<p>একটা সময় কৃষকের ফসলের জমি প্রস্তুতে গরুর সহায়তায় লাঙল-জোয়াল ছাড়া অন্য কিছু ভাবাই যেত না। পেশাদার হালুয়ারা (হাল মালিক) সকালে ঘুম থেকে উঠে দুটি গরু আর ঘাড়ে লাঙল-মই ও জোয়ালসহ ছুটে যেতেন মাঠে। দুটি গরুর ঘাড়ে জোয়ালের মাঝখানে দিতেন লাঙলের লম্বা ইষ। এরপর হালুয়ার ইশারায় চলতে শুরু করত গরু। এভাবে হাল দিয়ে চাষের জন্য জমি প্রস্তুত করা হতো।</p> <p>গ্রামবাংলায় প্রচলিত ছিল গরু কিংবা মহিষ দিয়ে হাল চাষের রীতি। তবে যন্ত্রের উন্নয়নে বৈজ্ঞানিক কৃষি যন্ত্রপাতির ব্যবহারে কালের বিবর্তনে হারিয়ে গেছে লাঙল দিয়ে জমি চাষাবাদ। গত শতাব্দীর আশির দশক থেকে বাংলাদেশের কৃষিতে পরিবেশবান্ধব লাঙল-জোয়ালের জায়গা দখল করে নেয় যন্ত্রচালিত পাওয়ার টিলার আর ট্রাক্টর। ফলে হারিয়ে যায় গ্রামবাংলার গরু ও লাঙলের সঙ্গে হালুয়ার মিতালির দৃশ্য।</p> <p>গ্রামবাংলার এই ঐতিহ্যের চিত্র এখনও দেখতে পাওয়া গেছে পিরোজপুর জেলার নাজিরপুর উপজেলার মাটিভাংগা ইউনিয়নের পূর্ব বানিয়ারী গ্রামে। এ অঞ্চলে এখনও অবশিষ্ট আছে গরুর হালে চাষাবাদ। আছে লাঙল-জোয়াল আর হালুয়া।</p> <p>উপজেলার পূর্ব বানিয়ারী গ্রামের কৃষক মো. শহীদুল ইসলামসহ (হেকমত) অনেকে এখনও গরুর হালে জমি চাষ করেন। তিনি ১ নম্বর মাটিভাংগা ইউনিয়ন পরিষদের সদস্যও।</p> <p>সময় বাঁচাতে বর্তমানে ট্রাক্টর বা পাওয়ার টিলার দিয়ে চাষের জমি প্রস্তুত করেন কৃষকরা। একটা সময় লাঙল-জোয়ালে গরু বেঁধে জমি প্রস্তুত কিংবা মই দেওয়ার দৃশ্য সবার নজর কাড়ত। আগে গরু দিয়ে হাল চাষে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় লাগলেও এখন ট্রাক্টর দিয়ে নিমিষেই প্রস্তুত করা যায় চাষের জমি। বর্তমানে কৃষক নিজেদের সুবিধামতো দিনের যেকোনো সময় ট্রাক্টর কিংবা পাওয়ার টিলার দিয়ে চাষের জমি প্রস্তুত করে ফসল আবাদ করছেন।</p> <p>সরেজমিন দেখা গেছে, শহীদুল ৩০ শতক জমি চাষের জন্য গরুর হাল দিয়ে প্রস্তুত করছেন। বাঁশের ফালা ও লোহা দিয়ে তৈরি ধারালো লাঙল ও জোয়াল দুই গরুর কাঁধে বেঁধে দিয়ে জমি প্রস্তুত করছেন আরো অনেকে। </p> <p>স্থানীয় কৃষকরা জানান, যে জায়গা ট্রাক্টর নিতে সমস্যা হয় বা জমির পরিমাণ কম সেখানে গরুর কাঁধে উঠে লাঙল ও জোয়াল।</p> <p>শহীদুল জানান, 'জমির পরিমাণ অল্প আর ট্রাক্টর নিতে সমস্যা, তাই গরু দিয়ে চাষ করেছি। আমার অনেক জমি আছে সেগুলো এভাবে চাষাবাদ করে থাকি। তবে ছোট বেলায় এই পদ্ধতিতে গ্রামের সবাই জমি চাষ করত। আধুনিকতার ছোঁয়ায় হারিয়ে যাচ্ছে বাংলার ঐতিহ্য।'</p> <p>স্থানীয়রা বলেন, স্থানীয়ভাবে আধুনিক ট্রাক্টরের ব্যাপক চাহিদা থাকার পরও লাঙল-গরু দিয়ে অনেকে জমি চাষ করে থাকে। কৃষিতে পাওয়ার টিলারের প্রচলন হওয়ায় গরু দিয়ে হাল চাষের কদর কমে গেছে। যেসব কৃষক গরু দিয়ে হালচাষ করে জীবিকা নির্বাহ করতেন তাদের বেশিরভাগ পেশাবদল করে অন্য পেশায় চলে গেছেন।</p> <p>শহীদুল ছেলে মো. সাব্বির বলেন, 'যতই আধুনিকতা আমাদের ঘিরে ধরুক, বাবার লাঙলের টানে জমির বুক চিরে উঠে আসে জীবনের গল্প। প্রতিটি ফসলের দানায় লুকিয়ে থাকে তার ঘাম ঝরানো পরিশ্রম আর আমাদের ভবিষ্যতের স্বপ্ন। তার মতো মানুষরা আমাদের শিকড়, আমাদের শক্তি। বাবার শরীরে এই মাটির ঘ্রাণ পাই।'</p>