<p>চলচ্চিত্র, নাটক কিংবা ওয়েব কনটেন্ট—যেকোনো কনটেন্ট তখনই দর্শকপ্রিয় হয়, যখন এর চিত্রনাট্যে থাকে নতুনত্ব। চিত্রনাট্যের গুণে একটি সাধারণ গল্পও হয়ে ওঠে অনন্য, মুগ্ধকর। স্বর্ণালি সময় বলতে এখনো সবাই যেমন ঘুরেফিরে গত শতকের সত্তর, আশি ও নব্বইয়ের দশকে ফিরে যায়, তখন কিন্তু গল্পকার-চিত্রনাট্যকারদের কদর ছিল। তাঁদের নামেই নাটক-সিনেমার প্রতি বাড়ত দর্শকের আগ্রহ। চিত্রনাট্য লিখে অনেকে সম্মানের পাশাপাশি সচ্ছল জীবনও যাপন করেছেন। সেই অবস্থা যে এখন আর নেই, তা বলাই বাহুল্য। একদিকে পেশাদার চিত্রনাট্যকারের সংখ্যা কমছে, অন্যদিকে বাড়ছে ‘একাই এক শ’ পন্থা! অর্থাৎ বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই গল্প-চিত্রনাট্যের কাজটা সেরে নিচ্ছেন পরিচালক। এতে প্রযোজক খুশি, কারণ বাজেট কমছে।</p> <p>কিন্তু সামগ্রিক অর্থে যে অবনতি হচ্ছে, তাতে ভ্রুক্ষেপ নেই কারো। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে একটি চলচ্চিত্র বা নাটকের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ অর্থাৎ গল্প-চিত্রনাট্য যাঁর সৃষ্টি, তিনি অধিকতর অবহেলিত, বঞ্চিত হন। মর্যাদা তো দূরের কথা, কখনো কখনো সম্মানি পর্যন্ত মেলে না, আবার কখনো নামটাই হয়ে যায় উধাও। আবার অনেকে লিখছেন বটে, কিন্তু তা নাটক, সিনেমা নাকি ওয়েব কনটেন্ট, সম্ভবত তিনি নিজেও পরিষ্কার নন। এসব সংকটের ভিড়েও সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। বিশেষ করে ওটিটি প্ল্যাটফরমগুলোতে যেসব কনটেন্ট আসছে, সেগুলোর জন্য দীর্ঘ সময় নিয়ে গবেষণা করে লেখা হচ্ছে চিত্রনাট্য। এতে চিত্রনাট্যের মান যেমন বাড়ছে, সম্ভাবনাও হচ্ছে প্রকট। চার চিত্রনাট্যকারের সঙ্গে কথা বলে সার্বিক হাল-হকিকত জানার চেষ্টা করেছেন <strong>কামরুল ইসলাম</strong>।</p> <p><img alt="চিত্রনাট্যের কদর বাড়বে কবে" height="360" src="https://asset.kalerkantho.com/public/news_images/share/photo/shares/1.Print/2025/1.%20january/14-01-2025/Rif/16-01-2024-p9-1.jpg" width="600" /></p> <p><strong>অর্থ ও সম্মান একসঙ্গে হয় না (</strong><em>বৃন্দাবন দাস)</em></p> <p>টিভিনাটকের ক্ষেত্রে পেশাদার চিত্রনাট্যকার খুব বেশি তৈরি হচ্ছে না। নাটক যেভাবে চলছে—বাজেট, আয়োজন সব মিলিয়ে হয়তো প্রয়োজনও হয় না। তবে চিত্রনাট্য লেখার আলাদা যে ধারা তৈরি হয়েছে, সেটা আশাব্যঞ্জক। ওটিটিতে যারা লিখছে, তারা গবেষণা করে, নতুন ভাবনা নিয়ে কাজ করছে। সমালোচনা থাকতে পারে, তবে আমার মতে ইতিবাচক দিকটাই বেশি। টেলিভিশনে ডিটেইলে কিংবা