<p>ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের পুরোধা, স্বাধীনতাসংগ্রামী বিপিন চন্দ্র পালের ১৬৬তম জন্মবার্ষিকী আজ। হবিগঞ্জ শহর সংলগ্ন পইল গ্রামে ১৮৫৮ সালের ৭ নভেম্বর (১২৬৫ বাংলার ২২ কার্তিক) বিপিন চন্দ্র পাল জন্মগ্রহণ করেন।</p> <p>এ উপলক্ষে ৯ নভেম্বর সকাল ১০টায় হবিগঞ্জ সদর উপজেলার পইল গ্রামে অবস্থিত বিপিন পাল স্মৃতি সংসদ প্রতিবছরের মতো এ বছরও আলোচনাসভা ও গুণীজন সংবর্ধনার আয়োজন করেছে। এবার সংবর্ধনা প্রদান করা হবে সিলেট এমসি কলেজের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক গোলাম আহমদ খানকে।</p> <p>বাবার হাতেই বিপিন চন্দ্র পালের লেখাপড়ার হাতেখড়ি। এরপর সিলেট ও কলকাতায় লেখাপড়া করেন এবং পরবর্তী সময়ে ইংল্যান্ডের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ধর্মততত্ত্ব নিয়ে গবেষণা করেন। বিপিন চন্দ্র পাল ১৮৭৭ সনে শ্রীহট্ট সম্মিলনী প্রতিষ্ঠা করেন। ১৮৮০ সালে তিনি রাজ চন্দ্র চৌধুরীর সহযোগিতায় দ্য ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করে প্রধান শিক্ষকের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। সর্বভারতে এটিই ছিল জাতীয় বিদ্যালয়।</p> <p>একই সঙ্গে বিপিন পালের সম্পাদনায় পরিদর্শক নামে একটি পত্রিকা বের হয়। শারীরিক অসুস্থতার জন্য কিছুদিনের মধ্যেই তিনি কলকতা চলে যান এবং সেখানে ব্রহ্মানন্দ কেশব চন্দ্র সেন দ্বারা প্রভাবিত হয়ে তিনি ব্রাহ্মসমাজে যোগ দেন। এ জন্য বিপিন পালের পিতা তাকে ত্যাজ্য ঘোষণা করেন। ১৮৮২ সনে বিপিন পাল কলকাতার বেঙ্গল পাবলিক ওপিনিয়ন পত্রিকার সহ-সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১৮৮৪ সালের লাহোরে ট্রিবিউন পত্রিকার সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। বছরখানেক লাহোরে থেকে পুনরায় কলকাতা ফিরে এসে ইম্পিরিয়াল লাইব্রেরির গ্রন্থাগারিক নিযুক্ত হন। তারপর ইউনিটেরিশন সোসাইটির বৃত্তি নিয়ে ইংল্যান্ড যান। সেখান থেকে আমেরিকা-ফ্রান্স হয়ে কর্মস্থল কলকাতা ফিরে আসেন। </p> <p>রাজনৈতিক জীবনে বিপিন পাল কংগ্রেসের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। কংগ্রেসের জন্মলগ্ন ১৮৮৫ থেকে ১৯০০ সাল পর্যন্ত সর্বভারতীয় কংগ্রেসের নেতা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ প্রতিরোধ আন্দোলনে মতানৈক্যের কারণে ১৯০৫-০৬ সালে বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। এ সময় তিনি নিউ ইন্ডিয়া নামক একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা বের করে ভারতের স্বায়ত্তশাসন দাবির পরিপ্রেক্ষিতে প্রচার শুরু করেন।