<p>তিন দিনের ভারি বৃষ্টি এবং ভারতের মেঘালয়ের উজান থেকে আসা পাহাড়ি ঢলে ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট ও ধোবাউড়া উপজেলায় বন্যা পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। শেরপুর জেলার বন্যা পরিস্থিতির আরো অবনতি হয়ে এখন অন্তত ১২৮টি গ্রাম প্লাবিত। বন্ধ হয়ে গেছে উপজেলাকেন্দ্রিক যোগাযোগের সড়কগুলো। অন্যদিকে নেত্রকোনার সব কটি নদ-নদীর পানি বেড়ে অন্তত ৩০টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে।</p> <p>কালের কণ্ঠের নিজস্ব প্রতিবেদক ও সংশ্লিষ্ট প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর :</p> <p>হালুয়াঘাটে দর্শা নদীর পানির স্রোতে দুজন ভেসে গেছে। তাদের উদ্ধার করা যায়নি বলে জানিয়েছে থানা পুলিশ।</p> <p>হালুয়াঘাট পৌর শহরের বাসিন্দা সত্তরোর্ধ্ব আকবর আলী বলেন, ‘আমি ১৯৮৮ সালের বন্যায়ও এত পানি দেখিনি। হালুয়াঘাট শহরে পানি উঠেছে, এই প্রথম দেখলাম। আমাদের ঘরে বুক সমান পানি, তাই আশ্রয়কেন্দ্রে যাচ্ছি।’</p> <p>হালুয়াঘাট পৌর শহরের দর্শা নদীর পানি বেড়ে খাদ্যগুদাম, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সসহ বেশ কিছু স্থাপনায় পানি ঢুকে পড়েছে। গার্লস স্কুল, পোস্ট অফিস, মণিকুড়া, শুঁটকি মহল, পাগলপাড়াসহ পৌরশহরের অনেক রাস্তায় এখন কোমর সমান পানি। বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে দর্শা, গাঙ্গিনা ও কংস নদীর পানি।</p> <p>হালুয়াঘাটের গাজিরভিটা ইউনিয়নের বেলতলী ও মহাজনীকান্দা; জুগলী ইউনিয়নের গামারীতলা; নড়াইল ইউনিয়নের গোপীনগর, বাদশাহ বাজার; ভুবনকুড়া ইউনিয়নের আমিরখাকুড়া, পলাশতলা, নড়াইল, বিলডোরা, ধারা ও ধুরাইল; আমতৈল ইউনিয়নের অনেক গ্রামের ফসলি জমি, রাস্তাঘাট, পুকুর ও মাছের ফিশারি পানিতে তলিয়ে গেছে। গ্রামের বাড়িগুলোতেও উঠেছে পানি।</p> <p>উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মাহবুবুর রহমান বলেন, গতকাল পর্যন্ত দুই হাজার ৫০০ হেক্টর আমন ধানের জমি পানিতে ডুবে গেছে, যা আরো বাড়তে পারে। তিন-চার দিনের মধ্যে পানি না কমলে ফসল একেবারেই নষ্ট হয়ে যাবে।</p> <p>অন্যদিকে ধোবাউড়া উপজেলায় গামারীতলা, ঘোষগাঁও, পোড়াকান্দুলিয়া ইউনিয়নের ৩০টি গ্রাম প্লাবিত হয়ে তলিয়ে গেছে পুকুর, ফসলি জমি ও মাটির রাস্তা।</p> <p>গ্রামীণ সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। নরসিংহপুর, পঞ্চনন্দপুরসহ বিভিন্ন স্থানে নেতাই নদীর বেড়িবাঁধ ভেঙে আশপাশের ফসলি জমিগুলো এখন আট থেকে ১০ ফুট পানির নিচে।</p> <p>ধোবাউড়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা গোলাম সারোয়ার তুষার জানান, উপজেলায় রোপা আমনের ৬০০ হেক্টর জমি পানিতে ডুবে রয়েছে।</p> <p>হালুয়াঘাট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এরশাদুল আহমেদ বলেন, ‘বন্যাকবলিত এলাকায় সব বিদ্যালয়ে আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। আমরা চেয়ারম্যান ও মেম্বারদের নির্দেশনা দিয়েছি, যদি কেউ আটকা পড়ে তাকে যেন উদ্ধার করে নিয়ে আসা হয়।’</p> <p>ধোবাউড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নিশাত শারমিনও জানান, এরই মধ্যে সব মেম্বার ও চেয়ারম্যানকে উদ্ধার কার্যক্রম পরিচালনার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।