নিজের ইচ্ছামতো কাজ করার সীমাবদ্ধতা আছে; যেহেতু ড্রয়িংরুম মিডিয়া, পরিবারের সবাই মিলে দেখে। ওটিটিতে সেই স্বাধীনতা পাওয়া যায়। টিভিতে যেমন আমি আঞ্চলিক ভাষার একটি নাটক করলাম, সেটা খুব জনপ্রিয় হলো। এরপর ওটারই শর্টকাট রাস্তা খোঁজে অনেকে। ওই গল্প কিংবা গল্পের কোনো চরিত্র নিয়ে এদিক-সেদিক করে নাটক বানিয়ে ফেলল! এই নকলবাজি করে আসলে হয় না। মোস্তফা সরয়ার ফারুকী এবং তার সতীর্থরা একটা ধারা শুরু করেছিল, আবার আমরা গ্রামীণ গল্পের নাটকের একটা ধারা নিয়ে এলাম। তখন টেলিভিশনের দুয়ার খুলে গেল, বিটিভির পাশাপাশি অনেক চ্যানেল পেলাম। কাজের সুযোগ হলো। নতুন ভাবনাও তুলে ধরলাম। আরেকটা বিষয় হলো, এখনকার নাটক দিনশেষে ইউটিউবে যাচ্ছে। ফলে অনেকের মধ্যেই ভিউ বাড়ানোর চিন্তা। এখন চিত্রনাট্য লেখার সময়ই যদি ভাবেন, ভিউয়ের জন্য লিখব, তাহলে আসলে চর্চাটা থাকে না। চিত্রনাট্যকার কিংবা নাট্যকার হিসেবে আগে হুমায়ূন আহমেদ, আবদুল্লাহ আল মামুন, মামুনুর রশীদ, ইমদাদুল হক মিলনের মতো মানুষদের চিনতাম। তাঁদের পরে অনেকে হয়তো মাসুম রেজা কিংবা আমার নাম বলেন। কিন্তু এখন কি এমন কেউ আছেন, যাঁকে নাট্যকার হিসেবে স্বতন্ত্রভাবে চেনা যায়? আলাদা কিছু না করতে পারলে স্বতন্ত্র পরিচয় তৈরি হবে না। টেলিভিশনের বাজেট তো একদম তলানিতে। ফলে সম্মানিও তেমনই। আমরা যারা সিনিয়র, তাদের মোটামুটি চলে যায়। জনপ্রিয় অভিনয়শিল্পী বাদে অন্য সবার অবস্থা হলো—কাজ করলে আছি, না করলে নেনই। চিত্রনাট্যকারদের অবস্থাও তেমনই। নতুনদের অনেকে অভিযোগ করেন, সম্মানি পান না ঠিকঠাক। অনেকের নামও উল্লেখ করা হয় না। জাতিগতভাবে আমরা অন্যের মেধা বা সাফল্যকে স্বীকৃতি দিতে চাই না। ব্যক্তিগতভাবে আমি এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন হইনি। আমি হয়তো ভাগ্যবান। আর ভালো ভাবনা নিয়ে, সামাজিক দায়বদ্ধতা নিয়ে কেউ যদি লিখতে চান, খুব বেশি অর্থ উপার্জন করতে পারবেন না, এটা নিশ্চিত। কেউ যদি অর্থই চান, সেটার পথও খোলা আছে। সে ক্ষেত্রে শুধু টাকাই অর্জন হবে, নাম-যশ আসবে না। আমি মনে করি, লেখালেখির ক্ষেত্রে অর্থ ও সম্মান দুটি একসঙ্গে হয় না।</p> <p><img alt="5" height="338" src="https://tds-images-bn.thedailystar.net/sites/default/files/styles/big_202/public/images/2021/08/26/masum_reza.jpg" width="600" /></p> <p><strong>ন্যূনতম সম্মানি হওয়া উচিত ২ লাখ টাকা </strong>(<em>মাসুম রেজা)</em></p> <p>শুধুই চিত্রনাট্য লেখেন, বাংলাদেশে এ রকম মানুষের খুব অভাব। