<p>শেখ হাসিনার সরকারের টানা ১৫ বছরের শাসনামলে ফরিদপুরে ছাত্রলীগের ভূমিকা নানা আলোচনায় এসেছে। বিশেষ করে, ফরিদপুর জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করা অনেকেই বর্তমানে কোটিপতির খাতায় নাম লিখিয়েছেন। দায়িত্ব গ্রহণের সময় যাদের পকেট প্রায় খালি ছিল, তারা এখন কোটি কোটি টাকার মালিক। </p> <p>অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, জমি দখল, মাদক কারবার, তদবির বাণিজ্য, অবৈধ সম্পদ অর্জনসহ এমন কোনো অপরাধ নেই যা তারা করেনি। অভিযোগ রয়েছে, এসব নেতারা বিভিন্ন সময় হামলা, খুন, জখম, এবং ছিনতাইয়ের মতো অপরাধে জড়িয়ে পড়েছে। তবে করোনা এবং রমজান মাসে সামাজিক কর্মকাণ্ডের জন্য জেলা ছাত্রলীগ প্রশংসিত হলেও, কয়েকজনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড সংগঠনের সব অর্জন ম্লান করে দিয়েছে।</p> <p>২০০৮ সালের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর ফরিদপুর-৩ (সদর উপজেলা) আসনের সাবেক মন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেনের ছত্রছায়ায় জেলা ছাত্রলীগ-যুবলীগের একাংশ টানা এক যুগ ধরে নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড চালিয়ে গেছে। মোশাররফ হোসেনের পতনের পর, ফরিদপুর-৪ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও যুবলীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য মুজিবুর রহমান নিক্সন চৌধুরীর শেল্টারে তারা আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠে।</p> <p>সাধারণ কর্মীরা অভিযোগ করেন যে, জেলা ছাত্রলীগ করোনাকালে এবং রোজায় সামাজিক কার্যক্রম চালিয়ে প্রশংসা কুড়ালেও, কয়েকজনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড সংগঠনের অর্জনকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিয়েছে। এসব নেতারা কলেজ ক্যাম্পাসে হেলমেট বাহিনী হয়ে টেন্ডারবাজি, জমি দখল, মাদক কারবার এবং তদবির বাণিজ্যের মতো নানা অবৈধ কাজে জড়িত হয়েছে। প্রভাবশালী নেতাদের হাতে লাঠিসোঁটা, ধারালো অস্ত্র, এমনকি ভারী আগ্নেয়াস্ত্রসহ মহড়ার ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়েছে।</p> <p>নব্বইয়ের দশকে ফরিদপুর সরকারি রাজেন্দ্র কলেজে সন্ত্রাসী কার্যকলাপের মাধ্যমে ছাত্রলীগের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা হয়। প্রতিপক্ষ ছাত্র সংগঠনের ওপর হামলা চালিয়ে তারা ক্যাম্পাসে একক আধিপত্য লাভ করে। একসময় তারা নিজ দলের সদস্যদের ওপরও আক্রমণ চালায়।</p> <p>২০০৩ সালে জেলা ছাত্রলীগের সম্মেলনে মনিরুজ্জামান মনির সভাপতি এবং সত্যজিৎ মুখার্জি সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। তবে ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর তারা অভ্যন্তরীণ বিরোধে জড়িয়ে পড়েন। ২০১০ সালে মনিরুজ্জামান মনিরের ওপর হামলা চালিয়ে তাকে গুরুতর জখম করা হয়। এরপর ছাত্রলীগে ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে আসে নিশান মাহমুদ শামীম ও সাইফুল ইসলাম জীবনের নেতৃত্বাধীন কমিটি।</p> <p>এই সময় থেকেই ছাত্রলীগ ভয়ংকর হেলমেট ও হাতুড়ি বাহিনীর রূপ ধারণ করে এবং প্রতিপক্ষকে দমন করতে পুলিশি সহযোগিতায় ক্যাম্পাস থেকে বিতাড়িত করে একক আধিপত্য স্থাপন করে। ২০২০ সালে খন্দকার মোশাররফের পতনের আগ পর্যন্ত এই কমিটির আধিপত্য ছিল দৃশ্যমান।