'নদীর নাম মধুমতী' (১৯৯৬), 'চিত্রা নদীর পারে' (১৯৯৯), 'লালসালু' (২০০১), 'লালন' (২০০৪), 'রাবেয়া' (২০০৮), 'জীবনঢুলী' (২০১৪) -- এসব রাজনীতি ও ইতিহাসসচেতন চলচ্চিত্রের মতোই তানভীর মোকাম্মেল (জন্ম ১৯৫৫, খুলনা) 'রূপসা নদীর বাঁকে' চলচ্চিত্রটি যুক্ত করলেন তাঁর সৃষ্টির ঝুলিতে। স্বদেশি আন্দোলনের সময় থেকে ১৯৭১ সালের দীর্ঘ সময়পরিক্রমায় বাংলা জনপদের কাল ও সময়কে ধারণ করে এ চলচ্চিত্রটি নির্মিত। ঔপনিবেশিক বাস্তবতায় মানব মুখোপাধ্যায় (জাহিদ হোসেন শোভন) নাম্নী একজন ত্যাগী বামপন্থী নেতার শৈশব, কৈশোর, যৌবন ও বৃদ্ধ সময়ের আপসহীন রাজনৈতিক সংগ্রাম প্রতিবিম্বিত হয়েছে চলচ্চিত্রটিতে। অনুশীলন সমিতি ও কৃষক আন্দোলনে বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখে তিনি কখনো এলাকার সবার কাছে 'কমরেড মানবদা' আবার কখনো দরিদ্র নমঃশূদ্র কৃষকদের থেকে পান 'কমরেড ঠাকুর' উপাধি।
ব্রিটিশ সরকার এমনকি পাকিস্তান আমলেও জেল-জুলুম ও নির্যাতনের শিকার মানবের জীবনের নির্মম পরিসমাপ্তি ঘটে মুক্তিযুদ্ধের সময় রাজাকারদের হাতে।
গ্রিক ট্র্যাজেডির নায়কের মতো সব যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও মানব মুখোপাধ্যায় নিয়তি তথা সময়ের কাছে পরাজিত হন। দক্ষিণাঞ্চলে কমরেড বিষ্ণুঠাকুরের সত্যিকার জীবন উঠে এসেছে মানবচরিত্রের মধ্য দিয়ে -- তিনি কৃষকদের নিয়ে প্রজা বান্ধি বাঁধ নির্মাণ করেছিলেন -- যা ঐতিহাসিক সত্য। এই বাঁধ নির্মাণের মধ্য দিয়ে জনগণের শক্তির জয়গাথা উচ্চারিত হয়েছে।
পূর্ববঙ্গের ভূমিপুত্র তানভীর মোকাম্মেল ফিল্মটির মানব চরিত্রের মধ্য দিয়ে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের আদর্শ, বাঙালি জাতীয়তাবাদ, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ভাবনা গুলোকে রূপায়িত করেছেন। রাষ্ট্রের নাম হয়তো পাল্টে যায় কিন্তু দেশ তো একটা চিরন্তন ব্যাপার, নিজের দেশে বাস করতে পারাটা একটা মানুষের মৌলিক অধিকার-- এই চিন্তাকে খুব দরদ দিয়ে দেখিয়েছেন নির্মাতা।
স্বদেশি আন্দোলন (১৯৩০ এর উত্তাল সময়), মন্বন্তর (১৯৪৩), তেভাগা (১৯৪৬-১৯৪৭) আন্দোলন, দেশভাগ (১৯৪৭), রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারে সংগঠিত খাপড়া ওয়ার্ড গণহত্যা (১৯৫০), ভাষা আন্দোলন (১৯৫২), যুক্তফ্রন্ট সরকার (১৯৫৪), সামরিক শাসন (১৯৫৮), গণঅভ্যুত্থান (১৯৬৯), বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ (১৯৭১) প্রভৃতি দৈশিক প্রেক্ষাপটের সঙ্গে সঙ্গে দুটি বিশ্বযুদ্ধ, বিশ্বব্যাপী মার্ক্সবাদী দর্শনের উত্থান ও বিকাশ চিত্রিত হয়েছে।
