয়ে যান।</p> <p style="text-align:justify">তাঁরা তাকে চোখ বাঁধা অবস্থায় লাঠি দিয়ে পেটান। এক পর্যায়ে ত্বকী জ্ঞান হারালে কালাম শিকদার নামের এক ব্যক্তি তার বুকের ওপর উঠে তাকে শ্বাস রোধ করে মেরে ফেলেন। পরে ময়নাতদন্তের রিপোর্টের মাধ্যমে জানতে পারি, ত্বকীর মাথার তিন দিক দিয়ে আঘাত করা হয়েছে। বিভিন্ন অঙ্গ থেঁতলে দেওয়া হয়েছে। মৃত্যু তাড়াতাড়ি নিশ্চিত করতে শ্বাস রোধ করা হয়েছিল। </p> <p style="text-align:justify"><strong>কালের কণ্ঠ : </strong>ওসমান পরিবারের বিরোধিতার জেরে ত্বকীকে হত্যা করা হবে, এমন শঙ্কা কি আগেই সৃষ্টি হয়েছিল?</p> <p style="text-align:justify"><strong>রফিউর :</strong> না। এমন শঙ্কা থাকলে ৮ মার্চ যেদিন ত্বকীর মরদেহ পাওয়া যায় সেদিনই ওসমান পরিবারের নামে মামলা দেওয়া হতো।</p> <p style="text-align:justify"><strong>কালের কণ্ঠ :</strong> সাড়ে ১১ বছরেও ত্বকী হত্যাকাণ্ডের বিচার না হওয়ার কারণ কী?</p> <p style="text-align:justify"><strong>রফিউর :</strong> ২০১৪ সালের ৫ মার্চ র‌্যাব সংবাদ সম্মেলনে বলেছিল ত্বকীকে কারা, কিভাবে হত্যা করেছে এবং অচিরেই তারা হত্যাকাণ্ডের চার্জশিট আদালতে দেবে। এর তিন মাস পর ৩ জুন সংসদে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বললেন, ওসমান পরিবারকে তিনি দেখে রাখবেন। তার পরই এই হত্যাকাণ্ডের বিচার কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়।</p> <p style="text-align:justify"><strong>কালের কণ্ঠ :</strong> ত্বকী হত্যা মামলা নিয়ে র‌্যাবের বর্তমান তৎপরতায় ন্যায়বিচার পাওয়ার ব্যাপারে আপনি কতটুকু আশাবাদী?  </p> <p style="text-align:justify"><strong>রফিউর :</strong> বর্তমানে যাঁরা ক্ষমতায় তাঁরা চাইছেন ত্বকীসহ অন্যান্য হত্যাকাণ্ডের বিচার গুরুত্বসহকারে করবেন। র‌্যাব গত এক মাসে ছয়জনকে গ্রেপ্তার করেছে। ফলে একদিকে আশার সঞ্চার ঘটেছে, অন্যদিকে র‌্যাব বারবার এই হত্যাকাণ্ডের মূল আসামি হিসেবে আজমেরী ওসমানের নাম বলেছে। কিন্তু মূল ব্যক্তি শামীম ওসমান। ত্বকীর সঙ্গে আজমেরীর কোনো সম্পর্ক নেই।</p> <p style="text-align:justify">এই হত্যাকাণ্ডের নির্দেশদাতা শামীম ওসমান এবং জড়িত তাঁর ছেলে অয়ন ওসমান। কারণ হত্যাকাণ্ডের পর নাসিম ওসমানের সঙ্গে তাঁর ছেলে আজমেরীর এক ফোনালাপ ফাঁস হয়। এটা র‌্যাব, ডিবি সবাই শুনেছে। সেখানে আজমেরী বলেছেন, ছোটডা অর্থাৎ অয়ন এই হত্যা করেছেন। তার পরও র‌্যাবের অভিযোগপত্রে শামীম ও অয়নের নাম ছিল না।