</p> <p><strong>শেরপুরে নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত</strong></p> <p>ঢলের পানি ভাটির দিকে নামতে থাকায় নালিতাবাড়ী, ঝিনাইগাতী ও শ্রীবরদী উপজেলার নিম্নাঞ্চলে নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। নতুন করে ঢলের পানি ঢুকেছে শেরপুর সদর ও নকলা উপজেলার চার ইউনিয়নের নিম্নাঞ্চলেও।</p> <p>গতকাল পর্যন্ত জেলার পাঁচ উপজেলার ২২ ইউনিয়নের অন্তত ১২৮টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। পানিবন্দি প্রায় ৬২ হাজার মানুষ। নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে যাওয়ার সময় নালিতাবাড়ীতে নারীসহ তিনজনের মৃত্যুর সংবাদ পাওয়া গেছে। পানির তোড়ে ভেসে নিখোঁজ রয়েছে আরো পাঁচজন।</p> <p>পানিবন্দি মানুষকে উদ্ধারে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের সদস্য, পুলিশ, স্বেচ্ছাসেবীদের পাশাপাশি উদ্ধার কার্যক্রম শুরু করেছে সেনাবাহিনীও। দুর্গম ও ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা থেকে স্পিডবোটের মাধ্যমে সেনাবাহিনীর সদস্যদের পানিবন্দি মানুষকে উদ্ধার করে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিতে দেখা গেছে। এদিকে পাহাড়ি ঢলের তোড়ে শেরপুর-নালিতাবাড়ী ভায়া তিনানী সড়কের রানীগাঁও এলাকা ভেঙে ওই সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। </p> <p>গতকাল শনিবার সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, নালিতাবাড়ী ও ঝিনাইগাতী উপজেলার একটি পৌরসভাসহ ১৯টি ইউনিয়নের সব কটিই পাহাড়ি ঢলে প্লাবিত। বেশ কিছু ঘরবাড়ি ধসে পড়েছে।</p> <p>ঝিনাইগাতী ও নালিতাবাড়ী উপজেলার সব স্কুলকে আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ঘোষণা করেছে উপজেলা প্রশাসন। খোলা হয়েছে কন্ট্রোলরুম এবং ত্রাণ ও উদ্ধারকাজ সমন্বয়ের জন্য কর্মকর্তাদের নিয়ে প্রতিটি ইউনিয়ন ও পৌরসভার জন্য পৃথক টিম গঠন করা হয়েছে।</p> <p>জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক কৃষিবিদ ড. সুকল্প দাস জানিয়েছেন, এ পর্যন্ত জেলায় সাত হাজার ৭০০ হেক্টর জমির আমন ধান সম্পূর্ণ এবং ৯ হাজার ৭০০ হেক্টর জমি আংশিক তলিয়ে গেছে। নিমজ্জিত হয়েছে ৬০০ হেক্টর জমির শীতকালীন সবজি। তবে ক্ষতির পরিমাণ আরো অনেক বেশি বলে জানিয়েছে স্থানীয় লোকজন।</p> <p><strong>নেত্রকোনায় ৩০ গ্রামে পানি</strong></p> <p>নেত্রকোনার সোমেশ্বরী, কংস, উপদাখালী, ধনু, নেতাই, মগড়াসহ সব কটি নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) ও স্থানীয় সূত্র জানায়, সোমেশ্বরী, কংস ও নেতাই নদীর পানি উপচে দুর্গাপুর উপজেলার গাওকান্দিয়া, কাকৈরগড়া, চণ্ডিগড় ও কুলাগড়া ইউনিয়নের রামবাড়ি, লক্ষ্মীপুর, কাঁকড়াকান্দা, ভাদুয়া, গোদারিয়াসহ অন্তত ৩০টি গ্রামে পানি ঢুকেছে। এসব এলাকায় প্রায় ৬০ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে।</p> <p>নেত্রকোনার জেলা প্রশাসক বনানী বিশ্বাস বলেন, ‘আমরা সার্বক্ষণিক খোঁজ রাখছি। বন্যা হলে তা মোকাবেলায় সব প্রস্তুতি রয়েছে।’</p> <p>[প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন নিজস্ব প্রতিবেদক, ময়মনসিংহ, শেরপুর, নেত্রকোনা ও হালুয়াঘাট প্রতিনিধি]</p>