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, পরিচালক নিজেই কাজটি করেন। আবার অন্য কাউকে দিয়ে কিছুটা চিত্রনাট্য করিয়ে তাঁর সঙ্গে নিজের নাম যুক্ত করে দেন পরিচালক। ফলে বাংলাদেশে চিত্রনাট্যকার ব্যাপারটাই পরিষ্কার নয়। সোহেল রানা বয়াতির ‘নয়া মানুষ’ ছবির চিত্রনাট্য আমি লিখেছি এবং শুধু আমার নামটিই চিত্রনাট্যকার হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এমনটা সচরাচর দেখা যায় না। চিত্রনাট্যের সম্মানি নির্ভর করে নানা বিষয়ের ওপর। তবে আমার মতে, চিত্রনাট্যকারদের ন্যূনতম সম্মানি হওয়া উচিত দুই লাখ টাকা। সম্ভাবনা নিয়ে বললে, আমি বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে চিত্রনাট্যের ওপর পড়াই। অনেকের মধ্যেই আগ্রহ দেখতে পাচ্ছি। যদিও বেশির ভাগের ঝোঁক ফিল্মমেকিংয়ে। তবে আলাদা করে চিত্রনাট্য লিখতে চায়, এমনও অনেক আছে। আর নতুনদের জন্য জায়গা সব সময় খোলা। যিনি চিত্রনাট্য করবেন, তাঁর নিজস্ব সৃজনশীলতা, নিষ্ঠা ও ইচ্ছার ওপর নির্ভর করবে তিনি কতটুকু এগোতে পারবেন।</p> <p><img alt="চিত্রনাট্যের কদর বাড়বে কবে" height="360" src="https://asset.kalerkantho.com/public/news_images/share/photo/shares/1.Print/2025/1.%20january/14-01-2025/Rif/16-01-2024-p9-3.jpg" width="600" /></p> <p><strong>সম্মিলিত একটি প্ল্যাটফরম দরকার</strong> (<em>আব্দুল্লাহ জহির বাবু)</em></p> <p>এখন কাজ একটু কম। ফলে চিত্রনাট্যকাররা বিপদেই আছেন। আর যাঁরা কাজ করছেন, তাঁদের মধ্যে কোনটা চলচ্চিত্র, কোনটা নাটক, কোনটা ওয়েব কনটেন্ট—এসব গুলিয়ে ফেলছেন। যেটাকে আমরা সিনেমা বলছি, সেটা আদৌ সিনেমা হচ্ছে না; যেটাকে সিরিজ বলা হচ্ছে, সেটা আদতে ধারাবাহিক নাটক হয়ে যাচ্ছে! যেহেতু কোনো প্রাতিষ্ঠানিক জায়গা নেই, ফলে নতুন চিত্রনাট্যকাররা এগুলোর পার্থক্য করতে পারছেন না। প্রতিটি দৃশ্যমাধ্যমের গুরুত্ব ও পরিধি সম্পর্কে জানা জরুরি। এ ক্ষেত্রে কিছু কর্মশালা থাকলে ভালো হতো। যেমন—আমি বঙ্গর সঙ্গে কাজ করেছি ২০১৯ সাল পর্যন্ত, শুধু শেখার জন্য—ওয়েব সিরিজ কী, ওয়েব ছবি কী? একজন চিত্রনাট্যকারকে অবশ্যই নির্দেশনা জানতে হবে। তিনি কোন দৃশ্য কেমন চান, কিভাবে দৃশ্যটা ধারণ করা হবে, সেটা জানা জরুরি। এখানে চিত্রনাট্যকারদের সম্মানি পর্যাপ্ত নয়। ধরুন, ‘বরবাদ’ ছবির বাজেট প্রায় ২০ কোটি টাকা। সেখান থেকে চিত্রনাট্যকারকে কতই বা দিচ্ছেন? পুরো বাজেটের ১ শতাংশও চিত্রনাট্যকারের জন্য বরাদ্দ থাকে না। একটি ভালো দিক আছে, চিত্রনাট্যকাররা টাকা আগেই পেয়ে যান। বেশির ভাগ সময়ই টাকার অঙ্কটা খুব কম। আমরা যারা