<p>আগস্ট মাসে ছাত্রজনতা গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটার পর দলটির শীর্ষ নেতারা নিরাপদ অবস্থানে চলে যান। তবে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী জাফরউল্লাহ দেশের বাইরে না গিয়ে ঢাকায় অবস্থান করায়, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাকে রাজধানীর গুলশান থেকে গ্রেফতার করে। যদিও কোনো মামলায় তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে, তা জানা যায়নি। গ্রেফতারের পর অসুস্থতা বোধ করায় তাকে জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে নেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে।</p> <p>ফরিদপুর-৫ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য এবং আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজী জাফরউল্লাহ এবং তার স্ত্রী নিলুফার জাফরউল্লাহ নিয়োগ-পদ বাণিজ্যের মাধ্যমে বিপুল সম্পদ ও টাকার পাহাড় গড়েছেন। পানামা ও প্যারাডাইস পেপারস কেলেঙ্কারিতে তাদের নাম এসেছে। এ তালিকায় কাজী জাফরউল্লাহ, তার স্ত্রী নিলুফার জাফরউল্লাহ এবং ছেলে কাজী রায়হান জাফরের নামও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। ফরিদপুর-৪ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য নিক্সন চৌধুরী কাজী জাফরউল্লাহকে বিভিন্ন সভায় 'চোর' আখ্যায়িত করেছেন।</p> <p>ফরিদপুর-৪ (ভাঙ্গা-সদরপুর-চরভদ্রাসন) সংসদীয় আসন থেকে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে মনোনীত হয়েছিলেন কাজী জাফরউল্লাহ, যিনি আওয়ামী লীগের জাতীয় সংসদ নির্বাচনী মনোনয়ন বোর্ডের কো-চেয়ারম্যান হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছিলেন। ২০১৮ সালের হলফনামায় তার পেশা শিল্পপতি উল্লেখ করা হলেও দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের হলফনামায় তিনি নিজেকে রাজনীতিক হিসেবে উল্লেখ করেন।</p> <p>এর আগে, ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনেও কাজী জাফরউল্লাহ ফরিদপুর-৪ আসনে নৌকার প্রার্থী হিসেবে স্বতন্ত্র প্রার্থী নিক্সন চৌধুরীর সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে পরাজিত হন। তবে ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে তার স্ত্রী নিলুফার জাফরউল্লাহ সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন।</p> <p>হলফনামা অনুযায়ী, কাজী জাফরউল্লাহর সম্পদের পরিমাণ ৬২ কোটি ৩৭ লাখ ৩২ হাজার ৫৩৯ টাকা এবং নিট সম্পদের পরিমাণ ৬১ কোটি ৩৪ হাজার ৫১৭ টাকা। অস্থাবর সম্পত্তি হিসেবে তার নিজের ৫ লাখ ৬৫ হাজার ২৩৮ এবং স্ত্রীর ৬ লাখ ৭ হাজার ২২৭ টাকা দেখানো হয়েছে। ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানে তাদের জমা করা অর্থের পরিমাণ যথাক্রমে ২১ লাখ ২৯ হাজার ৩৪ এবং স্ত্রীর নামে ৮৪ লাখ ৫ হাজার ৪৫০ টাকা।</p> <p>এছাড়া বন্ড, ঋণপত্র, স্টক এক্সচেঞ্জে তালিকাভুক্ত এবং তালিকাভুক্ত নয় এমন কোম্পানির শেয়ারে কাজী জাফরউল্লাহর নামে ১ কোটি ৯৭ লাখ ৮২ হাজার ৬৭০ এবং তার স্ত্রীর নামে ১৩ কোটি ৭ লাখ ৯৩ হাজার ১৬০ টাকার বিনিয়োগ রয়েছে।