হাসপাতালে নেওয়ার পর চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। তবে তাকে কেন আটক করা হয়েছিল বা কীভাবে মৃত্যু ঘটেছে, তা এখনই নিশ্চিতভাবে বলা যাচ্ছে না। তৌহিদুলের বিরুদ্ধে কোনো মামলা বা অভিযোগ নেই বলে জানিয়েছে পুলিশ।
ঘটনার বর্ণনা দিয়ে তৌহিদুল ইসলামের ভাই সাদেকুর রহমান জানান, বৃহস্পতিবার রাতে তারা বাবার কুলখানির প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। রাত আড়াইটার দিকে সেনাবাহিনীর সদস্যরা বাড়ি আসেন। তাদের সঙ্গে পুলিশের পোশাক পরা কাউকে দেখা যায়নি, তবে সাদা পোশাকে পাঁচজন যুবক ছিলেন। তারা তৌহিদুলকে আটক করেন, এরপর সবার মোবাইল ফোন কেড়ে নিয়ে ঘরে তল্লাশি করেন, কিন্তু কিছু পাননি। তৌহিদুলকে আটকের কারণ জানতে চাইলেও কোনো উত্তর দেননি এবং তাকে গাড়িতে করে নিয়ে যান।
সকালে আবারও সেনাবাহিনীর সদস্যরা বাড়ি এসে ব্যাপক তল্লাশি করেন উল্লেখ করে সাদেকুর রহমান বলেন, সকালেও তৌহিদুল তাদের গাড়িতে ছিলেন। কিন্তু তাকে গাড়ি থেকে নামানো হয়নি। দূর থেকে তাকে নিস্তেজ মনে হচ্ছিল।
তৌহিদুল ইসলামের স্ত্রী ইয়াসমিন নাহার বলেন, ‘আমার চারটি মেয়ে এখনো ছোট। আমি জানি না কীভাবে তাদের নিয়ে বাঁচব। আমার স্বামী কোনো অপরাধ করেনি। তাকে কেন নির্যাতন করে হত্যা করা হলো? আমি পুরো ঘটনার সঠিক তদন্ত এবং বিচার চাই।’
কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা যুবদলের সদস্যসচিব ফরিদ উদ্দিন বলেন, ‘তৌহিদুল ইসলামের বিরুদ্ধে কখনো কোনো অভিযোগ ছিল না। তার শরীরের বিভিন্ন স্থানে ইলেকট্রিক শক দেওয়ারও অভিযোগ রয়েছে। আমরা পুরো ঘটনার তদন্ত চাই।’
কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের চিকিৎসক তানভীর আহমেদ বলেন, ‘শুক্রবার দুপুরের দিকে পুলিশ তৌহিদুল ইসলামকে জরুরি বিভাগে নিয়ে আসে। পরীক্ষানিরীক্ষার পর দেখা যায়, হাসপাতালে আনার আগেই তার মৃত্যু হয়েছে। শরীরের বিভিন্ন স্থানে আঘাতের চিহ্ন।’
কমান্ডার প্রত্যাহার, বিচার হবে সেনা আইনে : গতকাল আইএসপিআর বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, ‘৩১ জানুয়ারি ৩টয় সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে যৌথ বাহিনীর অভিযানে কুমিল্লার আদর্শ সদর উপজেলা থেকে আটক মো. তৌহিদুল ইসলাম (৪০) একই দিন সাড়ে ১২টায় কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন। এ অনাকাক্সিক্ষত ও দুঃখজনক ঘটনাটি তদন্তে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। ইতিমধ্যে ওই সেনা ক্যাম্পের ক্যাম্প কমান্ডারকে তাৎক্ষণিক প্রত্যাহার করা হয়েছে। এ ছাড়া মৃত্যুর সঠিক কারণ উদ্ঘাটনের জন্য একটি উচ্চপদস্থ তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তদন্তে দোষী সাব্যস্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে সেনা আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
প্রধান উপদেষ্টার নিন্দা, তদন্তের নির্দেশ : কুমিল্লায় যৌথ বাহিনীর অভিযানে আটকের পর যুবদল নেতার মৃত্যুর ঘটনা জরুরি তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। গতকাল প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে পাঠানো বিবৃতিতে বলা হয়েছে, কুমিল্লায় তরুণ তৌহিদুল ইসলামের মৃত্যুর বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকার জরুরি তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে। প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস যে কোনো ধরনের হেফাজতে নির্যাতন ও হত্যার কঠোর নিন্দা জানিয়েছেন বলে বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়।
যুবদল নেতাকে নির্যাতন চালিয়ে হত্যা করেছে : মির্জা ফখরুল : কুমিল্লায় যুবদল নেতা তৌহিদুল ইসলামকে সাদা পোশাকধারী লোকেরা ‘নির্যাতন চালিয়ে হত্যা করেছে’ বলে অভিযোগ করেছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। একই সঙ্গে সরকার ও প্রশাসনে ঘাপটি মেরে থাকা আওয়ামী দোসররা এ ঘটনা ঘটিয়েছে কি না, তার অনসুন্ধান জরুরি বলেও দাবি করেন তিনি।