</p> <p style="text-align:justify">পরে জানতে পারি, তখন র‌্যাবের এডিজি কর্নেল মুজিব এবং র‌্যাবের আরেক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জিয়াউল আহসানের সঙ্গে শামীমের সুসম্পর্ক ছিল। তাই প্রভাব খাটিয়ে শামীম কাজটি করেন। চার্জশিটে শামীম, অয়ন, শাহ নিজামের নাম না এলে এটি গ্রহণযোগ্য হবে না। </p> <p style="text-align:justify"><strong>কালের কণ্ঠ :</strong> আপনারা এই হত্যাকাণ্ডের বিচার চেয়ে নিয়মিত কর্মসূচি করেছেন। এতে কি হুমকির সম্মুখীন হয়েছেন?  </p> <p style="text-align:justify"><strong>রফিউর : </strong>হত্যার বিষয়টি তদন্ত সংস্থা উন্মোচনের পরও শেখ হাসিনা বিচার বন্ধ করে রেখেছিলেন; আমরা তা জাতির সামনে কর্মসূচির মাধ্যমে তুলে ধরেছিলাম। এসব কর্মসূচি করতে গিয়ে আমি ও সহকর্মীরা অনেক বাধা পেয়েছি। আমার বিরুদ্ধে সাতটি মামলা করা হয়। শামীম ওসমানের স্ত্রী, তাঁর মামাশ্বশুর এবং দলের লোকজন মামলাগুলো করিয়েছিলেন। নাসিম ওসমান তখন বলেছিলেন, আমাদের টুকরা করে শীতলক্ষ্যায় ভাসিয়ে দেবেন। শামীম বলেছিলেন, বাড়ির ইট খুলে নিয়ে যাবেন। ত্বকী হত্যার আইনজীবী প্রদীপ ঘোষকে গালি দিয়েছিলেন।</p> <p style="text-align:justify"><strong>কালের কণ্ঠ :</strong> ত্বকীর হত্যাকারীদের বিচারের দাবিতে শুরু থেকে সরব ছিলেন নাসিকের সাবেক মেয়র সেলিনা হায়াত আইভী।</p> <p style="text-align:justify"><strong>রফিউর : </strong>হ্যাঁ, মেয়র আইভীর দলের লোক এই হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার পরও তিনি হত্যাকাণ্ডের বিচার চেয়েছিলেন। তিনি তিন-চারবার শেখ হাসিনার কাছেও হত্যাকাণ্ডের বিচার নিয়ে কথা বলেছিলেন। শেখ হাসিনা শুধু আইভীকে আশ্বাস দিয়েছিলেন।</p> <p style="text-align:justify"><strong>কালের কণ্ঠ :</strong> ত্বকীকে নিয়ে কোনো মজার স্মৃতি আছে?</p> <p style="text-align:justify"><strong>রওনক রেহানা :</strong> অনেক আছে। তবে এখন আমরা শুধু এই হত্যাকাণ্ডের দ্রুত বিচারের অপেক্ষায় রয়েছি।</p> <p style="text-align:justify"><strong>কালের কণ্ঠ : </strong>ত্বকীকে নিয়ে আপনাদের কী প্রত্যাশা ছিল? </p> <p style="text-align:justify"><strong>রওনক রেহানা : </strong>আমরা চেয়েছিলাম ত্বকী যা হতে চায় তাকে তা হতেই সাহায্য করা। ত্বকীর লেখালেখি, ছবি আঁকা, গান গাওয়াতে আগ্রহ ছিল। ত্বকী নিখোঁজের পরদিন ৭ মার্চ তার ‘এ লেভেল’ পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হয়। সে পদার্থবিজ্ঞানে ৩০০ নম্বরের মধ্যে ২৯৭ পেয়েছিল, যা সারা দেশে সর্বোচ্চ।</p> <p style="text-align:justify">‘ও লেভেল’ পরীক্ষায়ও সে পদার্থবিজ্ঞান ও রসায়নে দেশে সর্বোচ্চ নম্বর পেয়েছিল। ত্বকীকে বলা হয়েছিল, ‘এ লেভেল’ পরীক্ষার পর দেশের বাইরে চলে যেতে। কিন্তু দেশের প্রতি অন্য রকম টান থাকায় সে দেশ ছাড়ার কথা চিন্তা করত না।</p>