</p> <p>কাজী জাফরউল্লাহর পোস্টাল, সেভিংস সার্টিফিকেটসহ সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগের পরিমাণ ৭৫ লাখ টাকা (সঞ্চয়পত্র), ৫৩ কোটি ৫৯ লাখ ৫৭ হাজার ২৫১ টাকা (এফডিআর), এবং তার স্ত্রীর নামে রয়েছে ১৪ কোটি ৬৮ লাখ ৪৯ হাজার ১১৮ টাকা (এফডিআর) এবং ৭৫ লাখ টাকার (সঞ্চয়পত্র)।</p> <p>এছাড়া, কাজী জাফরউল্লাহর কাছে আরএমএমএল শেয়ার মানি হিসেবে ৪ কোটি ৪৯ লাখ ২০ হাজার টাকা রয়েছে। তাদের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে জমা রয়েছে যথাক্রমে ২১ লাখ ২৯ হাজার ৩৪ এবং স্ত্রীর নামে ৮৪ লাখ ৫ হাজার ৪৫০ টাকা। তাদের গাড়ি, অলংকার, আসবাব, এবং আগ্নেয়াস্ত্রসহ আরও কিছু সম্পদও রয়েছে।</p> <p>বার্ষিক আয়ের ক্ষেত্রে বাড়ি, অ্যাপার্টমেন্ট ও অন্যান্য ভাড়া বাবদ কাজী জাফরউল্লাহর আয় ৮৩ লাখ ৮৭ হাজার ৭৩৫ টাকা, শেয়ার, সঞ্চয়পত্র ও ব্যাংকে আমানত থেকে আয় ১ কোটি ৪ লাখ ৯৯ হাজার ৪৯১ টাকা এবং চাকরি (ডিরেক্টর রিমুনারেশন) থেকে আয় ১২ লাখ টাকা।</p> <p>তার নিজের নামে ৯৩ হাজার ৯২১ টাকা ও স্ত্রীর নামে ৩৯ লাখ ৩৩ হাজার ৪৩৭ টাকা ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে জমা রয়েছে। এছাড়া তার নামে ২ লাখ ২৮ হাজার ৮৭৫ টাকা এবং স্ত্রীর নামে ৫০ লাখ ৪০ হাজার ৪২৫ টাকা সঞ্চিত রয়েছে।</p> <p>এছাড়া বন্ড, ঋণপত্র, স্টক এক্সচেঞ্জে তালিকাভুক্ত ও তালিকাভুক্ত নয় এমন কোম্পানির শেয়ার রয়েছে, যার মধ্যে কাজী জাফরউল্লাহর নামে ১০ কোটি ৪ লাখ ৭৮ হাজার টাকা এবং তার স্ত্রীর নামে ৫ কোটি ৮ লাখ ১১ হাজার ২০০ টাকা। এছাড়া তার এফডিআর ছিল ৭ কোটি ৯০ লাখ টাকা, সঞ্চয়পত্র ছিল ১ কোটি ৫ লাখ টাকা এবং শেয়ারমানি ডিপোজিট ছিল ৪ কোটি ৪৯ লাখ ২০ হাজার টাকা। তার স্ত্রীর নামে এফডিআর ছিল ১ কোটি ৩৫ লাখ টাকা এবং সঞ্চয়পত্র ছিল ৮০ লাখ টাকা।</p> <p>আওয়ামী লীগের এই প্রভাবশালী নেতার আয়ের বড় উৎস শেয়ার, সঞ্চয়পত্র ও ব্যাংক আমানত, যেখান থেকে তার বার্ষিক আয় ৩ কোটি ৮৮ লাখ ২৫ হাজার ৩১৪ টাকা। এর বাইরে বাড়ি, অ্যাপার্টমেন্ট, দোকান ও অন্যান্য ভাড়া থেকে বার্ষিক আয় ১ কোটি ৪৮ লাখ ৯৪ হাজার ৭৯৪ টাকা এবং চাকরি থেকে বার্ষিক আয় ১২ লাখ টাকা। তবে কৃষি খাত ও ব্যবসা থেকে কোনো আয় দেখানো হয়নি।</p> <p>২০০১ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে ফরিদপুর-৫ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন কাজী জাফরউল্লাহ। পরবর্তীতে ২০১৪ ও ২০১৮ সালে ফরিদপুর-৪ আসনে নৌকা প্রতীক নিয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী মজিবুর রহমান চৌধুরী নিক্সনের কাছে পরাজিত হন। সর্বশেষ ২০২৪ সালের নির্বাচনেও নিক্সনের কাছে হেরে যান আওয়ামী লীগের এই প্রেসিডিয়াম সদস্য।</p> <p>পানামা পেপারস কেলেঙ্কারিতে কাজী পরিবারের নাম উঠে আসে। এ তালিকায় রয়েছেন কাজী জাফরউল্লাহ, তার স্ত্রী নিলুফার জাফরউল্লাহ এবং তাদের ছেলে কাজী রায়হান জাফর।</p> <p><strong>টাকার নেশায় মত্ত ছিলেন কাজী জাফরুল্লাহ: </strong>আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে একবার সংসদ সদস্য এবং আট বছর ধরে দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন কাজী জাফরুল্লাহ। অভিযোগ রয়েছে, তিনি ২০১৬-২০২৪ সাল পর্যন্ত ১০ বছরে অন্তত ৫০০ কোটি টাকা আয় করেছেন। এলাকায় পুলিশের এসআই, কনস্টেবলসহ বিভিন্ন সরকারি দপ্তরের নিয়োগ-বাণিজ্য, বদলি-বাণিজ্য, টেন্ডার-বাণিজ্য, হাট-ঘাট লিজ দেওয়া এবং বিভিন্ন প্রকল্পে কমিশন-বাণিজ্যের মাধ্যমে এই অর্থ সংগ্রহ করা হয়। ২০২৪ সালের সংসদ নির্বাচনের আগে সদরপুর ও ভাঙ্গা থানার ওসিদের কাছে নির্বাচনী খরচ দাবি করেন তিনি। তারা খরচ দিতে রাজি না হলে, তিনি নির্বাচন কমিশনারের মাধ্যমে তাদের বদলি করিয়ে দেন।