<p>‘অন্তত ৪০ জন সশস্ত্র ডাকাত গভীর রাতে প্রধান ফটক ভেঙে আমার বাসায় ঢোকে। তারা নারী, শিশুসহ আমাকেও মারধর করে বাসায় ভাঙচুর ও লুটপাট চালায়। এক পর্যায়ে ডাকাতরা বাসা থেকে বের হয়ে আমার ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান লাকি আয়রন স্টোরের তালা ভেঙে ভেতরে ঢোকে। এরপর দুটি ট্রাকে করে দোকানের পাইপ, অন্য মালপত্রসহ অন্তত ২০ লাখ টাকার সরঞ্জাম লুট করে পালিয়ে যায়।’ বৃহস্পতিবার এভাবে কথাগুলো বলছিলেন পুরান ঢাকার ব্যবসায়ী কামাল হোসেন। গত মঙ্গলবার রাত ১২টার দিকে ১৭০/১ পোস্তগোলার ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে ডাকাতি করে দুর্বৃত্তরা। কামাল দাবি করেন, ডাকাতদলের সদস্যদের বেশির ভাগ এলাকার দুর্বৃত্ত। তাদের মধ্যে বেশির ভাগ কিশোর ও তরুণ।</p> <p>কুষ্টিয়ার খোকসা উপজেলার ব্যবসায়ী মো. শিপন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ওষুধের দোকান বন্ধ করে গত বুধবার রাত ১০টার দিকে শোমসপুর বাজার থেকে জানিপুরের সড়ক দিয়ে বাসায় ফিরছিলাম। এ সময় পথে একদল ডাকাত আমাকে আটকে সঙ্গে থাকা টাকা, মোবাইল ফোন ছিনিয়ে নেয়। বাধা দিতে গেলে মারধর করে।’ </p> <p>একইভাবে পাবনার আটঘরিয়া পৌর এলাকার এক ব্যবসায়ী জানান, উত্তরচক মহল্লায় এক সংখ্যালঘু ব্যবসায়ীর বাড়িতে দুর্ধর্ষ ডাকাতি সংঘটিত হয়েছে। ডাকাতদল এ সময় টাকা, স্বর্ণালংকার, আসবাবসহ প্রায় ২৫ লাখ টাকার মালপত্র লুটে নিয়ে যায়।</p> <p>শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কার আন্দোলনে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর গত সোমবার থেকে দেশে শুরু হয় ব্যাপক নৈরাজ্য। ডাকাতির পাশাপাশি লুটপাট, রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাসহ মানুষের বাসাবাড়িতে হামলা চালিয়ে করা হয় অগ্নিসংযোগ। সেই থেকে রাজধানীসহ সারা দেশে চলতে থাকে ব্যাপক ডাকাতি, ছিনতাই, চুরিসহ নানা অপরাধমূলক কাজ। ভুক্তভোগী এলাকাগুলোর বেশির ভাগ মানুষ জানায়, সবচেয়ে বেশি ডাকাতি ও লুটপাট চলছে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের বাসায়।</p> <p>যারা ডাকাতি করছে তাদের বেশির ভাগ টোকাই এবং উঠতি তরুণ। মানুষের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে দিতে সারা দেশে একযোগে এই ডাকাতি চলছে বলে মনে করছে অনেকে।</p> <p><strong>রাজধানীবাসীর আতঙ্ক বাড়ছে</strong><br /> বুধবার বিকেল ৪টা ৫০ মিনিট। রাজধানীর মোহাম্মদপুর তিনরাস্তা দিয়ে সিকদার মেডিক্যালের দিকে যাচ্ছিলেন ব্যবসায়ী সানোয়ার হোসেন। রায়েরবাজারে পৌঁছলে পাঁচ-ছয়জন তরুণ তাঁর গতি রোধ করে। তাদের প্রত্যেকের হাতে ছিল ছোরা, চাপাতি, রডসহ দেশীয় অস্ত্র। অস্ত্রের মুখে ডাকাতদল সানোয়ার হোসেনের মোবাইল ফোন, মানিব্যাগ ও ঘড়ি ছিনিয়ে নেয়।