গতকাল বিবৃতিতে বিএনপি মহাসচিব বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার আমলে এ ধরনের বিচারবহির্ভূত হত্যা দুর্ভাগ্যজনক। তিনি আরও বলেন, ‘কোনো সরকারি বাহিনীই আইন হাতে তুলে নিতে পারে না। অপরাধ সংঘটনকারী যতই শক্তিশালী হোক, তাকে আইনের আওতায় নিয়ে এসে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া আইনের শাসনের অন্যতম শর্ত। আামি তৌহিদুল ইসলামকে হত্যার তীব্র নিন্দা, প্রতিবাদ ও ধিক্কার জানাই।’
যুবদলের নিন্দা ও প্রতিবাদ : জাতীয়তাবাদী যুবদলের কেন্দ্রীয় সভাপতি আবদুল মোনায়েম মুন্না ও সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ নূরুল ইসলাম নয়ন যৌথ বাহিনী কর্তৃক যুবদল নেতা তৌহিদুল ইসলামকে নৃশংসভাবে হত্যার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানান। নেতৃদ্বয় এ বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আওতায় আনার দাবি জানান।
ছাত্রদলের প্রতিবাদ : যুবদল নেতা তৌহিদুল ইসলাম হত্যার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছেন ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সভাপতি রাকিবুল ইসলাম রাকিব ও সাধারণ সম্পাদক নাছির উদ্দীন নাছির। গতকাল বিবৃতিতে নেতৃদ্বয় বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার মানবাধিকারের সুরক্ষা দিতে ব্যর্থ হয়েছে। সরকারকে অতিদ্রুত সব রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।
ছাত্রশিবিরের প্রতিবাদ : যুবদল নেতা হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছে ইসলামী ছাত্রশিবির। শিবিরের কেন্দ্রীয় সভাপতি জাহিদুল ইসলাম ও সেক্রেটারি জেনারেল নূরুল ইসলাম সাদ্দাম যৌথ বিবৃতিতে বলেন, একটি সভ্য দেশে রাষ্ট্রীয় বাহিনীর প্রধান দায়িত্ব হলো নাগরিকের জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। যুবদল নেতার এ হত্যাকা ফ্যাসিবাদের সেই নির্মম হত্যাযজ্ঞেরই পুনরাবৃত্তি।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের উদ্বেগ : যৌথ বাহিনীর পরিচয়ে তুলে নেওয়ার পর যুবদল নেতা তৌহিদুল ইসলামের মৃত্যুতে মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) উদ্বেগ প্রকাশ করে নিরপেক্ষ তদন্তের দাবি জানিয়েছে।
গতকাল সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ উদ্বেগ ও বিচার দাবি করে বলা হয়, তৌহিদুল ইসলামের বিরুদ্ধে কোনো অস্ত্র থাকার অভিযোগ ছিল না এবং তাকে অজ্ঞাত কারণে গভীর রাতে বাসা থেকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। পরিবারের সদস্যরা থানায় যোগাযোগ করেও কোনো খোঁজ পাননি। নিহতের শরীরে আঘাতের চিহ্ন থাকায় পরিবারের সদস্যরা এ মৃত্যুকে পরিকল্পিত ও সন্দেহমূলক দাবি করেছেন।
আসক মনে করে, এ ধরনের ঘটনা মানবাধিকার ও আইনের শাসনের পরিপন্থি। আটক ব্যক্তির সুরক্ষা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। এ ধরনের মৃত্যুর ঘটনা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। আসক এ ঘটনার স্বাধীন, নিরপেক্ষ ও দ্রুত বিচারিক তদন্ত এবং দায়ীদের যথাযথ আইনি শাস্তির আওতায় আনার দাবি জানাচ্ছে।
এমএসএফ : এদিকে যুবদল নেতার মৃত্যুর ঘটনায় তদন্তের দাবি জানিয়েছে মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশন (এমএসএফ)। গতকাল সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ‘স্বজনদের দাবি, আটকের পর অমানবিক নির্যাতনের কারণে তার মৃত্যু হয়েছে। নিহতের শরীরে নির্যাতনের ক্ষতচিহ্ন পাওয়া গেছে। আমরা এ ঘটনার নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু তদন্ত নিশ্চিত করে নিরাপত্তা বাহিনীর বিরুদ্ধে উত্থাপিত নির্যাতনে মৃত্যুর বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানাচ্ছি।’
সূত্র : বাংলাদেশ প্রতিদিন।