</p> <p><strong>নিজ পরিবারের নামে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও স্টেডিয়াম:</strong> আওয়ামী লীগ সরকার টানা ১৫ বছর ক্ষমতায় থাকাকালে ফরিদপুর-৪ আসনের তিনটি উপজেলায় কাজী জাফরুল্লাহ একচ্ছত্র ‘প্রভাব’ প্রতিষ্ঠা করেন। মা-বাবা এবং দাদা-দাদির নামে দুই উপজেলায় প্রতিষ্ঠা করেছেন তিনটি উচ্চ বিদ্যালয়, একটি কলেজ এবং একটি স্টেডিয়াম। তার প্রভাবের জোরে এসব প্রতিষ্ঠানের নামকরণও নিজের পরিবারের নামে করে নেন। এর মধ্যে ভাঙ্গা উপজেলার কাউলিবেড়া ইউনিয়নে তার দাদার নামে কাজী ওয়ালীউল্লাহ উচ্চ বিদ্যালয়, দাদির নামে কাজী শামসুন্নেছা পাইলট বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, ভাঙ্গা পৌর এলাকায় তার বাবার নামে সরকারি কাজী মাহবুবউল্লাহ কলেজ এবং তার চাচার নামে ডা. কাজী আবু ইউসুফ স্টেডিয়াম রয়েছে। সদরপুর উপজেলার সদর ইউনিয়নে তার মায়ের নামে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বেগম কাজী জেবুন্নেছা সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়।</p> <p><strong>পদ বাণিজ্য:</strong> ফরিদপুর ও পাশের জেলার বিভিন্ন উপজেলা আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনের পদগুলোর তালিকা করে কাজী জাফরুল্লাহ নিজ সিদ্ধান্তে পদদান করতেন। তার সম্মতি ছাড়া কখনোই কাউকে পদ দেওয়া হতো না, ফলে পদ পাওয়ার জন্য নেতা-কর্মীরা লক্ষ লক্ষ টাকা নিয়ে তার পিছু ছুটতেন। ফরিদপুর-৪ আসনের (ভাঙ্গা, সদরপুর, চরভদ্রাসন) এই তিন উপজেলায় তিনি টাকার বিনিময়ে বিবাহিত, অছাত্রদেরও ছাত্রলীগের পদে রেখেছেন। তার ক্ষমতা এতটাই প্রবল ছিল যে, তার তদবিরকৃত নেতাদের বিরুদ্ধে সেন্ট্রালে বিপুল অভিযোগ উঠলেও কোনো শাস্তি বা কমিটি ভেঙে দেওয়ার ঘটনা ঘটেনি। তার নির্দেশেই সেন্ট্রাল কমিটি কমিটি গঠন, বহিষ্কার, এবং সম্মেলনের আয়োজন করতেন।</p> <p><strong>তিন উপজেলায় তিন নিয়ন্ত্রক:</strong> কাজী জাফরুল্লাহ ঢাকায় বেশি সময় অবস্থান করলেও তার অনুপস্থিতিতে তিনটি উপজেলার দায়িত্ব পালন করতেন তার তিন প্রতিনিধি। সদরপুর উপজেলায় দায়িত্বে ছিলেন সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক ফকির আব্দুর ছত্তার, ভাঙ্গায় উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আকরামুজ্জামান রাজা, এবং চরভদ্রাসনে উপজেলা আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক ইসহাক মিয়া। এই তিনজন কাজী জাফরুল্লাহর লোক হিসেবে পরিচিত ছিলেন এবং তার নির্দেশে তদবির, নিয়োগ, বদলি, এবং টেন্ডার বাণিজ্যের টাকা সংগ্রহ করতেন। তাদের দাপট শুধু স্থানীয় এলাকাতেই সীমাবদ্ধ ছিল না; পুরো জেলায় প্রশাসন, পুলিশসহ সবখানে তাদের প্রভাব ছিল। কাজী জাফরুল্লাহর ব্যক্তিগত সহকারী মামুন আর রশীদ পেছন থেকে এই কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করতেন।</p>