১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন বাঙালির ইতিহাসে একটি গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়। মাতৃভাষার জন্য রক্তদানের এই সংগ্রাম শুধু বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষাই করেনি, বাঙালির জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষেও ভূমিকা রেখেছে। এই ঐতিহাসিক ঘটনাকে কেন্দ্র করে নির্মিত হয়েছে বেশ কিছু চলচ্চিত্র, যার মধ্যে জহির রায়হানের ‘জীবন থেকে নেয়া’, শহীদুল ইসলাম খোকনের ‘বাঙলা’ এবং তৌকীর আহমেদের ‘ফাগুন হাওয়ায়’ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এই তিনটি চলচ্চিত্র শুধু বাঙালির ইতিহাসের দলিলই নয়, নতুন প্রজন্মের কাছে ভাষা আন্দোলনের চেতনা পৌঁছে দেওয়ার মাধ্যমও বটে।
জীবন থেকে নেয়া (১৯৭০)
পরিচালক : জহির রায়হান
জহির রায়হানের ‘জীবন থেকে নেয়া’ শুধু একটি চলচ্চিত্র নয়, এটি বাঙালির সংগ্রামী চেতনার একটি শিল্পিত প্রকাশ। ১৯৭০ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত এই চলচ্চিত্রটি ১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থানের পটভূমিতে তৈরি হলেও এর মধ্যে ভাষা আন্দোলনের প্রভাব স্পষ্ট। ছবিটির গল্প একটি মধ্যবিত্ত পরিবারকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হলেও তা বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনের প্রতীক হয়ে উঠেছে।
চলচ্চিত্রটির বিশেষত্ব হলো এর প্রতীকী ব্যঞ্জনা।
জহির রায়হান খুব সূক্ষ্মভাবে পরিবারের সদস্যদের মাধ্যমে সমাজের বিভিন্ন শ্রেণির মানুষের সংগ্রামকে ফুটিয়ে তুলেছেন। ছবিটির সংলাপ, গান ও চরিত্রায়ণ দর্শকদের মনে গভীর প্রভাব ফেলে। বিশেষ করে ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো’ গানটি শুনলে মনে হয় যেন ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের স্মৃতি ফিরে এসেছে।
কেন মনে রাখবেন : ‘জীবন থেকে নেয়া’ শুধু একটি চলচ্চিত্র নয়, এটি বাঙালির ইতিহাসের একটি জীবন্ত দলিল।
এটি দেখলে বোঝা যায়, কিভাবে শিল্প ও সংস্কৃতির মাধ্যমে একটি জাতির সংগ্রামী চেতনা ফুটে উঠতে পারে।
বাঙলা (২০০৬)
পরিচালক : শহীদুল ইসলাম খোকন
শহীদুল ইসলাম খোকনের ‘বাঙলা’ ভাষা আন্দোলনের পটভূমিতে তৈরি একটি আধুনিক চলচ্চিত্র। আহমেদ ছফার উপন্যাস ‘ওঙ্কার’ অবলম্বনে নির্মিত এই ছবিটি ২০০৬ সালে মুক্তি পায়। চলচ্চিত্রটি একটি বাকপ্রতিবন্ধী মেয়ে সুখীর (শাবনূর) জীবনের গল্প বললেও তা বাঙালির ভাষা ও সংস্কৃতির সংগ্রামের প্রতীক হয়ে উঠেছে।
চলচ্চিত্রটির গল্প ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের সময়কার প্রেক্ষাপটে আবর্তিত হয়।
সুখী কথা বলতে পারে না, কিন্তু সে বাংলা ভাষার জন্য সংগ্রামরত মানুষের কণ্ঠস্বর হতে চায়। ছবিটির শেষ দৃশ্যে সুখীর মুখ থেকে রক্ত ঝরতে থাকে, এবং সে কষ্ট করে একটি শব্দ উচ্চারণ করে—‘বাঙলা’। এই একটি শব্দই যেন বাঙালির ভাষা আন্দোলনের সমগ্র ইতিহাসকে ধারণ করে।
কেন মনে রাখবেন : ‘বাঙলা’ শুধু একটি চলচ্চিত্র নয়, এটি নতুন প্রজন্মের কাছে ভাষা আন্দোলনের চেতনা পৌঁছে দেওয়ার একটি মাধ্যম। এটি দেখলে বোঝা যায়, কিভাবে একটি ভাষার জন্য একটি জাতি জীবন দিতে পারে।
ফাগুন হাওয়ায় (২০১৯)
পরিচালক : তৌকীর আহমেদ
তৌকীর আহমেদের ‘ফাগুন হাওয়ায়’ ভাষা আন্দোলনের পটভূমিতে তৈরি একটি আধুনিক চলচ্চিত্র। টিটো রহমানের গল্প ‘বউ কথা কও’ অবলম্বনে নির্মিত এই ছবিটি ২০১৯ সালে মুক্তি পায়। চলচ্চিত্রটি একটি উর্দুভাষী পাকিস্তানি পুলিশ অফিসার জমশেদ খানের (যশপাল শর্মা) গল্প বললেও তা বাঙালির ভাষা ও সংস্কৃতির সংগ্রামের প্রতীক হয়ে উঠেছে।
চলচ্চিত্রটির গল্প ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের সময়কার প্রেক্ষাপটে আবর্তিত হয়। জমশেদ খান বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়, কিন্তু শেষ পর্যন্ত বাঙালির সংগ্রামী চেতনার কাছে হার মানে। ছবিটির চরিত্রায়ণ, সংলাপ ও নির্মাণশৈলী দর্শকদের মনে গভীর প্রভাব ফেলে। বিশেষ করে ভাষা আন্দোলনের সময়কার ঐতিহাসিক দৃশ্যগুলো খুব বাস্তবসম্মতভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে।
কেন মনে রাখবেন : ‘ফাগুন হাওয়ায়’ শুধু একটি চলচ্চিত্র নয়, এটি নতুন প্রজন্মের কাছে ভাষা আন্দোলনের চেতনা পৌঁছে দেওয়ার একটি মাধ্যম। এটি দেখলে বোঝা যায়, কিভাবে একটি ভাষার জন্য একটি জাতি জীবন দিতে পারে।
শেষকথা
ভাষা আন্দোলন নিয়ে নির্মিত এই তিনটি চলচ্চিত্র শুধু বাঙালির ইতিহাসের দলিলই নয় বরং নতুন প্রজন্মের কাছে ভাষা আন্দোলনের চেতনা ও সংগ্রামের গল্প পৌঁছে দেওয়ার মাধ্যমও বটে। ‘জীবন থেকে নেয়া’, ‘বাঙলা’ ও ‘ফাগুন হাওয়ায়’—প্রতিটি চলচ্চিত্রই তার নিজস্ব শৈলী ও গল্প বলার ভঙ্গিতে ভাষা আন্দোলনের গুরুত্বকে নতুনভাবে উপস্থাপন করেছে। এই সিনেমাগুলো দর্শকদের মনে দেশপ্রেম ও ভাষার প্রতি ভালোবাসা জাগিয়ে তোলে।