সিনিয়র, তাদেরই অনেক ক্ষেত্রে ছাড় দিতে হয়। নবীনদের কী অবস্থা, বোঝেন! চিত্রনাট্য লেখাকে পেশা হিসেবে নেওয়া আমাদের দেশে এখনো খুব রিস্কি ব্যাপার। যদি একটি কমন প্ল্যাটফরম থাকত, তাহলে সংকটের কিছুটা সমাধান আসত। সিনেমার চিত্রনাট্যকারদের একটি সংগঠন আছে—ফোয়াব; নাটকেরও আলাদা সংগঠন আছে। তবে সম্মিলিত একটি প্ল্যাটফরম থাকা দরকার, যেখান থেকে চিত্রনাট্যকারদের বিভিন্ন গ্রেড করা হবে। সেই গ্রেড অনুসারে তাঁরা সম্মানি চাইতে পারবেন।</p> <p><img alt="চিত্রনাট্যের কদর বাড়বে কবে" height="360" src="https://asset.kalerkantho.com/public/news_images/share/photo/shares/1.Print/2025/1.%20january/14-01-2025/Rif/16-01-2024-p9-4.jpg" width="600" /></p> <p><strong>সম্মানির আগে সম্মান দেওয়াটা জরুরি</strong> (<em>শফিকুর রহমান শান্তনু)</em></p> <p>একসময় নাট্যকারদের নামেই নাটক দেখতাম আমরা। এখন সেই চিত্র নেই। এমন অনেক দর্শকের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে যিনি ভাবতেন, অভিনেতা যে সংলাপটি বলছেন এটি বুঝি তাঁরই লেখা। একজন নাট্যকার যে ঘটনাক্রম সাজিয়ে চিত্রনাট্য দাঁড় করান, এটা তাঁরা জানেনই না। একবার ঘুরতে গিয়ে হোটেলে উঠেছি। যখন বললাম, আমার পেশা নাট্যকার। তিনি বুঝলেন না। আরেকটু সহজ করে বললাম, লেখক। বললেন, দলিল লেখক? বুঝতে পারছেন চিত্রনাট্যকারদের সার্বিক অবস্থা! সাধারণের কথা বাদ দিই, নাটকের লোকজনের মধ্যেও চিত্রনাট্যকারের ব্যাপারে এক ধরনের উদাসীনতা দেখি। কিছুদিন আগে এক জনপ্রিয় অভিনেত্রী আমার লেখা নাটক থেকে পুরস্কার পেয়েছেন। তিনি সোশ্যাল মিডিয়ায় পরিচালক, চিত্রগ্রাহক থেকে শুরু করে কয়েকজনকে কৃতজ্ঞতা জানালেও নাট্যকারের নাম সেখানে অনুপস্থিত। অথচ একটি নাটকের  স্রষ্টা চিত্রনাট্যকার। তাঁরা বলেন, ভালো গল্প পেলে কাজ করেন। ভালো গল্পটি যিনি লেখেন, তাঁকে সম্মান দিতে কুণ্ঠা দেখে অবাক হই। তাই বলি, সম্মানির আগে সম্মান দেওয়াটা জরুরি। সম্মানির বিষয়টি আসলে আপেক্ষিক। প্রথমত একজন চিত্রনাট্যকারের মেরুদণ্ড থাকাটা খুব দরকার। কারণ তিনি চিত্রনাট্যের মাধ্যমে একটি দর্শন প্রকাশ ও প্রচার করেন। সেটা মূল্যায়নের মাধ্যমেই তাঁর সম্মানি নির্ধারিত হয়। বিনয়ের সঙ্গে বলছি, প্রায় ২০ বছর ধরে লিখছি। আমি বলব, অবশ্যই মোটামুটি সচ্ছল জীবন যাপন করা সম্ভব। তবে নিত্যনতুন ভাবনা নিয়ে কাজ যথেষ্ট কঠিন। আমরা আশা করি ভালো গল্প, কিন্তু চিত্রনাট্যকারকে যে যথার্থ মূল্যায়ন ও সম্মানি দেওয়া দরকার, সেটা হয় না। এত সস্তায় পৃথিবীর কোথাও চিত্রনাট্য পাওয়া যায় না।</p>