</p> <p>১৯০৬ সালে তিনি কলকাতা থেকে শ্রীহট্টে এসে সুরমা উপত্যাকার রাষ্ট্রীয় সম্মেলনে প্রথম অধিবেশনে যোগ দেন। এ সময় বন্দে মাতরম পত্রিকাটি প্রকাশিত হয়। তিনি পত্রিকায় প্রবন্ধ লিখে ব্রিটিশ বণিকনীতির সমালোচনা করতেন। পরবর্তী সময়ে বন্দে মাতরম পত্রিকার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিতে অস্বীকার করায় বিপিন পাল ছয় মাসের কারাদণ্ড ভোগ করেন। ১৯০৮ সালে সুরমা উপত্যকায় দ্বিতীয় সম্মেলনে বিপিন পাল বিশেষ বক্তা হিসেবে যোগ দেন। একই বছর তিনি লন্ডন যান এবং স্বরাজ  নামে একটি পত্রিকা বের করেন। স্বরাজে প্রকাশিত প্রবন্ধের জন্য তিনি রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে অভিযুক্ত হন। তিন বছর পর তিনি দেশে ফিরে আসেন এবং ১৯১২ সালে হিন্দু রিভিউ নামক একটি মাসিক পত্রিকা বের করেন। এ ছাড়া তিনি সোনার বাংলা পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন।</p> <p>মহাত্মা গান্ধীর কংগ্রেসে যোগদানেরআগ পর্যন্ত দেশের বামপন্থী নেতৃত্ব বিপিন পালের হাতেই ছিল। পরবর্তীতে অসহযোগ আন্দোলনে গান্ধীর সাথে মতানৈক্যের কারণে বিপিন পাল রাজনীতি থেকে সরে দাঁড়ান। পণ্ডিত মতিলাল নেহেরু বিপিন পালের গুণমুগ্ধ ছিলেন। বিপিন পালের জীবন পরিক্রমার অসংখ্য ঘটনার মধ্যে আরো একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা হলো- তার এক সঙ্গী সহবিধবা বিয়ে করে সমাজে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন। এ ছাড়া বিপিন পাল রেখে গেছেন বিরাট সাহিত্য-সম্ভার। তাঁর ২৫-৩০টি গ্রন্থ বাংলা ও ইংরেজিতে প্রকাশিত হয়েছে।</p> <p>ব্রিটিশ শাসিত পরাধীন ভারতবর্ষে যে কজন বাঙালি নেতা ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে অকুতোভয় ভূমিকা রেখেছিলেন, তাঁদের অন্যতম বিপিন চন্দ্র পাল। তিনি শুধু রাজনৈতিক নেতাই ছিলেন না। ছিলেন একাধারে সাংবাদিক, সাহিত্যিক, সম্পাদক ও সমাজসংস্কারক। অনলবর্শী বক্তা হিসেবে তাঁকে ‘বাগ্মী বিপিন চন্দ্র পাল’ বলে অভিহিত করা হয়। সে সময় ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের অপর দুই পুরোধার সাথে তার নাম উচ্চারিত হতো। তাঁরা ‘লালু বালু পাল’ নামে খ্যাত ছিলেন। লাল অর্থাৎ পাঞ্জাবের লালা রাজপত রায়, মহারাষ্ট্রের বাল গঙ্গাধর তিলক আর বাংলার বিপিন চন্দ্র পাল।</p> <p>মানুষের মুক্তির আলো ছিনিয়ে আনতে, আপসহীন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড, সাহসী লেখনীর জন্য বিপিন চন্দ্র পাল ব্রিটিশ শাসকের রোষানলের শিকার হন বারবার। কারাবরণসহ নানা নির্যাতনে নির্যাতিত হন। কিন্তু কখনোই পিছপা হননি। তাঁর রাজনৈতিক আদর্শ, সাহিত্য রচনা, সাংবাদিকতা এবং তেজস্বী বক্তৃতা ও পাণ্ডিত্যের জন্য পেয়েছিলেন পরাধীন মানুষের ভালোবাসা আর পরিচিত হয়ে উঠেছিলেন বিশ্বের জ্ঞানী-গুণী মনীষীসমাজের কাছে।</p> <p>১৯৩২ সালের ২০ মে বিপিন চন্দ্র পাল মৃত্যুবরণ করেন। মহান এ নেতাকে শ্রদ্ধা জানাতে ভারতের জাতীয় আন্দোলনের নেতা পরবর্তী সময়ে ভারতের স্বনামধন্য প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত জহরলাল নেহেরু ১৯৩৭ সালে হবিগঞ্জের পইল গ্রামে আসেন বিপিন পালের জন্মস্থান দর্শনের জন্য। সেখানে তিনি আবেগাপ্লুত হন এবং এই মহান নেতার জন্মস্থান থেকে একমুঠো মাটি তার পাঞ্জাবির পকেটে করে নিয়ে যান।</p>