দু’পায়ের তলা থেকে প্রায় হাঁটু পর্যন্ত চামড়া খসে পড়েছে। বেড়িয়ে এসেছে মাংসপেশি। হাটা-চলা বন্ধ। দিন-রাত কাটছে মশারিবন্দি একাকি জীবন।
দেখে মনে হবে পচন ধরেছে। দুর্গন্ধের কারণে তার কাছে যাওয়াও দুষ্কর হয়ে পড়েছে। অর্থের অভাবে জুটছে না উন্নত চিকিৎসা তাই শয্যাশায়ী হয়ে কাতরাচ্ছেন বাবার বাড়িতেই। মাত্র ২৮ বছর বয়সেই মৃত্যুর দিকে যেন এগিয়ে যাচ্ছে এই তরুণী মা। খাদিজার আকুতি দুই শিশু সন্তানের জন্য হলেও বাঁচতে চান তিনি। ফিরতে চান স্বাভাবিক জীবনে। তাই সমাজের বিত্তবানদের দিকে চেয়ে আছেন খাদিজার পরিবার।
‘আমি বাঁচতে চাই আমার দুইডা সন্তান লইয়া, আমারে একটু বাঁচতে দেন আমনেরা।
আমার সন্তান দুইডার মোহের (মুখের) দিকে চাইয়া হইলেও আমনেরা আমারে একটু হেল্প করেন।’ কান্নাজড়িত কন্ঠে এমন কথা বলছেন দু’পায়ের দূরারোগ্য এমন ব্যাধিতে আক্রান্ত পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালীর দুই সন্তানের জননী খাদিজা বেগম। অসহ্য যন্ত্রণায় বিছানায় শুয়ে কাতরাচ্ছেন আর ছটফট করছেন। তার চোখে কেবলই অশ্রু। পায়ের যন্ত্রণার চেয়েও তাকে বেশি কষ্ট দিচ্ছে দুই শিশু সন্তানের অনিশ্চিত এক ভবিষ্যতের ভয়।
খাদিজা পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালী উপজেলার সেনেরহাওলা গ্রামের বাসিন্দা ইমরান হাওলাদারের স্ত্রী ও একই ইউনিয়নের উত্তরীপাড়া গ্রামের বাসিন্দা আক্কাস খানের মেয়ে। স্বামী ইমরান হাওলাদার ভাড়ায় চালিত মোটরসাইকেল চালক। আর বাবা আক্কাস পেশায় জেলে।
পরিবারের লোকজন জানান, খাদিজার ৭ বছর বয়সী তাহিদ নামের এক ছেলে সন্তানের পর তার জীবনে নতুন অতিথির আগমনী বার্তা আসে গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে। কিন্তু মাতৃত্বের আনন্দের সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয় তার দুঃস্বপ্নের দিনও। প্রথমে জুলাইয়ের দিকে দুই পা ফুলে যাওয়া দিয়ে শুরু হয় তার অসুস্থতা। যা তিনি সাধারণ গর্ভকালীন পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ভেবে এড়িয়ে যান। কিন্তু ধীরে ধীরে সেই ফোলা পা ভয়ংকর এক রোগের রূপ নেয়।
সন্তান গর্ভে থাকায় উন্নত কোনো চিকিৎসা নিতে পারেননি, ফলে দিন দিন শারীরিক অবস্থার অবনতি হতে থাকে। তিন মাস আগে কন্যা সন্তান জন্ম দিয়েছেন ঠিকই কিন্তু সুস্থ হতে পারেননি খাদিজা। একটু ছুঁতেও পারেনি তার আদরের সন্তানকে বরং মায়ের পরশ থেকে নবজাতককে রাখা হচ্ছে দূরে। আর দুরারোগ্য ব্যাধির মুখে ঢলে পড়ে হাঁটু পর্যন্ত তার পা বিকল হয়ে গেছে যার ফলে হারিয়েছেন হাঁটতে পারার ক্ষমতা।
খাদিজা জানেন না এই পৃথিবীতে তার জন্য আর কতটা সময় বাকি। কিন্তু জানেন তার ছোট্ট মেয়েটা এখনো কোল চায় মায়ের, ছেলেটা এখনো জড়িয়ে ধরতে চায় মাকে। হয়তো কোনো মহৎ হৃদয়ের মানুষ এগিয়ে এলে আবার নতুন করে জীবন পেতে পারেন এই অসহায় মা। অর্থ নেই, চিকিৎসা নেই, বাঁচার আশাও নেই। তবুও খাদিজা স্বপ্ন দেখছেন স্বাভাবিক জীবনের। তিনি বাঁচতে চান, ফিরতে চান সন্তানদের কাছে, আবার আগের মতো চান হাঁটতে, চান প্রাণখুলে হাঁসতে। তাই তো সমাজের বৃত্তবানদের সহানুভূতির ওপর নির্ভর করে পথ চেয়ে আছেন খাদিজা ও তার পরিবার।
খাদিজার মা কল্পনা বেগম বলেন, ‘দিন দিন ওর অবস্থা খারাপ হইতেছে, পায়ের মাংস পঁচে ভিতরের সব বের হয়ে যাইতেছে। আমনেরা একটু দয়া করে আমার মেয়েকে একটু সাহায্য করেন। আমি যেরকম বাঁচতে চাই আমার সন্তান লইয়া (নিয়ে) আমার মেয়েও তার সন্তান লইয়া বাঁচতে চায়।’
খাদিজারা বেড়িবাঁধের বাইরে বসবাস করেন। তার বাবা জেলে ও স্বামী ভাড়ায় মোটরসাইকেল চালক। খাদিজার পরিবারের পক্ষে চিকিৎসার খরচ মেটানো সম্ভব নয়। বিগত দিনে চিকিৎসায় অনেক চেষ্টা চালিয়েছেন, সহায়-সম্বল যা ছিল সবই খুইয়েছেন। সমাজের বিত্তবানদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানান স্বেচ্ছাসেবী কর্মী সাব্বির ইসলামসহ প্রতিবেশীরা।
রাঙ্গাবালী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. ইকবাল হাসান বলেন, ‘খাদিজার ব্যাপারে আমরা খোঁজ-খবর নিয়েছি, সমাজসেবা অফিসের মাধ্যমে করা ওনার আবেদনটা অতিদ্রুত জেলায় প্রেরণের ব্যবস্থা নিচ্ছি। উপজেলা প্রশাসন ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলো খাদিজার পাশে আছে।’