</p> <p>২০২০ সালে জেলা ছাত্রলীগের পদ থেকে শামীম ও সাইফুলকে বহিষ্কার করা হয় এবং নতুন নেতৃত্ব আসে তানজিলুর রশীদ চৌধুরী রিয়ান ও ফাহিম আহমেদের হাত ধরে। যদিও এই নেতৃত্বের কিছু সামাজিক কাজ প্রশংসা পেয়েছিল, তাদের মধ্যেও কিছু সদস্যের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড সংগঠনের সুনাম ক্ষুণ্ন করেছে।</p> <p>২০০৪ সালের পর রাজেন্দ্র কলেজের রুকসু নির্বাচন ১৩ বছর বন্ধ ছিল। ২০১৭ সালে আবার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলেও ২০১৯ সালের পর থেকে এটি বন্ধ হয়ে যায়। এরপর থেকে রুকসু ভবনটি জেলা ছাত্রলীগের কার্যালয় হিসেবে ব্যবহৃত হতে থাকে, এবং সেখানে জেলা ছাত্রলীগের সাইনবোর্ড টাঙানো হয়। সাবেক মন্ত্রী খন্দকার মোশাররফের সমর্থনে ছাত্রলীগের অরাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে রুকসু ক্যাম্পাস মাদক ও সন্ত্রাসের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়।</p> <p>রাজেন্দ্র কলেজের শহর শাখার হোস্টেল থেকে জেলা ছাত্রলীগের এক নেতার তত্ত্বাবধানে শহরে মাদক সরবরাহ করা হত। এ সময় রুকসু ভবনটি মাদকসেবীদের আস্তানায় রূপ নেয়।</p> <p>২০১৭ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি ঝিলটুলী এলাকায় ছিনতাইকারীদের হামলায় ফরিদপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের স্টাফ নার্স অরুনিমা ভৌমিক নিহত হন। অভিযুক্তদের মধ্যে দুজন ছাত্রলীগের সদস্য ছিল। ২০১৯ সালে সিগারেট খাওয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে ফরিদপুর মেডিক্যাল কলেজের ডাক্তার ডা. আদনানকে কুপিয়ে গুরুতর আহত করা হয়। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে জেনারেল হাসপাতালে এক যুবককে কুপিয়ে আহত করে জেলা ছাত্রলীগের সহসভাপতি দেবাশীষ রায়।</p> <p>২০২২ সালের ৬ আগস্ট শহরের বায়তুল আমান-চাঁদমারি এলাকায় ছাত্রলীগের দুই পক্ষের সংঘর্ষে সবুজ নামে এক যুবক নিহত হন। সেপ্টেম্বর মাসে রুকসু ক্যাম্পাসে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে ছাত্রলীগের কয়েকজন কর্মী আহত হন। ২০২২ সালের ২৮ আগস্ট অস্ত্র নিয়ে মহাসড়কে মহড়া দেওয়ার ঘটনায় ছাত্রলীগ নেতাসহ পাঁচজন গ্রেপ্তার হয়।</p> <p>ফরিদপুর মেডিক্যাল কলেজের একাডেমিক কাউন্সিলের সভায় ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি ও সম্পাদককে সনদ স্থগিত করার সুপারিশ করা হয়েছে। পাশাপাশি আরও ১৬ ছাত্রলীগ নেতার বিরুদ্ধে বিভিন্ন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করা হয়। তবে রুকসু ভবন দখল করা ছাত্রলীগ নেতাদের বিরুদ্ধে এখনো কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।</p> <p>গত ১৫ বছরে ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক সত্যজিত মুখার্জি, সাইফুল ইসলাম জীবন ও সাবেক ভিপি কাউছার আকন্দ কোটি কোটি টাকার মালিক হয়ে উঠেছেন। তারা পদ পাওয়ার আগে লাখ টাকার মালিকও ছিলেন না, কিন্তু এখন নানা দুর্নীতি ও অনিয়মের মাধ্যমে বিপুল সম্পদ অর্জন করেছেন। গত সরকারের আমলে হওয়া ২ হাজার কোটি টাকার পাচার মামলার আসামিরা বর্তমানে জামিনে রয়েছে।</p>