</p> <p>একইভাবে মোহাম্মদপুরের কাদিরাবাদ হাউজিং, শেখেরটেক, বসিলা, বসিলা মেট্রো হাউজিং, জিগাতলাসহ ধানমণ্ডি, হাজারীবাগ এলাকা, শনির আখড়া, বাড্ডার আফতাবনগর, হাতিরঝিল, রূপনগর, ভাটারা, খিলক্ষেত, যাত্রাবাড়ী, শ্যামপুরের আরশিনগর, আটিবাজার, নয়াবাজার, মিরপুরের পল্লবী, মিরপুর ১০, ইসিবি চত্বর এলাকা, উত্তরার ৮-৯, ১০-১১ নম্বর সেক্টরসহ বিভিন্ন এলাকায় ডাকাতি বেড়েছে। এ ছাড়া পুরান ঢাকার বিভিন্ন জায়গায়ও রাতে দল বেঁধে ডাকাতি ও ছিনতাইয়ের অভিযোগ পাওয়া গেছে।</p> <p>সূত্র বলছে, শুধু পথচারী নয়, গাবতলী-সদরঘাটের বেড়িবাঁধে অটোরিকশা, গাড়ি, সিএনজিচালিত অটোরিকশা থামিয়ে গণছিনতাই করছে সন্ত্রাসীরা।</p> <p><strong>ডাকাতদের অস্ত্রের আঘাতে শিশুর মৃত্যুর অভিযোগ</strong><br /> সূত্র জানায়, বুধবার রাতে ডাকাতদের এলোপাতাড়ি অস্ত্রের আঘাতে মিরপুরের ইসিবি চত্বর এলাকায় দুই শিশুর মৃত্যু হয়েছে। তবে ওই দুই শিশুর নাম-পরিচয় এখনো জানা যায়নি।</p> <p>অন্যদিকে বুধবার রাতে মোহাম্মদপুরের নূরজাহান রোড, শিয়া মসজিদ, বাঁশবাড়ি, ঢাকা উদ্যান এলাকার বেশ কিছু বাড়ির দরজা ভেঙে লুটপাট চালিয়েছে দুর্বৃত্তরা। ডাকাতি হয়েছে দোকানপাটেও। ডাকাতির খবর পাওয়া গেছে আদাবরের শেখেরটেক, রিং রোডসহ বিভিন্ন এলাকায়ও। এই অবস্থায় গভীর রাতে মসজিদ থেকে মাইকে ঘোষণা দিয়ে স্থানীয় বাসিন্দাদের সতর্ক করা হয়েছে। এরপর বাসিন্দারা নিজেরাই পাহারা বসায়। ডাকাতদের সঙ্গে স্থানীয় লোকজনের পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। আদাবরের একটি বাড়িতে ডাকাতরা গুলি করায় একজন নিরাপত্তাকর্মী আহত হয়েছেন।</p> <p>মোহাম্মদপুর এলাকার বাসিন্দা সুমি জানান, বুধবার রাতে বসিলা মেট্রো হাউজিং, সিটি হাউজিংয়ে ডাকাত ঢুকেছিল। এ সময় তারা মেট্রোর কয়েকটি বাসা থেকে নগদ টাকা ও স্বর্ণ নিয়ে যায়। এরপর সেনা সদস্যরা চলে আসায় আবার সিটি হাউজিংয়ে ঢুকে পড়ে। তবে সিটি হাউজিংয়ে কারো বাসায় ঢুকতে পারেনি। এর আগেই দুজনকে ধরে ফেলে এলাকার লোকজন। অন্যরা পালিয়েছে। এলাকাবাসী সবাই মিলে নিজ নিজ বাড়ি পাহারা দিচ্ছে।</p> <p><strong>যেভাবে নিয়ন্ত্রণ</strong><br /> ডাকাতির এমন খবর ছড়িয়ে পড়ার পর রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় এলাকাবাসী একত্র হয়ে ডাকাত প্রতিরোধ কমিটি গঠন করেছে। সেনাবাহিনীর দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের ফোন নম্বর বিভিন্নজনের মাঝে বিতরণ করছে, যাতে সহজে কল করলে তাঁরা সহায়তায় এগিয়ে আসতে পারেন। এ ধরনের কমিটি করা হয়েছে মোহাম্মদপুর, লালমাটিয়া, বসিলা, পশ্চিম ধানমণ্ডি এলাকায়। রাতে ডাকাতি ও ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটলে অনেকে সেনাবাহিনীর দেওয়া জরুরি নম্বরে ফোন করছে। সেনাবাহিনী মোহাম্মদপুরের বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে বেশ কয়েকজন ডাকাতকে আটক করেছে।