তানভীর মোকাম্মেল নিজে ছাত্র ইউনিয়ন করতেন, একসময় বাংলাদেশ ক্ষেতমজুর সমিতিতে যোগ দিয়ে গ্রাম বাংলার মানুষের অর্থনৈতিক - সামাজিক বৈষম্যকে খুব কাছ থেকে দেখেছিলেন-- তাই হয়তো তাঁর সৃষ্ট মানব চরিত্রটি এত বেশি জীবন্ত। তবে এরকম কমরেড প্রায় প্রত্যেক জেলাতেই ছিল। কিন্তু বাংলা সিনেমায় কমিউনিস্ট নেতাদের সম্ভবত এত গুরুত্ব দিয়ে নির্মাণ করা হয়নি।
অভিনয়ের ক্ষেত্রে জাহিদ হোসেন শোভন, ঝুনা চৌধুরী, ফখরুল বাসার মাসুম, চিত্রলেখা গুহ, Mili Basher, Naziba Basher, Rajib Saleheen, Abm Saidul Haq সকলেই স্ব স্ব চরিত্রানুযায়ী ভালো করেছেন। তবে খায়রুল আলম সবুজ বৃদ্ধ মানব চরিত্রে আর Ramendu Majumdar কমিউনিস্ট চরিত্রে যেন একাকার হয়ে গিয়েছেন। মাহফুজুর রহমান খানের সিনেমাটোগ্রাফি, কালার গ্রেডিং অসামান্য।
খুলনা ও পার্শ্ববর্তী কিছু লোকেশনে এ ছবিটির চিত্রায়ণ ও স্টক ফুটেজের যথাযথ ব্যবহার সময়ের কাছাকাছি দর্শকদের নিয়ে গেছে। মহাদেব শী এর সম্পাদনা বরাবরের মতোই প্রশংসনীয়। শব্দগ্রহণ, পোশাক পরিকল্পনা যথাযথ মনে হয়েছে। সৈয়দ সাবাব আলী আরজুর সুর ও সঙ্গীত আয়োজন অনন্য। তবে সংগীত প্রয়োগে কোথাও কোথাও আরও পরিমিত হলেও হয়তো চলতো (যেমন : বিয়ের পরের দিন স্নান করে মানবের প্রেমিকা ঊর্মিমালার (নাজিবা বাশার) 'আজি ঝড়ের রাতে' গান গাওয়া তেমন কোনো অর্থ প্রকাশ করে না আবার মানব যখন তার বন্ধুর বাড়িতে গিয়ে 'মায়া বন বিহারিণী' গানটা ধরছে, সাথে সাথেই ছেড়ে দিয়ে ঘুমিয়ে যাচ্ছে এক্ষেত্রে গানটা না গাইলেও সমস্যা ছিল না)। কিন্তু এগুলো ছাড়াও সিনেমাটির বিষয় ও চিন্তাকে প্রকাশ করেছে কালজয়ী কিছু গান (যেমন : একবার যেতে দে মা ঘুরে আসি, জয় বাংলা বাংলার জয়)। Uttam Guha-এর শিল্প নির্দেশনা সময় ও ইতিহাসকে ভীষণভাবে বাস্তবসম্মত করেছে। তবে আলোর প্রক্ষেপণ ও রূপসজ্জা কোথাও কোথাও আরো নিখুঁত হতে পারত।
এত দীর্ঘ সময় ও সুগভীর রাজনৈতিক দর্শনকে যে সযত্ন প্রয়াসে নির্মাতা ২ ঘণ্টা ১৭ মিনিটের মধ্যে দর্শকের সামনে উপস্থাপন করেছেন তা অসামান্য। বাঙালির আত্মানুসন্ধান তথা স্বাধিকার চিন্তার সবগুলো সূত্রকে একবৃত্তে উপস্থাপন করে তানভীর মোকাম্মেল দেশ ও জাতির প্রতি গুরু দায়িত্ব পালন করেছেন।
লেখক : অধ্যাপক, বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়।