</p> <p><strong>আটক হয়েছে যেসব ডাকাত</strong><br /> সূত্র জানায়, মিরপুরের পল্লবী এলাকায় ডাকাতি করতে গিয়ে আটক হয়েছে ১৭ জন। আটক হওয়া কয়েকজন ডাকাত এলাকাবাসীর মারধরের সময় জানিয়েছে, নাহিদ নামের এক যুবক তাদের টাকা-পয়সা দিয়ে নামিয়েছে এবং সেই সঙ্গে বিভিন্ন এলাকা থেকে ৩০০ যুবক সংগ্রহ করে এই কাজে লাগাচ্ছে শহিদ। শহিদ একজন ছিনতাইকারী ও সন্ত্রাসী।</p> <p><strong>সারা দেশে ডাকাতি</strong><br /> রাজধানীর বাইরে সাভার, আশুলিয়া, বাইপাইল, গাজীপুরের শ্রীপুর, হবিগঞ্জের চুনারুঘাট, টাঙ্গাইলের নাগরপুর, মানিকগঞ্জ, নড়াইল, মুন্সীগঞ্জ, কুষ্টিয়ার বিভিন্ন এলাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় গত মঙ্গলবার রাত থেকে ডাকাতি হয়েছে বলে খবর পাওয়া গেছে।</p> <p><strong>যা বলছেন আইজিপি</strong><br /> দেশের বিভিন্ন স্থানে ডাকাতি নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে জানতে চাইলে আইজিপি মইনুল ইসলাম বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে জনসাধারণের জানমাল ও সরকারি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাসহ সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চলছে।</p> <p>এদিকে চলমান ডাকাতিসহ সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণসহ যেকোনো নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড, হানাহানি ও  প্রাণনাশের হুমকির সম্মুখীন হলে নিকটস্থ সেনাবাহিনী ক্যাম্পে যোগাযোগ করার জন্য অনুরোধ করা হয়েছে।</p> <p><strong>গুজবে কান না দিতে বিজিবির অনুরোধ</strong><br /> রাজধানীতে ডাকাতি কিংবা জননিরাপত্তাহানিকর কর্মকাণ্ড প্রতিরোধে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশকে (বিজিবি) জানাতে বলা হয়েছে। গতকাল বিজিবির জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. শরিফুল ইসলাম বলেন, রাজধানীতে ডাকাতি অথবা জননিরাপত্তাহানিকর কর্মকাণ্ড প্রতিরোধে বিজিবিকে জানান। বিজিবির সহায়তার জন্য যোগাযোগ করুন ০১৭৬৯-৬০০৫৫৫ ও ০১৮৮৯-৬০০৫৫৫ নম্বরে।</p> <p>এ ছাড়া সীমান্ত এলাকা সংক্রান্ত বিভিন্ন ধরনের গুজব ছড়ানো হচ্ছে। সবাইকে সচেতন থেকে গুজবে কান না দেওয়ার জন্য অনুরোধ করেছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)।</p> <p>[প্রতিবেদন তৈরিতে তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করেছেন স্থানীয় প্রতিনিধিরা]</p>